আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ ষোড়শ সংখ্যা ● ১৬-৩১ আগস্ট, ২০২৩ ● ১-১৫ ভাদ্র, ১৪৩০

প্রবন্ধ

নয়া উদারবাদ ও আন্তর্জাতিক ক্রিকেট

সুমিত গঙ্গোপাধ্যায়


ক্রিকেটে নয়া উদারবাদ গত তিন দশকে যে বিপুল বাণিজ্যিকীকরণ ঘটিয়েছে, তা সতত পরিবর্তনশীল ক্রিকেটীয় প্রেক্ষাপটকে আরও দ্রুতগতির ও ক্রমাগত পরিবর্তনের মাধ্যমে এমন এক পর্যায়ে এনে ফেলেছে তা বিশ্ব-ক্রিকেটে নিত্যনতুন সঙ্কটকে ডেকে আনছে। যা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশকে প্রভূত সমস্যায় ফেলে দিচ্ছে। শুধু মাত্র টেস্ট না-খেলা দেশগুলি নয়, সঙ্কটের মধ্যে পড়ে যাচ্ছে টেস্ট খেলিয়ে দেশগুলি অবধি।

সত্তরের দশকের শেষের দিকে কেরি প্যাকারের বাণিজ্যিক নীতি প্রকৃতপক্ষে ক্রিকেটে নয়া উদারবাদের সূত্রপাত ঘটিয়েছিল। প্রথমে অস্ট্রেলিয়া বোর্ডের কাছে কেরি প্যাকার বিভিন্ন ম্যাচের সরাসরি সম্প্রচারের প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিলেন। অস্ট্রেলিয়ান বোর্ড তাঁর সেই প্রস্তাবকে নাকচ করলে তিনি অস্ট্রেলিয়ার রুল ফুটবলের একটি স্টেডিয়াম ভাড়া নিয়ে ওয়ার্ল্ড সিরিজের সূত্রপাত ঘটান। দক্ষিণ আফ্রিকা তখন সাসপেন্ডেড। কাজেই, ইংল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও অস্ট্রেলিয়ার খেলোয়াড়রা এতে যোগ দেন। এর স্বাভাবিক ফলাফল ছিল, সারা পৃথিবীতে মূলধারার ক্রিকেট সম্পূর্ণভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে এবং অসম্ভব শক্তিশালী ওয়ার্ল্ড সিরিজ ক্রিকেটের উত্থান ঘটে, যা ক্রিকেটের বাণিজ্যিকরণের রাস্তা প্রস্তুত করে। দিনরাতের খেলা, দিনরাতের টেস্ট ম্যাচ, একদিনের ম্যাচ এবং বিশ্বের শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড়দের এক জায়গাতে ঐক্যবদ্ধ করা - এই বিষয়টি সারা বিশ্বের ক্রিকেটে বিপুল পরিমাণে প্রভাব ফেলেছিল। অস্ট্রেলিয়া এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজের দল রীতিমতো দুর্বল হয়ে পড়ে। পরবর্তীকালে অবশ্য তারা ঘুরে দাঁড়ায়। কিন্তু এই ঘটনা আসলে বিশ্বক্রিকেটে নয়া-উদারবাদের পথ প্রস্তুত করে।

নয়া-উদারবাদ আর একবার সমস্যায় ফেলে দিয়েছিল ভারতবর্ষকে। ১৯৮০-র দশকের শেষের দিকে যখন অননুমোদিত একটি মার্কিন ক্রিকেট বোর্ড ভারতীয় দলকে আমেরিকায় নিয়ে গিয়ে পাকিস্তান ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে কিছু অননুমোদিত আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচ খেলায়। সেই সময়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে চূড়ান্তভাবে পর্যূদস্ত ভারতীয় ক্রিকেট দল। এইভাবে অর্থ রোজগার করছে - এই হাওয়ায় গোটা দলকে সমালোচনার মুখে ফেলা হয় এবং গোটা দলকে সাসপেন্ড করা হয়। যদিও পরে তাদের ফিরিয়ে আনা হয়।

এর পরে ১৯৯২ সালে বিশ্বকাপ ক্রিকেটে রঙিন পোশাকে খেলার সূত্রপাত ঘটে। এই রঙিন পোশাকের ক্রিকেট, কেরি প্যাকারের ফরম্যাট অবশেষে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেল। দিনরাতের খেলা, সাদা বলের খেলা, রঙিন পোশাকের ক্রিকেট পৃথিবীর ক্রিকেটের চেহারা বদলে দিল। সঙ্গে এল দ্রুতগতিতে রান তোলার পিঞ্চ-হিটিং ফরম্যাট, যা প্রথম পনেরো ওভারে ফিল্ডিংয়ের সীমাবদ্ধতার সুযোগ নিয়ে দ্রুতগতিতে রান তোলার পদ্ধতিকে চালু করল। এল অসংখ্য উন্নত মানের ফিল্ডিং, যা আমদানি করল দক্ষিণ আফ্রিকা। এর পর থেকে ক্রিকেটের বাণিজ্যিকরণ চরমভাবে এগোতে থাকে। ১৯৯৩ সালে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের 'ওয়ার্ল্ড টেল'-এর সঙ্গে হওয়া চুক্তির জন্য ভারতীয় সম্প্রচারমন্ত্রকের সংঘাত এবং ভারতীয় মাটি থেকে সম্প্রচারিত যেকোনো রেডিও, টিভি প্রচারকে ভারতীয় জনগণের সম্পত্তি বলে, অর্থাৎ সরকারি রেডিও, টিভি চ্যানেলেই দেখানোর অধিকার আছে, এমনটা তারা ঘোষণা করে। এর বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে কেস হলে কোর্ট রায় দেয়, যেহেতু এই সম্প্রচার ভারতীয় মাটি থেকে করা হচ্ছে এবং ভারতীয় জনগণের সম্পত্তি, তাই প্রতিটি ভারতীয় জনগণের শ্রেষ্ঠ সম্প্রচারটি পাওয়ার অধিকার আছে। তাই যারা সবচেয়ে উন্নতমানের সম্প্রচার করবে, এবং সম্প্রচারের দর দেবে, তাদেরকেই সম্প্রচারের অধিকার দেওয়া হবে। এই বলে দূরদর্শনের সম্প্রচারের অধিকারকে খর্ব করে দেওয়া হয়। এই ঘটনা ভারতীয় ক্রিকেটের বাণিজ্যিকরণ এবং বিশ্ব-ক্রিকেটের নয়া-উদারবাদকে এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে চলে যায়, ভারতীয় বোর্ডের হাতে সম্প্রচার অধিকার থাকার কারণে বিপুল পরিমাণে অর্থাগম ঘটে।

১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেটে অফিশিয়াল স্পনসর, অফিশিয়াল কোল্ডড্রিংকস, প্রতিটি ক্ষেত্রে ভিন্ন স্পনসর এবং যারা অফিশিয়াল হতে পারল না, তাদের 'নাথিং অফিশিয়াল' বলে প্রচার, নয়া-উদারবাদকেই চিহ্নিত করে। এই সময়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের একাধিক ম্যাচ দিন-রাতে খেলা হয়, সম্পূর্ণ রঙিন পোশাকের ক্রিকেট এবং সাদা বলে খেলা হতে শুরু করে।

১৯৯০-এর দশকের মধ্যভাগে নয়া-উদারবাদী চিন্তাভাবনার আর একটি ফসল ছিল বিশ্ব-একাদশ বা বিশ্বের বিভিন্ন দলের সাথে মশালা ম্যাচ বা এক্সহিবিশন ম্যাচ। এই ম্যাচগুলোকে ঘিরে খেলোয়াড়দের হাতে বেশ কিছু অর্থাগম হত। এছাড়া, বেনিফিট ম্যাচের নামে বিভিন্ন ম্যাচকে ঘিরে 'ডবল উইকেট টুর্নামেন্ট'ও একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।

১৯৯০-এর দশকেই কমনওয়েলথের বাইরের অন্যান্য ক্রিকেট দলকেও বিশ্বকাপের অন্তর্ভুক্ত করার আইসিসির একটি নীতি তৈরি হয়, যা অচিরেই দশটি ডিভিশনে অ্যাসোসিয়েটেড ও অ্যাফিলিয়েটেড দেশগুলিকে বিভক্ত করে প্রতিযোগিতা শুরু করে এবং অবনমন ও উন্নয়নের মাধ্যমে এক ডিভিশন থেকে অন্য ডিভিশনে দলগুলির যাতায়াতকে সুনিশ্চিত করে।

অ্যাসোসিয়েট দেশগুলির মধ্যে থেকে ২০০০ সালে বাংলাদেশকে এবং ২০১১-১২ সাল নাগাদ আয়ারল্যান্ড এবং আফগানিস্তানকে টেস্ট খেলার স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ইতিমধ্যে নয়া-উদারবাদী পদ্ধতিকেই ধরে রেখে ক্রিকেট খেলাকে চুঁইয়ে পড়া অর্থনীতির দিকে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়। বিশেষত, ক্রিকেটের স্বীকৃত সংক্ষিপ্ততম সংস্করণ 'কুড়ি ওভারের ক্রিকেট'-এর আমদানি ঘটে। পরবর্তীকালে এই কুড়ি ওভারের ক্রিকেটকে ব্যবহার করে আইসিসি বিশ্বের বিভিন্ন দেশগুলির মধ্যে হওয়া কুড়ি ওভারের ম্যাচগুলিকে আন্তর্জাতিক বলে ঘোষণা করে যার ফলস্বরূপ ডিভিশনাল ক্রিকেট বন্ধ হয়ে যায় এবং বিভিন্ন তুলনামূলক দুর্বল দেশের উত্থান ঘটে। এই সময়ের নয়া-উদারবাদী যুগের ক্রিকেটের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল উপমহাদেশীয় খেলোয়াড়দের বাদবাকি দলগুলিতে ব্যাপক পরিমাণে যুক্ত হওয়া।

ভারত-পাকিস্তান-শ্রীলংকা-বাংলাদেশ থেকে সারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে খেলোয়াড়রা খেলে এবং যেখানে তারা খেলে, সেই দলগুলি অ্যাসোসিয়েট দলগুলির তুলনায় শক্তিশালী, যারা দেশীয় দলগুলিকে খেলায়, তাদের দলগুলি তুলনামূলক দুর্বল। তার বাইরে উপমহাদেশীয় টেস্ট-খেলিয়ে দেশেও উপমহাদেশীয় খেলোয়াড়দের উপস্থিতি লক্ষ্যণীয়। এবং অনেক ক্ষেত্রেই তারা দলের অপরিহার্য অঙ্গ এবং সংশ্লিষ্ট দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটেও উপমহাদেশীয় ক্রিকেটারদের বিপুল পরিমাণে অস্তিত্ব প্রমাণ করে আদতে নয়া-উদারবাদ এই উপমহাদেশকেই কেন্দ্র করে ক্রিকেটের বাজারকে সম্প্রসারণ করতে চায়।

এরই মধ্যে ভারত হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দেশ। এই কারণে বারংবার ধাক্কা খাচ্ছে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ টেস্ট-খেলিয়ে দেশগুলি।

২০০৭-এর পর থেকে অস্ট্রেলিয়ার একাধিপত্য কমে গিয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকা কিছুদিন আগে যে চরম সংকটে পড়েছিল, তা কল্পনার অতীত।

নজর রাখতে হবে পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কার দিকেও। পাকিস্তান সন্ত্রাসবাদের অভিযোগে ভারত এবং অন্যান্য দেশের সঙ্গে খেলা একরকম বন্ধই করে দিয়েছিল। তাঁদের বিরুদ্ধে ভারত নিরপেক্ষ দেশ ছাড়া এখনও খেলে না। তাছাড়া, বিভিন্ন খেলার শেডিউল এবং দেশ পরিবর্তিত হয়ে যায় প্রায়ই। সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হল, 'টি-টোয়েন্টি' ফ্র্যাঞ্চাইজির খেলার মধ্যে ভারতের 'আইপিএল'-এ কোনোভাবেই পাকিস্তানের খেলোয়াড়দের সুযোগ দেওয়া হয় না। তা এক ব্যাপক সংকট তৈরি করেছিল। যদিও পাকিস্তানি ফ্র্যাঞ্চাইজি 'পিএসএল'ও এখন বেশ শক্তিশালী হয়ে উঠেছে, তবে তা আইপিএলের ধারেকাছেও নেই। পাকিস্তান দীর্ঘকাল ধরে নিউট্রাল ভেন্যুতে খেলায় এবং তাদের নিজেদের দেশে দীর্ঘদিন খেলা না হওয়ায় তার প্রভাব তাদের ঘরোয়া ক্রিকেটেও পড়েছে। খেলোয়াড়রা অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়ে। পাকিস্তানি ক্রিকেটের মিডল-অর্ডার ব্যাটিং এবং দক্ষ ফাস্ট বোলারের অভাব ঘটেছে, যা পাকিস্তানের টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে কোনোদিন ঘটেনি।

শ্রীলঙ্কার একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হচ্ছে, ১৯৮৩ থেকে প্রায় ১৯৯৭-৯৮ অবধি যে একাধিক খেলোয়াড় শ্রীলঙ্কার দলকে শক্তিশালী করেছিল, যা ১৯৯৬ সালে তাদের বিশ্বকাপ এনে দিয়েছিল, ১৯৯৭ সালে বিশ্বের সেরা দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল, কিন্তু ১৯৯৮-এর পর থেকে তাদের পতন ঘটে। যদিও তারা সেখান থেকে বেরিয়ে আসে, কিন্তু ২০০৮-এর পর থেকে দ্রুতগতিতে তাদের পতন হয়। বর্তমানের ক্রিকেটে তারা যথেষ্ট পরিমাণে প্রশ্নচিহ্নের মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে। অবস্থা এমনই হয়েছে যে, পাকিস্তান তাদেরকে তাদের ঘরের মাঠে গিয়ে প্রায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় হারিয়ে চলে আসছে। একাধিক খেলোয়াড়ের একসঙ্গে খেলা থেকে অবসর, (যেমন মাহেলা জয়বর্ধন, চামিন্দা ভাস, কুমার সঙ্গক্কারা, মুথাইয়া মুরলীধরণ, সনৎ জয়সূর্য) শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটকে ব্যাপক ধাক্কা দিয়েছে।

পিছিয়ে নেই অ্যাসোসিয়েট দেশগুলোও। কেনিয়ার ক্রিকেট প্রায় ধ্বংস হতে বসেছে। কেনিয়া এখন আর একদিনের আন্তর্জাতিক খেলা খেলারও অধিকার পায় না। ২০০৩ সালের সেমিফাইনাল খেলা কেনিয়া থেকে আজ কোনো ভালো ক্রিকেটার ওঠে না। তার বড় কারণ হল তাদের ক্রিকেটের পরিকাঠামোর অভাব। একটি স্বর্ণপ্রজন্মে তারা যে সাফল্য এনেছিল, তা দুর্বল ঘরোয়া ক্রিকেটের কারণে তারা ধরে রাখতে পারেনি।

বর্তমানে নামিবিয়া দলটির কিছুটা উত্থান ঘটেছে কারণ তারা দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ইংল্যান্ডে ঘরোয়া ক্রিকেট খেলে বেড়ায়। তাদের অনূর্ধ্ব উনিশ দলটি সেমিফাইনাল খেলেছিল। সেই দলের খেলোয়াড়রাই এখনও খেলছে। কিন্তু এই প্রজন্ম চলে যাওয়ার পর তাদের কী হবে কেউ বলতে পারে না।

নেদারল্যান্ডসের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এবার বিশ্বকাপ খেলতে নেদারল্যান্ডস আসছে বটে, কিন্তু পরবর্তী প্রজন্ম কতদূর এই ধারা ধরে রাখতে পারবে, তা বলা খুব মুশকিল।

জিম্বাবোয়ে অত্যন্ত সংকটে রয়েছে। রবার্ট মুগাবের ফলে তারা যেভাবে টেস্ট ক্রিকেটে ফিরে এসেছিল, তার স্বৈরাচারীতা তাদেরকে রীতিমতো ধ্বংস করেছে। ফলে তাদের অজস্র ক্রিকেটার খেলতে খেলতে দলটাকে যে জায়গায় দাঁড় করিয়েছিল, সেই থেকে তাদের এখন ব্যাপক পতন ঘটে গিয়েছে। তারা এ বছর বিশ্বকাপে আবারও কোয়ালিফাই করতে পারেনি।

এই তালিকায় সর্বশেষ নাম হল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। তবে তার আগে দক্ষিণ আফ্রিকার কথা মাথায় রাখতে হবে। কোলপ্যাক চুক্তির ফলে দক্ষিণ আফ্রিকার যতখানি উন্নতি হয়েছিল, নয়া-উদারবাদের অন্যতম অবদান ব্রেক্সিটের ফলে সেই চুক্তি ভেঙে যায়। তার ফলে দক্ষিণ আফ্রিকার অস্তিত্ব এখন রীতিমতো সংকটময়।

নয়া-উদারবাদী অভিঘাত একদিকে ডিভিশনাল ক্রিকেট বন্ধ করেছে, একদিকে নীচুতলার ক্রিকেট দলগুলিকে আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি খেলার অধিকার দিয়েছে। অপরদিকে এনে দিয়েছে দশদলীয় ফরম্যাট। তাও বন্ধ হয়ে যাবে বলে বলা হচ্ছে, কিন্তু তার আগে অন্তত একটি বিশ্বকাপে কোনো অ্যাসোসিয়েট দেশ সুযোগ পায়নি এবং দুটি বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে বিদায় নিতে হয়েছে।

ওয়েস্ট ইন্ডিজে ঘরোয়া ক্রিকেটে বছরে খুব কম ম্যাচ খেলা হয়। কোনও দল সফরে এলে সংখ্যা বাড়ত, কিন্তু জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়া ক্রিকেটাররা ছাড়া বছরে এই প্রতি খেলোয়াড় গড়ে ৫/৭টি ম্যাচ পেত। ফলে কাউন্টি বা দক্ষিণ আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়ায় খেলতে যাওয়ার একটা প্রথা ছিল, তাও সে সুযোগ বড় ক্রিকেটারদের কাছে আসত। বর্তমানে এই সংখ্যা আরও কম হয়েছে। তারওপর কাউন্টি ক্রিকেটের মানের অবনতি আর ক্যারিবীয়ানদের কাউন্টি খেলতে উৎসাহিত করে না।

এই ঘটনাই প্রাথমিকভাবে ক্যারিবীয় জনগণকে ক্রিকেট খেলা থেকে মুখ ফেরাতে বাধ্য করে। জাতীয় দলেও ম্যাচ ফি খুবই কম। শুধু ম্যাচ ফি'র ভিত্তিতে ভারতের একজন অনিয়মিত ক্রিকেটার (মহিলা ধরে) জাতীয় দলে তিনটি ফরম্যাটে তিনটি করে ম্যাচ খেলে বছরে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সর্বোচ্চ স্যালারির (গ্রেড সহ) ক্রিকেটারের প্রায় ৪৫% আয় করে।

আরেকটি সম্ভাবনাও কিন্তু ভেবে দেখা উচিৎ।

আইসিসির নতুন নীতিও ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিশ্বকাপে যাবার পথে সম্ভবত কিছুটা বাধার সৃষ্টি করছে। আইসিসির নতুন নীতিতে স্থির হয়েছে, বিশ্বকাপে পূর্ণাঙ্গ সদস্যদের প্রথম আটটি দল সরাসরি কোয়ালিফাই করবে। পরবর্তী চারটি পূর্ণাঙ্গ সদস্য এবং অ্যাসোসিয়েটেড ও অ্যাফিলিয়েটেড সদস্যরা রাঙ্কিংয়ের ভিত্তিতে যোগ্যতা নির্ণায়ক পর্বের বাধা পেরিয়ে বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পাবে। এই নিয়মের মধ্যে পড়ে ২০১৯ সালের বিশ্বকাপে কোনোরকমে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সুযোগ পেলেও গত কুড়ি ওভারের বিশ্বকাপে সুযোগ পায়নি এবং এই বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালের আগামী বিশ্বকাপের কোয়ালিফাইং রাউণ্ডে বিদায় নিল দু’বারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ঘটনাচক্রে এই নীতিটি আসলে ক্রিকেটের মানোন্নয়ন এবং ব্যয়সঙ্কোচনের জন্য গৃহীত হয়।

নয়া-উদারবাদ আগামীদিনে আরও বড় সংকট তৈরি করতে পারে। যেহেতু ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট এই নীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ, ট্রান্সক্যাপিটালের চিহ্ন, এদিকে জাতি-রাষ্ট্র বন্ধ হয়ে যায়নি। ফলে জাতি-রাষ্ট্র এবং ট্রান্সক্যাপিটালের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব, তার ফলে আগামীদিনে এই ফ্র্যাঞ্চাইজি যে আইসিসির মতো দেশে দেশে ফ্র্যাঞ্চাইজি বা আলাদা বোর্ড তৈরি করবে না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এগুলিতে যে পরিমাণ বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করা হয়, তাতে করে খেলোয়াড়রা যে সেদিকেই ঝুঁকবেন এবং জাতীয় বোর্ড থেকে নিজের নাম সরিয়ে নেবেন, সেটা বলাই বাহুল্য। বর্তমানে যে স্টেডিয়ামগুলিতে খেলা হচ্ছে, তা ছাড়াও তারা নিজেদের অর্থ বিনিয়োগ করে আরও স্টেডিয়াম তৈরি করতে পারে, এবং কোনো সরকার তাতে কোনোরকমের বাধা সৃষ্টি করতে পারে না। দীর্ঘদিন ধরে ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট দেখে দেখে ক্রীড়াপ্রেমীদের একটি বড় অংশ এই ক্রিকেট ফরম্যাটকে বেশি পছন্দ করতে শুরু করে দিয়েছে। কারণ এর মানও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের চেয়ে অনেক বেশি। আইপিএল বা বিগ ম্যাচে ব্যাটিং, বোলিং বা ফিল্ডিংয়ের যে উৎকর্ষতা দেখা যায়, তা সারাবছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে কেন পাওয়া যায় না, তা এখন বড় প্রশ্ন। তার ফলে ক্রীড়াপ্রেমীরা সততই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ছেড়ে ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের দিকে ঝুঁকছেন। নিজের দেশের খেলোয়াড়ের ব্যর্থতায় উল্লসিত হয়ে নিজের পছন্দের খেলোয়াড়ের পক্ষে কথা তুলছেন এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিজের রাজ্যদলের বিরুদ্ধে গিয়ে ফ্র্যাঞ্চাইজি দলকে সমর্থন করছেন, তাও আবার যখন সেই দল নিজেরই রাজ্যদলের বিরুদ্ধে, রাজ্যদলেরই ঘরের মাঠে খেলতে আসছে। ট্রান্সন্যাশনাল ক্যাপিটালিজম জাতীয় রাষ্ট্রকে উৎখাত করতে পারেনি। দ্বন্দ্বকে বজায় রেখে দিয়েছে। আগামীদিনে এই দ্বন্দ্ব আন্তর্জাতিক ক্রিকেট-বিশ্বে বড়সড় বিভাজন যে আনবে না, এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। উলটে, বর্তমানে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মতো যে ভারতেরও অবস্থা হবে না, সে সম্পর্কেও নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না।