আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ প্রথম সংখ্যা ● ১-১৫ জানুয়ারি, ২০২৩ ● ১৬-২৯ পৌষ, ১৪২৯

সম্পাদকীয়

আবাসের দুর্নীতি, দুর্নীতির আবাস


পশ্চিমবঙ্গ নামক হতভাগ্য রাজ্যটির বিড়ম্বনা এই যে সারা বছরই বিভিন্ন দুর্নীতির খবরে রাজ্যের নাম বারবার উঠে আসে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, গনবন্টন, সরকারি ভাতা বন্টন ইত্যাদি এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যেখানে রাজ্যে কোনো বৃহদাকার দুর্নীতি হয়নি গত ১০ বছরে। রাজ্যের বর্তমান শাসক দল ও দুর্নীতি প্রায় সমার্থক হয়ে গিয়েছে।

বিগত কয়েক সপ্তাহ বিভিন্ন দৈনিক সংবাদপত্রে উঠে আসছে রাজ্যের আবাস দুর্নীতির বিবরণ। প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা তৈরি হয় নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষের জন্য নিজস্ব বাড়ি তৈরিতে ভর্তুকি দেওয়ার জন্য। এই যোজনার আওতায় থাকা ব্যক্তি নিজের বাড়ি তৈরির জন্য সমতল অঞ্চলে ১.২ লক্ষ টাকা ও পার্বত্য অঞ্চলে ১.৩ লক্ষ টাকা অবধি ভর্তুকি পেতে পারেন। মূলত যাদের কাঁচা বাড়ি, মাসিক আয় ১০ হাজার-এর কম, কোনো সরকারি চাকরি করেন না এবং তসফিলি, অনগ্রসর বা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত তারাই এই প্রকল্পের সুবিধা পেতে পারেন। পরিসংখ্যান অনুযায়ী এ রাজ্যে প্রতিটি গ্রাম ধরে এই তথ্যভাণ্ডারে ৪৯ লক্ষ ২২ হাজার নাম নথিভুক্ত রয়েছে। বর্তমানে কেন্দ্র এই প্রকল্পে রাজ্যে ১১,৩৬,৪৮৮টি বাড়ি তৈরির অনুমতি দিয়েছে। কিন্তু ২০১৮ সালের সমীক্ষায় দেখা যায় যে এই তালিকা থেকে বহু গৃহহীন গরীব মানুষের নামই বাদ গেছে। এই পরিপ্রক্ষিতে কেন্দ্রের সরকার বাদ পড়া মানুষদের নাম নথিভুক্তির জন্য আবাস প্লাস প্রকল্পটি চালু করে। কিন্তু এই প্রকল্পে একাধিক বেনিয়মের অভিযোগ ওঠায় কেন্দ্র এই প্রকল্পে টাকা পাঠানো বন্ধ করে দেয়। পরে রাজ্যের সরকার কেন্দ্রের দেওয়া শর্তাবলী মানার অঙ্গীকার করলে কেন্দ্র এই প্রকল্পে টাকা বরাদ্দ করার প্রশ্নে সম্মতি দেয়। কিন্তু গোল বেধেছে এই শর্তাবলী মানতে গিয়েই। দেখা যাচ্ছে রাজ্যের সরকার তথা শাসক দল নিজেদের দুর্নীতির অভ্যাস ত্যাগে নারাজ। শুধু তাই নয়, শাসক দলের নেতা, পঞ্চায়েত প্রধান থেকে শুরু সরকারি আধিকারিকদের দুর্নীতি আড়াল করতে সামনে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে রাজ্যে কর্মরত আশা কর্মীদের। পরিস্থিতি কিছুক্ষেত্রে এতটাই বেগতিক হয়ে উঠেছে যে সংশ্লিষ্ট আশা কর্মীরা নিজেদের নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কায় ভুগছেন। আর এই পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে রাজ্যের শাসক দলের বেলাগাম দুর্নীতির অভ্যাসের জন্য।

পাঠকরা প্রতিদিন বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে ও খবরের কাগজের পাতায় দেখছেন রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় কিভাবে গরীব মানুষেরা আবাস যোজনায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে পঞ্চায়েত ও গ্রামীন ব্লক অফিসগুলির সামনে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন। কেন এই পরিস্থিতির উদ্ভব হল? কেন্দ্রের শর্ত অনুযায়ী আবাস প্লাস যোজনায় নতুন করে কোনো নাম নথিভুক্ত হবে না। ৪ বছর আগে যে নামগুলি প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় নথিভুক্ত হয়েছিল সমীক্ষা করে তার থেকে কেবল অযোগ্যদের নাম কেটে বাদ দিতে হবে। এর জন্য চার দফায় সমীক্ষা হবে। একটি প্রাথমিক সমীক্ষা হবে তালিকাভুক্ত উপভোক্তাদের বাড়ির অবস্থাসহ আরো কিছু আর্থসামাজিক অবস্থার। ওই প্রাথমিক সমীক্ষার ভিত্তিতে উঠে আসা তালিকা ধরে আবার তা খতিয়ে দেখবেন গ্রাম পঞ্চায়েতের জন্য নিযুক্ত অফিসার পদমর্যাদার আধিকারিকেরা। তৃতীয় স্তরে সংশ্লিষ্ট ব্লক ভূমি আধিকারিক, থানার ওসি-আইসিরা তালিকা ধরে বিক্ষিপ্ত ভাবে খতিয়ে দেখবেন। পরে তালিকা ধরে মোট উপভোক্তার ১০ শতাংশের যোগ্যতা যাচাই করবেন বিডিও-রা। তিন শতাংশ করে উপভোক্তার উপযুক্ততা যাচাই করবেন জেলাশাসক এবং এসডিও-রা। এর পরেই খসড়া তালিকা প্রকাশিত হবে। সেই তালিকা গ্রামসভায় নিয়ে গিয়ে বাসিন্দাদের জানানো হবে। সেখানে কেউ অযোগ্য হিসাবে চিহ্নিত হলে তাঁর নাম বাদ যাবে। কিন্তু নতুন করে কোনও নাম পঞ্চায়েত সংযোজন করতে পারবে না। এর পর সংশোধিত তালিকা পাঠানো হবে জেলা প্রশাসনের কাছে। জেলাস্তরের অ্যাপেলেট কমিটি সেই তালিকায় অনুমোদন দিলে তা কেন্দ্রের আবাস ডেটাবেসে (তথ্যভান্ডার) আপলোড করা হবে। সেখানেও আর এক দফা ঝাড়াই-বাছাই হবে। কেন্দ্রীয় বিধির বাইরে থাকা নাম স্বয়ংক্রিয় প্রক্রিয়া বাদ দেবে কেন্দ্রের সফটওয়্যার। তার পরেই প্রকল্পের টাকা পাবেন উপভোক্তারা।

এখানেই বর্তমান রাজ্য সরকার যে চালিয়াতিটা করেছে তা হল প্রাথমিক সমীক্ষার কাজের দায় তারা চাপিয়ে দিয়েছে রাজ্যের আশা ও অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের ঘাড়ে। ফলে মানুষের ক্ষোভের প্রাথমিক আঁচটা গিয়ে পড়ছে তাদের উপর। বিগত ১০ বছর ধরে রাজ্যের শাসকদলের নেতারা এই আবাস যোজনাকে কেন্দ্র করে একের পর এক দুর্নীতি করে গিয়েছে। একদিকে যেমন গৃহহীন গরিব মানুষদের ন্যায্য অধিকারকে বঞ্ছিত করে তাদেরই জন্য গঠিত প্রকল্পে নাম নথিভুক্ত করিয়ে দেওয়ার জন্য তোলা আদায় করেছে শাসকদলের ছোট থেকে বড় সমস্ত নেতানেত্রীরা তেমনই বিভিন্ন জায়গায় প্রকৃত উপভোক্তাদের নাম বাদ দিয়ে নিজের পরিবার, আত্মীয় থেকে শুরু করে নিজের পেটোয়া চামচাদের নাম আবাস যোজনার তালিকায় ঢুকিয়েছে। ফলে গোটা রাজ্যজুড়েই আবাস প্রকল্প থেকে বাদ গেছে প্রকৃত গৃহহীন গরীব মানুষের নাম। এখন যখন আশা কর্মীরা গ্রামে গ্রামে যাচ্ছেন এই তালিকা নিয়ে গরীব মানুষ ভাবছেন এই আশাকর্মীরাই তাদের নাম তালিকায় তুলে দিতে পারবেন। ফলে নিজেদের নাম তালিকায় না দেখতে পেয়ে ক্ষুব্ধ মানুষ এই আশাকর্মীদেরই ঘেরাও করছেন, হেনস্থা করছেন। অথচ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এঁরা নিজেরাই এই দুর্নীতির শিকার, অথবা শাসকদলের মাফিয়া নেতৃত্বের চাপে বাধ্য হয়েছেন তালিকায় কারচুপি করতে। আশাকর্মীরা বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন একাধিক জায়গায় যাতে তাদের এই পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে না হয়। নিজেদের নিরাপত্তার দাবীতে তারা অবস্থান করছেন, আন্দোলন করছেন।

কিন্তু তৃণমূল আছে তৃণমূলেই। এই দলের নেতাদের না আছে লজ্জা না আছে ভয়। একদিকে এখনও গ্রামাঞ্চলে শাসকদলের নেতানেত্রীরা আশাকর্মীদের হুমকি দিয়ে চলেছে আবাস প্লাসের তালিকায় তাদের পছন্দের নাম নথিভুক্ত করার জন্য, কোথাও কোথাও প্রাথমিক সমীক্ষার তালিকা পঞ্চায়েত অফিসে বসে আবার পাল্টে ফেলা হচ্ছে। খবরে প্রকাশ রেবা বিশ্বাস নামে এক আশাকর্মী আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন কারণ অঞ্চলের ‘দাপুটে’ তৃণমূল নেতা আবাস যোজনায় নিজের পছন্দের নাম তালিকাভুক্ত করার জন্য ওনাকে হুমকি দিয়েছিল এমনকি বাড়িতেও ভাঙচুর করা হয়। ফলে এটা দিনের আলোর মত পরিষ্কার যে শাসকদলের এই সমস্ত সম্পদদের কোন কিছুতেই কিছু আসে যায় না। এরা জানে যে প্রশাসনের স্নেহাশীষ এদের ওপর আছে। রাজ্যের পুলিশি ব্যবস্থা রয়েছে এদের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য। আর নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার আশঙ্কাও এদের নেই। রাজ্যের শাসকদলের রয়েছে একটি সংগঠিত লুম্পেন বাহিনী। তাই শাসকদলের নেতানেত্রীরা যতই দুর্নীতিতে ডুবে থাক, নির্বাচনী বৈতরণী পার করতে এদের ভরসা এই লুম্পেন বাহিনী। আর তার সাথে যোগ্য সঙ্গত দেবে রাজ্যের পুলিশ প্রশাসন। শাসকদলের ঠ্যাঙাড়ে বাহিনীকে নিরাপত্তা দেওয়াই আজকে এ রাজ্যে পুলিশ প্রশাসনের একমাত্র কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে একদিকে যেমন পুলিশের লোক এসে প্রতিবাদী ছাত্র আনীশ খানকে বাড়িতে এসে খুন করে দিয়ে চলে যায়, তেমনিই পুলিশকেই বোমা মারতে নিদান দেওয়া মাফিয়া নেতাকে ইডির জেরার হাত থেকে বাঁচাতে পুলিশই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মামলা করে এবং তারপর সেই অভিযুক্তকেই জামাই আদর করে নিজেদের হেফাজতে রেখে নিরাপত্তা দেয়। দুর্নীতির দায়ে একটা সরকারের গোটা শিক্ষাদপ্তরটাই প্রায় জেলে চলে গেছে। কিন্তু তারপরেও সেই দুর্নীতির দায় নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী পদত্যাগ করেন না, উল্টে সেই বেনিয়মকেই লাগু রাখার সওয়াল করে যান।

বিগত ১০ বছর ধরে তৃণমূল দলটি এ রাজ্যে এক বিষময় রাজনৈতিক সংস্কৃতির আমদানী সফলভাবে ঘটাতে পেরেছে। এই রাজনীতিতে মূল্যবোধের কোন স্থান নেই। রাজনীতিকে পরিণত করা হয়েছে সমাজের সবচাইতে অকর্মণ্য, পরজীবি এবং লুম্পেন অংশের হাতে সম্পদ কুক্ষিগত করার মাধ্যম হিসাবে। এই রাজনীতিতে গরীব, পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য কোনো ভাবনা নেই, তাদের জীবনযাত্রার মানের স্থায়ী উন্নতি ঘটানোর জন্য কোনো পরিকল্পনা নেই। আছে কেবল ক্ষমতার আস্ফালন, ক্ষমতাকে ব্যবহার করে নিজের উদরপূর্তির ধান্দা আর মাঝেমাঝে রাজনৈতিক জনপ্রিয়তা বজায় রাখতে সমাজের পিছিয়ে থাকা মানুষদের দিকে তাদেরই অধিকারকে দান হিসাবে ছুঁড়ে দেওয়ার চালাকি। কেন্দ্র এবং এ রাজ্যের শাসকদল, উভয়েই এই দোষে দুষ্ট। ফলে এই দুই দলের নেতা ও কর্মীদের এক দল থেকে অন্যদলে আনাগোনা লেগেই থাকে। আর এই সব রাজনৈতিক ভাঁড়ামোর মাঝে পিষ্ট হয়ে চলে এই রাজ্যের গরীব, মেহনতি ও সামাজিকভাবে পিছিয়ে থাকা মানুষেরা।

আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনে হয়ত আবারও এ রাজ্যের মানুষ সাক্ষী থাকবেন নির্বাচন ঘিরে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের একাধিক ঘটনার। গ্রামীন প্রশাসনের দখল নেওয়ার জন্য রাজ্যের শাসকদলের মরিয়া মনোভাবের বলি হবে রাজ্যের সুস্থ গণতান্ত্রিক পরিবেশ। গ্রামীন প্রশাসনের দখল মানেই গরিব মানুষের জন্য বরাদ্দ প্রকল্পের টাকা নয়ছয় করা, নিজেদের ব্যক্তিগত তহবিল পুষ্ট করার অবাধ সুযোগ। আর সেই একই সম্পদের দখল নিতে রাজ্যের তথাকথিত বিরোধী দলটিও সক্রিয় হবে। কিন্তু গরীব মেহনতী মানুষমাত্রেই জানেন যে এই দুজনের কেউই তাদের আশা ভরসা পূরণ করবে না। তবুও মানুষ বাধ্য হবে হয়ত এই দুয়ের ভেতরে কাউকে বেছে নিতে। আর হয়ত এখানেই এ রাজ্যের বাম গণতান্ত্রিক শক্তিগুলি তাদের প্রতি মানুষের প্রত্যাশার ভরসাস্থল হয়ে উঠতে পারবে। তাই আসন্ন রাজ্যের পঞ্চায়েত নির্বাচনই ঠিক করে দেবে এ রাজ্যের রাজনীতি এই তৃণমূল-বিজেপির অন্তঃসারশূন্যতায় ঘুরপাক খাবে নাকি বাম গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল আন্দোলন সত্যিই তাদের ভুলত্রুটি কাটিয়ে রাজ্যের গরীব, খেটে খাওয়া, পিছিয়ে থাকা মানুষের প্রত্যাশার উপযোগী হয়ে বিকল্প হয়ে দেখা দেবে নাকি কোনো বিকল্প বাম গণতান্ত্রিক শক্তির উত্থান ঘটবে এ রাজ্যের বুকে। যদি সত্যিই এ রাজ্যের এই কলুষিত রাজনীতির আবর্তকে ভেঙে বেরোতে হয় তবে রাজ্যের আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূল ও বিজেপি উভয়কেই পরাজিত করতে হবে।