আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ অষ্টাদশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ● ১-১৫ আশ্বিন, ১৪৩০

প্রবন্ধ

মুনাফা ও মাদক

প্রতীশ ভৌমিক


একদিকে বিশ্বজুড়ে মাদকের বিরুদ্ধে মানুষের বিস্তর লড়াই। অন্যদিকে শুধু মুনাফার লোভে কর্পোরেটের মানবতা বিসর্জনের উদাহরণ হল আমেরিকার Purdue Pharma-র ওষুধের মোড়কে মাদকের ব্যবসা।

পৃথিবীজুড়ে মাদকের বিক্রি ও মাদক পাচারকারীদের এক বিশাল নেটওয়ার্ক রয়েছে। আফগানিস্তান, পাকিস্তান, নেপাল ও ভারতের সীমান্তবর্তী রাজ্যের মধ্যে দিয়ে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, চীন থেকে রাশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত এই মাদকের ব্যবসা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে মেক্সিকো বর্ডার অঞ্চল, উত্তর এবং দক্ষিণ আমেরিকা, ইটালী সর্বত্রই মাদকের রমরমা বাজার। আমেরিকা, ইউরোপ, আফ্রিকা এশিয়া সর্বত্রই মাদকের ব্যবসায় বিশাল পরিমাণ টাকার লেনদেন হয়েছে বছরের পর বছর। যদিও এর পিছনে যুক্ত আছে মাফিয়ারাজ, ক্রিমিনাল সোসাইটি, একশ্রেণীর পুলিশ, কিছু দাউদ ইব্রাহিমের মতো মানুষ ও উগ্রপন্থী সংগঠন। কোকেন, মরফিন, হেরোইন ছাড়াও বহুবিধ মাদকের রমরমা ব্যবসা চলে পৃথিবীজুড়ে। শুধু ২০১৪ সালেই সারা পৃথিবীতে ৬৫২ বিলিয়ন ডলারের মাদক বিক্রি হয়েছে। তথ্য বলছে এই মাদকের বিক্রির পরিমাণ ঐসব দেশের GDP-র দ্বিগুণ।

এই মাদকের ব্যবসা ক্রমশঃ বাড়ছে স্যোশাল মিডিয়ায়, অনলাইন ডার্ক ওয়েব অর ডার্কনেট মার্কেটের মাধ্যমে এবং তথ্য আরও বলছে যে এই মাদকই পৃথিবীজুড়ে বেশ কয়েক লক্ষ মানুষের মৃত্যুর কারণ। মাদকে আশক্ত মানুষের পরিবার, সুস্থ জীবন ও ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত নাগরিক সমাজ ও সমাজবিজ্ঞানীরা। মাদকে আক্রান্ত হয়ে এক ভয়ঙ্কর নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে, যা সমাজের মেরুদন্ড তথা যুবসমাজকে পঙ্গু করে দেয়। পানশালা, হুক্কাবার, স্কুল, কলেজ, হোস্টেল, ডিস্কোথেক, সমুদ্র সৈকতের পানশালা ওদের টার্গেট। LSD, Brown Sugar, Hashish, Cannabis ছোট থেকে বড় সবধরনের মাদকের ব্যবহার করে বাজার তৈরি করে। সারা বিশ্বের সব সরকারের চোখকে ফাঁকি দিয়েই এইসমস্ত মাদকের ছড়াছড়ি। কোডিন ফসফেট আছে এমন কাশির ওষুধ চোরাচালান হচ্ছে শুধু নেশার জন্য। সরকারীভাবে এর উপর নজরদারি থাকলেও কোডিন যুক্ত ওষুধ, ট্রামাডল জাতীয় ওষুধেরও অপব্যবহার হয় এদেশে। ভারতের ড্রাগ কন্ট্রোল পাবলিক হেলথের স্বার্থে নজরদারি করে এবং ওষুধের দোকানে লিপিবদ্ধ থাকে বলে ড্রাগ কন্ট্রোল দপ্তরের প্রত্যক্ষ নজরেও থাকে। কন্ট্রোল বলতে যা বোঝায় তা DCGI দ্বারা কেন্দ্রীয় সরকার নিয়ন্ত্রন করে তা কেবল পাবলিক হেলথ ও সেফটির জন্যে। একথা ঠিক যে আগামীদিনে সর্বত্র অনলাইনে ওষুধের বিক্রির পরিমাণ যতো বাড়বে ততোই এই নজরদারি কমবে এবং প্রেসক্রিপশনের আড়ালেই বিক্রি হবে (কন্ট্রোল ওষুধ, মাদক বা ঐ পর্যায়ের ওষুধগুলো)। ভারতীয় বাজারে ফেনসিডিল-টি বা কোরেক্স সিরাপের প্রেসক্রিপশন চিকিৎসকেরা খুব প্রয়োজন ছাড়া লেখেন না। কেবল নেশার জন্যই এই ওষুধগুলো পাইকারি বাজার থেকে রাতের অন্ধকারে, চোরাপথে বর্ডার পেরিয়ে পাচার হয়ে থাকে। এযাবৎ প্রচুর পরিমাণে বেআইনিভাবে বিক্রিত মাদক ও ওষুধ বাজেয়াপ্ত হয়েছে।

বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আমেরিকায় ওষুধ হিসেবে হেরোইন জাতীয় ড্রাগের ব্যবহার হতো অনেক আগে থেকেই। বিভিন্ন অসুখ, বিশেষত যন্ত্রণাদায়ক অথচ সম্পূর্ণ নিরাময়ের সম্ভাবনা নেই সেইসব রোগের ক্ষেত্রে চিকিৎসকরা ব্যাথা কমানোর জন্য কোকেন ছাড়া অন্যান্য ওপিঅয়েড প্রেসক্রাইব করতেন। সময়ের সঙ্গে সেগুলোও যেকোনও সাধারণ রোগের চিকিৎসাতেও বেশি বেশি ব্যবহার হতে শুরু করে। ফলত হেরোইন, মরফিন-এর মতো ড্রাগও অত্যন্ত সহজলভ্য হয়ে যায়। কিন্তু এইসব ড্রাগ অনেক দামি বলেই বিকল্পের দরকার পড়ে। অসহ্য যন্ত্রণায় চিকিৎসকের কাজ রোগীকে প্রথমে ব্যাথা-মুক্ত করতে হবে - চিকিৎসক মহলে এই বিষয়টা তখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল।

যদিও ওপিঅয়েড যুক্ত ওষুধ নেশার জন্য ব্যবহার হতে পারে বা ব্যবহারকারী তাতে আশক্ত হতে পারে বলে সেইসব ওষুধ চিকিৎসকদের কাছে খুব ভরসার ছিল না। এমন পরিস্থিতিতে পারডিউ ফার্মা Purdue pharma ১৯৯৬ সালে আমেরিকার বাজারে আনে অক্সিকনটিন নামক ওষুধ। কোম্পানি দাবি করে এই ওষুধটি অত্যন্ত ধীরে ধীরে রক্তে নিঃসৃত হয় এবং তার প্রভাব থাকে ১২ ঘন্টা পর্যন্ত। এই ওষুধে আশক্তি হবার সম্ভানা শতকরা মাত্র এক শতাংশ। খুব দ্রুত FDA approval-ও পেয়ে যায় অক্সিকনটিন।

দেখা গেছে নির্লজ্জ লোভ ও মানুষের অসহায়তার সুযোগ নিয়ে ঐ ওষুধের যথেচ্ছ ব্যবহার করে অসহায় মানুষকে এক নেশার জগতে ঠেলে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। Purdue ফার্মার অক্সিকনটিন মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে আমেরিকার সবচেয়ে বেশি প্রেস্ক্রাইবড ওষুধ হিসাবে বাজার দখল করে নেয় আর তার সঙ্গে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসে কীভাবে এই ওষুধে আশক্তি বাড়ছে এবং অক্সিকনটিন ওভারডোজে মৃত্যুর সংখ্যাও কীভাবে বাড়ছে। ওষুধটি শুরুতে অল্প ডোজে ১০ মিলিগ্রামে কাজ হচ্ছিল। কিন্তু কিছু সময়ের পর ১০ মিলিগ্রামে কাজ না হওয়াতে কোম্পানি ২০, ৪০, ৮০ মিলিগ্রামের ওষুধ তৈরি করে। মার্কেটিং টিম ডোজ সংক্রান্ত তথ্য পৌঁছে দেয় চিকিৎসকের কাছে। ক্যানসার বা অনিয়ন্ত্রিত ব্যথা ছাড়াও, যেকোনো সার্জারি সহ অন্যান্য ব্যথা কমানোর জন্যও এই ওষুধ ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয়। ওষুধে আশক্তির সম্ভাবনা প্রায় নেই বলা হয় তাতে ওষুধ প্রেস্ক্রাইব করার মাত্রা বাড়তে থাকে। দুর্ঘটনাজনিত ব্যাথা কমাতে বা সার্জারির পরবর্তী সময়ে ওষুধটির ব্যবহারে সাধারণ মানুষ আশক্ত হতে শুরু করে। কর্পোরেট কর্তৃপক্ষ চিকিৎসকদের বিলাসবহুল ভ্রমণে পাঠিয়ে, বড় বড় শহরে সিম্পোজিয়াম করে, যেখানে তারা আমেরিকান পেইন সোসাইটির সঙ্গে যুগ্মভাবে এই ওষুধের পক্ষে রোগীদের দ্রুত সেরে ওঠার কথা প্রচার করেন। এই প্রবল প্রচারের মধ্যে অক্সিকনটিন আসক্তির কথা চাপা পড়ে যেতে থাকে। পারডিউ ফার্মার লাভ হতে থাকে আকাশছোঁয়া। ওষুধে দ্রুত ব্যাথা কমলেও শুরু হয় অন্ধ নির্ভরতা বা Drug dependency, পাশাপাশি দীর্ঘদিন ব্যাথায় থাকা মানুষ যেমন বোঝেন ৪০ বা ৮০ মিলিগ্রামের অক্সিকনটিন কত তাড়াতাড়ি আশক্তি তৈরি করতে পারে তেমনই ড্রাগ খুঁজে বেড়ানো অল্পবয়সীরা খুব তাড়াতাড়ি বুঝে যায় এই ওষুধের বাইরের কোটিং খুলে নিয়ে গুঁড়ো করে ইনহেল করলে এটা (স্বপ্নময় নেশার) মতো ড্রাগের কাজ করে। শহরতলিতে স্কুলের ছাত্র থেকে কারখানায় বা খনিতে কাজ করা হাজারো শ্রমিক সাধারণ মানুষ অক্সিকনটিনে আশক্ত হয়ে নষ্ট করে ফেলেছে নিজেদের জীবন। আমেরিকার ফিলাডেলফিয়ার রাস্তায় এই মাদকাসক্তির বাস্তব ছবি সহজেই দেখা যায়।

ব্যক্তিগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত বহু মানুষজন পারডিউ ফার্মার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন, এছাড়াও নিউয়র্কের বিখ্যাত ফোটোগ্রাফার ন্যান্সী গোল্ডিনের মতো কিছু মানুষ তো বটেই। তবে সমাজকর্মী সহ বিভিন্ন স্তরের মানুষ এর প্রতিবাদে সামিল হয়েছেন। শ্রমিক, স্বাস্থ্যকর্মী, সমাজকর্মী, ডাক্তার, আইনজীবী, মাদকাসক্তদের পরিবারের মানুষজন সবাই মিলিতভাবে এই কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। প্রায় পাঁচ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে শুধু এই ড্রাগের কারণে। আমেরিকার আটটি স্টেট একসঙ্গে মামলা করেছে পারডিউ ফার্মা বিরুদ্ধে। মাদকের আশক্তির ঘটনা জেনেও কর্তৃপক্ষ মিথ্যে প্রচারে বিক্রি ও উৎপাদন বাড়িয়ে গেছে এবং যে কোনও উপায়ে ঐ ওষুধ চিকিৎসকের কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করেছে। মামলায় হারার পর এই কোম্পানি নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করার চেষ্টা করেছিল। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এটর্নি জেনারেল ঘোষণা করেন ওপিঅয়েড মহামারীর অপরাধ কাঁধে নিয়ে Purdue Pharma-কে ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতিপূরণ দিতে হবে যা ওপিঅয়েড জনিত মৃত্যুতে চিকিৎসা আর প্রতিরোধের কাজে খরচ করা হবে।

এক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা হলো যে সরকারী নজরদারি ও দায়বদ্ধতা পালনে সরকার ব্যর্থ হলে কী ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় এবং তার সামাজিক প্রতিফলন কেমন তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ হলো কর্পোরেট সংস্থার Oxycontin উৎপাদন ও তার বিস্তার।