আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ ষোড়শ সংখ্যা ● ১৬-৩১ আগস্ট, ২০২৩ ● ১-১৫ ভাদ্র, ১৪৩০

প্রবন্ধ

‘‘বরাটা ওআর্ সা জাম্বুডুইপা’’

অতীন দাস


ঋগ্ববৈদিক আর্যভাষীরা শুধুমাত্র ভারতের সাথে সম্পর্কিত ছিলেন না, তাদের ভাষা এবং পূজার ভাবনা মায় পদ্ধতিগুলি ভারতের বাইরেও ছিল। এদের সবচেয়ে নিকট সম্পর্ক ছিল ইরানিদের সঙ্গে। বেদ এবং আবেস্তার ভাষা ও ধর্ম পরস্পরের খুবই কাছাকাছি। সেটা আমরা এই দুটি সভ্যতার ভাষায় ব্যবহৃত শব্দের তুলনা থেকে বুঝতে পারব। ইরানের সাথে আর্য বা বৈদিক সাদৃশ্য সুপরিচিত, এই সূত্র ধরে প্রাক-খ্রিস্টীয় স্লাভ জনগোষ্ঠীর পৌত্তলিকতা (পাগান) এবং এতে বৈদিক প্রভাব বর্তমান নিবন্ধের আলোচ্য বিষয়।

প্রাচীন পারস্য মূলত আজকের ইরান, তার জরাথ্রুস্ট ধর্ম এবং তার ধর্মগ্রন্থ 'জেন্দ আবেস্তা' - এদের বহুল ব্যবহৃত কিছু শব্দের তুলনা করা যায় প্রাচীন ভারতের বৈদিক সংস্কৃত শব্দের সাথে।

সারণী ১ - জরাথ্রুস্ট ধর্ম এবং ধর্মগ্রন্থ 'জেন্দ আবেস্তা' কেন্দ্রিক পার্সি ও সংস্কৃত শব্দের তুলনা

বিষয় পার্সি শব্দ সংস্কৃত শব্দ বাংলা হরফে (অর্থ)
দেবতার পূজারক জরাথ্রুস্ট জরাত্ (হরিৎ্)+উস্ট্র (উট)
মূল দেবতা আহুর মাজদা আহুর (অসুর) + মেধা (জ্ঞান)
ধর্মের নাম মাজদাযস্ন মেধা + যজ্ঞ
ধর্মের চরিত্র বিদেবদাত বিদেবদাত
শ্লোকের নাম গাথা গাথা

 

বিভিন্ন দেবতার নাম বিভিন্ন সাংস্কৃতিক বিষয়
পার্সি শব্দ সংস্কৃত শব্দ (বাংলা) পার্সি শব্দ সংস্কৃত শব্দ (বাংলা)
আপস অপঃ (জল) হাওমা সোম (পানীয়)
গাও গৌ (গরু) নাহা স্নান
ঊষা ঊষা উর্বর উর্বর
যিমা যম দ্রুজ দ্রু (মিথ্যা)
যাস্ন যজ্ঞ হরসবইতি সরস্বতী

দ্রষ্টব্যঃ পার্সি শব্দগুলির উচ্চারণ ও বানানে সামান্য পার্থক্য দেখা যায় বিভিন্ন লেখায়।

পারস্যে ভারতীয় ‘স’ উচ্চারিত হয় ‘হ’ আকারে। ফলে ভারতের যেখানে আর্যভাষীদের প্রথম বসতি স্থাপন, সেই জায়গাটি ‘সপ্তসিন্ধু’ থেকে হয়ে গেল ‘হপ্তহিন্দু’- বহু পরে যেভাবে আমাদের দেশের নাম হল হিন্দু বা হিন্দুস্থান। বিভিন্ন সূত্রে উপরোক্ত তুলনা দেখা যায়, যেমনঃ সুভাষ কাক লিখিত নিবন্ধ। [১]

প্রশ্ন হল এই আর্যভাষী প্রভাবযুক্ত আর কোনো প্রাচীন জনগোষ্ঠী আছে কি না, এবং থাকলে তারা কারা। রাহুল সাংকৃত্যায়ন তাঁর ‘ঋগ্ববৈদিক আর্য’ [২] গ্রন্থে বলেছেন, আর্যভাষীদের কাছাকাছি হলেন স্লাভ জাতি। রুশ, ইউক্রেন, বুলগেরিয়া, পূর্বতন যুগোস্লাভিয়া, চেক, পোল, স্লাভ জাতি হলেন শকদের বংশধর। এছাড়াও লেত-লিথুনিয়দের সাথেও সম্পর্ক ছিল। সমস্যা হল যে সাত-আটশো বছর আগে এদের পূর্ব্বজ নিজেদের ধর্মকে ত্যাগ করেন, ফলে প্রাচীন গাথা/দেবতাদের মূর্তি ইত্যাদি ব্যাপকভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। এমন কি সংগ্রহশালাতেও এসব দুর্লভ। বরুণ, সুর্য ইত্যাদি স্লাভ দেবতাদের মূর্তি তাই বিরল। এরপর প্রাচীন গ্রিক, ল্যাটিন এবং আধুনিক জার্মান, ফ্রেঞ্চ ও ইংরেজি ভাষার সাথেও অল্পবিস্তর যোগাযোগ ছিল। [২]

স্লাভ জাতি গোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে আর্য-বৈদিক প্রভাব

স্লাভ মানুষেরা নিজস্ব ধর্ম ত্যাগ করে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন হাজার বছর আগেই। একাদশ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এই প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হয়েছিল। যেমনটা রাহুলজী লিখেছেন, এই প্রক্রিয়ায় স্লাভদের পৌত্তলিক প্রাক-খ্রিস্টধর্মের দেবতারা সংস্কৃতির থেকে মুছে যান বা তাঁদের গল্প-কথা, মূর্তি, চিত্র সব মুছে ফেলা হয়। ফলে আধুনিক দুনিয়ায় স্লাভ ধর্মের সাথে আর্য-বৈদিক ধর্মের বা দেবতাদের তুলনার খুব কমই প্রামাণ্য রসদ আছে। বেশ কিছু ক্ষেত্রে কাব্যিক কল্পনার আশ্রয় নেওয়া হয়েছে, যেখানে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ধর্মগ্রন্থ থেকে তুলনা করার সময় সবারই মনে রাখা দরকার যে ধর্মগ্রন্থ ইতিহাস নয়, যদিও কয়েক হাজার বছর আগেকার মানুষ, তাঁর সমাজ সম্পর্কে এগুলি তথ্যের রত্নখনি।

এখানে আর একটি বিপদের সম্ভবনা থেকে যায়। বৈজ্ঞানিক প্রমাণ আর কল্পনার মধ্যেকার যে ফাঁক, বিপদ হল, সেখানে প্রচুর আগাছা জন্মায় - যাদের বেশ কিছু বিষাক্ত। আধুনিককালে কিছু স্বঘোষিত গবেষক বিশ্বব্যাপী বেদের, আর্য সভ্যতার প্রমাণ খুঁজে বেড়ান হিন্দু ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে। ভারতেও আর্যভাষীরা প্রবেশ করেছিলেন, তাঁর আগে থেকে উন্নততর সভ্যতা ভারতে ছিল, ভারতবাসী আমরা সকলেই মিশ্র জাতি - একমাত্র সভ্যতা থেকে বিচ্ছিন্ন কোন জনজাতি ‘খাঁটি’ থাকতে পারে - এই সহজ সরল বৈজ্ঞানিক সত্যটা মেনে নিতে পারেন না তারা। ভারতের বাইরে মাটি খুঁড়ে হিন্দু দেব-দেবীর মূর্তি পাচ্ছেন, এমনকি নানা দেশের পৌরাণিক কাহিনীর মধ্যে বেদের দেবতা বা তাঁদের ছায়া প্রক্ষেপ করছেন এই অতি-উৎসাহী ব্যক্তিবর্গ।

এই বিপদ মাথায় রেখেও ধর্মীয় গবেষণা এগিয়ে চলে এটা প্রমাণ করতে যে উৎপত্তির সময় থেকে মানুষ ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীর নানা প্রান্তে - জীবনধারণের উন্নততর, অনুকূল পরিবেশের সন্ধানে। অভিযোজিত মানুষ স্থানীয় মানুষদের সাথে বাণিজ্য করেছে, যুদ্ধ করেছে, সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও জৈবিকভাবে মিশ্রিত হয়েছে। ধর্ম বা ধর্মীয় বিশ্বাস পিছিয়ে থাকবে কেন? বিষয়টি মাথায় রেখেই স্লাভদের প্রাচীন ধর্ম চিন্তার সম্পর্কে কিছু আলোচনা করব আমরা।

বর্তমান সময়ের স্লাভিক জনগণকে পশ্চিম স্লাভিক (প্রধানত পোল, চেক এবং স্লোভাক), পূর্ব স্লাভিক (প্রধানত রাশিয়ান, বেলারুশিয়ান এবং ইউক্রেনীয়) এবং দক্ষিণ স্লাভিক (প্রধানত সার্ব, বুলগেরিয়ান, ক্রোয়াট, বসনিয়াক, ম্যাসেডোনিয়ান, স্লোভেনিস এবং মন্টেনিগ্রিন) শ্রেণীভুক্ত করা হয়েছে। যদিও কখনও কখনও পশ্চিম স্লাভ এবং পূর্ব স্লাভ একটি একক গ্রুপে মিলিত হয় যা 'উত্তর স্লাভ' নামে পরিচিত।

উচ্চারণ এবং তাৎপর্য উভয় ক্ষেত্রেই স্লাভিক প্রাচীন, পৌত্তলিক দেবতাদের (পাগান) সাথে হিন্দু দেবতাদের সম্ভাব্য বেশ কিছু মিল রয়েছে। সংস্কৃত এবং স্লাভিক শব্দগুলি সর্বদা সম্পূর্ণরূপে একই রকম নাও হতে পারে (উচ্চারণ এবং অর্থে), কিন্তু সাদৃশ্যের উল্লেখযোগ্য উপাদান বহন করতে পারে, যেমনঃ

ক) ভেলস - এই দেবতা বন, প্রকৃতি এবং জলের প্রভু, পৌরাণিক মতে তিনি একটি গরু জেমুন এবং দেবতা রডের ছেলে। তিনি রাখাল এবং জ্ঞানের পৃষ্ঠপোষককে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। স্লাভদের ভেলসের প্রতি শ্রদ্ধা ছিল কারণ তারা তার মধ্যে এমন একজন দেবতা দেখেছিল যাঁকে ঘিরে তারা বেঁচে থাকার চেষ্টা করেছিল। তিনি ফসল, মাঠ এবং বন্য এবং গৃহপালিত পশুদের দায়িত্বে ছিলেন। পুরো সম্প্রদায় ভেলসের উপর নির্ভরশীল ছিল। অনেক কিংবদন্তি অনুসারে, ভেলস হলেন বজ্রের দেবতা যিনি দেবতা পেরুনের শপথকৃত শত্রু। পুরনো রাশিয়ান কবিতায়, মেসিডোনিয়ার শহরের নাম হিসেবে 'ভেলস', গ্রীক 'ভেলেসা' এবং আলবেনিয়ায় 'ভেলেস' নাম পাওয়া যায়। ভোলস পালাক্রমে ৯০৭ সালে একজন খ্রিস্টান সাধু হিসাবে আবির্ভূত হন, এবং অন্যান্য সাধুদের তালিকায় তাঁকে পাওয়া যায় এবং প্রাণীদের পৃষ্ঠপোষক সন্ত সেন্ট ব্লেইসের সাথে তিনি যুক্ত।

স্লাভিক দেবতা ভেলেসের ক্ষেত্রে (মেষপালকদের দেবতা এবং একটি মহান সর্প), যিনি বৈদিক বলের সাথে সাদৃশ্য বহন করেন। [৩] বল সম্পর্কিত ঋগ্বেদের কয়েকটি শ্লোক (মন্ডল, সূক্ত, ঋক) সহ উল্লেখ করা হল। যেমন (২.১২.৩) "হে মনুষ্যগণ! …যিনি বল কর্তৃক নিরুদ্ধ গোসমূহকে উদ্ধার করেছিলেন, যিনি মেঘদ্বয়ের মধ্যে অগ্নি উৎপাদন করেন এবং যুদ্ধকালে শত্রুগণকে বিনাশ করেন, তিনিই ইন্দ্র"। (২.১১.২০) "…সেরূপ ইন্দ্র অঙ্গিরাগণের সাহায্য লাভ করে বজ্র ঘূর্ণিত করছিলেন এবং বলকে বিনাশ করেছিলেন"। (৮.১৪.৭) "সোমজনিত মত্ততা হলে ইন্দ্র দীপ্তিমান অন্তরিক্ষকে বর্ধিত করেছেন, যেহেতু তিনি বলকে ভেদ করেছেন"। [৪] এরকম আরও কিছু শ্লোক আছে। দেখা যাচ্ছে, কেবল নামের সাদৃশ্য নয়, কাজের ক্ষেত্রে, এমনকি শত্রুতার নকশাতেও দুই দেবতার মিল আছে।

খ) রড-বিশ্বাস এসেছে স্লাভিক 'রডনো' থেকে যার অর্থ জন্ম। রুদ্রের সাথে আরও একটি ঐতিহাসিক সংযোগ হল যে রুদ্র এসেছে ‘রুদ’ থেকে যার অর্থ হল 'কান্না' বা 'বিলাপ' (যেমন নবজাতক শিশু করে) যা ধর্মীয় মতে শিবের অনুগ্রহ দ্বারা প্রতিরোধ না করা পর্যন্ত স্বাভাবিক চেতনার কতকটা অসহায়ত্বের ইঙ্গিত দেয়। [৫]

গ) স্লাভিক 'যিভা', পোলিশ উপাধি 'যাভা', সার্বো-ক্রোয়েশিয়ান প্রদত্ত নাম 'জিভা', বুলগেরিয়ান 'ঝিভা' ইত্যাদি একটি প্রদত্ত নাম ছিল, যা পরে একটি অজানা দেবীর উপাধিতে পরিণত হয়েছিল। টোপোরভ প্রমুখ জিভাকে দেবী মোক্ষ-র সাথে তুলনা করেছেন।

ঘ) স্লাভিক পুরাণে, পেরুন সর্বোচ্চ দেবতা - আকাশ, বজ্র, বজ্রপাত, ঝড়, বৃষ্টি, আইন, যুদ্ধ, উর্বরতার দেবতা তিনি।

তাঁর সাথে তুলনা করা হয়েছে বেদের দেবতা 'পরজন্য'-এর যিনি হলেন বৃষ্টি, বজ্র, বজ্রপাতের দেবতা এবং বেদ অনুসারে পৃথিবীর উর্বরকারী দেবতা। [৫]

লুপ্তপ্রায় স্লাভ প্রাক-খ্রিস্টীয় পৌত্তলিক (পাগান) দেবতাদের সন্ধানে

শুরুতে এই বিষয়টি ব্যাখ্যা করার জন্য লেভ স্যামুলভিচ লিখিত ‘পেরুনের পুনরুত্থান, পূর্ব স্লাভিক পৌত্তলিকতার পুনর্গঠনের জন্য’ বইটির [৬] ভূমিকার গল্পটি পাঠ করতে পারি। স্লাভিকদের মূল দেবতা পেরুন সম্পর্কে গবেষণা করে লেখক পেরুনের কাহিনীর ব্যাপকতা সত্ত্বেও সূত্রের দুষ্প্রাপ্যতা, পৌরাণিক কাহিনি আর রূপকথার পার্থক্য, প্রয়োজনীয় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি নানা বিষয় ছুঁয়ে গেছেন ব্যক্তিগত অনুভূতি ও অভিজ্ঞতা দিয়ে। [৬] তিনি লিখছেনঃ

"পেরুন অপ্রত্যাশিতভাবে আমার কাছে এসেছিল, ঘটনাক্রমে, এবং বেশ কয়েক বছর ধরে সে আমার সমস্ত চিন্তাভাবনা দখল করেছিল। কিছু সময়ের জন্য অন্য সব কিছু ফেলে রেখে আমাকে এটি নিয়ে কাজ করতে হয়েছিল যা ১৯৮৫ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে গবেষণাপত্র আকারে প্রকাশিত হয়। বর্তমান বইটি ১৯৮০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে তৈরি করা হয়েছিল এবং আমার প্রকাশনাগুলি প্রতিফলিত হয়েছে।

অবশ্যই, আমি ছোটবেলা থেকেই পেরুন সম্পর্কে কিছু জানতাম। আমার জন্ম বেলারুশে, ডাক্তারদের একটি পরিবারে, এবং আমার বাবা-মা আমাদের - বাচ্চাদের রেখে গিয়েছিলেন একটি আয়া-র যত্নে যিনি বেলারুশিয়ান গ্রাম থেকে শহরে এসেছিলেন। আয়া বেলারুশিয়ান রূপকথার গল্প বলতেন, তাকে বিরক্ত করলে চিৎকার করতেন 'পেরুন তোকে ধরে নিয়ে যাবে'! পেরুনকে সে স্বর্গে বসবাসকারী এবং ঝড়, বজ্রপাত এবং বজ্রপাত-এর নিয়ন্ত্রক বলত। বেলারুশিয়ান ভাষায় 'প্যারুন' বলতে বোঝাত প্রক্ষিপ্ত বস্তুকে - যা তৎকালীন গ্রামের বৃদ্ধদের মতে, বজ্র এবং বজ্রপাতের সাথে আঘাত করে। 'বজ্র' একটি আঘাতের শব্দ, 'মালাঙ্কা' (বিদ্যুৎ) হল আলোর ঝলকানি।"

আমি যখন লেনিনগ্রাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করি এবং প্রত্নতত্ত্ব, ইতিহাস এবং লোককাহিনী অধ্যয়ন করতে শুরু করি, তখন প্রাচীন স্লাভিক দেবতাদের সম্পর্কে জ্ঞান - পেরুন, স্বরোগ, ভোলস এবং অন্যান্য - স্বাভাবিকভাবেই বৃদ্ধি পেয়েছিল। কয়েক ডজন বই, শত শত নিবন্ধ, অধ্যায় এবং হাজার হাজার পাঠ্যপুস্তক ইত্যাদি বিশেষভাবে স্লাভিক পুরাণের উপর লিখিত। বিজ্ঞান তার সম্পর্কে আমার ছেলেবেলার আয়ার চেয়ে সামান্য বেশি জানে। এমনকি আমরা যে কয়েকটি তথ্য সংগ্রহ করতে পেরেছি তা পৌরাণিক কাহিনীর সাথে সম্পর্কিত নয়, বরং তাঁর সাথে যুক্ত পৌত্তলিক দেবতাদের সম্পর্কিত - যেমন বলি, মূর্তি, শপথ, নাম সংকীর্তন।

পেরুনের পৌরাণিক কাহিনীর একটিও মূল প্রকাশ, অন্তত পুনরুদ্ধারে, বেঁচে নেই। এটা বিশ্বাস করা হয় যে রূপকথা হল পৌরাণিক কাহিনি যা তাদের পবিত্রতা হারিয়েছে, যেখান থেকে বিষয়বস্তু আংশিকভাবে হলেও হারিয়ে গেছে। একশো বছর আগে, আমার জন্ম যে শহরে, সেখানে ‘বেলারূশ সংগ্রহ’ (রোমানভ, ১৮৯১) প্রকাশিত হয়েছিল, এর কয়েকটি কাহিনিতে আছে শয়তান বা সাপকে তাড়া করছে পেরুন। কিন্তু পেরুন-এর নাম কোনো রাশিয়ান রূপকথায় উল্লেখ করা হয়নি, অর্থাৎ তাঁর নামে চরিত্র অঙ্কিত হয়নি। যদি কোনও রূপকথায় পেরুন সম্পর্কে পৌরাণিক কাহিনীর অবশিষ্টাংশ থাকে তবে সেটি কোনটি তাও স্পষ্ট নয়।

…আমার প্রাক্তন ছাত্র আমাকে বিদায় জানাতে এসেছিল। তিনি উত্তর ককেশীয় ইতিহাস এবং সংস্কৃতির বইগুলি জোগাড় করেছিলেন। একটি ছিল চেচেন-ইঙ্গুশ লোককাহিনির একটি সংগ্রহ। আমি যান্ত্রিকভাবে চোখ বোলাচ্ছিলাম নায়কদের ককেশীয় নামগুলিতে। চোখ আটকে গেল একটি নামে - পিরুন? আমি আবার শুরু করলাম - রাশিয়ান 'পেরুন'-এর মতো শোনাচ্ছে। এই নাম এল কোথা থেকে? আমি ভাবতে লাগলাম।

এবারে বুঝুন কেন আমি এই আকস্মিক আবিষ্কারের জন্য সবকিছু ছেড়েছি, আপনাকে স্লাভিক পৌত্তলিকতার সেই পুনর্গঠনগুলি জানতে হবে যা বিজ্ঞান পুরোনো উপকরণ দিয়ে তৈরি করতে পারে। অন্তত সংক্ষিপ্তভাবে, প্রাচীন রাশিয়ান পৌত্তলিক ধর্মের বিজ্ঞানের বিকাশের গতিপথ খুঁজে বের করা প্রয়োজন।

স্লাভিক পৌত্তলিকতার বিজ্ঞানের বিকাশের দুই শতাব্দীর মধ্যে, নানা পুনর্গঠন একে অপরকে একাধিকবার প্রতিস্থাপন করেছে। এই পরিবর্তনে কোনোপ্রকার যুক্তি বা সরলীকরণ অনুধাবন করা সহজ নয়। কিন্তু তাদের দিকে ঘনিষ্ঠভাবে তাকালে আমরা দেখতে পাব যে তিনটি কারণ পুনর্গঠনে পরিবর্তন এনেছেঃ উৎসের ঘাটতি পূরণ, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির উন্নতি এবং আদর্শগত আকাঙক্ষার পরিবর্তন। এবং ফলস্বরূপ, দেবতাদের ব্যবস্থায় পেরুনের স্থান, তার মর্যাদা, এমনকি এই উপস্থিতির চেহারারও পরিবর্তন হয়েছে। [৬]

স্লাভ জনগোষ্ঠীর উপর খ্রিস্টধর্ম প্রচারের নির্মমতার বর্ণনা

ক) স্লাভ জনতার উপর খ্রিস্ট ধর্ম প্রচারের নামে নির্মম আক্রমণ নামিয়ে আনা হয়েছিল অধিকাংশ ক্ষেত্রে। ১১৭২ সালে খ্রিস্টীয় পুরোহিত হেলমোল্ড বিশপের অনুরোধে ‘ক্রনিকা স্লাভোরাম’ বইটি [৭] লেখেন যা মধ্যযুগের ইতিহাস চর্চায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ৯০০ থেকে ১১০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে স্লাভ জাতিকে খ্রিস্টধর্মের অনুগত করতে জার্মানরা যে অভিযান চালায় তাঁর পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ এতে আছে - যার কিছ অংশ তুলে ধরা হচ্ছে। লেখক পাদরি হেলমোল্ড মহাশয়ের দৃষ্টিভঙ্গিও তাঁর লেখা থেকে পরিষ্কার হবে।

তিনি তাদের বনভূমির উপাসনালয়গুলি ধ্বংসের অনুমোদন দিয়েছিলেন। যদিও আতিথেয়তার অনুভূতির জন্য তাদের প্রশংসা করেছিলেন, …একটি সৈন্যদলকে একত্রিত করে, তিনি ডেনস অঞ্চলে অগ্রসর হন এবং অনেক কঠিন যুদ্ধে তাদের প্রায় ধ্বংস করেন। যুদ্ধটি উপর থেকে নির্দেশিত হয়েছিল, যদিও সংঘর্ষে এক লক্ষ পৌত্তলিক নিহত হয়েছিল, কখনও হয়ত বা একজন খ্রিস্টানকে হত হতে দেখা গিয়েছিল। উত্তরাঞ্চলের অধিবাসীদের সাথে নিপীড়ন এইরকম বুদ্ধিমত্তার সাথেই ঘটেছিল। প্রভু সত্তর বছর ধরে তাঁর দাসদের রক্তের প্রতিশোধ নিলেন। [৭] (পৃষ্ঠা - ৬৩)

...সত্যিই মানুষের উপর ঈশ্বরের বিচার লুকিয়ে আছেঃ “অতএব তিনি যাকে ইচ্ছা করুণা করেন... এবং তিনি যাকে ইচ্ছা তাকে কঠোর করে দেন।” কিন্তু তিনি, "ন্যায্য বিচারক, শক্তিশালী ও ধৈর্যশীল।" (পৃষ্ঠা - ৮৩)

যদি তাঁকে দীর্ঘজীবন দেওয়া হতো, তবে তিনি সমস্ত পৌত্তলিকদের খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করার কাজ নিষ্পত্তি করতেন,…

পুরাতন ভেঙ্গে যাওয়া গির্জাগুলো পুনঃনির্মাণ করা হয়।... কথিত আছে যে তিনি গোটশাকের সাথে ছিলেন সেই দিনগুলিতে তিনি হাজার হাজার পৌত্তলিককে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষা দিয়েছিলেন।

অন্যদিকে, স্লাভদের প্রতি ঘৃণা উস্কে দিতে এ ধরনের প্রচার করা হতঃ

বয়স্ক বিশপ জনকে ম্যাগনোপলিসে... খ্রিষ্টকে স্বীকার করার কারণে তাকে রড দিয়ে মারধর করা হয়েছিল এবং তারপরে স্লাভদের একের পর এক শহরে তাকে উপহাস করা হয়েছিল। যেহেতু তাকে খ্রিস্টের পেশা থেকে ফিরিয়ে আনা যায়নি তার হাত-পা কেটে ফেলা হয়েছিল এবং তার দেহ রাস্তায় ফেলে দেওয়া হয়েছিল। তার মাথা, তবে, বর্বররা কেটে ফেলে, একটি বর্শার উপর স্থির করে এবং তাদের বিজয়ের প্রতীক হিসাবে তাদের দেবতা রেডিগাস্টকে অর্পণ করে। (পৃষ্ঠা - ৯৮)

স্লাভরা যখন বিজয় অর্জন করেছিল তখন তারা আগুন এবং তলোয়ার দিয়ে হামবুর্গের পুরো অঞ্চলকে ধ্বংস করে দেয়।... এমনকি আমাদের ত্রাণকর্তাকে উপহাস করার জন্য পৌত্তলিকরা ক্রসগুলি বিকৃত করেছিল। (পৃষ্ঠা - ৯৯)

স্লাভরা ভবিষ্যতের জন্য গাছ, ঝরনা এবং পাথরের দ্বারা শপথ করা নিষিদ্ধ ছিল এবং তারা লোহা বা লাঙ্গলের ফায়ার দ্বারা বিচারের জন্য অপরাধের জন্য অভিযুক্তদের যাজকের কাছে আনতে হয়েছিল। (পৃষ্ঠা - ২২৪)

খ) পোমেরেনিয়া মধ্য ইউরোপের বাল্টিক সাগরের দক্ষিণ তীরে পোল্যান্ড এবং জার্মানির মধ্যে বিভক্ত একটি ঐতিহাসিক অঞ্চল। এই অঞ্চলের ক্যাথলিক বিশপদের ভূমিকার বিষয়েজি ভাইজম্যানলিখিত একটি নিবন্ধ [৮] (২০০৪) উল্লেখ করা যায়, যাতে পৌত্তলিক জনজাতির উপর খ্রিস্টধর্মের প্রচারকদের ভূমিকা আলোচনা করা হয়েছে।

দশম শতাব্দী থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত পশ্চিম পোমেরেনিয়াতে ক্যাথলিক চার্চের ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা বিশ্বাস করি যে এটি বেশ কয়েকটি উলটপালটের মধ্য দিয়ে গেছে। এক হাজার সাল থেকে শুরু করে, বেশ দীর্ঘস্থায়ী পৌত্তলিক প্রতিরোধ সত্ত্বেও, ১৬ শতকের মাঝামাঝি সময়ে এটি ভালোভাবে বিকাশ লাভ করে। ...রেইনবেমের জন্ম ৯৬৫ সালের দিকে। সম্ভবত তিনি ম্যাগডেবার্গের ক্যাথেড্রাল স্কুলে শিক্ষিত হয়েছিলেন, যেটি স্লাভদের ধর্মান্তরিত করার জন্য মিশনারিদের প্রস্তুত করত। ৯৯০ সালের দিকে তিনি ম্যাগডেবার্গে একজন যাজক নিযুক্ত হন এবং সম্ভবত ১০০০ সালে গনিজনোতে একজন বিশপ নিযুক্ত হন। তিনি মূর্তিগুলি, মন্দিরগুলিকে ধ্বংস ও পুড়িয়ে দিয়েছিলেন। ...পবিত্র জল ছিটিয়ে অশুভ আত্মাদের দ্বারা অধ্যুষিত সমুদ্রকে পরিষ্কার করেছিলেন।

দ্বিতীয় পোমেরিয়ান মিশনের ফলাফল খুব অনুকূল ছিল, কারণ সেগুলি শহিদ এবং পৌত্তলিক রক্তপাত ছাড়াই পরিচালিত হয়েছিল। ...এই আদেশগুলি শুধুমাত্র যাজকীয় যত্ন নিয়েই নয়, কর্মরত জনসংখ্যার মধ্যে সংস্কৃতি এবং অর্থনীতিকে উত্থাপনের সাথেও জড়িত, যেমন কৃষিকাজ, রাস্তা নির্মাণ, কল, বাগান এবং মৌমাছি পালন। ...চার্চও বুদ্ধিবৃত্তিক সংস্কৃতিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছিল। স্থানীয় পৌত্তলিক সংস্কৃতির জায়গায়, প্রথমে বিদ্যালয়গুলি ধীরে ধীরে প্রধান গির্জা প্রতিষ্ঠানগুলিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যা যাজকদের জন্য প্রার্থীদের শিক্ষিত করে। [৮]

গ) বর্তমানে সুইডেনের পঞ্চম বৃহত্তম শহর উপসালাতে প্রাচীন মন্দির পাওয়া গেছে যাতে আছে স্বর্ণখচিত মূর্তি যেটা স্লাভদের আরকোনাতে প্রাপ্ত মন্দিরের মত, সেখানে মূর্তি আছে ত্রিগলভ-এর। তিনটি মুখ বিশিষ্ট দেবতা ‘ত্রিগলভ’ এর উল্লেখ পাওয়া যায়। দ্বাদশ শতাব্দীর চার্চের নীচে পাওয়া ধবংসপ্রাপ্ত উপসালার পাগান মন্দিরে বর্গাকার নকশা দেখা গেছে যা প্রাচীন আরাকানা মন্দিরের মতো। এসব থেকে প্রমাণ হয় একসময় পাগান মন্দির ছিল।

দক্ষিণ রাশিয়া, স্টেপ অঞ্চলে পাথর কেটে বানানো মানুষের মূর্তি, হাতে শিং-য়ের পাত্র পান করার জন্য - পাওয়া গেছে, কিয়েভের পেরুন-এর মূর্তির মতন এটি। পেরুনের কাঠ খোদাই করা এই জাতীয় মূর্তি - সোনার গোঁফ, রুপোর মাথা সহ দেখা গেছে। [৯] যদিও এই নিবন্ধে এই দেবতাদের সাথে আর্যভাষী দেবতাদের কোন সাদৃশ্য দেখান হয়নি।

ভাষাগত সাদৃশ্য - সংস্কৃত ও স্লাভিক

রাশিয়ান এবং সংস্কৃত উভয়েই ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারের সদস্য, অন্যান্য সদস্যরা হল সমস্ত স্লাভিক, জার্মানিক, সেল্টিক, ইন্দো-ইরানিয়ান এবং হেলেনিক ভাষা গোষ্ঠী। কয়েকটি উদাহরণ উপস্থিত করা হল।১০সংস্কৃত এবং রাশিয়ান বাংলা হরফে লেখা হল।

সারণী ২ - কয়েকটি স্লাভ (রাশিয়ান) ও সংস্কৃত শব্দের তুলনা

সংস্কৃত রাশিয়ান (বাংলা হরফে) বাংলা অর্থ
ভগ বগ ভগবান
নভস নেবো আকাশ
দ্বার ডভের দরজা
মাতৃ মাত মাতা
ভ্রাতা ব্রাট ভ্রাতা


কয়েকটি সংখ্যা বাচক শব্দঃ রাশিয়ান (সংস্কৃত-বাংলা) আকারে লেখা হল -
দ্ভ (দ্বি-দুই), ত্রি (ত্রি-তিন), চিত্রিয়া (চতুর্‌-চার), প্যাত (পঞ্চ-পাঁচ), শ্যেস্ত (ষষ্ঠ-ছয়), দ্যেস্যত(দশ-দশ), স্ত (শত-শত), দ্ভিস্তি (দ্বিশতং-দুইশত)।

প্রাচীন ধর্মীয় প্রভাব - অতি উৎসাহের বিপদ বনাম জনগণের আত্মীকরণ

বর্তমান আলোচনাটি স্লাভ পৌত্তলিক জনগোষ্ঠীকে খ্রিস্টীয় ধর্মে রূপান্তর বা তাঁর পদ্ধতি সম্পর্কে নয়। পৃথিবীর ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, এক ধর্ম থেকে জনগোষ্ঠীকে অন্য ধর্মে রূপান্তরের সময় যখন কোন রাজা, সম্রাট বা শাসক জড়িত থাকে, ধর্মান্তকরণ প্রক্রিয়াতে নানা ছল চাতুরী, হিংসা, জীবনহানি ঘটে থাকে। আমরা দেখাতে চেয়েছি আর্য প্রভাব ভারত, ইরান ছাড়াও যেখানে ছড়িয়ে পড়েছিল, তার অন্যতম বড় উদাহরণ স্লাভ জনগোষ্ঠী যারা মূলত ইউরোপের বেশ কিছু দেশজুড়ে আছেন। স্লাভদের পৌত্তলিকতা, তার সাথে সম্ভাব্য সাদৃশ্য বহনকারী বৈদিক ধর্মচিন্তা ও দেবদেবী আজ প্রায় নিশ্চিহ্ন। কিছু সাহিত্যিক উপাদান, আরও কম টিকে থাকা কিছু ধর্মীয়-সামাজিক আচার থেকে এই ইতিহাস রচনা করতে প্রয়োজন বিজ্ঞান ভিত্তিক উদ্যোগ যা পূর্বে উল্লেখ করা পন্ডিতেরা তাঁদের লেখায় বলেছেন।

আরেকটি দিক সম্পর্কে আমরা পূর্বে বলেছি - সেটা হল বিশ্বব্যাপী বেদ-হিন্দুত্ব খুঁজে বেড়ানো এবং অর্ধসত্য-পুরোমিথ্যা দিয়ে প্রচার করে দেশের মধ্যে হিন্দুত্বের আসন প্রতিষ্ঠা করা। ইন্টারনেটের মাধ্যমে দ্রুত ছড়িয়ে দেওয়া হয় নানা গল্প। যেমন, রাশিয়ার স্তারায়া অঞ্চলে সাত থেকে দশ শতাব্দীর পুরোনো বিষ্ণু মূর্তি ‘আবিষ্কার’ - একটি সর্বভারতীয় বৃহৎ সংবাদপত্র এই ‘সংবাদ’ পরিবেশন করে ২০০৭ সালে - এক রাশিয়ান অধ্যাপকের ভাষ্যে। এই তথ্য নানাভাবে নানা মিডিয়াতে আসে, কেউই মূল সূত্রটি উল্লেখ করতে পারেননি। সংবাদপত্রটির সেই সংবাদের লিংকটিও আর কাজ করছে না। [১১] শতাধিক দেশে অন্য দুটি বৃহৎ ধর্মের বিশ্বাসীরা আছেন, হিন্দুদের তাঁদের সমকক্ষ বা উন্নততর করার কৃত্রিম প্রয়াস সম্ভবত এই অপচেষ্টার কারণ।

প্রাচীন কোন সভ্যতায় বা জনসমাজে আর্য-উপস্থিতির সংবাদ আমাদের আনন্দ দেয়, কারণ মনুষ্য প্রজাতির পৃথিবীব্যাপী নানা পরিযাণ, বিবর্তনের ফল বর্তমানে আমরাই ভোগ করছি। এটাতে আরও বোঝা যায়, যে প্রাচীন সভ্যতার আমরা ধারক-বাহক, তাতে বৈচিত্র্য একটি বড় উপাদান, ধর্মীয় অস্মিতা, অহংকার বা একমুখী চিন্তার স্থান নেই।

আমরা কোনো স্থানে হিন্দুত্বের প্রমাণ পেলে তাঁকে বর্তমানের ভারতের সাথে মিলিয়ে ভাবা সেখানকার মানুষের আত্মীকরণকে ছোট করা হয়। অধ্যাপক রমেশ চন্দ্র মজুমদার প্রচুর গবেষণা করে লিখেছেন ‘সুদূর প্রাচ্যে হিন্দু উপনিবেশ’ নামক বইটি [১২] যাতে সুবর্ণদ্বীপ, চম্পা, কম্বুজ ইত্যাদি অধ্যায়ে বিস্তারিতভাবে হাজার বছর আগে ছোট-বড় হিন্দু রাজত্বের বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন যাতে বর্তমান কাম্বডিয়া, ভিয়েতনাম, লাওস, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর সহ সমগ্র ইন্দোচীন ভূখন্ডে হিন্দু সভ্যতার পরিচয় পাওয়া যায়। সেখানে আজকের স্থানীয় মানুষ হিন্দু ধর্মের থেকে দূরে চলে গিয়ে, এমনকি অন্য ধর্মমত গ্রহণ করলেও হিন্দু সাংস্কৃতিক প্রভাব বহন করছেন স্বাভাবিকভাবে - যা তাঁদের আত্মীকরণের প্রক্রিয়ার ফল।

চিত্র ১ - চতুর্দশ শতকে তৈরি প্রম্বাননের ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রাচীন হিন্দু মন্দিরে শিবের মূর্তি। ১৮৮৫ সালের চিত্র। (উইকিমিডিয়া)

চিত্র ২ - ত্রিভুবনতুঙ্গাদেবী - রানির মূর্তি পার্বতীর রূপে, চতুর্দশ শতকে তৈরি।

ইন্দোনেশিয়া বিশ্বের বৃহত্তম মুসলিম জনসংখ্যার দেশ। প্রাচীন মাজাপাহিতে (বর্তমানের ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর, মালয়শিয়া, ব্রুনেই, থাইল্যান্ড জুড়ে প্রসারিত ছিল) শক্তিশালী হিন্দু সাম্রাজ্য বিকাশলাভ করছিল ১৩ থেকে ১৫ শতাব্দীতে, সংস্কৃতি, ভাষা এবং দৃশ্যপটে এর প্রভাব পড়েছিল। হিন্দুরা বর্তমানে জনসংখ্যার ২ শতাংশেরও কম। কিন্তু হিন্দু-মুসলমান সকলেই রামায়ণ এবং তাঁর কাহিনীগুলিকে সাংস্কৃতিকভাবে গ্রহণ করেছেন, মিশিয়েছেন নিজস্ব শিল্পরীতির সাথে, তাই আজও এগুলি জনপ্রিয়। শৈলেন্দ্র রাজবংশের শাসনকালে খ্রিস্টীয় চতুর্থ থেকে নবম শতাব্দীতে নির্মিত জাভার বরোবুদুর মন্দির বিশ্বের অন্যতম সেরা বৌদ্ধ নিদর্শন। বিষ্ণু এবং শিবের মন্দিরগুলি দ্বীপগুলির মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে, সংস্কৃত থেকে আগত শব্দগুলি নানা স্থান-নাম বা আচারে টিকে আছে এখনও, আধুনিক ইন্দোনেশিয়ায়। হিন্দু প্রম্বানন মন্দির এরকমই প্রসিদ্ধ, বৃহৎ আরেকটি মন্দির। আরও উল্লেখ্য ‘রামায়ণ’ ব্যালে জাভাদ্বীপের নিজশৈলীতে এখানে পরিবেশিত হচ্ছে ১৯৬১ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে যাতে সব ধর্ম-সস্প্রদায়ের মানুষ অংশ নেন। এটি 'গিনেস বুক' দ্বারা স্বীকৃত হয়েছে বিশ্বের দীর্ঘতম কাল ধরে চলা মঞ্চস্থ উপস্থাপনা হিসাবে- ২৪০ জন অভিনেতা, নর্তক সহ। [১৩], [১৪]

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়কে সাথে নিয়ে এই আত্মীকরণের অন্বেষণে ভ্রমণ করেছিলেন পূর্ব এশিয়ার নানা দেশে। সুনীতিকুমারের লেখা সেই ভ্রমণ বৃত্তান্ত [১৫] থেকে কিছুটা অংশ তুলে ধরা হচ্ছে যা যথার্থ মানসিকতার পরিচয় দেবে। তিনি দেখেছেন ইন্দোনেশিয়ার বলীদ্বীপের মানুষ হিন্দুত্ব বোঝেন-মানেন, ভারতবর্ষ কি বা কোথায় তা জানেন না, ভারত তাঁদের কাছে পৌরাণিক জম্মুদ্বীপ - তাঁদের মালয়ী উচ্চারণে জাম্বুডুইপা আর ভারবর্ষ হল বরাটা ওআর্ সা মাত্র। বইটির থেকে নিচে কিছু অংশ তুলে ধরছি।

হিন্দুস্থান বা ইন্ডিয়া, এই-সব বলীদ্বীপীয় লোক, যারা ডাচ্ ভাষায় অনভিজ্ঞ আর ইস্কুলে কখনও পড়েনি, তারা বুঝতে পারবে না। আমাদের দেশে গাঙ্গ্যো, জামুন্যো নদী আছে, হিমলায়া, উইন্ডিঅ (বিন্ধ্য) পর্বত আছে, আজোডিও, ইন্ড্রাপ্রাস্তা (অযোধ্যা, ইন্দ্রপ্রস্থ) প্রভৃতি নগর আছে, রময়ানা, মাহবরাটা-র দেশ হচ্ছে আমাদের দেশ - তোমাদের মতন আমাদের দেশেও ব্রামো, উইস্নু আর সিওঅ-র সম্মাননা হয়; বুডা আমাদের দেশেরই মানুষ; …। যে কয়েকটি কথা বললুম, তাতে খুব বেশী মালইয়ান জ্ঞানের দরকার হয় না।… ভারতবর্ষের সাথে যোগ হারানোর সঙ্গে-সঙ্গে, তাঁর স্মৃতির এমনকি তাঁর অস্তিত্বের কথা সাধারণ লোকে এখন ভুলে গিয়েছে। নিজেদের ভাষায় রামায়ন, মহাভারত পড়ে বটে, বিস্তর পৌরাণিক কাহিনী জানে বটে, কিন্তু এদের বিশ্বাস, দেবদেবীর লীলা আর পৌরাণিক যত ঘটনা ঘটেছিল, তাঁর সমস্ত বলীদ্বীপে আর যবদ্বীপেই ঘটেছিল - আর জম্বুদ্বীপ বা ভারতবর্ষের কথা এদের শাস্ত্রজ্ঞ পন্ডিতেরা জানেন বটে, এদের কাছে কিন্তু সে জম্বুদ্বীপ পুরাণের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে, বাস্তব জগতে তার যেন অস্তিত্ব নেই। [১৫]

আমরাও কি এই মানসিকতার পরিচয় দেব না?

তথ্যসূত্রঃ

১। সুভাষ কাক, 'বেদিক এলিমেন্টস ইন দি এনসিয়েন্ট ইরানিয়ান রিলিজিওয়ন অফ জরাথ্রুস্ত', দ্য আদায়ার লাইব্রেরি বুলেটিন, ৬৭, ৪৭-৬৩, ২০০৩।
https://www.sanskritimagazine.com/vedic-elements-in-the-ancient-iranian-religion-of-zarathushtra/

২। রাহুল সাংকৃত্যায়ন, 'ঋগ্ববৈদিক আর্য', অনুবাদক মলয় চট্টোপাধ্যায়, চিরায়ত প্রকাশন, কলকাতা, ২০১৯।

৩। কে. আলেকজান্দ্রা, ভেলেস, 'ভূমি, জল এবং ভূগর্ভস্থের আকৃতি পরিবর্তনকারী স্লাভিক ঈশ্বর', স্লাভোরাম, ২০১৬।
https://www.slavorum.org/veles-the-slavic-shapeshifting-god-of-land-water-and-underground/

৪। ঋগ্বেদ সংহিতা, হরফ প্রকাশনী, কলকাতা, ২০১৯।

৫। সুভাষ কাক, মিডিয়াম ডটকম, জুন ২০১৮।
https://subhashkak.medium.com/slavs-searching-for-their-gods-9529e8888a6e

৬। এল. এস. ক্লিয়েন, 'পেরুনের পুনরুত্থান'। পূর্ব স্লাভিক পৌত্তলিকতার পুনর্গঠনের জন্য, আর্কিওলজি, ইউরেশিয়া, সেন্ট পির্টাসবার্গ, রাশিয়ান ভাষায় প্রকাশিত, (যান্ত্রিক অনুবাদ), ২০০৪।
https://4italka.su/nauka_obrazovanie/istoriya/328309/fulltext.htm

৭। হেলমোল্ড বোসাউ, 'প্রিস্ট, ক্রনিকেল অফ দ্য স্লাভস', অনুবাদ ফ্রান্সিস জোসেফ তসকান, অক্টাগন বুকস, নিউ ইয়র্ক, ১৯৬৬। (রেকর্ডস অফ সিভিলাইজেশান, সোর্স এন্ড স্টাডিস, নং ১২ হিসেবে প্রকাশিত)

৮। জি. ভাইজম্যান, '১০ শতক থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত পশ্চিম পোমেরেনিয়ায় ক্যাথলিক বিশপেরা', রক্লাওস্কি থিওলজিক্যাল রিভিউ, ১২(১) পৃষ্ঠা ১৩৯-১৫৬, ২০০৪ (গুগুল ট্রানন্সলেশান)।
https://bazhum.muzhp.pl/media/files/Wroclawski_Przeglad_Teologiczny/Wroclawski_Przeglad_Teologiczny-r2004-t12-n1/Wroclawski_Przeglad_Teologiczny-r2004-t12-n1-s139-156/Wroclawski_Przeglad_Teologiczny-r2004-t12-n1-s139-156.pdf

৯। পেটাজোনি, রাফায়েল, 'এসেস অন হিস্ট্রি অফ রিলিজিয়ন', অধ্যায় ১৩, ওয়েস্ট স্লাভ পাগানিসম, অনুবাদক এইচ. জে. রোজ, লিদেন, ১৯৫৪।

১০। কলিন রুগ, https://vocab.chat/blog/russian-and-sanskrit.html

১১। রাশিয়ার প্রাচীন বিষ্ণু মূর্তি ‘আবিষ্কার’ - প্রকৃত তথ্য বিস্তারিতভাবে জানতে দেখুন -
https://satark.wordpress.com/category/dr-alexander-kozhevin/

১২। শ্রীরমেশ চন্দ্র মজুমদার, 'হিন্দু কলোনিস ইন দি ফার ইস্ট (১৯৬৩)', 'সুদূর প্রাচ্যে হিন্দু উপনিবেশ' - অনুবাদ শ্রীসুমিত্রা চৌধুরী, সম্বোধি পাবলিকেশানস, কলিকাতা।

১৩। জাকার্তা পোস্ট, বা মুরিয়ান্টো, যোগকার্তা, ১৭/১০/২০১২।
https://www.thejakartapost.com/news/2012/10/17/ramayana-ballet-breaks-world-records.html

১৪। গিনেস বুক, লার্জেস্ট রামায়ণ ডান্স, ২০১২।
https://www.guinnessworldrecords.com/world-records/103579-largest-ramayana-dance

১৫। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, 'রবীন্দ্র সঙ্গমে দ্বীপময় ভারত ও শ্যাম দেশ', অধ্যায় বলিদ্বীপ - বাস্তিল, পৃষ্ঠা ৩৫৩-৩৫৪, প্রকাশ ভবন, কলকাতা, ১৯৬৪।