আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ ষোড়শ সংখ্যা ● ১৬-৩১ আগস্ট, ২০২৩ ● ১-১৫ ভাদ্র, ১৪৩০

প্রবন্ধ

‘যে আমি ওই ভেসে চলে’

প্রবুদ্ধ বাগচী


চিত্রশিল্প বিষয়ে এক প্রতিক্রিয়ায় বুদ্ধদেব বসু লিখেছিলেন, ছবি যতটা না তর্ক করার তার থেকে অনেক বেশি তাকিয়ে থাকার বিষয়। এই একই কথা আমরা বলতে পারি রবীন্দ্রনাথের গানের বিষয়েও। তাঁর গান নিয়ে আমরা নানা তর্ক করি ঠিকই, কিন্তু আদপে গান হল শোনার জিনিস। আর গান মানে শুধু কথা নয় তার সঙ্গে মিশে থাকা সুরও - সুরের তন্নিষ্ঠ ব্যাকরণ না-জানলেও তাকে একরকমভাবে অনুভব করা যায়, কারণ তার একটা বিমূর্ত চেহারা আছে। সুচিত্রা মিত্র একবার সোভিয়েত রাশিয়ার এক শহরে গান গাইতে গিয়েছিলেন, আর সেই অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন সেই শহরের মেয়র। সুচিত্রা যখন ‘ছায়া ঘনাইছে বনে বনে’ গেয়ে উঠলেন, সেই মেয়র মহোদয় তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন, এটা কি বর্ষার গান? গানের কথার একবিন্দু না বুঝেও শুধু সুরের ওঠাপড়া থেকে একটা মেঘমেদুর আদল যে চিনে নেওয়া গেল, এটা সুরের ম্যাজিক। কিন্তু সুর কীভাবে কথার দু'দিকে দুটো ডানার উড়াল দেয় এটা অক্ষরে বোঝানো যায় না - আসলে ভাষার যেখানে শেষ, সুরের তো সেখানেই শুরু। তবু আমাদের শ্রেষ্ঠ সম্পদ রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে আমাদের মাঝে মাঝেই নানা কথা বলবার প্রসঙ্গ এসে পড়ে। আজকে তেমনই একটা গান নিয়ে দু-কথা বলার সুযোগ এল। গানটি আমাদের অচেনা নয়, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ১৯১৪-র অক্টোবরে লেখা হয়েছিল এই গান - তবে এই গানকে বুঝতে গেলে ওই তথ্য তত দরকারি নয়। আসুন আমরা একবার সামনে রাখি গানটির কথাকে -

আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া
বুকের মাঝে বিশ্বলোকের পাবি সাড়া।।

এই যে বিপুল ঢেউ লেগেছে তোর মাঝেতে উঠুক নেচে
সকল পরান দিক না নাড়া।।

বোস না ভ্রমর এই নীলিমায় আসন লয়ে
অরুণ আলোর স্বর্ণরেণু মাখা হয়ে।

যেখানেতে অগাধ ছুটি    মেল সেথা তোর ডানা দুটি
সবার মাঝে পাবি ছাড়া।। 

আপাতভাবে প্রথম পাঠে বোঝা যায় এখানে দুটো আলাদা অস্তিত্বের কথা নির্দিষ্টভাবে বলা হচ্ছে - একটি ‘আমি’ বা ‘আপন’ অন্যটা ‘বাহির’ বা ‘বিশ্ব’। রবীন্দ্রনাথের গানে এই ‘ভিতর’ আর ‘বাহির’-এর দ্বন্দ্বমুখর চলাচল খুব চেনা একটি ছবি, যার একটা সর্বোত্তম আখ্যান পাই খাঁচার পাখি আর বনের পাখির সেই আশ্চর্য কথোপকথনে যেখানে অন্তিম পর্বে একটা বাক্য উচ্চারিত হয় ‘দুজনে একা একা/ ঝাপটি মরে পাখা’ - ‘দুজনে একা একা’ হওয়ার ব্যঞ্জনা যে কী গভীর আমরা হয়তো গানটি শোনার সময় খেয়াল করতেই ভুলে যাই। কিন্তু আসলে সেই দুটো সত্ত্বার প্রশ্নই এখানে ঘুরে আসে - আমি আর আমার বাইরের বিশ্ব, আমার ‘আমি’ আর নিখিল বিশ্বে তার বিকল্প অবস্থান। আমাদের আলোচ্য এই গানটিতেও সেই প্রসঙ্গের ছায়া - তবে এখানে কিন্তু কোনো দোলাচল নেই, প্রত্যক্ষ আহ্বান - ‘আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া’। এই আহ্বান থেকে আমাদের বুঝে নিতে অসুবিধে হয় না যার প্রতি এই আহ্বান আসলে তিনি ‘বাহির’-এ নেই। প্রশ্ন হল তিনি কে? এর সহজ উত্তর হল, নির্দিষ্টভাবে এই ডাক পাঠানো নিজের দিকেই তাকিয়ে এবং কবির ‘আমি’ আসলে এইরকম অজস্র আমি-র এক প্রতিনিধি। আর এই ডাক যে তিনি এই প্রথম পাঠালেন তাও তো নয়।

‘আরোগ্য’-র ৩৩ নম্বর কবিতায় তিনি লিখছেন ‘এ আমির আবরণ সহজে স্খলিত হয়ে যাক’; অন্য একটি গানে বলেছেন ‘আপনারে দিয়ে রচিলি রে কি এ আপনারই আবরণ’ বা ‘প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে’ গানের আভোগ অংশে তার আর্তি ‘আরো প্রেমে আরো প্রেমে/ মোর আমি ডুবে যাক নেমে।’ তাই এটা খুব নতুন বিষয় নয় যে নিজের ‘আমি’কে নিয়ে তাঁর আত্মবিড়ম্বনা রয়ে গেছে বারবারই। আর তাই এই আবেদন রেখেই শুরু হয় এ-গান। পাশাপাশি স্থায়ী অংশের দ্বিতীয় পঙক্তিতে এটাও জানিয়ে দেওয়া হয় ওই ‘বাইরে দাঁড়া’লেই নিজের মধ্যে বিশ্বলোকের সাড়া পাওয়া সম্ভব, ওই প্রক্রিয়াটুকুর ভিতর দিয়েই স্খলিত হবে সেই আমির আবরণ ও বাইরের পৃথিবীর আলো-বাতাস স্পন্দিত হবে সেই মুক্ত আমি-র অন্তরে। আবারও একটু ফিরে দেখি আরেকটা গান ‘যে আমি ওই ভেসে চলে’ - সেখানে বলা হয় ‘ও যে সচল ছবির মতো,/ আমি নীরব কবির মতো -’! এই সচল ‘আমি’ কেমন? তারও জবাব দেয় ওই গানের শেষ লাইনঃ 'মুক্ত আমি তৃপ্ত আমি,/ শান্ত আমি, দীপ্ত আমি’ - অর্থাৎ যে আমি মুক্ত সেই আমিই তৃপ্ত ও দীপ্ত। এই দীপ্তির কথা আমরা খুঁজে পাব এই গানেও, সে প্রসঙ্গ পরে।

স্থায়ী থেকে অন্তরায় পৌঁছে এই গানের কি একটা অগ্রগমন ঘটতে দেখলাম না আমরা? বাংলা ভাষায় ক্রিয়ার কাল অনুযায়ী তার রূপ বদলে বদলে যায় এটা সকলেই জানি। তাহলে ‘এই-যে বিপুল ঢেউ লেগেছে’ যখন উচ্চারণ করা হয় তখন কি ক্রিয়ার যে চেহারা তা কি আসলে পুরাঘটিত বর্তমান কালের (প্রেজেন্ট পারফেক্ট টেন্স) কথাই বলে না? ‘লেগেছে’ অর্থে কবি তো সেটা বাইরে এসেই অনুভব করছেন - প্রথম লাইনে একটা সাধারণ স্টেটমেন্ট যাকে দিয়ে বলিয়েছিল, এমনটা হবে (সাধারণ বর্তমান, প্রেজেন্ট ইনডেফিনিট টেন্স), পরে তিনিই যখন বলছেন, ‘বিপুল ঢেউ লেগেছে’ তার মানে এই অবস্থায় তিনি নিজেই এখন সেই ঢেউয়ের মধ্যে মুক্ত করেছেন নিজেকে - অর্থাৎ বাইরে এসে দাঁড়ানোর প্রথম সোপান তিনি পেরিয়ে এলেন ইতিমধ্যেই। আর তাই তিনি উপলব্ধি করতে পারছেন এই ঢেউয়ের দোলা যদি সেই মুক্তসত্ত্বার শরীরে হিল্লোল তোলে তাহলে তাঁর প্রাণেও সঞ্চারিত হয়ে যাবে সেই ‘নাড়া’ বা আন্দোলন - শুরু হয়ে যাবে ওই বাইরে দাঁড়ানোর নিটোল এক প্রক্রিয়া।

আমরা জানি, রবীন্দ্রগানে সঞ্চারীর ভূমিকা অপরিসীম। এইখানে এসে তার গানে বাঁক-বদল হয়, গানের উত্তরণ ঘটে একটি স্তর থেকে অন্য স্তরে। এই গানেও আমরা দেখি, সঞ্চারীতে এসে সুর নমিত হয়ে ডাক পাঠায় এক ভ্রমরাকে, আহ্বান আসে ‘এই নীলিমায়’ আসন পেতে বসার। এই ‘ভ্রমর’ শব্দটি বা এই রূপকল্প বিষয়ে অনেক বলার কথা। রবীন্দ্রনাথের গানে বারবার ভ্রমরের কথা এসেছে - কখনো ঘরে ভ্রমর এসে গুনগুনিয়ে বাইরের কথা বলে গেছে, কখনো নিভৃত নীল পদ্মের জন্য ‘বিবাগী’ ভ্রমরকে আমরা পেয়েছি ‘আমি কান পেতে রই’-এর মতো চেনা গানে। কিন্তু একটা প্রসঙ্গ এখানে মনে হয় বিবেচনা করা দরকার, ‘ভ্রমর’ মানে কিন্তু এমন একটা কীট যা আকারে ছোট হলেও আসলে তার পিঠে দুটো ডানা আছে যা তার মুক্ত হয়ে উড়ে বেড়ানোর স্বাধীনতাকে চিহ্নিত করে। তাছাড়া, আমাদের লৌকিক ধারণায় ও উপকথায়/গানে পাওয়া যায় ‘প্রাণভোমরা’ শব্দটা যার ইঙ্গিত হল প্রাণটা যেন একটা অন্তরস্থিত ভ্রমরের মতো আর তাই জীবনাবসানে সেই আবদ্ধ ‘প্রাণভোমরা’ উড়ে যায়। এখানেও সেই উড়ে যাওয়ার কথা। আর উড়ে যাওয়ার প্রসঙ্গ এলে আমাদের আবারও স্মরণ করতে হবে রবীন্দ্রনাথের আরেকটি গানের প্রসঙ্গ যেখানে ‘সুদূরের পিয়াসী’ হিসেবে তিনি আক্ষেপ করেছেন ‘মোর ডানা নাই/ আছি এক ঠাঁই/ সে কথা যে যাই পাশরি’ (‘পাশরি’ শব্দের অর্থ ‘ভুলে যাওয়া’) - বুঝতে অসুবিধে হওয়ার কথা নয়, মুক্ত বিহঙ্গের মতো উড়াল দিতে চাওয়া কবিমনের বহু-প্রতীক্ষিত বাসনা। আমাদের স্মরণে আসবে, ‘মন মোর মেঘের সঙ্গী’ গানেও তিনি লেখেন ‘মন মোর হংসবলাকার পাখায় যায় উড়ে’ - আবারও এসে পড়ল ‘দিগ দিগন্তের পানে উড়ে চলার’ প্রসঙ্গ।

কিন্তু আমাদের এই গানে শুধুই যে উড়ে-চলার ইশারা তা কিন্তু নয়। ভ্রমরের উদ্দেশে তার যে আহ্বান তার সঙ্গে মিশে আছে আলোর একটি প্রসঙ্গ - ‘বোস্‌-না ভ্রমর, এই নীলিমায় আসন লয়ে/ অরুণ-আলোর স্বর্ণরেণু মাখা হয়ে।’ শুধু নীলিমায় ভ্রমরের বসাটুকুই নয় এখানে ‘স্বর্ণরেণু’ বাড়তি বিশেষণে জোর আছে আলোর ওপর। এই ‘আলো’ রবীন্দ্রগানের আরেক বহুধা-বিস্তৃত প্রসঙ্গ - ‘আলো’-কে গানের রবীন্দ্রনাথ দেখেছেন বহুভাবে। কখনো তাঁর মনে হয় ‘আলো যে আজ গান করে মোর প্রাণে গো’ কখনো তাঁর মনে জাগরূক হয়ে ওঠে ‘প্রথম আলোর চরণধ্বনি’ আবার কখনো ‘আলো আমার আলো ওগো’ বলে একেবারে আলোর বন্দন-গানেই তিনি নিজেকে উজাড় করে দিতে থাকেন আর তাঁর ‘মুক্তি’ যে ‘আলোয় আলোয়’ সে তো আমরা জেনেছি কবেই। এই গান নিয়ে ভাবতে বসলে তাই ডানা, মুক্তি, আলো প্রতিটি শব্দকে একটা হারমনির মতো বিচার করা দরকার আমাদের। গানের গোড়ায় নিজেকে মুক্ত করে বৃহত্তর বিশ্বে স্থাপন করার যে প্রত্যয় উচ্চারিত তার রূপায়ন হতে পারে একই সঙ্গে ভ্রমরের ডানায় আর সেই পক্ষের বিস্তারের সঙ্গে জুড়ে যায় আলো এবং আকাশের দিগন্তপ্লাবী আহ্বান। এখানে ‘স্বর্ণরেনু’ শব্দটাকে নিয়ে যদি একটু বাড়তি নাড়াচাড়া করা যায় তবে ভেবে নিতে হবে আলোর সোনালি রং দেখা যায় হয় প্রত্যূষে নয় দিনান্তবেলায় - তাহলে এই গান ঠিক কোন সময়ের কথা বলছে?

এই প্রশ্নটিকে বুকে আগলে আমাদের ফিরে আসতে হবে গানের আভোগ অংশে - যেখানে বলা হবেঃ 'যেখানেতে অগাধ ছুটি/ মেল সেথা তোর ডানা দুটি/ সবার মাঝে পাবি ছাড়া'। ‘ছুটি’ শব্দের দুটো ব্যঞ্জনা ভাবা যায় - একটি আনন্দের অন্যটা বেদনার। একালের সঙ্গীতকার মৌসুমী ভৌমিকের একটা গান আছেঃ 'তোমার দেওয়া লাল চাদরে/ ছুটি আমার ছুটি' - এই ছুটি আনন্দের। আবার রবীন্দ্রনাথের গল্পের ফটিক যখন বলে ‘মা, আমার ছুটি হয়ে গেছে...’ সেই ছুটির গায়ে লেগে থাকে গভীর বিষাদ। কিন্তু এখানে কীভাবে বিচার করা হবে ছুটিকে? এর একমাত্র চাবিশব্দ হতে পারে ‘অগাধ’ - যার আভিধানিক অর্থ ‘অতল’ বা গভীর। আলোচ্য গানের শুরু থেকে যে আত্ম-র সঙ্গে ‘বিশ্বসাথে’ র যোগ খুঁজে পাওয়ার কথা বলেছেন রবীন্দ্রনাথ সাধারণভাবে সেখানে মুক্তির স্বাদ আনন্দে, উপনিষদের ভাষ্যেও এই ক্ষুদ্র আমি থেকে বৃহৎ আমিতে উত্তরণ এক নিবিড় আনন্দের উপকরণ। জীবনানন্দের কবিতায় আমরা শুনেছিঃ 'আমি ঝ’রে যাবো - তবু জীবন অগাধ/ তোমারে রাখিবে ধ’রে সেইদিন পৃথিবীর পরে'। সব মিলিয়ে মনে হয় হয়তো এই গান সেই ছুটির কথাই বলে যার সুতীব্র অনুভব হতে পারে কেবলমাত্র আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়ালেই - আরেকটু বাড়িয়ে গানের শেষে বলা হয় তার কার্য-কারণ সম্পর্কের এক পরিণতি ‘সবার মাঝে পাবি ছাড়া’। সবাই আছেন, আমিও আছি কিন্তু কেউ কোনও ছোট খাঁচায় আবদ্ধ নই, সকলের মধ্যে মুক্ত স্বাধীন আমি - সবচেয়ে বড় কথা, এই আমি আর সেই আমি নই - ‘মুক্ত আমি তৃপ্ত আমি,/ শান্ত আমি, দীপ্ত আমি’। এতক্ষণে বোঝা যায় ওই ‘দীপ্ত’ শব্দটি কীভাবে একাকার হয়ে গেল এই গানের ‘বাঁধনছেঁড়ার সাধন’ আর তার অন্তর্গত আলোর সঙ্গে। গান যেন এক বৃত্ত শেষ করে স্থির হল সমে - এখন সেই ‘আমি’ দাঁড়িয়ে আছে অপার মুক্তির আলোয়, নিঃসীম আকাশের প্রান্তরে, ব্যাপ্ত মহাবিশ্বের পায়ের কাছে - একাকী নয়, বহুর মধ্যে বিলীন এক সত্ত্বা।

এই গানের আলোচনা হয়তো এখানেই শেষ করা যেতে পারত, কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়াল আমাদের কিছু পরিচিত স্বতঃসিদ্ধ। এটা ঠিক রবীন্দ্রনাথ যে প্রজন্মের মহামানব সেখানে তাঁর মধ্যে একটা সময় অবধি বহমান থেকেছে গভীর অস্তির বোধ। বাল্যকাল থেকে উপনিষদের দর্শনের সঙ্গে পরিচয়, তাঁর বেড়ে ওঠা ও হয়ে ওঠার মধ্যে এর সবটুকু চেতনাই ছিল। মনে না-পড়ে উপায় নেই একসময় ‘কল্লোল’-এর কবিদের বিচারে তিনি সমালোচিত হয়েছিলেন এই প্রশ্নহীন ‘ভাল’-র জন্যই। শান্তিনিকেতনের আশ্রমে তিনি দিনের পর দিন যেসব বক্তৃতা করেছেন তার পুরোটাই ওই ব্রহ্মদর্শন থেকে উঠে আসা, আর শান্তিনিকেতনের ভাল নামই তো ছিল ‘ব্রহ্মচর্যাশ্রম’। ‘গুরুদেব’ হিসেবে সবাই তাঁর বক্তৃতা শুনতেন কিন্তু সকলেই যে সেগুলি নিবিড়ভাবে বুঝতেন এমন নয় বা সবাই হয়তো সবটা ঠিক বিশ্বাস করতেন এমনও নয় - আসলে ওখানে ওই ছাতিমতলা, কাচের ঘর, দীক্ষাবেদী, নিয়মিত ঘরভর্তি শ্রোতা সব মিলিয়ে একটা যাকে বলে ‘অ্যামবিয়েন্স’ - সেইটাই ছিল প্রধান। কিন্তু ওই জোব্বা পরা মানুষটি যতটা ‘গুরুদেব’ ঠিক ততটাই ‘রবীন্দ্রনাথ’ নন, ‘গানের রবীন্দ্রনাথ’ তো ননই। আর ওই গানের রবীন্দ্রনাথকে চিনতে গেলে ওই তথাকথিত ‘আশ্রমগুরু’র পোশাকটা সরিয়ে নিতে হয়। অবনীন্দ্রনাথ সেদিকে ইঙ্গিত করে বলেছেন, "রবিকা যখন গান লেখেন তখন তিনি এক মুক্ত আবরণহীন মানুষ। মুশকিল হল, যত দিন গিয়েছে তত ওই জোব্বাটা আরও বেশি করে চেপে বসেছে ওঁর গায়ে, সারা বিশ্বে কবি হিসেবে তিনি যত ‘বাতিল’ হয়েছেন তত তাঁর অবয়ব ভরে উঠেছে এক ধরনের ঋষিত্বে আর একশ্রেণির কাছে তাঁর পরিচয় হয়ে উঠেছে নিছকই ‘গুরুদেব’, এই গুরুবাদী দেশে যা বেশ খাপ খেয়ে যায়"। এমনকি আমাদের ঘাতক প্রধানমন্ত্রী অবধি জাতে ওঠার জন্য বলেছেন তিনি নাকি যুবা বয়সে সকালে পাঁচটার সময় রেডিওতে গুরুদেবের গান নিয়মিত শুনতেন, আদপে যা নিখাদ অনৃতভাষণ। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের গান মানে গদগদ গুরুদেব নন, আরও আলোকিত কোনো উজ্জ্বল কোহিনূর। এই গান প্রসঙ্গে কথাগুলো তুলতে হল কারণ, আমাদের প্রাচ্যের দর্শনে এই ছোট-আমি থেকে বড়-আমি হয়ে ওঠার কথা ভাবা হয়েছে, বলা হয়েছে। যতদূর জানি, বেদের প্রথমভাগ নিরীশ্বরবাদী ও মূলত বিশ্ব-প্রকৃতির সঙ্গে একক মানুষের সম্পর্ক কী বা কেমন তা নিয়ে বিস্ময় ও চর্চা করেছিলেন তাঁর স্রষ্টারা। ফলে ‘ব্যাদে’ যেহেতু বিমান প্রযুক্তি থেকে প্লাস্টিক সার্জারি হয়ে কৃত্রিম প্রজননবিদ্যা পর্যন্ত সবই আছে তাই এই গানের ‘সারকথা’ তো সেই কবেই ‘বেদজ্ঞানীরা’ বলে গেছেন এইরকম একটা ‘লঘুবাচন’ আজকের বাজারে যে কেউ করে ফেলে শিরোনামে আসতে পারেন, তাঁদের থেকে সতর্ক থাকা প্রয়োজন। আর এই কথাও সত্যি নয় যে একমাত্র প্রাচীন প্রাচ্য চিন্তাতেই এই ধরনের ভাবনা আছে। আধুনিককালে বঙ্কিমচন্দ্রও লিখেছিলেন, "এই জীবন লইয়া আমি কী করিব", আর রবীন্দ্রনাথও ‘আত্মহোমের বহ্নিজ্বালা’র ভিতর মুক্তি খুঁজেছেন, মিশেল ফুকোও বলেছেন, 'কেয়ার অফ সেলফ'-এর কথা।

আর তাছাড়া, একটিমাত্র তত্ত্বের আওতায় রবীন্দ্রনাথের গানের বিচার হতে পারে না, হওয়া উচিত নয়। কারণ তাঁর গান হল সবথেকে মিতায়তনে সবথেকে গভীর কথার এক আশ্চর্য খনি, যার মধ্যে বিচিত্র আলো আঁধারির ওঠা-পড়া - এই গান নিয়ে সত্যিই তাই সবিশেষ তর্ক চলে না। এই গান দাবি করে আমাদের নিবিড় ও তন্নিষ্ঠ শ্রুতি - শুনি, কেবল শুনি।


[২৫ জুন, ২০২৩ ‘রবিরশ্মি’ আয়োজিত আন্তর্জাল আলোচনাসভায় পেশ করা বক্তব্যের লিখিত রূপ।]