আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ অষ্টাদশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ● ১-১৫ আশ্বিন, ১৪৩০

প্রবন্ধ

স্থবির দাশগুপ্তঃ ক্যান্সার ও অন্তর্ঘাতের রাজনীতি

আশীষ লাহিড়ী



স্থবির দাশগুপ্ত (১৯৪৯-২০২৩)



ইঞ্জিনিয়ার, সাহিত্যপ্রেমী বাবা ছিলেন প্রেমাঙ্কুর আতর্থীর 'মহাস্থবির জাতক' উপন্যাসের ভক্ত। সেই সূত্রে ছেলের নাম রেখেছিলেন স্থবির। "অমন নাম নিয়ে যে আমাকে নানান সময়ে যথেষ্ট বিড়ম্বনা সইতে হবে তা" স্থবির দাশগুপ্ত ছোটোবেলা থেকেই জানতেন। বড়োবেলায় অবাঙালিরা যখন তাঁকে সৎবীর বা ঠাবির বলে ডাকতেন, তিনি অবাক হতেন না; "কিন্তু বঙ্গসন্তানরা যখন স্থাবীর, ইস্থবীর, স্থঅবির" বলতেন তখন তিনি দুঃখ পেতেন। কারণ তাঁর মতে "ভাষা শিক্ষার মাধ্যম না, আসলে ভাষাই শিক্ষা। ...যে জাতির শিক্ষায় আর ভাষার উৎকর্ষ নেই, সে আসলে মৃতবৎ"। না, এ কোনো ভাষাতাত্ত্বিকের সন্দর্ভ নয়, সদ্যোপ্রয়াত ক্যান্সার-বিশেষজ্ঞ ডক্টর স্থবির দাশগুপ্ত-র আত্মজীবনী 'শীতলপাটি বিছিয়ে যারা' (লা স্ত্রাদা, ২০২৩) থেকে সংগৃহীত একটি উদ্ধৃতি মাত্র।

স্থবিরের জীবনকে মোটামুটি তিন দিক থেকে দেখা যেতে পারে। এক, তাঁর রাজনৈতিক জীবন। আর. জি. কর মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র হিসেবে তিনি নকশালবাড়ি বিপ্লবী আন্দোলনে যোগ দিয়ে সোজা চলে যান সুন্দরবন অঞ্চলে। পরে গ্রেপ্তার হন। জেল থেকে বেরিয়ে আবার ফিরে আসেন প্রাতিষ্ঠানিক ডাক্তারি শিক্ষার জগতে। নতুন করে পড়া শুরু করে, মাস্টারমশাই আর বন্ধুদের আনুকূল্যে প্রায় অসাধ্যসাধন করে ভালোভাবেই ডাক্তারি পাশ করেছিলেন।

তিনি কি ব্যর্থ বিপ্লবী? তাঁর এক বিপ্লবী বন্ধুর কথায়, "এ-ও এক ধরনের সাবভার্শান। বুঝলি তো! ...রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলি। এবার ডাক্তার হয়েও কত কী করা যায়, ভেবে দেখিস"।

পাশ করে বিখ্যাত এক ক্যান্সার সার্জনের সহকারী হিসেবে কাজ শিখতে লাগলেন। 'স্যার' তাঁর আয়ারল্যান্ড যাওয়ার পরিকল্পনায় জল ঢেলে দিলেন। দশ বছর চলল সেই শিক্ষানবিশি। ক্যান্সার সম্বন্ধে নতুন নতুন জ্ঞান আহরণ চলল নিরন্তর। এদিকে "চিত্তরঞ্জন ক্যান্সার হাসপাতালে দিনে গড়ে জনা পঞ্চাশেক রুগি" দেখার শিক্ষা চলছে।

কিন্তু "ডাক্তারি জগৎ যে আর ছয়ের দশকে দাঁড়িয়ে নেই, ...ক্যান্সার বিজ্ঞান যে ইতিমধ্যে 'ইন্ডাস্ট্রি' হয়ে গেছে", সেটা তিনি তখনো বোঝেননি। ইলিনয়ের প্রসিদ্ধ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার তাপস দাশগুপ্ত তাঁর চোখ খুলে দিলেনঃ "ক্যান্সার একটা ইন্ডাস্ট্রি হয়ে যাচ্ছে, খুব দ্রুত। তুমি-আমি কেউই একে আটকাতে পারব না। না পারি, অন্তর্ঘাত তো চালাতে পারব"? সেই সঙ্গে প্রশ্ন জাগল, "অন্তর্ঘাত কি এতই সহজ কর্ম? বিশ্বজোড়া কর্পোরেট ব্যবস্থা, অনলস পরিশ্রমে গড়ে উঠতে উঠতে কংক্রিটের মতো মজবুত হয়ে গেছে"। তাকে আঘাত হানবেন কী করে?

এরপর সমমনস্ক পুরোনো বন্ধু কিশোরের সঙ্গে চলল মাথার ভেতরের 'যুক্তির বাগান' চাষ করা, কমন সেন্স-এর খুরপি চালিয়ে। ক্রমে অভিজ্ঞতা বাড়ে, বোঝেন, "ক্যান্সার সারে, আবার সারেও না। ...ক্যান্সার তো প্রাণজীবনেরই আরেক রূপ"। সম্পূর্ণ নতুন কথা। এ-ই কি তাহলে তাঁর অন্তর্ঘাত-সাধনার গূঢ় তত্ত্ব? ক্যান্সারকে প্রাণজীবনেরই আরেক রূপ বলে মানতে শিখতে হবে। বুঝতে হবে, তার গমনপথ সে নিজেই ঠিক করে। সেই গমনপথের সঙ্গে তাল মিলিয়েই কোনো ক্যান্সার সারবে, কোনো ক্যান্সার সারবে না। তাহলে দুনিয়া-জোড়া ক্যান্সার-ইন্ডাস্ট্রি নিত্য যেসব নতুন নতুন 'যুগান্তকারী' ওষুধ বাজারে আনছে, তার সবই কি ধাপ্পাবাজি? না, তা কেন? কিন্তু তার দাবিগুলো অতিরঞ্জিত, তা যত না বিজ্ঞান-নির্ভর, তার থেকে বিপণনশাস্ত্র-নির্ভর। তার মধ্যে থেকে ঠিক কেমোটা বেছে নেওয়া, যা রুগির মনে বাড়তি আশা জাগাবে না, কিন্তু দেবে উপশম, কমাবে যন্ত্রণা, সেটাই আদর্শ ডাক্তারের কাজ। নির্বিচারে "বিজ্ঞানের অনন্য ফসল"গুলিকে রুগির ঘটিবাটির বিনিময়ে প্রয়োগ করার অর্থ দুনিয়া-জোড়া ওই বিপণন-জালে জড়িয়ে যাওয়া।

স্থবিরের অন্তর্ঘাত-সাধনা একটা জমি পেল। রুগির কষ্ট কমানো; যেখানে সারবার সেখানে সারানো; যেখানে সারবার নয়, সেখানে ন্যূনতম কষ্ট ভোগ করিয়ে শরীরকে অন্তিম পরিণতির দিকে অগ্রসর করে দেওয়া - এই হল তাঁর ইষ্টমন্ত্র। মনু কোঠারির দর্শন তাঁকে প্রভাবিত করল। এখানেও বন্ধুদের প্রশ্নঃ সেই দর্শনের মধ্যে যে-ভাববাদী উচ্ছ্বাসের প্রাবল্য, সেটা কি ধরতে পেরেছিলেন স্থবির?

স্বভাবতই, মূলস্রোতের ডাক্তাররা তাঁর এই মনোভাবকে বিজ্ঞানবিরোধী, নৈরাশ্যবাদী বলে অভিহিত করলেন। স্থবির কিন্তু নিজের জায়গায় অটল রইলেন। চিকিৎসক হিসেবে মোটেই ব্যর্থ নন তিনি। তাঁর চিকিৎসায় যাঁরা ভালো হয়েছেন, তাঁরা তো বটেই; যাঁরা ভালো হননি তাঁদের নিকটজনেরাও স্বীকার করেছেন, তাঁর চিকিৎসার মানবিক স্পর্শটুকু রুগির কাছে খুবই স্বস্তিদায়ক ছিল। তাঁর রুগিরা কখনো রোবট-সদৃশ 'এফিশিয়েন্সি'র শিকার হননি, পেয়েছিলেন মানুষ-ডাক্তারের স্নেহার্দ্র করস্পর্শ। মূলস্রোতের বিরুদ্ধে স্থবিরের এই অন্তর্ঘাত কতটা বিজ্ঞান ও বাস্তবসম্মত, সে-বিচার করার অধিকার আমার নেই, সে-সময়ও আসেনি; কিন্তু তাঁর এই স্বার্থশূন্য বিদ্রোহ এই পণ্যরতি-আক্রান্ত সময়ের একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা হয়ে থাকবে।

একই অন্তর্ঘাতের আরও তীব্র রূপ দেখেছিলাম তাঁর কোভিড ভ্যাকসিন-বিরোধী ভূমিকায়। ফাইজার, অ্যাস্ট্রা-আইডিএল প্রমুখ দানবাকার ওষুধ কোম্পানি অ-পরীক্ষিত কোভিড ভ্যাকসিন নিয়ে বিশ্বজুড়ে যে-বীভৎস খেলা খেলেছে, তার অনেক তথ্য এখন আমাদের জানা। তা সত্ত্বেও, কোভিডের নানাবিধ উপসর্গ দমনে ভ্যাকসিনের উপযোগিতা সম্পূর্ণ অস্বীকার করা কতখানি বাস্তবসম্মত ছিল, তা নিয়ে অনেকে, স্থবিরের অনেক বন্ধুও, প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁদের জিজ্ঞাসাঃ অন্তর্ঘাত কি বিজ্ঞানকে ছাপিয়ে উঠেছিল? জনস্বাস্থ্যর দিক থেকে সমস্যাটাকে না-দেখে নিছক ওষুধ আর ভ্যাকসিন দিয়ে কোভিড ভাইরাস-জাত উপসর্গগুলিকে ঠেকানোর প্রয়াস যে দেশে দেশে ব্যর্থ হয়েছিল, সে তো সত্য। তবু, তার পরেও প্রশ্ন ওঠে, এই সার্বিক ভাকসিন-বিরোধিতার দর্শন জনসাধারণকে কি বিহ্বল বিমূঢ়তার দিকে ঠেলে দেয় না?

স্থবিরের মধ্যে আমরা পেয়েছিলাম একজন মানুষকে যে তার দেশের, তার ভাষার সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে রেখেছিল গভীর অনুরাগে। যে হয়ে উঠেছিল বাংলা গদ্যের এক নিপুণ শিল্পী, যে ছিল সংগীতের সমঝদার। যে চেয়েছিল এই ব্যর্থ সমাজ বদলে একটা সুস্থ শ্রেণিহীন সমাজে উত্তরণের পথ প্রশস্ত করতে। যে চেয়েছিল চিকিৎসাবিজ্ঞান পণ্য বিক্রয়ের আউটলেট না হয়ে মানুষের কাজে লাগুক। এমন মানুষকে হারিয়ে দীন হল বাঙালি সমাজ। স্থবিরের 'পেশেন্ট', প্রয়াত সন্তোষ রাণার একটি উক্তি তার বড়ো প্রিয় ছিলঃ "সাবোতাজ-টাবোতাজ নয়, তুমি শুধু মানবতার পক্ষে দাঁড়াও। প্রতিষ্ঠান তোমাকে উপেক্ষা করবে, কিন্তু পীড়িত মানুষ তোমার কথা শুনবে, বুঝবে"। এটুকুই সান্ত্বনা।