আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ ষোড়শ সংখ্যা ● ১৬-৩১ আগস্ট, ২০২৩ ● ১-১৫ ভাদ্র, ১৪৩০
সমসাময়িক
বিভাজিত দেশ
স্বাধীনতার ৭৬তম বর্ষে দেশের সার্বিক ছবি দেখে কারো মনে হতেই পারে যে বিবিধের মাঝে মিলন নয়, যেন এই দেশের মানুষ বিভিন্নভাবে বিভাজিত। বিগত ৯ বছর ধরে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ ও তার রাজনৈতিক সংগঠন ভারতীয় জনতা পার্টি গোটা দেশ জুড়ে যে রাজনীতির ভাষ্য নির্মাণ করেছে আজ তার বিষবাষ্প গোটা দেশের মননকে যে এক ঘৃণাসর্বস্বতার স্তরে নামিয়ে আনতে পেরেছে একথা আজ কে অস্বীকার করবেন। রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের তীব্র স্পৃহায় যে দানবকে এরা বোতল থেকে বার করে ফেলেছে তাকে আজ ফের বোতলবন্দি করা বোধহয় তাদেরও অসাধ্য। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে তাকালে দেখা যাচ্ছে যে বিভিন্ন রাজ্যে মানুষ কোথাও জাতির নামে বা কোথাও ধর্মের নামে একে অপরের প্রাণনাশের উদ্দেশ্যে দাঙ্গা সংগঠিত করছে। ধর্মীয় সংখ্যাগুরু চোখ রাঙিয়ে সংখ্যালঘুকে বেঁচে থাকার নিয়ম বাতলে দিচ্ছে, একটা গোটা প্রজন্ম কেবল ঘৃণা আর আতঙ্কে বড় হয়ে উঠছে। স্বাধীনতার ৭৫ বছর পার করে এ কোন ভারতবর্ষ আমরা নির্মাণ করছি?
বিগত তিন মাস ধরে দেশের উত্তর-পূর্ব প্রান্তে মণিপুর রাজ্যটি আজ জাতিদাঙ্গায় ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। কিন্তু দেশের প্রধানমন্ত্রী একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি। অবশেষে সংসদে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো 'অনাস্থা প্রস্তাব' আনার পর বাধ্য হয়ে সংসদে তিনি এ বিষয়ে মুখ খুললেন ও আমরা জানলাম এ ঘটনার দায় দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর। স্বাধীনতার ৭৬তম বর্ষে এসে যে দেশের চতুর্দশতম প্রধানমন্ত্রী দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রীর ঘাড়েই দায় ঠেলেন, সেই দেশে প্রশাসন যে ঠুঁটো জগন্নাথই হবে এহ বাহ্য। নাহলে দেশের রাজধানীর উপকণ্ঠে দাঙ্গা হবে আর নিশ্চেষ্ট প্রশাসন পরে আক্রান্তদেরকেই উচ্ছেদ করতে নামবে কেন? নুহ থেকে ইমফল, ঘৃণার হিংসায় পুড়ে যাওয়া এই ভারতবর্ষই বিজেপি তথা আরএসএসের ঐতিহ্য।
গত ৩১ জুলাই, হরিয়ানার নুহতে বজরং দল ও তাদের সহযোগীরা একটি তথাকথিত ধর্মীয় শোভাযাত্রা আয়োজন করে। উল্লেখযোগ্যভাবে সেই যাত্রা মুসলিম প্রধান এলাকাতে পৌঁছানোর পরেই গোলমালের সূত্রপাত হয় এবং পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে বিগত ৭ই আগস্ট অবধি নুহ, পার্শ্ববর্তী গুরগাঁও ও সোহনা অঞ্চলেও মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। অন্তত ৭ জন মৃত এবং আহত দুই শতাধিক। তাৎপর্যপূর্ণ, এই গোটা অশান্তির সময় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মনোহরলাল খট্টর সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেন যে সরকারের পক্ষে সবাইকে নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব নয়। এও এক নতুন অভিজ্ঞতা নয় কি? খবরে এটাও প্রকাশ যে এই দাঙ্গায় পশ্চিমবঙ্গের মূলত মুসলিম পরিযায়ী শ্রমিকরাও আক্রান্ত। তারা তাদের রুজি রুটি হারিয়ে আপাতত অন্যত্র জীবন নিয়ে সরে যেতে চাইছেন। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য নিশ্চুপ। রাজ্যের শাষকদলেরও এই নিয়ে কোন মাথাব্যথা নেই।
হরিয়ানার এই দাঙ্গার সূত্রপাত অত্যন্ত পরিকল্পিত। বজরং দলের নেতা, কুখ্যাত মনু মানেসর, যে একজন স্বঘোষিত গোরক্ষক এবং যার বিরুদ্ধে দুই মুসলিম যুবক নাসের ও জুনেদকে হত্যার অভিযোগ রয়েছে, প্রকাশ্যেই ঘোষণা করেছিল যে এই শোভাযাত্রায় সে নিজে উপস্থিত থাকবে। অবশ্যই তার উপস্থিতি কোন ধর্মীয় আবেগে নয়, বরং ওই অঞ্চলের মুসলিম জনগণকে সন্ত্রস্ত করতে তা বলাই বাহুল্য। শোভাযাত্রার দু'দিন আগে থেকেই সামাজিক মাধ্যমে বিভিন্ন উত্তেজক ও প্ররোচনামূলক ভিডিও প্রচার যে হয়েছে তা প্রমাণিত। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল, এই অপরাধীকে ধরতে পুলিশের কোন আগ্রহ ছিল না। তাই এলাকায় উত্তেজনা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা থাকলেও পুলিশ কোনরকম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা ওইদিন নেয়নি। অথচ দাঙ্গা ঘটার পরে সেই পুলিশ ও প্রশাসন স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আইন শৃঙ্খলা রক্ষার নামে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের ঘরবাড়ি আর দোকান বুলডোজার দিয়ে ভেঙে চলে। পরিস্থিতি এমনই যে পাঞ্জাব-হরিয়ানা হাইকোর্টকে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে এই একতরফা উচ্ছেদ বন্ধ করার জন্য। আদালত এই প্রশ্ন রেখেছে যে সরকার কি একটা নির্দিষ্ট সম্প্রদায়কে সন্ত্রস্ত করতে চাইছে? একটা নির্বাচিত সরকার যে এহেন নির্লজ্জ্ব সাম্প্রদায়িক পক্ষপাতিত্ব করতে পারে, বিজেপির শাসনকাল ছাড়া তা জানার উপায় ছিলনা।
ঘটনাপ্রসঙ্গে কি মনে পড়ে না, ২০০২ সালে এমনই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় যখন গুজরাট দীর্ন, সেই সময় প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে বলেছিলেন রাজধর্ম পালন করতে। সেই নরেন্দ্র মোদি আজ রাজদণ্ড হাতে নিয়ে রাজার অভিনয় করছেন বটে, কিন্তু নিজে তো রাজধর্ম ভুলেইছেন, এমনকি হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রীকে রাজধর্ম পালন করতে বলার সাহসটুকুও দেখাতে পারেননি। বিজেপিতে বাজপেয়ী আজ অতীত। এখন শুধু 'মোদি মোদি' রবে দাঙ্গাকারীদের উল্লাস। সংখ্যাগুরু মানুষের মনে আজ ঘৃণার রাজনীতি কতটা মজবুত বোঝা যায় যখন চলন্ত ট্রেনে কর্তব্যরত পুলিশকর্মী নাম ডেকে বেছে বেছে মুসলিম যাত্রীদের গুলি করে হত্যা করে আর বলতে থাকে যে "দেশে থাকতে গেলে মোদি আর যোগীকে ভোট দিতে হবে"। আজ তবু দেশে শান্তি, শ্মশানের শান্তি। আর সেই বধ্যভূমিতে কেবল উন্মত্ত হত্যাকারীদের দাপাদাপি। এই তবে ছিল স্বাধীন ভারতবর্ষের স্বপ্ন? যে বিজেপি-আরএসএস আজ স্বাধীনতা সংগ্রামীদের দখল করতে উদগ্রীব তাঁদের স্বপ্নটাই আজ তো চিতায় জ্বলছে।
২০২৪-এর লোকসভায় পুনরায় জিতে আসার স্বপ্ন নরেন্দ্র মোদি দেখছেন। হিন্দু হৃদয়-সম্রাট হতেও তাঁর আপত্তি নেই। ভারতের সংবিধানকে ভেঙে চুরমার করতে গেলে, ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শকে জলাঞ্জলি দিয়ে সংখ্যাগুরুর আধিপত্যবাদের রাজনীতি, যা তারা শিখেছে মুসোলিনি আর হিটলারের কাছে, প্রতিষ্ঠা করতে গেলে তাদের দেশের শাসনক্ষমতা চাই বৈকি। তাই তারা সেটাই করছে যা তারা শিখেছে ফ্যাসিবাদীদের চরণতলে বসে। দেশে মূল্যবৃদ্ধি আজ সহনসীমার উপরে, বেকারত্ব সর্বাধিক, অর্থনীতি নিম্নমুখী কিন্তু সেসব কবেই বা ফ্যাসিবাদীদের রাজনীতির লক্ষ্যবস্তু ছিল। নির্বাচনে জিততে তাদের চাই কেবল এক শত্রুর নির্মাণ যার বিরুদ্ধে কেবল লড়াই করে যাওয়ার অভিনয় আর সেই সুবাদে প্রশ্নহীন ক্ষমতায় থাকার ছাড়পত্র। এটাই আরএসএস-বিজেপির রাজনীতি। তাই বাবরি মসজিদ ভেঙে রামমন্দির বানানোর জিগির, দেশেরই এক অংশের মানুষের বিরুদ্ধে সংখ্যাগুরু মানুষকে ক্ষেপিয়ে তোলা। উগ্র মুসলিম বিরোধিতার কারণ এটাই। আর তাই যে নুহতে গান্ধীজি স্বয়ং গিয়ে মুসলিম মানুষদের আশ্বস্ত করে থাকতে বলেছিলেন, গান্ধীজির হত্যাকারী নাথুরামের দল আজ সেই নুহ জেলাকেই কেটে টুকরো করে অন্য জেলায় মিশিয়ে দেওয়ার দাবি তুলছে। খাপ পঞ্চায়েত বসিয়ে মুসলিমদের সামাজিক বয়কটের ডাক দেওয়া হচ্ছে। আর সেই উন্মত্ততায় হিন্দুরা ভুলে যাচ্ছেন নোটবন্দীর বিভীষিকা, মূল্যবৃদ্ধির আঁচ।
এই পূর্বপরিকল্পিত দাঙ্গা কেবল মুসলিম মানুষদের সন্ত্রস্ত করতে নয়, নির্বাচনী রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করার এক কৌশল। আজকে গোটা আসাম জুড়ে লোকসভা আসনের পুনর্বন্টন থেকে পরিষ্কার যে মুসলিম জনগণের ভোটে যেন বিজেপির কোন আসনের ফলাফল নির্ধারিত না হয়। আজকে নুহতে এই অশান্তির পিছনেও একই লক্ষ্য। মুসলিম প্রধান জেলাতে সেভাবেই তারা ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর বিভাজন চাইছে যাতে কেবল হিন্দু জনগোষ্ঠীর মানুষেরই প্রাধান্য থাকে। আর তার সাথে উপরি পাওনা গোটা দেশজুড়ে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির চর্চা, যে তীব্র মেরুকরণে বিজেপির নির্বাচনী লাভ হবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় বিরোধীদের মঞ্চ 'ইন্ডিয়া' সংসদে এই বিষয়ে বিস্তর গলা তুললেও ময়দানের রাজনীতিতে তারা এখনও পিছিয়ে। মণিপুরে তারা পৌঁছলেন হিংসা শুরু হওয়ার ৩ মাস পর। কিন্তু নুহতে পৌঁছে, শান্তি ফেরানোর দাবিতে কোন আন্দোলন তারা এখনো গড়ে তুলতে পারলেন না। আগামী নির্বাচনে যদি তারা সত্যিই বিজেপিকে হারাতে সংকল্পবদ্ধ হন, তাহলে এখনই তাদের ময়দানের রাজনীতিতেও বিজেপিকে পরাস্ত করতে হবে। বিজেপির নির্মিত রাজনীতিকে এড়িয়ে তা হবে না। তারা মূল্যবৃদ্ধির কথা তুলবেন, অর্থনীতির কথা তুলবেন, কাজের কথা তুলবেন কিন্তু তার আগে বিজেপি-আরএসএস-এর এই দাঙ্গার রাজনীতিকে ময়দানে নেমেই হারাতে হবে। তবেই তারা শাসককে নিজের রাজনীতির আঙিনায় আনতে পারবেন। এ সত্য তারা যত তাড়াতাড়ি বোঝেন ততই ভালো, নয়ত যে ধর্মনিরপেক্ষ উদার ভারতের কথা তারা বলছেন তার অস্তিত্বই আর থাকবে না।