আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ পঞ্চদশ সংখ্যা ● ১-১৫ আগস্ট, ২০২৩ ● ১৬-৩২ শ্রাবণ, ১৪৩০

প্রবন্ধ

প্লাবিত যমুনা

মালবী গুপ্ত


হিমালয়ের যমুনোত্রী হিমবাহ থেকে যার জন্ম। তারপর উত্তরাখন্ড, হিমাচল, হরিয়ানা, দিল্লি, উত্তরপ্রদেশের পাহাড়, সমতল হয়ে এলাহাবাদ তথা প্রয়াগরাজের ত্রিবেনীতে গঙ্গার সঙ্গে যার মিলন। সেই যমুনাই ভারতের দীর্ঘতম ও গঙ্গার প্রধান উপনদী। যার দীর্ঘ ১,৩৭৬ কিলোমিটারের যাত্রাপথে হিন্দুদের ধর্মীয় সংস্কৃতির সঙ্গে সে যেমন ওতপ্রোত জড়িত, তেমনি ভারতের ইতিহাসের মধ্য ও আধুনিক যুগে সুলতান ও মুঘল বাদশাদের বহু উত্থান পতনেরও সাক্ষী সে। সাক্ষী সে বিগত কয়েক দশকে স্বাধীন ভারতের রাজধানী দিল্লির মসনদে বহু ক্ষমতা হস্তান্তরেরও। তবে অতীতে যমুনার সঙ্গে দিল্লির যে সম্পর্ক ছিল, আজ আর তেমনটা নেই। হয়তো থাকার কথাও নয়। কিন্তু গত মধ্য জুলাইয়ে সেই নদীর বন্যা অন্তত কয়েক দিনের জন্য যমুনা তীরবর্তী দিল্লির পূর্বের ল্যান্ডস্কেপটিকে হঠাৎই যেন খানিক ফিরিয়ে এনেছিল।

ঊনবিংশ শতাব্দীতে আঁকা বহু ছবিতে যেমনটা দেখা যায় - একদিকে রেড ফোর্ট আর অন্যদিকে সালিমগড় ফোর্ট, মাঝখান দিয়ে বয়ে চলেছে শান্তশিষ্ট যমুনা। অবশ্য বেশ কয়েক যুগ ধরেই সেই ল্যান্ডস্কেপটি ধীরে ধীরে বদলে গেছে।তবে যমুনা নদীর অকস্মাৎ ফুলে ওঠা জলে পুরোনো সেই ছবিটি যেন গত ১৩ জুলাই এক লহমায় সজীব হয়ে উঠল।এমনিতে ১৯২৪ থেকে যমুনার বন্যায় দিল্লি অনেকবারই প্লাবিত হয়েছে। দিল্লির পাশে যমুনার জলতলের বিপদসীমা ছিল ২০৫.৩৩ মিটার। কিন্তু ১৯৭৮-এর বন্যায় তা ছুঁয়েছিল ২০৭.৪৯ মিটার। যেবারের বন্যায় শহরের প্রায় অর্ধেকই জলমগ্ন হয়েছিল। এবার সেই রেকর্ডও ভেঙে সেদিন যমুনার জলতল পৌঁছে গিয়েছিল ২০৮.৬৬ মিটার উচ্চতায়। ফলে রিং রোড জলমগ্ন হওয়ায় রেড ফোর্ট ও সালিমগড় ফোর্টের দেওয়াল ছুঁয়ে ফেলল যমুনা, এক সময়ে যেখানে ছিল তার স্বাভাবিক প্রবাহ। সে পৌঁছে গেল কাশ্মীরি গেট, সিভিল লাইন, আইটিও, রাজঘাট ইত্যাদি দিল্লির নানা গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে।

প্লাবিত অঞ্চল থেকে ২৬ হাজারেরও বেশি মানুষকে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যেতে হয়। যাদের মধ্যে ২১,৫০৪ জন অস্থায়ী শিবিরে আশ্রয় নেন। কিন্তু মনে হতেই পারে, দিল্লি তো আমাদের কলকাতার মতো পরিকল্পনাহীন, আড়ে বহরে যেমন তেমন বেড়ে ওঠা জীর্ণ প্রাচীন নগরী নয়। যেখানে প্রায় প্রতি বর্ষায় কিছু কিছু রাস্তায় হাঁটু, কোমর পর্যন্ত জল জমে। ডিঙি নৌকাও চলে। বরং দিল্লি সুপরিকল্পিত, সুশোভিত ঝাঁ চকচকে নগর। যার শরীর থেকে সদা বিচ্ছুরিত হচ্ছে গ্ল্যামারের মহিমা। যা আমাদের যারপরনাই মুগ্ধ করে চলেছে। সেই কেতাদুরস্ত শহরে কিনা দেশের অন্যতম দূষিত নদীর পুতিগন্ধময় নোংরা জলের ঝাপট এসে লাগল! সেই জলের তলায় কি না ডুবে যেতে লাগল রাজধানীর ঐতিহ্যপূর্ণ দর্শনীয় স্থানগুলি। ওদিকে আগ্রায় বিশ্ব ঐতিহ্যস্থল তাজমহলেরও দেওয়াল ছুঁয়ে ফেলল শিল্প বর্জ্যের দূষণে আকীর্ণ যমুনার জল!

সত্য যে, নদীতে বন্যা হওয়া কোনো অপ্রাকৃত ঘটনা নয়। বরং একদা অনেক ক্ষেত্রেই তাকে আশীর্বাদ মনে করা হতো। কারণ নদীর দু’কুল ছাপিয়ে যাওয়া জলে পাহাড়ি পথে বয়ে আনা অত্যন্ত পুষ্টিসমৃদ্ধ পলি থাকত। যা আগামীদিনে চাষের ক্ষেতে উর্বরতা বাড়িয়ে, বাড়তি ফলন ফলিয়ে কৃষকের মুখে হাসি ফোটাত। কিন্তু দিন বদলের সঙ্গে সঙ্গে কোথাও বিদ্যুৎ চাহিদা, কোথাও পানীয় জল, কোথাও সেচের চাহিদা মেটাতে পদে পদে অন্যান্য নদীর মতোই যমুনাতে জলাধার, বাঁধ তৈরি করে তার গতিকে একদিকে রুদ্ধ করা হতে লাগল। অপরদিকে গঙ্গার মতোই তার পবিত্রতা নিয়ে নিঃসংশয় লক্ষ লক্ষ হিন্দু পুন্যার্থীকে ত্রিবেনীতে আয়োজিত প্রতি ১২ বছর অন্তর কুম্ভমেলা আকর্ষণ করলেও, তাকে দূষণে দূষণে ভারাক্রান্ত করে তোলা হল।

পবিত্র নদী হিসেবে গণ্য হয়েও রাজধানী দিল্লি সহ বহু নগরের দূষিত বর্জ্যের ভার বহন করতে করতে যমুনা এখন ভারতের অন্যতম দূষিত নদী। তার দীর্ঘ প্রবাহের প্লাবনভূমিতে অবৈধ নির্মাণ, যথেচ্ছ দখলদারি পদে পদে যমুনার গতি রুদ্ধ করেছে। তার ওপর শহরের নিকাশি নালাও অনেক জায়গায় বন্ধ। ফলে অল্প সময়ে ভারী বর্ষণ, আর হরিয়ানার হাতিকুন্দ জলাধার থেকে ছিল অতিরিক্ত জল ছাড়া। যা আগের বছরগুলির তুলনায় অনেক কম সময়ে দিল্লির যমুনায় পৌঁছে যায়। এবং তার রেকর্ড পরিমাণ জলের ধাক্কায় রাজধানীতে শেষাবধি এমন অকস্মাৎ বন্যা বিপর্যয়।

তবে আশ্চর্য লাগে এই ভেবে, যে নদী দেশের প্রায় ৫ কোটি ৭০ লক্ষ মানুষের পানীয় ও অন্যান্য ব্যবহারে জলের চাহিদা মেটায়। কৃষিতে সেচের চাহিদা মেটায়, তার স্বাস্থ্যের প্রতি রাজ্যসরকারগুলি ও কেন্দ্র এত উদাসীন কেন? দেখা যাচ্ছে, তার ধারে গড়ে ওঠা শহরগুলির বিপুল অপরিশোধিত নিকাশি বর্জ্য গিয়ে মিশছে যমুনার জলে। হরিয়ানা, দিল্লি ও উত্তরপ্রদেশের কলকারখানা থেকে যথেচ্ছ শিল্প বর্জ্য নিয়ে ফেলা হচ্ছে এই নদীতে। যমুনাকে কোথাও কোথাও দেখে মনে হয় নিকাশি নালা যেন। তার ওপর ওয়াজিরাবাদ থেকে ওখলা - মাত্র এই ২২ কিমি যমুনা নদীপথের ওপর ২০টিরও বেশি ব্রিজ নির্মাণ তার প্রবাহকে সতত বাধা দিচ্ছে। আর জমে ওঠা পলিতে নদীর বুক কেবলই উঁচু হয়ে হয়ে তার জলধারণের ক্ষমতাকেও কেড়ে নিচ্ছে।

আশ্চর্য লাগে এই ভেবেও যে, সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পগুলিই বা কি করে এমন ত্রুটিপূর্ণ হয়? অদূর ভবিষ্যতেই যে ত্রুটির ধাক্কা লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনকে এমন বিপদ সম্মুখীন করে তোলে? রাজ্য ও দেশের সরকার কি জানে না, একটি নদীর প্লাবনভূমি সেই নদী ও তার চারপাশের জনপদের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ? সে যে আদৌ খালি জায়গা নয়, নদীর চেয়ে নদীর প্লাবনভূমি যে তার অপরিসীম জীববৈচিত্র্যের আকর, জানে না তারা?

সম্প্রতি দিল্লি ডেভেলাপমেন্ট অথারিটি’র প্রাক্তন কমিশনার এ. কে. জৈন ‘এনডিটিভি’কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ১৯৬২ সালে দিল্লির প্রথম উন্নয়ন পরিকল্পনায় যমুনার প্লাবনভূমিকে ওই ‘খালি জায়গা’ হিসেবে দেখার ভুলটিই করা হয়েছিল। যার মাশুল গুনতে হচ্ছে। কারণ যমুনার সেই প্লাবনভূমিতেই দিল্লির রিং রোড সহ পাওয়ার স্টেশন, ইন্দিরা গান্ধী ইনডোর স্টেডিয়াম, দিল্লি সেক্রেটারিয়েট, দিল্লি ট্রান্সপোরট করপোরেশন ইত্যাদি গড়ে ওঠে। যদিও সেই সময় অ্যাক্টিভিস্টরা এর প্রতিবাদ জানিয়ে পাখিদের জন্য পার্ক, বোটানিকাল পার্ক, লেক ইত্যাদি গড়ে তোলার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু সমাজকর্মীদের কথায় কে আর কবে কর্ণপাত করেছে? পরিবেশবিদরা বলছেন, গত চার দশকে ওই প্লাবনভূমির ৪০ শতাংশই ধ্বংস হয়ে গেছে।

অথচ এক সময় যমুনা এতটাই চওড়া ছিল যে, সে রেড ফোর্টের দেওয়াল ছুঁয়ে যেত। গত কয়েক দশক ধরে তার ডাইনে বাঁয়ে বাঁধ দিয়ে দিয়ে তাকে সঙ্কুচিত করা হয়েছে। আর তার স্বাভাবিক প্রবাহের পথ আটকে গড়ে উঠেছে বহু কলোনি, যেখানে হাজার হাজার মানুষের বাস। গড়ে উঠেছে সরকারি বিল্ডিং, রাস্তাঘাট। আসলে নদীর প্রতি এমন নির্মমতা, এমন নিষ্ঠুরতার কোনো জবাবদিহি যে কাউকে করতে হয় না। যদিও এইসব অপকর্মই বেআইনি ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তাতে কী? আমাদের দেশে অসংখ্য আইন-কানুন তো কেবল তাকে তুলে রাখার জন্য। তার প্রয়োগে সংশ্লিষ্ট দফতর, অফিসার কারো তেমন মাথাব্যথা নেই। তাছাড়া সরকারই যখন নিয়ম ভাঙে তখন কে চাইবে জবাবদিহি?

সত্য যে দু’চার বছরে নয়, দশকের পর দশক ধরে আরো অসংখ্য নদীর মতো যমুনার সঙ্গেও এমন অন্যায় অবিচার হয়ে চলেছে। তবে এমনটাই বোধহয় হওয়ার কথা। কারণ একদিকে ভোট ব্যাঙ্ক। রাজনৈতিক দলগুলির ছত্রছায়াতেই নদীর গতি আটকে গড়ে ওঠে অবৈধ কলোনি। আর একদিকে আমাদের চোখে আঁটা যে উন্নয়নের ম্যাজিক চশমা, যার দৌলতে রকেট গতিতে সব বদলে ফেলার নেশায় মেতেছি আমরা। যার অবশ্যম্ভাবী কর্মফল উত্তর ভারতের নানা রাজ্যে আমাদের ক্রমাগত ধাক্কা দিয়ে যাচ্ছে।

আসলে সভ্যতাকে টিকিয়ে রাখতে হলে যে দেশের নদীগুলির প্রবহমানতাকে অটুট ও বাধাহীন রাখতে হয়। তাকে ডাম্পিং গ্রাউন্ডে পরিণত করা যায় না। সেকথা আমরা বুঝতেই চাই না। দেশের সরকারও যে আদৌ এই ব্যাপারে সিরিয়াস বা দায়িত্বশীল নয়, তা তাদের প্রতিনিয়ত কাজের ধারা প্রমাণ করে দিচ্ছে। যেমন কয়েক বছর আগে যমুনা নদীকে পরিষ্কার করার জন্য অর্থ বরাদ্দ হলেও সেই কাজে কোনো পদক্ষেপই দৃষ্টি গোচর হল না কেন? সেই টাকা কী ভাবেই বা দুর্নীতির কৃষ্ণ গহ্বরে অদৃশ্য হয়ে গেল?

সত্য যে, নদী কথা বলতে পারে না। সত্য যে, তার ওপর ঘটমান অত্যাচারের প্রতিবাদ করতে পারে না। যমুনাও পারেনি। কোনো প্রতিশোধও সে নিতে পারেনি। শুধু দশকের পর দশক ধরে তার বুকে জমে ওঠা যন্ত্রণাকে সে যেন মুক্তি দিতে চেয়েছে। এবং সেই যন্ত্রণার অশ্রু কেবল যমুনার বুকই নয়, তার দু’কুল ছাপিয়ে ভাসিয়ে দিয়েছে দেশের রাজধানীকেও। কিন্তু মুশকিল হল, যমুনার সেই যন্ত্রণার ঢেউ বন্যা ও ধসে প্রবল বিপর্যয়গ্রস্ত উত্তরাখন্ড বা হিমাচল প্রদেশের মতো কেবল আশ্রয়হীন, সম্বলহীন সাধারণ মানুষের জীবনেই এসে লাগছে। তাদের আরো অসহায় ও বিপন্ন করে তুলছে। এবং এ কথাও আমরা জানি যে, যমুনার জল যমুনায় ফিরে গেলে সবই আবার যেমন চলছিল তেমনই চলবে। কারণ ওই উন্নয়নের ম্যাজিক চশমাটি যে আর কিছুতেই চোখ থেকে খোলা যাবে না। তা যত মুষ্ঠিমেয় মানুষের জন্যই হোক না কেন। তা আদতে যত বিধ্বংসীই হোক না কেন।


ঋণ স্বীকারঃ

• আউটলুকইন্ডিয়া.কম

• ইন্ডিয়ানএক্সপ্রেস.কম