আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ ষোড়শ সংখ্যা ● ১৬-৩১ আগস্ট, ২০২৩ ● ১-১৫ ভাদ্র, ১৪৩০

সমসাময়িক

আধিপত্যের আইন


সংসদের সাম্প্রতিক বাদল অধিবেশনের তুমুল হট্টগোলের সময় ২৫ জুলাই সংসদে জীববৈচিত্র্য সংশোধনী বিল (২০২১) ধ্বনি ভোটে পাশ করিয়ে নেওয়া হয়। যথারীতি অন্যান্য অনেক বিলের মতো খসড়া প্রস্তাব নিয়ে আলোচনার কোনো সুযোগ ছিল না।

এই শতাব্দীর সূচনাপর্বের কিছু পরে আমাদের দেশের বায়ো-ডাইভারসিটি অ্যাক্ট (২০০২) তৈরি হয়। দেশের জীববৈচিত্র্য সম্পদ রক্ষার ক্ষেত্রে আইনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশজুড়ে আলোচনা এবং পঞ্চায়েত স্তরের জীববৈচিত্র্য নথি তৈরির অভিজ্ঞতাকে একত্রিত করে অনেক আলাপ আলোচনার পর ২০০২-এ আইনটি তৈরি হয়েছিল। এখনকার সংশোধনীসমূহ ২০০২-এর আইনকে অত্যন্ত লঘু করেছে এবং দেশের প্রাকৃতিক জৈব সম্পদকে কার্যত বহুজাতিকদের হাতে তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে।

সদ্য পাশ হওয়া এই বিলে আনুষ্ঠানিকভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, “কোলাবোরেটিভ রিসার্চ প্রোজেক্টস”-এর নামে 'রাজ্য বায়ো-ডাইভারসিটি অথরিটি'-কে না জানিয়ে দেশের জৈব সম্পদ বাইরে পাচার করা যাবে। এক্ষেত্রে দেশে গবেষণা, পেটেন্টিং এবং বাণিজ্যিক ব্যবহার সহ জৈবিক সম্পদে আরও বিদেশি বিনিয়োগ আনা অন্যতম একটি লক্ষ্য। অন্যদিকে ২০০২-এর আইনের মূল বিষয় ছিল জৈবিক বৈচিত্র্যের সংরক্ষণ এবং সুস্থায়ী ব্যবহারের উপর গুরুত্বদান এবং স্থানীয় সম্প্রদায়ের জন্য উপযোগী ব্যবস্থা প্রণয়ন। আইনের নতুন সংশোধনীটি জৈবিক সম্পদ সংরক্ষণের বিরুদ্ধে বাণিজ্যিকীকরণের রাস্তা খুলে দিতে সহায়তা করবে।

জাপানের নাগোয়া শহরে আয়োজিত ২০১০-এর 'কনভেনশন অন বায়োলজিক্যাল ডাইভারসিটি' দশম সিওপি (কনফারেন্স অব পার্টিজ)-তে এবং পরে ২০২২ সালে কুনমিং-মন্ট্রিল ফ্রেমওয়ার্ক 'গ্লোবাল বায়োডাইভারসিটি ফ্রেমওয়ার্ক অ্যাক্সেস' এবং 'বেনিফিট শেয়ারিং' অর্থাৎ জীববৈচিত্র্য থেকে যে সুবিধা পাওয়া যায় তা এলাকার জনজাতিদের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। তা ছাড়াও বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য 'স্থানীয় জনজাতি সম্প্রদায়ের থেকে অগ্রিম সম্মতি’ নেওয়ারও সুপারিশ করা হয়েছিল। আমাদের দেশের ২০০২-এর আইনেও এই ব্যবস্থাগুলির উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল।

সংশোধনী বিলে এই ধারাটি সরিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং বেশ কয়েক ধরনের সংস্থাকে অনুমতি ছাড়া আমাদের জৈবিক সম্পদ ব্যবহার করায় ছাড় দেওয়া হয়েছে। কয়েকটি ভেষজ ওষুধ নির্মাতা সংস্থা, যাদের উৎপাদিত পণ্যের গুণমান পরীক্ষিত নয় অথচ বিজ্ঞাপনের দাপটে যাদের বাণিজ্যিক সাফল্য, সম্ভবতঃ তাদের সুবিধার্থেই এমন একটি সংশোধনী পাশ করিয়ে নেওয়া হল বলে অনেকে মনে করছেন। স্থানীয় জনজাতিদের ক্ষতিপূরণ না দিয়ে প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার এবং প্রাকৃতিক সম্পদ লুট করতে দেওয়ার জন্য এটি একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা বলে অনেকের ধারণা। এই সংশোধনীর বিরুদ্ধে অনেক সরকারি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে সোচ্চার হয়েছে। মূল আইনে স্থানীয় সম্প্রদায়ের জৈবিক সম্পদ ব্যবহারের অনুমতি দানের যে অধিকার ও ক্ষমতা ছিল তা এই সংশোধনীতে ছিনিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সংশোধনীর ৮ নম্বর ধারা (১) উপধারায় যা বলা হয়েছে তার সরমর্ম - “দেশ বা দেশের বাইরের, কোনো সংস্থা জৈবিক সম্পদের উপর কোনো গবেষণা বা তথ্যের উপর ভিত্তি করে যে কোনো আবিষ্কার, এর সাথে সম্পর্কিত পরম্পরাগত জ্ঞান (traditional knowledge) সহ, এই সংক্রান্ত জাতীয় মেধা-সম্পত্তি (intellectual property)-র অধিকারের জন্য সরাসরি জাতীয় জীববৈচিত্র্য কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমোদন গ্রহণ করবে।” অর্থাৎ পঞ্চায়েত বা পুরসভা স্তরের 'বায়ো-ডাইভারসিটি ম্যানেজমেন্ট কমিটি' বা রাজ্য স্তরের 'স্টেট বায়ো-ডাইভারসিটি বোর্ড'-এর আর কোনো ভূমিকা থাকবে না। এই ক্ষমতা কেবল 'ন্যাশনাল বায়ো-ডাইভারসিটি অথরিটি'-কে দেওয়া হয়েছে অর্থাৎ সমস্ত ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণের চেষ্টা হয়েছে। অর্থাৎ, প্রাকৃতিক জৈবসম্পদের লুটকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে আইনের এই পরিবর্তন।

অরণ্য সংরক্ষণ আইন (১৯৮০)-এর সংশোধনী বিলও একই দিনে (২৫ জুলাই, ২০২৩) ধ্বনি ভোটে লোকসভায় পাশ করানো হয়। দেশের বেশ কয়েকটি বনাঞ্চলকে সংরক্ষণের বাইরে আনা এই সংশোধনীর আসল উদ্দেশ্য। এই সংশোধনীতে অরণ্যের সুপ্রিম কোর্ট নির্ধারিত সংজ্ঞা পরিবর্তন করে বেশ কিছু নির্ধারিত অরণ্য ব্যক্তি মালিকানার আওতায় ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

স্টকহোম পরিবেশ সম্মেলনের (১৯৭২) সিদ্ধান্তে ভারত অন্যতম স্বাক্ষরকারী দেশ। সেই অবস্থানকে কার্যকর করার জন্য ১৯৮০-তে অরণ্য সংরক্ষণ আইন সংসদে পাশ করানো হয়। অরণ্য থেকে খনিজ সম্পদ এবং বনজ সম্পদ সংগ্রহের ধারাবাহিক প্রয়াসের বিরুদ্ধে অরণ্যবাসীদের নিরন্তর আন্দোলনও এই আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল।

সরকারি হিসাব বলছে, ১৯৫০ থেকে ১৯৮০ পর্যন্ত সময়সীমায় দেশের ৪৩ লক্ষ হেক্টর বনভূমি ধ্বংস করা হয়েছে। এর অর্ধেক পরিমাণ ধ্বংস হয়েছে শিল্প, খনি, জলবিদ্যুৎ, পুনর্বাসন ও কৃষির মতো উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য এবং বাকি অর্ধেক ধ্বংসের কারণ অরণ্যের বেআইনি দখল। ১৯৮০-র অরণ্য সংরক্ষণ আইন কার্যকরী হওয়ার পর অরণ্য ধ্বংসের পরিমাণ অনেক কমে যায়। ১৯৮০-র আগে অরণ্য ধ্বংসের গড় বার্ষিক হার ছিল ১,৪৩,০০০ হেক্টর। আইন প্রবর্তনের পর এই হার কমে দাঁড়ায় বার্ষিক ৪০,০০০ হেক্টর। কেন্দ্রীয় সরকার গঠিত ফরেস্ট অ্যাডভাইজরি কমিটি (এফএসি)-র অনুমোদন ব্যতিরেকে অরণ্যভূমিকে অন্য কোনোভাবে ব্যবহারের উপর এই আইনে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়।

অরণ্যের বাইরে বৃক্ষাচ্ছাদন বাদ দিলে বর্তমানে দেশের বনভূমির পরিমাণ দেশের মোট আয়তনের প্রায় ২৩ শতাংশ (ফরেস্ট সার্ভে অফ ইন্ডিয়া-২০২১)। 'ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচারাল অর্গানাইজেশন' এবং 'ওয়ার্ল্ড রিসোর্স ইনস্টিটিউট' যে স্যাটেলাইট সমীক্ষা করে, সেই সমীক্ষা অনুযায়ী আমাদের সরকারি হিসাবে দেখানো অরণ্যের পরিমাণ যে অনেক বেশি করে দেখানো হয়েছিল তার ইঙ্গিত রয়েছে। তা সত্ত্বেও অরণ্য সৃজনের মাধ্যমে ২০৭০ সালের মধ্যে দেশে ‘নেট জিরো’ নির্গমন (বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে পরিমাণ কার্বনের নির্গমন ঘটবে তা শোষণ করবে অরণ্যভূমি) এক অলীক লক্ষ্যমাত্রা সরকার ঘোষণা করেছে।

জুলাই মাসে লোকসভায় পাস করা সংশোধনীতে যে বনাঞ্চলগুলি সংরক্ষণের আওতার বাইরে রাখা হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে -

১। দেশের আন্তর্জাতিক সীমানা থেকে দেশের ভিতর ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে অরণ্যভূমি এই সংরক্ষণের আওতার বাইরে রাখা হয়েছে। এই ছাড়ের আওতায় পড়বে সম্পূর্ণ উত্তর-পূর্ব ভারত, হিমালয়ের বিভিন্ন অংশের বনাঞ্চল এবং সুন্দরবন। উত্তর-পূর্ব ভারত এবং হিমালয়ের বনাঞ্চল বিশ্বের দুটি গুরুত্বপূর্ণ জীববৈচিত্র্য হটস্পট। সারা পৃথিবীতে ৩৬টি জীববৈচিত্র্যের হটস্পট চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে ভারতে চারটি জীববৈচিত্র্যের হটস্পট রয়েছে। এই হটস্পটগুলি চিহ্নিত হয়েছে উচ্চ প্রজাতি বৈচিত্র্য, এন্ডেমিক প্রজাতির সংখ্যা এবং এগুলির ক্ষয় হয়ে যাওয়ার প্রবণতা ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে। সুন্দরবন পৃথিবীর বৃহত্তম বাদাবন। অর্থাৎ এই তিনটি অঞ্চলের বনাঞ্চল পরিবেশ রক্ষার দিক দিয়ে অত্যন্ত সংবেদনশীল। নতুন সংশোধনী আইনে পরিণত হয়ে যাওয়ার পর সংরক্ষিত বনাঞ্চলে বেসরকারি এবং সরকারি যৌথ উদ্যোগে নির্মাণ কাজ করা যাবে।

২। একইভাবে নিরাপত্তার নামে দেশের যেকোনো প্রান্তে ৫ থেকে ১০ হেক্টর পর্যন্ত বনভূমি অধিগ্রহণ করে অরণ্য ধ্বংস করার ক্ষমতা এই সংশোধনীতে যুক্ত করা হয়েছে। এখানে বলা আছে যে, বাম-চরমপন্থীদের শায়েস্তা করতে এই ব্যবস্থা সরকার যে কোনো সময়ে নিতে পারে।

এই সংশোধনী বিলে জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমিত করার জন্য অরণ্য-ভিত্তিক কার্বন সিঙ্ক (অরণ্যে কার্বন ভাণ্ডার) তৈরি করার কথাও বলা হয়েছে। এই কারণে ক্ষতিপূরণমূলক বনায়ন (compensatory afforestation)-এর ব্যবস্থার কথাও উচ্চারিত হয়েছে। প্রাকৃতিক অরণ্যের কার্বন শোষণের ক্ষমতা বৃক্ষরোপণের মধ্য দিয়ে প্রতিস্থাপিত করা যায় না। একটি প্রাচীন গাছ কেটে ফেলে তার জায়গায় পাঁচটি চারা রোপণ করলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখা সম্ভব নয়। এছাড়াও প্রাকৃতিক অরণ্যের অনেক ধরনের বাস্তুতান্ত্রিক উপযোগিতা রয়েছে। এগুলিকে অস্বীকার করে কেবল কার্বন শোষণের উপর গুরুত্ব দেওয়া নির্বোধের কর্ম।

এই সংশোধনীর মাধ্যমে যে সমস্ত অরণ্য সংরক্ষণের আওতার বাইরে চলে যাবে সেগুলিতে অরণ্য অধিকার আইন (২০০৬)-এর হাল কী হবে সে বিষয়ে সরকার নীরব।

অরণ্য ও অন্যান্য জৈবিক সম্পদ কর্পোরেট ও বহুজাতিকদের সামনে উন্মুক্ত করে দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের অবাধ লুটের ব্যবস্থা করে দেওয়া কোনও কঠিন কাজ নয়। এর সঙ্গে যুক্ত আছে জৈবিক সম্পদের সাথে সম্পর্কিত জ্ঞান বা মেধা সম্পত্তির লুট। সম্প্রতি রাষ্ট্রপুঞ্জ স্পষ্টভাবে বলেছে যে, জীববৈচিত্র্যের লুণ্ঠন আমাদের মূল্যবান জেনেটিক বৈচিত্র্যের সামনে এক চ্যালেঞ্জ এবং এই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা না করতে পারলে আমাদের খাদ্য, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিপন্ন হবে।

সংসদে সংখ্যাধিক্যের দাপটে আইন পাশ করিয়ে আধিপত্য কায়েম করাই যায়। কিন্তু প্রকৃতিকে কি আইনের বাঁধনে শৃঙ্খলিত করা যায়?