আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ প্রথম সংখ্যা ● ১-১৫ জানুয়ারি, ২০২৩ ● ১৬-২৯ পৌষ, ১৪২৯

সমসাময়িক

‌ধর্মঘটে বিপর্যস্ত গ্রেট ব্রিটেন


আমেরিকা জুড়ে চলছে শৈত্যপ্রবাহ। আর আটলান্টিকের পূর্ব পাড়ে গ্রেট ব্রিটেনে জ্বলছে অসন্তোষের আগুন। অর্থনীতিতে মন্দা। এরই মধ্যে বেতন বৃদ্ধির দাবিতে প্রায় সমস্ত সরকারি পরিষেবা বড়দিন ও নববর্ষের ছুটির মরশুমে ধর্মঘট ডেকেছে। বড়দিনের আগের শনিবার থেকে রেল, বিমানবন্দর, জাতীয় সড়ক, সীমা সুরক্ষার প্রহরী, হাসপাতালের নার্স, অ্যাম্বুলেন্স এবং ডাক দপ্তর - সকল কর্মী ইউনিয়নের ধর্মঘটে কার্যত স্তব্ধ হয়ে গেছে গোটা ব্রিটেন। ২৭শে ডিসেম্বর মঙ্গলবার অবধি ধর্মঘট চলার পর সাময়িক বিরতি। পরের সপ্তাহান্তে বর্ষশেষ ও বর্ষবরণের উৎসবমুখর দিনগুলিতে আবার ধর্মঘট শুরু হবে আর তা গড়িয়ে যাবে জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত।

বিশেষজ্ঞদের মতে কোভিড পরবর্তী ব্রিটেন ব্রেক্সিট এবং ইউক্রেন যুদ্ধের মাশুল গুনছে। ঊর্ধ্বমুখী মূল্যবৃদ্ধিতে হাসফাঁস করছেন ব্রিটিশ জনগণ। বেড়েছে আয়কর, সুদের হার, পেট্রোলের দাম, রেলের ভাড়া সহ সমস্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম। সেই তুলনায় সরকারি কর্মক্ষেত্রে বেতন বৃদ্ধি হয়নি। কোভিডের জন্য সবচেয়ে বেশি মার খেয়েছে দেশে গণপরিবহণ ব্যবস্থা। এ কারণে চলতি বছরের মার্চ থেকে লন্ডনের আন্ডারগ্রাউন্ড বা মেট্রো পরিষেবা ও জাতীয় রেলের কর্মীরা ধর্মঘট শুরু করেন। তারপর লন্ডনের বাস কোম্পানিগুলোর কর্মচারীদের চাক্কাজ্যাম শুরু হয়। তাদের দাবি, এমনিতেই গণপরিবহণ সামান্য কর্মী নিয়ে চলছে। টাকার অভাবে সরকার নিয়োগ বন্ধ রেখেছে। বেসরকারি ক্ষেত্রে বেতনবৃদ্ধি হয়েছে ৬.৯% এবং সরকারি ক্ষেত্রে হয়েছে ২.৭%৷ অসন্তোষ সৃষ্টির যথেষ্ট কারণ রয়েছে। এই ব্যবধান ঘোচাবে কে?

সরকারি হস্তক্ষেপের দাবিতে মার্চ মাস থেকেই ব্রিটেনে সড়ক, রেল, নৌবাহিনী সহ বিভিন্ন কর্মী ইউনিয়ন ছুটির সময়গুলোতেই ধর্মঘট ডাকছে। বছর শেষের উৎসবে জল ঢালতে সেই ধর্মঘটে যোগ দিয়েছে হাসপাতাল এবং ডাক যোগাযোগ। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ব্যাপক ধর্মঘট আর্থিক বৃদ্ধির হার ০.৫ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস করতে পারে। বিভিন্ন গবেষণা ও তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, সমস্ত ইউনিয়নের দাবি মেনে বেতন বৃদ্ধি করতে হলে সরকারি কোষাগারে অন্ততঃ ২,৮০০ কোটি পাউন্ডের বাড়তি সংস্থান করতে হবে।

সরকারের পক্ষে যথারীতি জানানো হয়েছে, আলোচনার জন্য দরজা সবসময় খোলা। কিন্তু বিভিন্ন দপ্তরের ইউনিয়ন নিজেদের দাবি থেকে একচুলও নড়ছেন না। যার ফলে অচলাবস্থা দীর্ঘায়িত হচ্ছে। ১০৬ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম বিক্ষোভ ধর্মঘটে সামিল হয়েছে রয়্যাল নার্সিং কলেজের নার্সরা। তাদের দাবি, ‘‌সরকারের তিন শতাংশ বেতন বৃদ্ধি মানা যায় না।’ কমবেশি ১ লক্ষ নার্স ৭৬টি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ধর্মঘটে যোগ দিয়েছেন। স্বাস্থ্যক্ষেত্রে নার্সরা বিক্ষোভ শুরু করায় জরুরি অস্ত্রোপচার বা চিকিৎসার তারিখ পিছিয়ে গিয়েছে। সদ্যই প্রথম দফার ধর্মঘট করেছেন নার্সরা। এবার অ্যাম্বুল্যান্স কর্মীরা ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন। তাঁদের সঙ্গে শামিল হয়েছেন প্যারামেডিক্যাল কর্মী এবং পরিচালনা বিভাগের কর্মীরাও।

কোভিডের সময় হোটেল - ছোটো ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত স্বল্প আয়ের পরিবারগুলিকে সরকারি সাহায্য দেওয়া হয়েছিল। এর ফলে রাজকোষ থেকে নাকি ৫৫৫০ কোটি পাউন্ড বাড়তি খরচ করতে হয়েছে। তার উপর ইউক্রেন যুদ্ধ জাতীয় আয়ের উপর বড় প্রভাব ফেলেছে। ফলে সরকারি ক্ষেত্রে বেতন বাড়ছে না। এসব কিছুর মধ্যে বিপাকে সাধারণ মানুষ। বড়দিনের ছুটিতে বাড়ি যাওয়া বা ঘুরতে যাওয়ার আনন্দ মাটি করেছে দেশজোড়া ধর্মঘট। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের সেমিস্টারের পরীক্ষার সময় বিপাকে পড়তে হচ্ছে। কারণ অধ্যাপকের অভাব ও শিক্ষাকর্মীদের বেতন সংক্রান্ত অসন্তোষ।

অ্যাম্বুল্যান্স কর্মীরাও ধর্মঘটে যোগ দিয়েছেন। ২১ এবং ২৮ ডিসেম্বর ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে ব্রিটেনের অ্যাম্বুল্যান্স কর্মীদের তিন প্রধান ইউনিয়ন। ধর্মঘটের জেরে পরিস্থিতি কঠিন হতে পারে, জানিয়েছেন ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস্ (এনএইচএস)’র প্রধান। হাসপাতালের জরুরী পরিষেবা চালু রাখার জন্য ১২০০ ফৌজি অ্যাম্বুলেন্স মোতায়েন করা হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরেই সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা এনএইচএস-এর অ্যাম্বুল্যান্স কর্মীরা বেতন বৃদ্ধির দাবিতে সরব। মূল্যবৃদ্ধির চড়া হার প্রায় দু’অঙ্কে পৌঁছেও যাচ্ছে। সরকার অ্যাম্বুল্যান্স কর্মীদের ৪.৭৫ শতাংশ বৃদ্ধিতে রাজি হয়েছে। কর্মীদের দাবি মূল্যবৃদ্ধির হার হিসেবে রেখে বাড়াতে হবে বেতন। অ্যাম্বুলেন্স কর্মীদের পাশাপাশি ওয়েলস্ ও ইংল্যান্ডে কর্মবিরতিতে নেমেছেন স্বাস্থ্যকর্মী ও টেকনিশিয়ানরা। গত তিন দশকে এটাই তাঁদের সবচেয়ে বড় ধর্মঘট। আন্দোলনকারীদের কাছে আর্জি রাখা হয়েছে, যাতে তাঁরা মুমূর্ষু রোগীদের ফিরিয়ে না দেন।

আন্দোলন নিরসনের জন্য সরকার মোটেও উৎসাহী নয়। অ্যাম্বুলেন্স কর্মীদের ধর্মঘটে বিপর্যস্ত স্বাস্থ্য পরিষেবা নিরসনের বদলে সরকারের পরামর্শ এই মুহূর্তে দেশবাসীর অহেতুক নিজের বিপদ ডেকে আনা উচিত নয়। আর তাই যতই এখন প্রাক-বড়দিন বা নববর্ষের পার্টি চলুক না কেন, ‘মাতাল’ হওয়ার মতো মদ খাওয়া যাবে না। অপ্রয়োজনে গাড়ি নিয়ে রাস্তায় বেরনোর দরকার নেই। এমনকী খেলাধুলোও এই সময় বন্ধ রাখাই ভালো। কারণ, হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য চাইলেই যে অ্যাম্বুলেন্স মিলবে, এমন ভরসা দিতে পারছে না সরকার।

পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য এনএইচএস-এর তরফে সমস্ত হাসপাতালে চিঠি পাঠিয়ে যত বেশি সম্ভব রোগীকে ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। জরুরি বিভাগ খালি করার ওপর বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে। চিকিৎসার জন্য অন্য বিভাগে পাঠানোর প্রয়োজন থাকলে দ্রুত তা করতে বলা হয়েছে। কিন্তু করবে কে?

এর আগে ব্রিটেনে ধর্মঘট করেছেন রেল শ্রমিকরা। মার্চ মাস থেকে ভাগে ভাগে বিভিন্ন সময়ে বেতন-ভাতা বৃদ্ধি সহ একগুচ্ছ দাবি নিয়ে রেল সংগঠনগুলির প্রায় ৫০ হাজারের বেশি কর্মী ধর্মঘটে সামিল হয়েছেন। বিগত ৩৩ বছরের ইতিহাসে এটিই সবচেয়ে বড়ো রেল ধর্মঘট বলে মনে করা হচ্ছে।

স্বাস্থ্য, পরিবহণের মতো জনপরিষেবার ক্ষেত্রে টানা বেসরকারিকরণ চলেছে গ্রেট ব্রিটেনে। কোভিডের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি ব্রিটেনের স্বাস্থ্য কাঠামোর সঙ্কট আর চেপে রাখা যায়নি। সরকারি পরিষেবায় বরাদ্দ বাড়াতে নারাজ ব্রিটিশ সরকার।

রেলকর্মীরা বেতন-ভাতা বৃদ্ধির দাবি অনেকদিন ধরেই করে আসছেন। বর্তমানে গ্রেট ব্রিটেনে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি গত ৪০ বছরের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। এদিকে চাকরি ছাঁটাই লেগেই আছে কিন্তু, রেলকর্মীদের বেতন একটুও বাড়েনি। ২০২১-এ এই বিষয়ে সরকারি প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকও হয় এবং সরকারের পক্ষ থেকে ২০২২-এ কর্মীদের বেতন ৭.৯ শতাংশ বৃদ্ধির আশ্বাস দেওয়া হয়। কিন্তু আশ্বাস দেওয়ার পর দীর্ঘদিন কেটে গেলেও প্রতিশ্রতি পূরণ করেনি ব্রিটিশ সরকার। তাই নিজেদের হকের দাবি আদায়ের জন্য ধর্মঘট ছাড়া রেলকর্মীদের অন্য কোনও বিকল্প পথ খোলা নেই। যুক্তরাজ্যে সর্বশেষ রেল ধর্মঘট ১৯৮৯-এ হয়েছিল। এবার প্রায় ৩৩ বছর পর এহেন রেল আন্দোলন দেখছে ব্রিটেনবাসী।

স্বাস্থ্যকর্মীদের কর্মবিরতিকে সমর্থন জানিয়ে এবার একই পথে হাঁটার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ব্রিটেনের রেলকর্মী, পাসপোর্ট আধিকারিক ও ডাককর্মীরাও। ফলে বিলেতে বড়সড় সঙ্কট তৈরি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

ব্রিটেনের যে কোনো ঘটনায়, তা সে রানি বা যুবরানির মৃত্যু হোক বা নতুন রাজার অভিষেক কিংবা ভারতীয় শিল্পপতির জামাতার প্রধানমন্ত্রী হওয়া ইত্যাদি সব বিষয়েই ভারতীয় সংবাদমাধ্যম সর্বদাই সোচ্চার। কিন্তু শ্রমিক কর্মচারীদের সঙ্ঘবদ্ধ ধর্মঘটে বিপর্যস্ত ব্রিটেন সম্পর্কে কোথাও কোনো শব্দ উচ্চারিত হচ্ছে না। এটা কি সচেতন ভাবে পুরোনো প্রভুদের প্রতি দুর্বলতা প্রদর্শন? অথবা অন্য কোনো কারণে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম নীরব। এমনও হতে পারে যে ভারতের শ্রমিক কর্মচারীরা সঙ্ঘবদ্ধ ভাবে এই পথে এগিয়ে চলাকে মেনে নিয়ে যেন পথে নামতে উদ্বুদ্ধ হতে না পারে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের খেয়াল থাকে না মাত্র এক বছর আগে কৃষকদের বর্ষব্যাপী শান্তিপূর্ণ অবস্থান বিক্ষোভের কাছে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীকে আত্মসমর্পণ করতে হয়েছে। কাজেই সঙ্ঘবদ্ধ আন্দোলনের ক্ষমতা সম্পর্কে রাষ্ট্র যথেষ্ট সচেতন। ব্রিটিশ শ্রমিক কর্মচারীদের আন্দোলনের খবর ভারতের শ্রমিক কৃষকের সামনে একটা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে। তার বেশি কিছু নয়। বাকিটা তাঁরা নিজেরাই বুঝে নিতে সক্ষম।