আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ ষোড়শ সংখ্যা ● ১৬-৩১ আগস্ট, ২০২৩ ● ১-১৫ ভাদ্র, ১৪৩০
প্রবন্ধ
বিজ্ঞান ইতিহাসেঃ একটি পাঠপ্রতিক্রিয়া
শুভাশিস মুখোপাধ্যায়
২০২৩ সালের ২০ জুলাই, ৯১ বছর বয়সে সমর বাগচীর মৃত্যু, প্রায় এক শতাব্দীর এক ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় এক সাময়িক ছেদচিহ্ন এঁকে দিল। নানা কারণে সমর বাগচীর জীবন ও কর্ম বেশ কয়েক প্রজন্মের মানুষের কাছে এক অনন্য উদাহরণ হয়ে বিরাজ করবে।
ছাত্রজীবনে বামপন্থী চিন্তায় সম্পৃক্ত সমর বাগচী এক সময় অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি, সিপিআই-এর খুব ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে এসেছিলেন, কিন্ত পার্টিতে যোগ দেননি। ধানবাদ স্কুল অফ মাইনস থেকে খনি বিজ্ঞানে ডিগ্রি অর্জন করে খনির কাজে যোগ দিলেও জনমানসে বিজ্ঞানমনস্কতা প্রচারের যে নিরুচ্চারিত প্রবাহ তাঁকে তাঁর সেই প্রথম যৌবনে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াতো, সেই টানেই তিনি যোগ দিলেন 'বিড়লা ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড টেকনোলজিক্যাল মিউজিয়ামে', যেখানে তিনি দীর্ঘ ২৯ বছর কাটিয়ে স্বেচ্ছা অবসর নেন।
এই মিউজিয়াম সূত্রেই তাঁর বিজ্ঞান লোকপ্রিয়করণের কাজ শুরু, তেমনি শুরু হাতে-কলমে বিজ্ঞানশিক্ষার জন্য প্রদর্শনের কাজও। এদেশে বিজ্ঞানের ইতিহাস জ্ঞানচর্চার বিষয় হিসেবে আজও দুয়োরাণী। সেই বিষয়কে জ্ঞানচর্চার দুনিয়ার ভদ্রস্থ পরিসর দেওয়ার ব্যাপারে তাঁকে একজন স্থপতি বলা যেতে পারে।
যে বইটির আলোচনায় এই ‘ধান ভানতে শিবের গীত’-এর অবতারণা, সেটি এক অনন্য পুস্তক, অন্তত একাধিক অর্থে। এই বইয়ের প্রাককথন পর্ব লিখেছেন সুপরিচিত জনপ্রিয় বিজ্ঞানের কর্মী ও লেখক শ্রী মানস প্রতিম দাশ, তাঁর এই নিবন্ধের নাম, “বাঙলা ভাষায় বিজ্ঞান ইতিহাস রচনার ধারা”। বিষয়টির প্রতি বিশ্বস্ত থেকে এবং পরবর্তী অংশে শ্রী বাগচির প্রতিবাদ্য বিষয়ের কথা খেয়াল রেখে তিনি যথাযথভাবে বিষয়টি উপস্থাপিত করেছেন। এই লেখাটির ভাষা পাল তোলা তরীর মতো মসৃণভাবে বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করার পাশাপাশি পাঠকের মনোযোগ আগাগোড়া আকর্ষণে সক্ষম হয়েছে। যদি শুধু ইতিহাস লিখেই মানস প্রতিম ক্ষান্ত হতেন, তবে বইটি রুদ্ধশ্বাসে পড়ার পর পাঠকের মনে যে অতৃপ্তির জন্ম হতো, তা সম্ভবত লেখক আগাম আঁচ করতে পেরেছিলেন। তাই তিনি হয়তো “এদেশে বিজ্ঞানের অনুন্নতির কারণ” উপশিরোনামে বিষয়টি প্রাঞ্জল করতে প্রয়াসী হয়েছেন। তিনি বিনয় ঘোষের একটি প্রাসঙ্গিক উদ্ধৃতি দিয়েছেন, “...চীনা সমাজে যেমন, ভারতীয় সমাজেও তেমনি, প্রাচীন যুগের পরে, বিজ্ঞান ও টেকনোলজির অগ্রগতি রুদ্ধ হয়েছে প্রধানত একটি কারণে, এবং সেই কারণটি হল বণিকজনের প্রতি সামাজিক অবহেলা। বণিকজনের কোনও মর্যাদা আমাদের সমাজে নেই। প্রচুর ধনসম্পত্তির মালিক হলেও বণিকরা বণিক বা বৈশ্য এবং ব্রাহ্মণরা ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়েরা ক্ষত্রিয়...”। এরপর মানস প্রতিমের প্রাসঙ্গিক মন্তব্য এই রকম, “এই যুক্তির পাল্টা যুক্তি বা ভাবনা থাকাটাই স্বাভাবিক, কিন্তু আগ্রহী পাঠকের কাছে এই বিশ্লেষণ অতীব মূল্যবান। বিজ্ঞানের ইতিহাস সম্পর্কে বোধ তৈরি করতে এমন কাটা-ছেঁড়ার গুরুত্বকে কমিয়ে দেখা সম্ভব নয়।“ এই মন্তব্য থেকে আমরা বুঝতে পারি মানস প্রতিমের ঝোঁক আসলে কোন্ দিকে! এই প্রবন্ধের অন্যতম সম্পদ বাঙালি পাঠকদের জন্য স্বল্প, কিন্তু অত্যন্ত মূল্যবান তথ্যসূত্র, বাঙলা এবং ইংরেজি মিলিয়ে মোট ১৩টি, যা পাঠককে মূল বিষয়টি সম্পর্কে আরও জানায় আগ্রহী করে তুলবে।
এই বইয়ের দ্বিতীয় অংশটি সমর বাগচী মশাইয়ের 'এশিয়াটিক সোসাইটি'তে দেওয়া ছয়টি বক্তৃতার লিখিত রূপ। মুদ্রিত বই হিসেবে এই বইটি সমরবাবুর জীবিতকালের মধ্যে শেষ প্রকাশিত বই। প্রায় ৮৫ পাতা ব্যাপী এই বইয়ের দ্বিতীয় অংশে সমরবাবু মানবজাতির প্রজ্ঞার সন্ধানে যাত্রার সংক্ষিপ্ত, কিন্তু গভীর এক রূপরেখা উপস্থিত করেছেন। টি. এস. এলিয়ট উদ্ধৃত করে তিনি তাঁর আলোচনার প্রেক্ষাপটকে নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন প্রারম্ভেই - Where is the wisdom we have lost in knowledge?/ Where is the knowledge we have lost in information?
এই বক্তৃতামালার প্রথম ভাষণে তিনি বিজ্ঞানের ইতিহাসে ইসলামের অবদান তথ্য ও বিশ্লেষণ সহকারে উপস্থিত করেছেন, সেটি করেছেন যখন আমাদের দেশে 'একদল মূর্খ' (শ্রী বাগচীর অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক পর্যবেক্ষণ, তাই উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রাখতে হয়েছে) যখন 'হিন্দুত্বরসে' জারিত হয়ে অন্য সব জ্ঞানচর্চার ধারাকে 'অপর' বলে চিহ্নিত করে বাতিলের ঝুড়িতে ফেলে দিয়েছে। দ্বিতীয় ভাষণে এসেছে আরব দুনিয়া থেকে ইউরোপের দিকে বিজ্ঞানের পুনরুজ্জীবিত ধারার প্রত্যাবর্তনের কাহিনী, এসেছেন রজার বেকন, এসেছেন অ্যাকুইনাস, ব্যুরিডাঁ, শেষ করেছেন অটোম্যান সাম্রাজ্যের হাতে কস্টান্টিনোপলের পতন দিয়ে।
কাগজ ও ছাপাখানা জ্ঞানের সংরক্ষণ ও প্রচারের কাজে এক বিরাট বিপ্লবের জন্ম দেয়। এরপর আসে পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতকের রেনেসাঁস। মানুষের যে নতুন অভিধা রেনেসাঁসের মাধ্যমে উঠে আসে, তার বর্ণনা সমর বাগচী তুলে আনেন হ্যামলেটের বয়ানে, মানুষের কাজ, তার যুক্তি-বুদ্ধি-র জয়গান ফুটে ওঠে এই বয়ানে। বস্তুত যুক্তিবাদের কথা তিনি যখন বিভিন্ন আলোচনায় নিয়ে আসতেন, তখনই সভাঘরে তার কম্বুকণ্ঠে ধ্বনিত হতো হ্যামলেটের সেই অমোঘ সংলাপঃ
What a piece of work is a man
How noble in reason
How infinite in faculties
In form and moving
How express and admirable
In action how like an angel
In appreciation how like a God
The beauty of the world
The paragon of animal.
বাণিজ্যের হাত ধরে যে ইউরোপে পুঁজিবাদের উদ্ভব হয় এবং তার হাত ধরে উপনিবেশবাদ, দাস ব্যবসার জন্ম হয়, সেইসব কথাও তিনি উল্লেখ করেছেন। বনেদি ঔপনিবেশিক জাতিগুলির এশিয়া-আফ্রিকা-লাতিন আমেরিকা লুণ্ঠনের ফলে ১৬০০ সালেই ইউরোপে সোনার সঞ্চয় দ্বিগুণ হয়ে যায়, আসে ষোড়শ শতকের বিজ্ঞানে বিরাট বিপ্লব।
এরপর তিনি বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিভাগ, যেমন উদ্ভিদবিদ্যা, প্রাণীবিদ্যা, চিকিৎসাবিদ্যা, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা প্রভৃতি নানান বিষয়ের অবতারণা করে নিউটন-এর আবিষ্কারে প্রবেশ করেন, 'রয়াল সোসাইটি' সহ অন্যান্য সারস্বত সভাগুলির উন্মেষ ও বিকাশ নিয়েও তিনি অনেক কথা বলেছেন।
ইংল্যান্ডে কেন শিল্প বিপ্লব হলো, তিনি তার কারণ খুঁজতে গিয়ে ভারতকে উপনিবেশ করার কথা এনেছেন। আর তাঁর শেষ অধ্যায় হলো আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়কে নিয়ে। আচার্য রায় ভারতে বিজ্ঞানের পতনের কারণ নিয়ে যে পর্যবেক্ষণ করেছেন, তার এক সুস্পষ্ট রূপরেখা উপস্থিত করেছেন সমর বাগচী। তিনি এই বইয়ের জন্য লেখা মুখবন্ধে উল্লেখ করেছেন কত চেষ্টার পর তিনি প্রফুল্লচন্দ্রের আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় সমাবর্তন উৎসবের দীক্ষান্ত ভাষণটি জোগাড় করেছেন, অন্তর্জালহীন সেই সাবেক দুনিয়ায়।
সমর বাগচীর মৃত্যু আমাদের নিশ্চিতভাবেই বঞ্চিত করেছে আরও অনেক এই মানের বই থেকে; আর কিশোর-কিশোরীরা, যারা এখন বিদ্যার আলয়গুলিতে বিজ্ঞানের নামে যে পিটুলিগোলা জল পাচ্ছে, যারা বিজ্ঞানের ক্ষীরের স্বাদ পেলনা, তারা সমর বাগচীর পরিবেশিত অতি উত্তম ক্ষীর থেকে বঞ্চিত হয়েই চলবে। আমাদের আধুনিক মাতা-পিতারা কি সিলেবাসের বইয়ের ক্ষুদ্র আঙিনা ছেড়ে তাঁদের সন্তানদের 'বাইরের বই' পড়ে 'সময়ের অপচয়' করাকে উৎসাহ দেবেন? এই বইটি তাহলে সেই পছন্দের তালিকায় খুব ওপরের দিকেই থাকবে!
বিজ্ঞান ইতিহাসে
সমর বাগচী
প্রকাশকঃ আশাবরী [পুরুলিয়া, সুপার মার্কেট, হাটতলা, রুম নং. সি ৩৬, পুরুলিয়া-৭২৩১০১]
প্রকাশকালঃ নভেম্বর, ২০২২
মুদ্রিত মূল্যঃ ২০০ টাকা