আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ ষোড়শ সংখ্যা ● ১৬-৩১ আগস্ট, ২০২৩ ● ১-১৫ ভাদ্র, ১৪৩০

প্রবন্ধ

ইউনিফর্ম সিভিল কোডঃ একটি আলোচনা

রঞ্জন রায়


মুখবন্ধ

এই বিষয়ে 'আরেক রকম' সাময়িক পত্রিকার মে মাসের দ্বিতীয়ার্ধে একটি লেখা লিখেছিলাম। তবে ঘটনার ঘনঘটা দেখে শেষপাতে কিছু সংযোজন জরুরি মনে হচ্ছে। আগের নিবন্ধটি মে মাসে শেষ করেছিলাম এই আশায় যে ইউনিফর্ম সিভিল কোড বা সমান নাগরিক সংহিতা নিয়ে ল’ কমিশন (কার্যকাল মার্চ, ২০২৩ পর্যন্ত) অন্ততঃ জুন নাগাদ সংসদের বর্ষাকালীন অধিবেশনের আগে কিছু একটা সুপারিশ করবে বা ভারত সরকারকে বিধিসম্মত পরামর্শ দেবে।

কিন্তু বিগত ১৪ জুন, ২০২৩ তারিখে ২২তম ল’ কমিশনের চেয়ারম্যান জাস্টিস ঋতুরাজ অবস্থী, কর্ণাটক হাইকোর্টের ভূতপূর্ব মুখ্য ন্যায়াধীশ (যিনি স্কুলে মেয়েদের হিজাব পরার মামলায় সরকারের পক্ষে রায় দিয়েছিলেন), আগের কমিশনের জনতার মতামতের জন্য ডিজিটাল মাধ্যমে জারি করা ১৬ বিন্দু প্রশ্নপত্রটি ফের জারি করলেন। মতামত দেওয়ার সময়কাল ৩০ দিন, অর্থাৎ ১৪ জুলাই অব্দি। তারপর সেটা বাড়িয়ে ২৮ জুলাই করা হয়।

কেন এই কেঁচে গণ্ডুষ?

শোনা যাচ্ছিল যে ২১তম কমিশনের চেয়ারম্যান, জাস্টিস বি. এস. চৌহান নাকি স্পষ্ট কোন অনুশংসা বা সুপারিশ না দিয়েই অবসর নিয়েছেন। আগের কিস্তিতে আমিও তাই লিখেছিলাম। এখন দেখছি কথাটি অর্ধসত্য।

এই বিষয়ে জারি নতুন সরকারি নোটিসেই বলা হয়েছে যে ২১তম ল’ কমিশন এই বিষয়ে জনতার, ধর্মীয় সংগঠনের এবং সমস্ত স্টেক হোল্ডারের অভিমত জানতে চেয়ে বিগত ৭ জুলাই, ২০১৬-তে উপরোক্ত ১৬ বিন্দু প্রশ্নপত্র জারি করে। তারপর আরও পাবলিক নোটিসের পর (যেমন ১৯ মার্চ, ২০১৮; ২৭ মার্চ, ২০১৮ এবং ১০ এপ্রিল, ২০১৮) জনতার কাছ থেকে অভূতপূর্ব সাড়া পায়। এসবের অধ্যয়নের ভিত্তিতে কমিশন বিগত ৩১ আগস্ট, ২০১৮ সরকারের জন্য 'রিফর্মস্ অফ ফ্যামিলি ল’ নামে একটি ১৮৫ পাতার কনসাল্টেশন পেপার জারি করে। তারপর প্রায় তিন বছর কেটে গেল। সরকার ব্যাপারটা নিয়ে গা’ করল না। এখন আগের কন্সাল্টেশন পেপার তামাদি হয়ে গেছে জানিয়ে ফের একই প্রক্রিয়া শুরু।

সামনে লোকসভার সাধারণ নির্বাচন। এবং ভারতীয় জনতা পার্টির তিনটি প্রধান নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির মধ্যে দুটো (ধারা ৩৭০ বিলোপ এবং অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণ) পূর্ণ হয়েছে, বাকি সমান নাগরিক সংহিতা।

কিন্তু কী ছিল সেই ফ্যামিলি ল’ কন্সাল্টেশন পেপারে যা ভারত সরকার এড়িয়ে গেল?

২১তম কমিশন কোন স্পষ্ট অভিমত দেয়নি - কথাটা ভুল। সমস্ত মতামত/সাজেশন খুঁটিয়ে দেখে কমিশনের বক্তব্যঃ ইউনিফর্ম সিভিল কোড বর্তমান পর্যায়ে আবশ্যক নয়, জরুরিও নয় (is neither necessary nor desirable at this stage)।

এখানে দুটো কথা গুঁজে দিচ্ছি।

কথা তো ছিল ইউনিফর্ম সিভিল কোড বা সমান নাগরিক সংহিতার। এর মধ্যে ফ্যামিলি ল’ শব্দটি কেন?

ভারতীয় নাগরিক সংহিতার (Indian Civil Code) সিংহভাগ - যেমন কনট্র্যাক্ট অ্যাক্ট, ট্রান্সফার অফ প্রপার্টি, মর্টগেজ, স্ট্যাম্প ডিউটি, আরবিট্রেশন, জমি কেনাবেচা, খাজনা এবং কৃষি আইন, শ্রম কানুন, ব্যাংক সম্বন্ধিত আইন, নেগোশিয়েবল ইন্সট্রুমেন্ট অ্যাক্ট, সেলস অফ গুডস অ্যাক্ট, প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ কর, জিএসটি ইত্যাদি, ল’ অফ লিমিটেশন, ট্রেসপাস, মানহানি ইত্যাদি - সমস্ত নাগরিকের জন্যে সমান, জাতিধর্ম নির্বিশেষে।

তাহলে কোনগুলো আলাদা? শুধুমাত্র পারিবারিক আইন বা ফ্যামিলি ল’। অর্থাৎ সমস্ত জাতি বা ধার্মিক সম্প্রদায়ের বিয়ে, সম্পত্তির ভাগ-বাঁটোয়ারা, দত্তক নেওয়া এবং উত্তরাধিকারের আইন।

আমাদের প্রধানমন্ত্রী মোদীজি গত ২৭ জুন, ২০২৩ তারিখে মধ্যপ্রদেশের রাজধানী ভোপালে বিজেপির দশ লক্ষ বুথ ওয়ার্কারদের সভায় বলেছেন - এক পরিবারে আলাদা আলাদা নিয়ম চললে পরিবার টিকবে কী করে? ভিন্ন সম্প্রদায়ের জন্য ভিন্ন ভিন্ন কানুন হলে দেশ একসাথে চলবে কী করে? দেশের সংহতির কী হবে?

তাই দেশ চাইছে সমান নাগরিক সংহিতা। মুসলমানদের সতর্ক হতে হবে - কারা ওদের ভুল বোঝাচ্ছে। এবছরের শেষে মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড় ও রাজস্থানে বিধানসভার নির্বাচন আসন্ন।

ফলে নির্বাচনী প্রচারে ইউসিসি কতটা গুরুত্ব পাবে তা এখন থেকেই বোঝা যাচ্ছে।

কিন্তু ২১তম ল’ কমিশনের জাস্টিস চৌহানের বক্তব্য মোদীজির বিপ্রতীপে।

জাস্টিস চৌহান আরও স্পষ্ট করে ব্যাখ্যা করেছেনঃ আমরা যদি অভিন্ন দেওয়ানি বিধির টানে আমাদের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে জলাঞ্জলি দিই তাহলে সেটাই জাতির আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষার ক্ষেত্রে প্রধান বিপদ হয়ে দেখা দেবে।

উনি আরও বলেছেন যে প্রত্যেক সম্প্রদায়ের মধ্যেও ফ্যামিলি ল’ এবং আচার অনুষ্ঠান নিয়ে এত বৈচিত্র্য আছে! আগে হিন্দু এবং মুসলিম সম্প্রদায় নিজেদের মধ্যে বিয়ে, সম্পত্তি, উত্তরাধিকার নিয়ে ভিন্নতা দূর করুক। তারপর না হয় গোটা দেশের মধ্যে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি প্রণয়ন করার কথা ভাবা যাবে।

এবার আমরাও স্পষ্ট করে বুঝতে পারছি - কেন জাস্টিস চৌহানের 'ফ্যামিলি ল’ কন্সাল্টেশন পেপার' - হিন্দি বাগধারা থেকে ধার নিয়ে বললে - এতদিন ঠান্ডা বস্তায় পড়ে ছিল। আর চার বছর পরে তার তিলাঞ্জলি হল।

অমর্ত্য সেন গত ৫ জুলাই শান্তিনিকেতনে তাঁর বাসভবনে কিছু ছাত্র-ছাত্রীর সঙ্গে কথাবার্তার সময় সাংবাদিকদের বলেন - ইউনিফর্ম সিভিল কোড এদেশে প্রয়োগ করা হবে বক্তব্যটি ভুয়ো (a bluff)। তিনি পালটা প্রশ্ন করেন - এতে কার লাভ হবে? এটা মুর্খামি (a stupid thing). আমরা ইউসিসি ছাড়াই হাজার বছর পেরিয়ে এসেছি। ভবিষ্যতেও এটা ছাড়াই আমাদের চলে যাবে। হ্যাঁ, এ হল হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এজেন্ডার অংশ।

দ্বিতীয় কথাটি হল বিগত ল’ কমিশনের চেয়ারম্যান তাঁর কার্যকাল শেষ হওয়ার (২০১৬-১৮) আগে আরও অনেকগুলো বিষয়ে নিজের রায় ও সরকারকে পরামর্শ দিয়েছেন। তার মধ্যে একটি হল - ধর্মমত নির্বিশেষে সমস্ত বিয়ের রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত। এখানে বলা ভাল, সাধারণত কোন ধার্মিক বিয়েতেই স্বতঃপ্রণোদিত রেজিস্ট্রেশন হয় না। পাত্র-পাত্রী নিজের উদ্যোগে করায়, কখনও পাসপোর্ট-ভিসার প্রয়োজনে। তবে মুসলিম বিয়ে একধরণের সামাজিক চুক্তির ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে। তাই তাদের পাঁচ জন সাক্ষীর দস্তখতে যে নিকাহ্নামা বা বিয়ের চুক্তিপত্র তৈরি হয় সেটা তাদের ধর্মীয় রেজিস্টারে নথিভুক্ত হয়। তবে সেই রেকর্ড সরকারের কাছে জমা হয় না। চৌহান কমিশনের রিপোর্ট মেনে নিলে জন্মমৃত্যুর খতিয়ানের মত সমস্ত বিয়েরই তথ্য সরকারের কাছে নথিবদ্ধ হবে। আমার মতে হলে মন্দ কি!

সরকারের কাছে আমার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে লেনদেনের সমস্ত তথ্য প্যান নাম্বারের মাধ্যমে জমা হয়েছে। এটাও না হয় গেল। তাতে হয়ত কোন নটবরলালের লোক ঠকিয়ে একাধিক বিয়ে করার খেলা খানিকটা হলেও নিয়ন্ত্রিত হবে। বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে কেউ এলে ঘরে বসেই পাত্রীটি পাত্রের নামধাম ঠিকানা দিয়ে সরকারের পোর্টালে সার্চ করে জানতে পারবে পাত্রটি প্রতারক কিনা।

কিন্তু মুসলিম পার্সোনাল ল’ বোর্ড এবং দেওবন্দ-এর দার-উল-উলুম এই সংস্কারের বিরোধী। ওদের মতে মুসলিম বিয়ে তো নথিবদ্ধ হয়। তাতে দেনমোহরের পরিমাণ ইত্যাদি সমস্ত শর্তের উল্লেখ থাকে। তাহলে সেই তথ্য সরকারের কাছে জমা দেওয়া অপ্রয়োজনীয় এবং ধর্মীয় ব্যাপারে সরকারের অনভিপ্রেত হস্তক্ষেপও বটে।

সে যা হোক, সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ল ল’ কমিশন আসলে ইউসিসি-র পক্ষে ভোট নিচ্ছে। জনতার বড় অংশ যদি পক্ষে ভোট দেয় তাহলে সরকার এটা নিয়ে আইন তৈরি করবে। সংসদে তো শাসকদল বিপুলভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ। কাজেই বিল পাস করতে কোন অসুবিধে হবে না।

আরও ’ফরওয়ার্ডেড পোস্ট’ ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। যেমন, এর মধ্যেই ৪ কোটি মুসলিম এবং ২ কোটি খ্রীস্টান এর বিরুদ্ধে কমিশনের কাছে রায় দিয়েছে। ওরা এককাট্টা।

অতএব, জাগো হিন্দু জাগো! আমরা বিপন্ন! শীগগির এর পক্ষে ভোট দাও, দেশের অখণ্ডতার জন্যে রুখে দাঁড়াও!

কেউ বলছেন না যে এগুলো হেট স্পীচের পর্যায়ে পড়ে। কেউ বলছেন না যে ২২তম ল’ কমিশন আগের কমিশনের সেই ১৬ পয়েন্ট বিন্দুতে সবার চিন্তাভাবনা ও অভিমত চাইছেন, পক্ষে বিপক্ষে ভোটাভুটি নয়।

যেটা হতে পারত তা হল সরকার কী অর্থে ইউসিসি চায় তার একটা খসড়া তৈরি করে এই আইনের সঙ্গে যাদের ভাগ্য জড়িত (stakeholder) তাদের সবার মধ্যে আলোচনার জন্যে প্রচারিত করা।

হঠাৎ বেসুর বাজলো কেন?

ভারত সরকার ইউসিসি প্রণয়নের জন্যে একটি পার্লামেন্টারি প্যানেল বানিয়েছেন যার চেয়ারম্যান হলেন সুশীল মোদী (Chairman of the Parliamentary Committee on Law and Justice)। উনি বিহারে এনডিএ-র কোয়ালিশন সরকারে উপ-মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন এবং ভবিষ্যতে বিজেপি একা সরকার গড়লে মুখ্যমন্ত্রী হতেন এমনই প্রচলিত মত। কিন্তু রাজনৈতিক দাবাখেলায় তাঁকে বিহারের রাজ্য-রাজনীতি থেকে দূরে দিল্লিতে সাংসদ হতে হয়েছে। আপাততঃ উনি শিরোনামে এসেছিলেন ‘মোদী’ নামের সবার অপমান হয়েছে এই অভিযোগে রাহুল গান্ধীর বিরুদ্ধে বিহারে একটি মানহানির (ক্রিমিনাল) এফআইআর করে।

এবার উনি ফের শিরোনামে এসেছেন - ৩ জুলাই তারিখে ইউসিসি প্যানেল মিটিং চলাকালীন বিতর্কিত মন্তব্য করে। ওনার অভিমত হল উত্তর-পূর্ব ভারতকে এই ইউসিসি আইনের আওতার বাইরে রাখা হোক কারণ, ওই অঞ্চল সংবিধানের আর্টিকল ৩৭১ অনুসারে বিশেষ তালিকাভুক্ত, তাই স্বতন্ত্রভাবে পরিচালিত হয়। মূল ভারতের অনেক আইন ওখানে প্রযুক্ত হয় না।

পাঠকের মনে পড়বে - কাশ্মীর আর্টিকল ৩৭০ অনুসারে পরিচালিত হত। দেশের অখণ্ডতার ধুয়ো তুলে সেটা বাতিল করা হল। কিন্তু নাগা-মিজো-কুকি-টিপরা জনজাতির বিস্তৃত এলাকার আর্টিকল ৩৭০ বাতিল করা হয়নি।

সুশীল মোদী নিজে আইনজ্ঞ, তাই কথাটি উনি হঠাৎ বলেননি। ওনার সাতদিন আগে মেঘালয়ের মুখ্যমন্ত্রী কনরাড সাংমা ইউসিসি নিয়ে তাঁর আপত্তি জানিয়ে বলেছেন - তাঁর রাজ্যের জনজাতিদের সামাজিক প্রথা এবং অনুষ্ঠান, ক্রিয়াকর্ম এসব একটা নতুন আইনে বাতিল করে সবাইকে একঘাটে মাথা মুড়োতে বাধ্য করা যাবে না।

যেমন মেঘালয়ে ঘরের ছোট মেয়ে সম্পত্তির বড় অংশ পায়।

প্যানেলের বৈঠকে কংগ্রেসের বিবেক তনখা, মধ্যপ্রদেশের প্রাক্তন মহাঅধিবক্তা ও সুপ্রীম কোর্টের অধিবক্তা এবং দ্রাবিড় মুন্নেত্রা কাজাঘম (ডিএমকে) সাংসদ পি. উইলসন ল’ কমিশনের সদস্য-সচিব কে. বিসওয়ালকে প্রশ্ন করেন - যখন আগের ল’ কমিশন ২০১৮ সালেই অভিমত প্রকাশ করেছিল যে ইউসিসি ‘neither necessary, nor desirable’ তাহলে কেন ফের জনসাধারণের কাছে অভিমত চাওয়া হচ্ছে।

বিজেপির প্রতিনিধি রাম জেঠমালানির পুত্র মহেশ জবাবে বললেন যে, এটা তো ১৯৪৯ সালে সংবিধান সভার বিতর্কেই অবশ্যকর্তব্য হিসেবে ধরা হয়ে হয়েছিল। অন্যরা বলেন যে মোটেই তা নয়। সেই বিতর্কে এটা বলা হয়েছিল ইউসিসি একটি ‘স্বেচ্ছায় গ্রহণযোগ্য বিকল্প’ (voluntary option) মাত্র এবং বাবাসাহেব আম্বেদকরও একই মত পোষণ করতেন।

বিবেক তনখা আরও বলেন যে উনি যতদূর খবর পেয়েছেন যে বিয়ে - যা কিনা ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক আইনের আওতায় পড়ে - সেটাও নাকি ইউসিসির আইনে বদলে যাবে।

কিন্তু বর্তমান সরকার তো সুপ্রীম কোর্টে সমলিঙ্গের বিবাহের অধিকার মামলায় দলিল দিয়েছিল যে বিবাহ স্বভাবতঃ প্রত্যেক জন-সমুদায়ের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের অঙ্গ। তাহলে ইউসিসি যদি বিবাহের আইনে হস্তক্ষেপ করে সেটা নাগরিকদের ধর্মীয় অনুভূতিকে আহত করবে না?

বিরোধের কণ্ঠস্বর ক্রমশঃ প্রবল হচ্ছে। কয়েকজন বিজেপি সাংসদও গলা মিলিয়েছেন। ছোটনাগপুর অঞ্চলের আদিবাসী মহাসভা একই যুক্তিতে প্রবল আপত্তি জানিয়েছে। আপত্তি জানিয়েছে ক্রিশ্চানদের সর্বভারতীয় সংগঠন। মুসলিম সমাজের দৃঢ় বিশ্বাস যে এর উদ্দেশ্য মুসলিমদের বিয়ে ও সম্পত্তির অধিকারে হস্তক্ষেপ।

আবার দলিতদের একাংশের মনে হচ্ছে যে মুসলিম নয়, আসল লক্ষ্য ইউনিফর্মিটি বা সমান আইনের বাহানায় উচ্চবর্ণের পক্ষধর মনুবাদী আচার সংহিতা লাগু করে দলিতদের বরাবরের মত দাবিয়ে রাখা।

তারা অনেক প্রশ্ন তুলছে। তার কয়েকটিঃ

অভিন্ন দেওয়ানি বিধি হলে কি -
● তফসিলি আদিবাসীদের জমি অন্যেরা কিনতে পারে না, এখন পারবে?
● গোয়ায় হিন্দুদের পুত্রসন্তান না হলে দ্বিতীয় বিয়ের অধিকার আছে সেটা বন্ধ হয়ে যাবে? নাকি অন্যেরাও সেই সুযোগ পাবে?
● উত্তর-পূর্ব ভারতের পাঁচটি রাজ্যের (ত্রিপুরা, মণিপুর, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড এবং অরুণাচল প্রদেশের) আদিবাসীরা আয়কর অধিনিয়ম ১৯৬১, ধারা ১০(২৬) অনুয়ায়ী সম্পূর্ণ ছাড় পায়। এবং সংবিধানের ষষ্ঠ সূচীর অন্তর্গত গঠিত জেলা কাউন্সিল এলাকার আদিবাসীদেরও আয়কর দিতে হয় না। অভিন্ন দেওয়ানি বিধি হলে দিতে হবে?
● হিন্দু সংযুক্ত পরিবারে (Hindu Undivided Family) আয়কর অধিনিয়ম ধারা ১০(২) অনুয়ায়ী যে ছাড় আছে তা মুসলিম, ক্রিশ্চান বা পার্শি সংযুক্ত পরিবারে নেই। এরপর কি এই ছাড় তুলে দেওয়া হবে? নাকি সবাইকে ছাড় দেওয়া হবে?
● দক্ষিণ ভারতে মামা-ভাগ্নি এবং মামাতো পিসতুতো ভাইবোনের মধ্যে বিয়ে অত্যন্ত পবিত্র মনে করা হয়। অভিন্ন দেওয়ানি বিধির পরে এই বিয়েগুলো অবৈধ হবে? নাকি অন্যদেরও অমন বিয়ে করতে হবে?
● মেঘালয়ে ঘরের ছোট মেয়ে সম্পত্তির বড় অংশ পায়। সেসব বদলে যাবে?

সুপ্রীম কোর্টের বিশিষ্ট আইনজীবি এবং রাজ্যসভার সাংসদ কপিল সিব্বল প্রশ্ন তুলেছেন - প্রধানমন্ত্রী কোন কোন ইস্যুতে ইউনিফর্মিটি চান সেটা দেশের সামনে স্পষ্ট করুন। কোনো খসড়া নেই তো বিতর্ক কিসের ভিত্তিতে হবে? কেউ কিছু জানে না, অথচ পক্ষে-বিপক্ষে বিতর্ক হচ্ছে!

এখানে প্রশ্নঃ সত্যিই কি বিজেপির সামনে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নিয়ে কোন মডেল নেই? ওরা বলছেন আছে; গোয়ায় ইউসিসির সফল প্রয়োগ হয়েছে।

গোয়ার বিশেষ ইউনিফর্ম সিভিল কোড

গোয়ার মুখ্যমন্ত্রী প্রমোদ সাবন্ত গত ১ জুলাই তারিখে বললেনঃ গোয়া ভারতের প্রথম ইউনিফর্ম সিভিল কোড মেনে চলা রাজ্য। যদিও এই রাজ্যে অল্পসংখ্যকের (পড়ুনঃ খ্রিস্টান) প্রতিশত ২৭%, তবু এখানে এই ব্যাপারে কোনো অভিযোগ নেই। বিয়ে, সম্পত্তি ও উত্তরাধিকার আইন সবার জন্যে সমান।

সাবন্ত আরও বললেন যে, এই কোড লৈঙ্গিক সাম্য (gender equality) ও অন্যান্য কারণে কেন সম্পূর্ণ দেশে জারি হওয়া আবশ্যক - এটা বুঝিয়ে বলার জন্যে উনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে কৃতজ্ঞ।

সুপ্রীম কোর্টের প্রাক্তন প্রধান ন্যায়াধীশ জাস্টিস ববড়ে বলেছেন যে, গোয়ার সিভিল কোড সংবিধান প্রণেতাদের স্বপ্নকে সাকার করেছে। বিয়ে এবং উত্তরাধিকারের বিষয়ে এই আইন ধার্মিক সম্প্রদায় নির্বিশেষে সবার জন্যে সমান।

তাহলে আমরাও এই আদর্শ মডেলটিকে একটু খুঁটিয়ে দেখি।

গোয়া আগে পর্তুগালের উপনিবেশ ছিল। তখন ১৮৫০-এর পর্তুগাল সিভিল কোড গোয়ার নাগরিকদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হল। ১৯৬২ সালে গোয়া যখন স্বাধীন ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়ে কেন্দ্রশাসিত রাজ্য হল বা যখন ১৯৮৭ সালে আলাদা রাজ্য হল, তখনও ওই আইনটিতে ভারত সরকার কোন হস্তক্ষেপ করল না। ওখানকার ফ্যামিলি ল’ অপরিবর্তিত রইল।

তবে ২০১২ এবং ২০২২ সালে গোয়ার উত্তরাধিকার আইনে বেশ কিছু প্রগতিশীল সংশোধন হল।

আমরা স্বল্প পরিসরে কিছু নির্ণায়ক বিন্দুগুলোকে ছুঁয়ে যাব -

১) বিয়ে রেজিস্টার করতে হবে।

২) ক) বিয়ের আগে এবং পরে বর-কনের দু'পক্ষের স্বোপার্জিত বা উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তি যা ছিল, বিয়ের পর তার সংযুক্ত স্বামিত্ব হবে, অর্থাৎ দুজনেই তার মালিক হবে। বিচ্ছেদ হলে দু’পক্ষই অর্ধেক ভাগ পাবে। বিবাহিত স্ত্রী/পুরুষ একে অপরের সম্মতি বিনা সম্পত্তি বেচতে পারবে না।
- এটা কি মনুস্মৃতিকে আদর্শ বিধি মেনে চলা পুরুষেরা, ইউসিসির পক্ষধর হলেও, মেনে নিতে পারবেন? হিন্দু কোড বিলে মেয়েদের সম্পত্তির অধিকার প্রশ্নে গত শতকে কারা সংস্কারের বিরোধিতা করেছিলেন?

খ) কিন্তু সংযুক্ত সম্পত্তির তদারকি করবে শুধু স্বামী। সে সম্পত্তির কোনো অংশ ভাড়ায় খাটাতে পারবে। এর জন্যে স্ত্রীর অনুমতির দরকার নেই।
- লিঙ্গ সাম্যের যোদ্ধারা কী বলবেন?

৩) মেয়ে সম্পত্তির অর্ধেক পাবে। ভাই-বোনের পৈতৃক সম্পত্তিতে সমান অধিকার।

৪) গত ২০২২-এর সংশোধনের পরে গোয়ায় মেয়েদের অধিকার কিছুটা এগিয়েছে। পুরুষ মারা গেলে বসতবাটি এবং ঘরের জিনিসপত্রে বিধবার একচ্ছত্র অধিকার। বাকি সম্পত্তি বিধবা এবং অন্যান্য উত্তরাধিকারীদের মধ্যে সমান ভাগ হবে।
- এই নিয়ম গোটা দেশে কার্যকরী হলে হিন্দু পুরুষেরা মেনে নেবেন কি?

৫) হিন্দু উত্তরাধিকার আইনের ধারা ১৫ অনুয়ায়ী যদি কোনো বিধুর পুরুষ নিঃসন্তান অবস্থায় গত হন এবং উইল না করে থাকেন, তাহলে সেই পুরুষের সম্পত্তির মালিক হবে তাঁর বাবা-মা। কিন্তু নিঃসন্তান বিধবার সম্পত্তি (যদি উইল না করে থাকেন) পাবেন তাঁর শ্বশুর-শাশুড়ি, নিজের বাবা-মা নন; সেই সম্পত্তি বিধবার চাকরি করা মাইনের থেকে কেনা হলেও।
- এমন কোন নিয়ম গোয়ার আইনে নেই। তা ভারতের মূল ভূখণ্ডের হিন্দু পুরুষ কি ওই সুবিধেগুলো ছাড়তে রাজি?

৬) বহুবিবাহ (bigamy and polygamy) নিষিদ্ধ; এটা সবধর্মের ক্ষেত্রেই প্রয়োজ্য। আর তিন তালাকের প্রশ্নই নেই কিন্তু একটা ব্যতিক্রম আছে। কোনো হিন্দু পুরুষের স্ত্রী যদি ২১ বছর বয়সেও সন্তানের জন্ম না দেয় বা ৩০ বছর বয়স হলেও পুত্রসন্তানের (male child) জন্ম না দিতে পারে তাহলে স্বামী দ্বিতীয়বার বিয়ে করতে পারে।

উপসংহার

ভারতে সমান নাগরিক সংহিতা নিয়ে উত্তপ্ত বাদ-বিবাদে জড়িয়ে পড়ার আগে দরকার একবার চোখ মেলে দেখা - বিশ্বের সভ্য দেশগুলো পারিবারিক আইন বলতে (বিয়ে-উত্তরাধিকার-সম্পত্তির ভাগাভাগি) কোন নীতিগুলোকে সাম্য, বিশেষ করে লিঙ্গসাম্যের সহায়ক বলে মেনে নিয়েছে।

বহুবিবাহ নয়, একবারে একটিই বিয়ে (monogamy) - ভারতে বিয়ের ব্যাপারে রয়েছে আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ বিয়ের আইন - Special Marriage Act, 1954, যা ধর্ম-জাতির প্রশ্ন না তুলে দুই প্রাপ্তবয়স্ক নারীপুরুষকে স্বেচ্ছায় বিয়ে করে দাম্পত্য জীবনযাপনের অনুমতি দেয়।

খোরপোষ (alimony) - এর জন্যে পুরুষের আয় ও জীবনযাপনের স্তরকে আধার মেনে বিচ্ছেদ হওয়া নারীর জন্যে খোরপোষ হেতু দেয় রাশির পরিমাণ ঠিক করা হয়। এর সঙ্গে স্বীকৃত হয়েছে বৃদ্ধ বাবা-মাকে দেখাশোনার জন্যে সন্তানের দায়িত্বের আইন - Parents and Senior Citizens Act, 2007

সম্পত্তির উত্তরাধিকারে ছেলে ও মেয়ের সমান অধিকার - Gender equality in property rights

এইভাবে প্রায় অধিকাংশ সভ্য এবং উন্নত দেশে আমরা সু-বিচার এবং বিবেকবুদ্ধির প্রতি আস্থাশীল হয়ে ঐক্যমতে পৌঁছেছি। এই নীতিগুলো কোন ধর্মীয় আচরণবিধি-নির্ভর নয়।

তিন তালাককে বেআইনি ঘোষণা করা (Outlawing Tripple Talaq) - অনেকগুলো মুসলিমপ্রধান দেশ, যেমন পাকিস্তান, মিশর, তিউনিসিয়া, বাংলাদেশ, তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া, ইরাক, অনেক আগেই তিন তালাক প্রথাকে নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। ভারতে ২০১৭ সালে সুপ্রীম কোর্ট তিন তালাক প্রথাকে সংবিধানের মূল ভাবনার পরিপন্থী মেনে বে-আইনী ঘোষণা করেছে।

উল্লেখনীয় যে এইসব ন্যায়োচিত নাগরিক আইন প্রণয়ন এবং পারিবারিক আইনে সংশোধন করার জন্যে আমাদের দেশে আলাদা করে কোন ইউনিফর্ম সিভিল কোড প্রণয়নের দরকার হয়নি। তাহলে কি বুঝতে হবে আসল এজেন্ডা অন্য?

হিন্দি প্রবচনে যেমন বলা হয় ‘হাতি কে খানে কে দাঁত অঊর দিখানে কা দাঁত অলগ’ অর্থাৎ হাতির চিবোনোর দাঁত আর দেখানোর দাঁত আলাদা।

এইসব পরিপ্রেক্ষিত মাথায় রেখেই সংবিধান প্রণেতাদের বিশেষ প্রতিনিধি বাবাসাহেব আম্বেদকর ভেবেছিলেন যে ইউনিফর্ম সিভিল কোড হওয়া উচিত পূর্ণতঃ ঐচ্ছিক, কোনো কেন্দ্রীয় সরকারের একতরফা চাপিয়ে দেওয়া নয়। তাই একে সংবিধানের অধ্যায় তিনে মৌলিক অধিকারের অন্তর্ভুক্ত না করে ডায়রেক্টিভ প্রিন্সিপল বা নীতি-নির্ধারক অধ্যায়ে আর্টিকল ৪৪-এ স্থান দেওয়া হয়েছে।

এখন দরকার সমস্ত ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে আলাপ-আলোচনা, একে অপরকে বোঝা। সৌহার্দ্যের বাতাবরণ নির্মাণ করা। এছাড়া একতরফা প্রচার, কোনো একটি সম্প্রদায়কে ক্রমাগত বেয়াড়া এবং অবুঝ বলে দাগিয়ে দেওয়ার ফল হবে বিষময়। তার কিছু নমুনা বর্তমান মণিপুরের সংকটে ফুটে উঠেছে।

মনে পড়ছে কবি রায়গুণাকর ভারতচন্দ্রের একটি পংক্তি - “নগর পুড়িলে দেবালয় কি এড়ায়”?

______________________________
● ল’ কমিশনের পাবলিক নোটিস।
● ১৪ জুন, 'দি হিন্দু'।
● 15 June, 'thewire.in'.
● ২৭ জুন, ২০২৩, 'দি হিন্দু'।
● 15 June, 'thewire.in'.
● ৬ জুলাই, 'দি হিন্দু'।
● ৪ জুলাই, ২০২৩, 'আউটলুক'।
● ৪ জুন, ২০২৩, 'আউটলুক'।
● ৩ জুলাই, ২০২৩, 'টাইমস্ অফ ইণ্ডিয়া'।
● ১ জুলাই, ২০২৩, 'ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস'।