আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ অষ্টাদশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ● ১-১৫ আশ্বিন, ১৪৩০

সম্পাদকীয়

ভারত ও ইন্ডিয়া


জি২০ শীর্ষ সম্মেলনের নৈশভোজের আমন্ত্রণপত্রে হঠাৎ দেখা গেল যে মাননীয়া রাষ্ট্রপতির পরিচয় দেওয়া হয়েছে ‘প্রেসিডেন্ট অফ ভারত’। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভারতবর্ষের নাম ইন্ডিয়া লেখাই দস্তুর। ভারতের সংবিধানের প্রথম ধারায় স্পষ্ট ভাষায় লেখা আছে, "India, that is Bharat, shall be a Union of States"। সরকার পক্ষ এবং বিরোধী পক্ষ উভয়েই এই ধারাটির উল্লেখ করে বলতে চাইছেন যে ভারত এবং ইন্ডিয়া নামের মধ্যে কোনো ফারাক নেই। অন্যদিকে, মিডিয়ার একাংশ অত্যুৎসাহী হয়ে এই প্রচার করতে শুরু করে যে কেন্দ্রীয় সরকার দেশের নাম পরিবর্তন করে ভারত করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে সংসদের বিশেষ অধিবেশন ডেকেছে।

ভারত এবং ইন্ডিয়া আমাদের দেশের নাম। বহু শতাব্দী ধরে এই দুটি নাম আমাদের মজ্জাগত হয়ে গেছে। মনে রাখতে হবে যে আরএসএস-এর বহুদিনের দাবি হল এই যে দেশের নাম পরিবর্তন করে শুধুমাত্র ভারত করা হোক! ইন্ডিয়া শব্দটি নাকি উপনিবেশবাদীদের দেওয়া, অতএব তা পরিত্যাজ্য। বীরেন্দ্র সেহবাগ অথবা অক্ষয় কুমারের মতন ক্রিকেটার অথবা অভিনেতা থেকে শুরু করে বিজেপি-র বিভিন্ন নেতা ভারত নামের মধ্যেই এখন দেশপ্রেম খুঁজে পাচ্ছেন। এমন একটি ধারণা মানুষের মনে জন্ম দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে, যেন ভারত নামেই একমাত্র প্রকৃত দেশপ্রেম পাওয়া যাবে, কিন্তু ইন্ডিয়া নামটি যেহেতু বহিরাগত তাই তার মধ্যে প্রকৃত দেশপ্রেম প্রকাশিত হবে না।

আসল কথাটি হল এই যে বিরোধী দলগুলির যে নির্বাচনী জোট তৈরি হয়েছে, তার নামকরণ করা হয়েছে 'ইন্ডিয়া'। অতএব, এখন দেশের নাম ইন্ডিয়া এবং বিরোধী জোটের নাম এক হওয়ায় শাসকদল মনে করছে যে দেশের নামটিই পালটে দেবে। যারা দেশপ্রেমের নামে প্রতিদিন অন্যদের বিবিধপ্রকার জ্ঞান বিতরণ করে থাকে, তারা তাদের রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক সম্মেলনের মঞ্চে হঠাৎ দেশের রাষ্ট্রপতিকে ‘প্রেসিডেন্ট অফ ভারত’ বলে পরিচয় করাচ্ছেন! বোঝাই যাচ্ছে যে রাজনৈতিক সুবিধালাভের জন্য বিজেপি তথা মোদী কতদূর যেতে পারে।

কিন্তু সংবিধান কী বলছে? আমাদের দেশের নাম কী? সংবিধানের এক নম্বর ধারায় পরিষ্কার লেখা আছে যে, "India, that is Bharat, shall be a Union of States"। সংবিধানের মূল বয়ানটি রচিত হয় ইংরেজিতে। সেই বয়ানে এক নম্বর ধারা ব্যতিরেকে অন্য কোথাও ভারত শব্দটি উল্লেখিত নেই। পরবর্তীকালে হিন্দি অনুবাদে 'ভারত' শব্দটি 'ইন্ডিয়া' শব্দের পরিবর্তে লেখা হয়। অর্থাৎ, সংবিধানে ভারত শব্দটিকে ইন্ডিয়ার অনুবাদ হিসেবেই ভাবা হয়েছে।

এই কথা ঠিকই যে ভারত নামের গভীর তাৎপর্য দেশের মানুষের জন্য রয়েছে। আমাদের দেশের জাতীয় সঙ্গীতেও লেখা আছে ‘ভারতভাগ্যবিধাতা’। কিন্তু ইন্ডিয়া শব্দটিও একইভাবে দেশের মানুষের মর্মে প্রোথিত রয়েছে। এমনকি মোদী সরকারের মননেও রয়েছে ইন্ডিয়া শব্দটি। ‘স্কিল ইন্ডিয়া’, ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’, ‘স্টার্ট-আপ ইন্ডিয়া’ ইত্যাদি সরকারী প্রকল্পের নামেও রয়েছে ইন্ডিয়া। মাত্র কয়েক বছর আগেই এই প্রকল্পগুলি বাস্তবায়িত করা হয়েছে। তখন কিন্তু আরএসএস অথবা বিজেপি মনে করেনি ভারত নামটি ব্যবহার করার কথা।

শুধু তাই নয় ২০২০ সালে সুপ্রিম কোর্ট দেশের নাম পরিবর্তন করার আর্জি জানিয়ে দাখিল করা একটি মামলা শুনতে অস্বীকার করে। মাননীয় প্রধান বিচারপতি বলেন যে ভারত এবং ইন্ডিয়া দুটিই দেশের নাম। ২০১৫ সালে নরেন্দ্র মোদী সরকার সুপ্রিম কোর্টে হলফনামা দাখিল করে বলে যে দেশের নাম পরিবর্তন করার কোনো কারণ নেই। ২০০৪ সালে উত্তরপ্রদেশ বিধানসভা প্রস্তাব গ্রহণ করে যে "India, that is Bharat", পরিবর্তন করে "Bharat, that is India" করা হোক। এই প্রস্তাব গ্রহণের সময় বিজেপি উত্তরপ্রদেশে বিরোধীর আসনে বসেছিল, সরকার ছিল মুলায়ম সিং যাদবের। এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে বিজেপি বিধানসভা থেকে ওয়াকআউট করে।

অতএব, বিজেপি নিজেই ইন্ডিয়ার নাম পরিবর্তন করে ভারত রাখার বিরুদ্ধে একাধিকবার বক্তব্য রেখেছে। আজ শুধুমাত্র বিরোধী জোটের নামের জন্য তারা দেশের নাম পরিবর্তন করার ভাবছে!

দেশের আসল সমস্যা হল বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধি, বাড়তে থাকা আর্থিক বৈষম্য, আদানির দুর্নীতি, সাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদি। দেশকে আমরা ইন্ডিয়া বলি অথবা ভারত, এই সমস্যা-জর্জরিত মানুষের জীবনে নতুন করে কোনো উপদ্রব তৈরি না করে, সবার উন্নতিকল্পে সরকারের মনোনিবেশ করা উচিত। ইন্ডিয়া ও ভারত দুই-ই আমাদের হৃদয়ে। বিজেপি-র রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য একটি নামের পরিবর্তে অন্য নাম দেওয়ার রাজনীতির সর্বাত্মক বিরোধিতা করা উচিত।