আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ পঞ্চদশ সংখ্যা ● ১-১৫ আগস্ট, ২০২৩ ● ১৬-৩২ শ্রাবণ, ১৪৩০
প্রবন্ধ
ভারতে অভিন্ন দেওয়ানি বিধির এখন কী প্রয়োজন?
আলবিনা শাকিল ও প্রসেনজিৎ বসু
এই বছরের ১৪ই জুন কেন্দ্রের ২২তম আইন কমিশন একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি বা ইউনিফর্ম সিভিল কোড-এর বিষয়ে জনসাধারণ এবং 'স্বীকৃত' ধর্মীয় সংগঠনগুলির থেকে মতামত জানতে চায়। এই বিজ্ঞপ্তিতেই উল্লিখিত যে ২১তম আইন কমিশন ২০১৬ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে একাধিক বিজ্ঞপ্তি, আবেদন ও প্রশ্নমালা জারি করে জনগণের মতামত সংগ্রহ করে ৩১শে আগস্ট, ২০১৮ তারিখে "পারিবারিক আইনের সংস্কার"-এর উপর ১৮২ পাতার একটি বিস্তারিত আলোচনাপত্র (কন্সালটেশন পেপার) প্রকাশ করে।
২২তম আইন কমিশন তাদের সাম্প্রতিক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে যে ২১তম আইন কমিশনের আলোচনাপত্রটি যেহেতু তিন বছরের বেশি পুরোনো হয়ে গেছে তাই অভিন্ন দেওয়ানি বিধির বিষয়ে নতুন করে তারা আলোচনা চাইছে। এই প্রসঙ্গে তারা কিছু আদালতের রায়ের কথাও উল্লেখ করেছে। কিন্তু অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নিয়ে বিচার ব্যবস্থার মধ্যেও কম মতানৈক্য নেই, আদালতের বিভিন্ন রায়ে এই বিষয়ে আলাদা আলাদা মত দেওয়া রয়েছে। তাহলে এখন আবার নতুন করে মতামত সংগ্রহ করা হচ্ছে কেন?
২১তম আইন কমিশনের সুপারিশ
২১তম আইন কমিশনের আলোচনাপত্রে বেশ কয়েকটি তাৎপর্যপূর্ণ পর্যবেক্ষণ এবং সুপারিশ ছিলঃ
• আলোচনাপত্রে স্পষ্ট করে বলা হয়েছিল যে, "...এই পর্যায়ে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নিষ্প্রয়োজন ও অবাঞ্ছিত"।
• আলোচনাপত্রে আরও বলা হয় যে, ন্যায্যতার সাথে আইনব্যবস্থা পরিচালনা করার জন্য ধর্মপালনের স্বাধীনতা এবং সকলের সমান অধিকারকে একে অপরের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হতে হবে - এই দুটিই মূল্যবান অধিকার যা সংবিধান দ্বারা প্রতিষ্ঠিত এবং নারীদের দুটির মধ্যে একটিকে বেছে নিতে বলা অসমীচীন।
• এই বোঝাপড়ার ভিত্তিতে ২১তম আইন কমিশন আইনসভাগুলিকে পরামর্শ দেয় যে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে একই ধরণের সাম্য আনার পরিবর্তে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের অভ্যন্তরে নারী-পুরুষের মধ্যে সাম্য আনায় সচেষ্ট হওয়া দরকার। তার জন্য বর্তমান পর্যায়ে প্রয়োজনীয়তার ভিত্তিতে একটু একটু করে ব্যক্তিগত আইনের সংশোধন করা উচিৎ।
• ২১তম আইন কমিশনের আলোচনাপত্রে এটাও উল্লিখিত যে সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলে অনেক রাজ্যের জনজাতিদের সংস্কৃতি এবং প্রথাগত রীতিনীতি সুরক্ষিত রাখার ব্যবস্থা আছে। কোনো অভিন্ন বিধির মাধ্যমে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য খর্ব হলে তা দেশের ঐক্য ও অখণ্ডতার ক্ষেত্রে বিপজ্জনক হতে পারে।
অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নিয়ে কোনো ঘোষণা করার আগে ২১তম আইন কমিশনের আলোচনাপত্রের উপরোক্ত পর্যবেক্ষণ এবং সুপারিশগুলি কেন গ্রহণযোগ্য নয়, ২২তম আইন কমিশনের তা বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করা উচিৎ। শুধু কয়েক বছর পুরোনো হয়ে যাওয়ার যুক্তি দিয়ে এগুলিকে খণ্ডন করা হলে সেটা হবে স্বেচ্ছাচারিতার নিদর্শন। ২২তম আইন কমিশনের আরও উচিৎ অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু আছে এমন দেশগুলির সাথে একাধিক বা বিভিন্ন দেওয়ানি বিধির আওতায় থাকা দেশগুলির ভিতরে একটি তুলনামূলক অনুসন্ধান করা। বিশ্বের অন্যান্য বড় দেশগুলির অভিজ্ঞতা থেকে অভিন্ন দেওয়ানি বিধির শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ হয় কিনা সেটা জানা দরকার।
পারিবারিক আইনের বৈচিত্র্য
এটা সর্বজনবিদিত যে আমাদের দেশে বিবাহ, বিবাহ-বিচ্ছেদ, অভিভাবকত্ব, খোরপোশ, সম্পত্তির উত্তরাধিকারের মতন ব্যক্তিগত বা পারিবারিক আইনের ক্ষেত্রে হিন্দু, মুসলমান, খ্রিষ্টান, শিখ, পার্সি, জৈন ইত্যাদি সম্প্রদায়গুলির মধ্যে বিভিন্ন পার্থক্য আছে। সংবিধানের পঞ্চম ও ষষ্ঠ তফসিল অনুযায়ী আদিবাসীদের জন্য এবং দেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলের কিছু রাজ্যের জন্য ব্যক্তিগত বা পারিবারিক আইনের ক্ষেত্রবিশেষে ছাড় দেওয়া রয়েছে। আমাদের দেশে কেবল হিন্দু এবং বিভিন্ন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে পারিবারিক আইন, সামাজিক প্রথা ও ধর্মবিশ্বাসের পার্থক্য রয়েছে শুধু তাই নয়, হিন্দু ধর্মালম্বীদের মধ্যেও এই সমস্ত ক্ষেত্রে বিশাল বৈচিত্র্য আছে। এইরকম একটি বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশে একটি অভিন্ন ব্যক্তিগত বা পারিবারিক আইন বলবৎ করা খুবই দুষ্কর। কেবল আদিবাসী বা সংখ্যালঘুরাই নন, সমস্ত হিন্দুদের মধ্যেও অভিন্ন আইনের গ্রহণযোগ্যতা কতটা তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।
অভিন্ন দেওয়ানি বিধির সমর্থকেরা ব্যক্তিগত বা পারিবারিক আইনে লিঙ্গ বৈষম্য নিরসনের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টিকেই প্রাধান্য দেন। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে লিঙ্গ বৈষম্য কোনো একটি বিশেষ ধর্মীয় বা আদিবাসী সম্প্রদায়ের ব্যক্তিগত বা পারিবারিক প্রথার মধ্যেই অন্তর্নিহিত, এমনটা নয়; প্রত্যেক সম্প্রদায়ের রীতিনীতি এবং সামাজিক প্রথার মধ্যেই বৈষম্যের নানারকম উপাদান আছে। সমস্ত সম্প্রদায়ের প্রচলিত ব্যক্তিগত আইন এক ধাক্কায় বাতিল করে একটি অভিন্ন বিধি চালু করলে তবেই লিঙ্গ বৈষম্যের নিরসন ঘটবে, এটি একটি কষ্টকল্পনা।
আমাদের সমাজে বিভিন্নতা এবং বৈচিত্র্যের সম্বন্ধে সঠিক তথ্য এবং সচেতনতার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। আমরা নিজেদের ধর্মীয় এবং সামাজিক প্রথাগুলিকেই শ্রেষ্ঠ, যুক্তিপূর্ণ এবং ন্যায়সঙ্গত ভাবতে এবং অন্যান্য সম্প্রদায়ের সামাজিক প্রথাগুলি নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ বা ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করতেই অভ্যস্ত। এর একটা উপযুক্ত উদাহরণ বহুবিবাহ। ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভের (NFHS) তথ্য অনুযায়ী দেশে বহুবিবাহের হার কিন্তু নিম্নগামী। ২০০৫-০৬ সালের সমীক্ষায় (NFHS-3) ১.৯ শতাংশ মহিলা জানিয়েছিলেন যে তাঁর স্বামীর একাধিক স্ত্রী আছে, ২০১৯-২১ সালের সমীক্ষায় (NFHS-5) সেই হার নেমে গেছে ১.৪ শতাংশে।
২০১৯-২১ সালের সমীক্ষা (NFHS-5) থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী মেঘালয়, মিজোরাম, সিকিম, অরুণাচল প্রদেশের মতন উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলিতে বহুবিবাহের হার ৩ থেকে ৬ শতাংশের মতন, যা দেশের মধ্যে সবথেকে বেশি। ছত্তিসগড়, ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা, তেলেঙ্গানা, অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ু, কর্ণাটক ইত্যাদি রাজ্যের কয়েকটি জেলায় বহুবিবাহের প্রচলন ৪ শতাংশের বেশি। সারা দেশে জনজাতি বা আদিবাসীদের মধ্যে বহুবিবাহের হার ২০১৯-২১ সালে ছিল ২.৪ শতাংশ এবং তফসিলি জাতিদের মধ্যে ১.৫ শতাংশ। খ্রিষ্টানদের মধ্যে বহুবিবাহের হার ২.১ শতাংশ, মুসলিমদের মধ্যে ১.৯ শতাংশ, হিন্দুদের মধ্যে ১.৩ শতাংশ, বৌদ্ধদের মধ্যে ১.৩ শতাংশ, শিখদের মধ্যে ০.৫ শতাংশ এবং অন্যান্য ধর্মালম্বীদের মধ্যে ২.৩ শতাংশ। ২০০৫-০৬ থেকে ২০১৯-২১-এর মধ্যে তফসিলি জাতি, জনজাতি এবং সমস্ত ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যেই বহুবিবাহের হার কমেছে (শিখ সম্প্রদায় ব্যতীত)।
এই তথ্যগুলি থেকে কয়েকটি বিষয় পরিষ্কার হয়। প্রথমত, কোন অভিন্ন দেওয়ানি বিধি ছাড়াই আমাদের দেশে বহুবিবাহের হার কমে যাচ্ছে। দ্বিতীয়, বহুবিবাহ প্রথার যতটুকু ব্যাপ্তি, তা আছে জাতি এবং ধর্ম নির্বিশেষে। এর জন্য কোনো একটি বিশেষ ধর্মকে দায়ী করা অনুচিত। সর্বোপরি, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে বহুবিবাহের হার মোটেও এমন নয় যা দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বড় বাধা সৃষ্টি করছে। বরং তথ্য এটাই দেখায় যে হরিয়ানা, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, গুজরাট বা উত্তরপ্রদেশের মতন রাজ্যে বহুবিবাহের হার জাতীয় গড়ের তুলনায় অনেক কম হওয়া সত্ত্বেও এই রাজ্যগুলিতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার জাতীয় গড়ের তুলনায় অনেক বেশি। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ একাধিক বিবাহ করে অনিয়ন্ত্রিতভাবে দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি করছে বলে যে সাম্প্রদায়িক প্রচার দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে, তা আসলে ভিত্তিহীন। এই ধরণের ভ্রান্ত ধারণা থেকে অনেকেই অভিন্ন দেওয়ানি বিধিকে সমর্থন করেন। এই দৃষ্টিভঙ্গি অলীক এবং পক্ষপাতদুষ্ট।
বরং আমাদের দেশে ব্যক্তিগত বা পারিবারিক আইনের বিচিত্র বাস্তবতার একটি অনন্য নমুনা ছোট্ট রাজ্য গোয়ার দেওয়ানি বিধি (গোয়া সিভিল কোড)। উনবিংশ শতাব্দীতে পর্তুগিজ শাসকদের তৈরি এই দেওয়ানি বিধি ১৯৬১ সালে ভারতে অন্তর্ভুক্তির পরেও গোয়াতে বজায় রাখা হয়েছে। দুই বছর আগে সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি শরদ বোবডে গোয়াতে উচ্চ আদালতের একটি অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখার সময় উল্লেখ করেন যে ভারতের সংবিধান প্রণেতাদের কাম্য অভিন্ন দেওয়ানি বিধি গোয়াতে চালু রয়েছে, বিবাহ ও উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে সমস্ত গোয়াবাসী ধর্মনির্বিশেষে যেই বিধির আওতায় পড়েন। প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি গোয়ার দেওয়ানি বিধিকে অনুকরণযোগ্য বলে মনে করলেও, গোয়ার সিভিল কোড অনুযায়ী কোন হিন্দু বিবাহিত মহিলার ৩০ বছর বয়সের মধ্যে পুত্রসন্তান না হলে তার স্বামী দ্বিতীয়বার বিবাহ করতে পারে, কিন্তু খ্রিষ্টান, মুসলিম বা অন্যান্য সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় বিবাহ অবৈধ।
অর্থাৎ, গোয়ার এই বিধিকে 'অভিন্ন' বলাটাই বিভ্রান্তিকর, কারণ বিবাহের ক্ষেত্রে স্পষ্ট করেই ভিন্ন বিধি চালু আছে। তদুপরি, কেবলমাত্র হিন্দুদের জন্য এই ধরণের বহুবিবাহের অনুমোদন অন্যান্য রাজ্যের হিন্দু, মুসলিম, খ্রিষ্টান বা অন্যান্য সম্প্রদায়ের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে কি? কোনো দম্পতির যদি পুত্রসন্তান না জন্মায় তার দায়ভার শুধুমাত্র স্ত্রীর উপরে চাপানো হবে কেন? পুত্রসন্তান হতেই হবে এটাও তো একটি পিতৃতান্ত্রিক ধারণা।
রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
২১তম আইন কমিশনের আলোচনাপত্রে সংবিধান প্রণয়নের সময় গণপরিষদের বিতর্কে ড. আম্বেদকরের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল যে ভারতে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি কাম্য কিন্তু প্রাথমিক পর্যায়ে সেই বিধি হতে হবে সম্পূর্ণরূপে ঐচ্ছিক বা স্বতঃপ্রণোদিত; "...in the initial stage the application of the Code may be purely voluntary"। স্বাধীনতার ৭৫ বছর পর ভারতের বর্তমান রাজনীতি যেভাবে ব্রাহ্মণ্যবাদ, সংখ্যাগুরুর সাম্প্রদায়িকতা এবং তৎসহ নিপীড়িত জাতি, জনজাতি এবং সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ঘৃণা এবং হিংসার দ্বারা চালিত হচ্ছে, তাতে আদিবাসী, দলিত এবং সংখ্যালঘুদের মধ্যে কোনো অভিন্ন দেওয়ানি বিধির প্রতি সম্মত হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। ঐচ্ছিক বা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ব্যক্তিগত বা পারিবারিক আইনের সংস্কার করার জন্য যে সামাজিক পরিবেশ প্রয়োজন, বর্তমানে তার বিপরীত পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
শান্তি, সৌভ্রাতৃত্ব, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ভেতর পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠিত না হলে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ব্যক্তিগত বা পারিবারিক আইনের সংস্কার করা সম্ভব নয়। এছাড়াও বর্তমানে সংবিধানের পঞ্চম ও ষষ্ঠ তফসিলে আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলগুলিকে যে বিশেষ অধিকার দেওয়া আছে, তাকে লঙ্ঘন করে কোনো অভিন্ন দেওয়ানি বিধি উপর থেকে চাপিয়ে দিতে গেলে আদিবাসীদের জীবনশৈলী ব্যাহত হবে। এটাও মনে রাখা প্রয়োজন যে পঞ্চম ও ষষ্ঠ তফসিলভুক্ত অঞ্চলগুলির বাইরেও অনেক আদিবাসী থাকে। যেমন পশ্চিমবঙ্গে কোনো অঞ্চল পঞ্চম বা ষষ্ঠ তফসিলের আওতায় না এলেও এখানে জনজাতিদের জনসংখ্যা ২০১১-র জনগণনা অনুযায়ী ছিল প্রায় ৫৩ লক্ষ, রাজ্যের জনসংখ্যার প্রায় ৬ শতাংশ। এর মধ্যে ২৫ লক্ষের বেশি ছিল সাঁওতাল, ৬.৪ লক্ষ ওরাওঁ, এবং আরও বেশ কয়েক লক্ষ ভূমিজ, মুন্ডা ইত্যাদি। গত ১২ বছরে এই জনসংখ্যা আরও বেড়েছে। অভিন্ন দেওয়ানি বিধির এক্তিয়ার থেকে পঞ্চম ও ষষ্ঠ তফসিলভুক্ত অঞ্চলগুলিকে বাদ দেওয়া হলেও এর বাইরের অঞ্চলে বসবাসকারী বড় সংখ্যার আদিবাসীদের জীবনযাত্রায় এর কুপ্রভাব পড়বে। অভিন্ন দেওয়ানি বিধির বিরুদ্ধে কেন বিভিন্ন অংশের আদিবাসীরা ইতিমধ্যেই প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছে তা সহজেই অনুমেয়।
সাম্প্রতিক সময়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী অভিন্ন দেওয়ানি বিধির পক্ষে জনসমক্ষে একাধিকবার সওয়াল করেছেন, যার মূল নির্যাস হল একই দেশে দুই রকমের আইনব্যবস্থা চলতে পারেনা। ২২তম আইন কমিশন যখন এই বিষয়ের উপর সবে জনগণের মতামত নেওয়া শুরু করেছে তখন দেশের প্রধানমন্ত্রী আইন কমিশনে বিষয়টির নিষ্পত্তির জন্য অপেক্ষা না করেই রাজনৈতিক প্রচার শুরু করে দিলেন কেন? ইতিমধ্যেই উত্তরাখন্ড, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ এবং গুজরাটের রাজ্য সরকারগুলি অভিন্ন দেওয়ানি বিধির প্রস্তাব খতিয়ে দেখার জন্য রাজ্যস্তরে কমিটি গঠন করে ফেলেছে। ফলে ২২তম আইন কমিশনে জনমত সংগ্রহের প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়েই প্রশ্ন উঠছে।
আসলে অযোধ্যায় বাবরি মসজিদের ধ্বংসাবশেষের উপর রাম মন্দির নির্মাণ শুরু করে এবং কাশ্মীরের বিশেষ স্বায়ত্ব সুনিশ্চিতকারী সংবিধানের ৩৭০ ধারা বিলোপ করার পর মোদী সরকার আর সংঘ পরিবার আসন্ন ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনে অভিন্ন দেওয়ানি বিধির ইস্যুকে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের হাতিয়ার বানাতে চাইছে। ব্যক্তিগত বা পারিবারিক আইনে নারী-পুরুষের সমান অধিকার সুনিশ্চিত করার সাথে মোদী সরকারের অভিন্ন দেওয়ানি বিধি সংক্রান্ত উদ্যোগের কোন সম্পর্ক নেই, এর আসল উদ্দেশ্য সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের সাথে আদিবাসী এবং সংখ্যালঘুদের দ্বন্দ্ব বাধিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা তোলা, যেটা তারা এনআরসি-সিএএ-র নামে শুরু করেছিল ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের আগে। এই বিভাজনের রাজনীতির আগুনে আজ মনিপুর জ্বলছে, চলছে জাতিবিদ্বেষী হিংসা, গণহত্যা এবং বর্বরসুলভ নারীনির্যাতন।
অভিন্ন দেওয়ানি বিধি সংক্রান্ত বিতর্কের একই পরিণতি যাতে না হয় সেটা আমাদের সকলকেই সুনিশ্চিত করতে হবে। ভারতের মতন বহু বৈচিত্র্যের দেশে উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া কোনো অভিন্ন দেওয়ানি বিধি হবে জাতীয় ঐক্যের পরিপন্থী। ২১তম আইন কমিশনের ভাষায় অভিন্ন দেওয়ানি বিধি "নিষ্প্রয়োজন ও অবাঞ্ছিত"। ২২তম আইন কমিশন যাতে ২১তম আইন কমিশনের সুপারিশগুলো উল্টোতে না পারে তার জন্য জনমত সংগঠিত করতে হবে।