আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ পঞ্চদশ সংখ্যা ● ১-১৫ আগস্ট, ২০২৩ ● ১৬-৩২ শ্রাবণ, ১৪৩০

প্রবন্ধ

জোট জটিলতাঃ প্রসঙ্গ ’ইন্ডিয়া’

শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদার


তোলপাড় এখন পশ্চিমবঙ্গের বাম কর্মী সমর্থক মহল। পঞ্চায়েত নির্বাচন এবং বেঙ্গালুরু বৈঠক পরপর গেল। এর আগে গেছে পাটনা। উত্তপ্ত আলোচনা হচ্ছে সামাজিক গণমাধ্যমে, ‘যখন কমরেডরা রক্তাক্ত হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামাঞ্চলে, তখন এক মঞ্চে সীতারাম ইয়েচুরি ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়!’ শোনা যাচ্ছে শুধু কর্মী সমর্থকরা নয়, মাঝের পর্যায় থেকে নিচের তলার নেতৃত্বের মধ্যেও নাকি রয়েছে এ নিয়ে জোরালো আপত্তি ও সমালোচনা।

নেতৃত্বের তরফে গৃহীত সিদ্ধান্ত নিয়ে অভ্যন্তরীণ অসন্তোষ সিপিআই(এম)-এর ইতিহাসে এটাই প্রথম নয়। মোরারজী মন্ত্রীসভার ওপর থেকে ১৯৮০-তে সমর্থন প্রত্যাহার নিয়েও দলের ভেতরে প্রবল বিতর্ক হয়েছিল। কেন্দ্রীয় কমিটিতে ২৩-২১ ভোটে মোরারজী মন্ত্রীসভার ওপর থেকে সমর্থনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। দলের পশ্চিমবঙ্গ শাখার মতামত সাধারণভাবে ছিল মোরারজী মন্ত্রীসভার প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখার স্বপক্ষে। তারপর ১৯৯৬ সালে জ্যোতি বসুকে প্রধানমন্ত্রী করার প্রস্তাব নিয়েও দলের মধ্যে তীব্র মতপার্থক্য হয়। দফায় দফায় কেন্দ্রীয় কমিটির সভা করে শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হয় সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়ার স্বপক্ষে। জ্যোতিবাবুর প্রধানমন্ত্রীত্ব বিষয়ক বিতর্কের মতাভিমতে কোনো রাজ্যগত চেহারা ছিল না। পশ্চিমবঙ্গ থেকে নির্বাচিত হওয়া পলিটবুরোর সদস্যদের মধ্যেও মতের অনৈক্য ছিল। এই প্রসঙ্গে পরে জ্যোতিবাবুর ‘ঐতিহাসিক ভুল’ মন্তব্যটি অন্যদিক থেকেও ঐতিহাসিকই ছিল। দলের গৃহীত সিদ্ধান্ত নিয়ে জ্যোতিবাবু বা তাঁর স্তরের নেতৃত্বের তরফে প্রকাশ্যে এ ধরনের সমালোচনামূলক মন্তব্য প্রকাশ সিপিআই(এম)-এ আগে কখনো ঘটেনি।

এখন পৃথিবী পাল্টে গেছে। সামাজিক গণমাধ্যম চলে এসে তথ্যপ্রবাহকে অনেকটাই অবারিত ও ‘গণতান্ত্রিক’ করে তুলেছে। ফলে ‘ইন্ডিয়া’ নিয়ে সমর্থকদের আপত্তিতে মন্তব্যে ভরে গেছে ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপ। পার্টির রণকৌশলের স্বপক্ষে বলতে গিয়ে সর্বভারতীয় রাজনীতি ও রাজ্যস্তরের রাজনীতি একমুখী নয় এই কথাও উঠে আসছে কর্মী সমর্থকদের অন্য অংশের পোস্টে। বোঝা যাচ্ছে এই আপত্তির ঝড় বেশ অনেকটাই অভূতপূর্ব। নতুন প্রযুক্তির যুগে সাংগঠনিক শৃঙ্খলার বজ্রআঁটুনি সবসময় কাজও করে না। মুক্ত সমালোচনাগুলি যে শুধু সাধারণ সমর্থক বা কর্মীরাই করছে তা নয়। মাঝের ও নিচের তলার নেতৃত্বের তরফেও কেউ কেউ প্রকাশ্যে পার্টির এই পদক্ষেপের সমালোচনা করেছেন।

একটা সময়ে বিতর্ক হয়েছে কংগ্রেসের সাথে জোট করা উচিত কি অনুচিত এই নিয়ে। ২০২১ সালের নির্বাচনের আগে ও পরে তার সাথে আইএসএফ-কে যোগ করে সমালোচনার ঝড় বয়ে গেছে ফেসবুক আর হোয়াটসঅ্যাপে। ২০২৩ সালে এসে কংগ্রেস নিয়ে আপত্তির মাত্রা এখন অনেকটাই কমে গেছে। যদিও বাইরন বিশ্বাসের রাতারাতি দলবদলের পর জোট বিরোধীরা স্বল্পসময়ের জন্যে খানিকটা সরব হয়েছিল সামাজিক গণমাধ্যমে। ২০২১ সালে আইএসএফ নিয়ে আপত্তির প্রধান কারণ ছিল আব্বাস সিদ্দিকী। কারণ ছিল তার কিছু পুরোনো ধর্মীয় জলসার কট্টরপন্থী বক্তব্য। আবার কিছুটা কারণ অবশ্য নিহিত ছিল বাঙালি হিন্দু মধ্যবিত্তের মজ্জাগত মুসলিম বিরূপতা ও বিদ্বেষেও। মাথায় টুপি, লুঙ্গি পাঞ্জাবি ও ঘাড়ে গামছা একটা মানুষ এসে বামপন্থীদের সমাবেশে ভাষণ দেবে এটা চোখকে সইয়ে নিতে সমস্যা ছিল। পরবর্তী সময়ে সংযুক্ত মোর্চার একমাত্র জয়ী বিধায়ক নৌশাদ সিদ্দিকীর বলিষ্ঠ ভূমিকা বামপন্থী কর্মী সমর্থকদের মধ্যে তাকে অনেকটাই জনপ্রিয় করেছে। ২০২১ সালের নির্বাচনের পর থেকে নৌশাদও কখনোই বামপন্থীদের সম্পর্কে কোনো বিরূপ কথা বলেননি। এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচনে রাজ্যস্তরে কংগ্রেস ও আইএসএফ-এর সাথে বামপন্থীদের সার্বিক জোট গড়ে না উঠলেও বামপন্থী কর্মী সমর্থকদের মধ্যে এমন জোট গড়ে ওঠা নিয়ে তেমন আপত্তি পরিলক্ষিত হয়নি। বরং বিপরীতে এই অভিমত বেশি করেই শোনা গেছে যে জেলা পরিষদ স্তরে পূর্ণাঙ্গ জোট হলে আরো ভালো ফল করতে পারত বামপন্থীরা।

এখন যে ঝড় উঠেছে বা যে কারণে ঝড় উঠেছে, তার একটিও অপ্রত্যাশিত নয়। সিপিআই(এম)-এর বিগত কংগ্রেসের সিদ্ধান্তের সাথে বেঙ্গালুরু বা পাটনার বৈঠকে বামপন্থীদের অংশগ্রহণ সঙ্গতিহীন নয়। আবার পঞ্চায়েত নির্বাচনের সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতার পর তৃণমূলের অংশগ্রহণ সহ কোনো বিরোধী বৈঠকে সিপিআই(এম) যোগ দিলে পশ্চিমবঙ্গের বাম কর্মী সমর্থকদের মধ্যে এমন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হওয়াটাও কি অপ্রত্যাশিত? প্রশ্ন উঠবে, এই পরিস্থিতিতে কী করা বাঞ্ছনীয়? তবে তারও আগে আত্মানুসন্ধান প্রয়োজন, কেন এমন হল?

এর প্রধান কারণ, পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য রাজনীতি ও দেশের জাতীয় রাজনীতির মধ্যে মূলগতভাবে থাকা কতগুলি পার্থক্য। যে যে বিষয়গুলিকে ঘিরে এই পার্থক্য, তার মধ্যে কতগুলি অনেক পুরোনো। আর কয়েকটি বিষয় সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ইতিহাসের। আটের দশক অবধি ভারতবর্ষের রাজনীতি ছিল কংগ্রেস-কেন্দ্রিক। দেশের সমস্ত রাজনৈতিক দলের রাজনৈতিক নীতি ও কৌশল আবর্তিত হত কংগ্রেসকে ঘিরে। অর্থাৎ কংগ্রেসকে সমর্থন ও বিরোধিতাকে কেন্দ্র করে। ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রথম বিভাজনও হয়েছে এই বিতর্ক থেকেই। এই দ্বিমেরু রাজনীতিতে প্রথম বদল আসে নয়ের দশকে বিজেপির আত্মপ্রকাশের পরবর্তী সময়ে। প্রথম অবস্থায় বামপন্থীরা কংগ্রেস ও বিজেপি, এই দুইয়ের বিরুদ্ধেই সমান বিরোধিতার রাজনৈতিক লাইনকে সামনে রেখে তৃতীয় মোর্চা গঠনের উদ্যোগ নিয়েছিল। নয়ের দশকের শেষ থেকে পরিস্থিতি আরো পাল্টে যায়। এই উপলব্ধি অনুভূত হয় যে কংগ্রেস এবং বিজেপিকে একচোখে দেখাটা সঠিক নয়। এই নীতিগত বদলটি এতটাই গুরুত্বপূর্ণ সিপিআই(এম)-এর দলীয় কর্মসূচিতেই অন্তর্ভুক্ত হয় এই বিষয়টি যে রাজনৈতিক দল হিসেবে বিজেপি ভারতের আর বাকি সব দল থেকেই সম্পূর্ণ পৃথক। অন্য দক্ষিণপন্থী দলের প্রতি যে দৃষ্টিভঙ্গী সেটা দিয়ে বিজেপি দেখা একেবারেই চলবে না। জাতীয় রাজনীতির স্তরের রাজনীতিও এই সময় থেকেই কংগ্রেস-কেন্দ্রিকতা থেকে বিজেপি-কেন্দ্রিক বিবেচনার দিকে মোড় নেয়। কংগ্রেসের সমর্থনে জ্যোতি বসুর প্রধানমন্ত্রীত্বের প্রস্তাবটি এই দিকবদলকেই সূচিত করে। বামপন্থী রাজনীতিতে জাতীয় স্তরের বিবেচনায় কংগ্রেস বিরোধিতা-সর্বস্বতা সমাপ্তি ঘটে। রাজ্যস্তরে এই বিষয়টি সমান্তরালে ঘটেনি সুনির্দিষ্ট বাস্তবতার জন্যেই। কেরল ও পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাসীন বামপন্থী সরকারের প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি তখনও কংগ্রেস বা তাদের নেতৃত্বাধীন ফ্রন্টই। এমনকী আসামের মতো রাজ্য যেখানে বিজেপি অনেকটাই শক্তি সঞ্চয় করে নিয়েছিল সেই সময়ে সেখানেও একই সাথে কংগ্রেস ও বিজেপি বিরোধিতাই ছিল বামপন্থীদের রাজনৈতিক রণকৌশল। বাজপেয়ীর নেতৃত্বাধীন তুলনায় দুর্বল শক্তির বিজেপি জোট সরকারের সময়েই গুজরাটে গণহত্যা হয়েছে, নাগরিকত্ব বিষয়ক ভবিষ্যৎ রাজনীতি ঘুঁটি সাজাবার লক্ষ্যে নাগরিকত্ব সংক্রান্ত নির্দেশনামায় ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’ অভিধা নাগরিকত্ব আইনে যুক্ত করা হয়েছে। তখনও পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির সর্বস্তরে বিজেপির বিপদ নিয়ে ততটা মুখরতা প্রসারিত হয়নি। এমনকী পশ্চিমবঙ্গের জন্যে, বিশেষ করে বাস্তুহারা জনগোষ্ঠীর জন্যে নাগরিকত্ব সংক্রান্ত নির্দেশনামা যে সুদূরপ্রসারী অভিঘাত নিয়ে আসছে সেটা বামপন্থীরা যথাযথভাবে অনুমান করতে পারেনি। ইতিমধ্যে জাতীয় স্তরে বিজেপি বিরোধিতার রাজনীতি আরও অগ্রসর হয় ২০০৪-এ মনমোহন সিংহকে প্রধানমন্ত্রী করে কংগ্রেসের নেতৃত্বে ইউপিএ সরকার গঠিত হয়েছে বামপন্থীদের সমর্থন নিয়ে।

পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি এগিয়েছে একটু ভিন্নভাবে। কেন্দ্রে যখন কংগ্রেস এবং বামপন্থীরা বিজেপি বিরোধিতাকে সামনে রেখে কাছাকাছি আসছে, তখন কংগ্রেসের অভ্যন্তরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে একটা অংশ সরব হয়েছে এই বলে যে তাদের দলের রাজ্য নেতৃত্ব কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের বশংবদ হয়ে রাজ্যে বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে জোরালো আন্দোলন গড়ে তুলতে অনীহা প্রকাশ করছে। পশ্চিমবঙ্গ কংগ্রেসের এই অভ্যন্তরীণ বিরোধ আরো তীব্র হওয়ার পর ১৯৯৮ সালে তৃণমূল কংগ্রেসের আত্মপ্রকাশ। কংগ্রেসের এই অভ্যন্তরীণ বিরোধকে তৃণমূল কংগ্রেস গঠন অবধি এগিয়ে নিয়ে যেতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষে সমর্থন জানিয়ে গেছে বিজেপি ও আরএসএস। তৃণমূলের জন্ম নাগপুরের আরএসএস-এর সদর দপ্তরে, কথাটা হয়ত এ জন্যেই বলা হয়। কথাটি আংশিক সত্য। আরএসএস-এর প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকেই মূল রণনীতি কংগ্রেসে ভেতর থেকে ভাঙন ধরানো এবং মহাত্মা গান্ধীর বিরোধিতা। তাদের কাছে এটাই প্রতিভাত হয়েছিল যে স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়কালীন জাতি ধর্ম ভাষা নির্বিশেষে ভারতীয় জনগণের একটি রাজনৈতিক মঞ্চ হিসেবে কংগ্রেসের উপস্থিতি আরএসএস-এর গড়ে ওঠার পথে একটি প্রধান বাধা। এ ছাড়া মহাত্মা গান্ধী হিন্দুধর্মকে যেভাবে উপস্থিত করেন সেটা হেডগেওয়ার ও গোলওয়ালকারদের হিন্দুধর্মের ব্যাখ্যার পথে একটি অন্তরায়। ফলেই কংগ্রেসের অভ্যন্তরে ভাঙন ও মহাত্মা গান্ধীর বিরোধিতা, পরবর্তীতে আত্মসাৎ করা আরএসএস-রাজনীতির প্রধান রণনীতি। পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট ও কংগ্রেসের দ্বিমেরু রাজনীতির অবসান ঘটাতে তৃণমূলের আত্মপ্রকাশে সহায়তা প্রদান আরএসএস-এর এক ঢিলে তাদের দুই প্রধান শত্রু কমিউনিস্ট ও কংগ্রেসকে ঘায়েল করারই কৌশল। প্রধান বিরোধী শক্তিকে দুর্বল করতে আরএসএস এ ধরনের কৌশল অন্য রাজ্যেও নিয়েছে। কাঁসিরাম ও মুলায়মের জোট ভাঙতে কীভাবে এই কৌশলের রূপায়ন হয়েছিল তার বিস্তারিত বিবরণ বেরিয়েছিল 'ফ্রন্টলাইন' পত্রিকায়।

পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে দ্বিমেরু বাস্তবতার কার্যকরী আত্মপ্রকাশ ঘটে মূলত ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে। এর আগে একটা দীর্ঘ সময় বিজেপি নির্বাচনে লড়েছে তৃণমূলের শরিক হয়ে। আর, ২০১১ সালে তৃণমূল এবং কংগ্রেসের মধ্যে নির্বাচনী বোঝাপড়া হয়েছিল। ২০১১ সালের আগে রাজনীতি ছিল বামফ্রন্ট ও বামফ্রন্ট বিরোধী শিবিরের দ্বিমেরুতে বিভাজিত। বিজেপি-র একক শক্তি ছিল খুবই দুর্বল। তৃণমূলের সমর্থনেই লোকসভা নির্বাচনে কয়েকটি আসনে জয়ী হয়েছিল তারা। ২০১১ সালে ২৮৯টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিজেপির ভোট ছিল ৪.০৬%, আর ২০১৬ সালে ২৯১টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সেটি দাঁড়ায় ১০.১৬%। শক্তিবৃদ্ধির ইঙ্গিত থাকলেও কার্যকরী তৃতীয় শক্তি তখনও হয়ে ওঠেনি বিজেপি। ২০১৯ সালের নির্বাচনী ফলাফলে দেখা গেল বিজেপি শুধু গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক শক্তি হিসেবেই নয়, বামপন্থীদের সরিয়ে দ্বিতীয় নির্বাচনী শক্তি হিসেবে উঠে এসেছে। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয়টি হল, বিজেপির এই উত্থান ঘটেছে বামপন্থীদের শক্তিক্ষয়ের বিনিময়ে। বাম বিরোধী মহল অবশ্য একে অভিহিত করেছে বামপন্থীদের দ্বারা ভোটের হাতবদলের মাধ্যমে। নেতৃত্বের সিদ্ধান্তে ভোটের হাতবদলের এই অভিযোগ নিছক রাজনৈতিক কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি ছাড়া কিছু নয়। তবে একই সঙ্গে আরেকটি বিষয়ও উপেক্ষনীয় নয়, গ্রামাঞ্চলে তৃণমূলের লাগাতার হিংস্র আক্রমণের মুখে পড়া একটি অংশের নিচের তলার বামপন্থী কর্মী ও নেতৃত্ব ২০১৮ পঞ্চায়েত নির্বাচনে স্থানীয় স্তরে কোনো কোনো জায়গায় বিজেপি-র সাথে বোঝাপড়া করে নিয়েছিল। নির্বাচন পরবর্তী সময়ে এদের বিরুদ্ধে কড়া শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হলেও ২০১৯ সালের নির্বাচনে বামপন্থী ভোটারদের সমর্থন ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। গণভিত্তিতে নেমে আসা বড় ধরনের ধ্বস ও নির্বাচনী শক্তির এই ক্ষয় দেখে তৃণমূলের অত্যাচারে অতিষ্ঠ সাধারণ মানুষ এবং বামপন্থী কর্মী সমর্থকদের একটি অংশের মধ্যে বিজেপিকে একটি সাময়িক বিকল্প হিসেবে ভেবে নেওয়ার প্রবণতা দেখা দেয়। সম্ভবত এই সময় থেকেই হৃত গণভিত্তি পুনরুদ্ধার ও বিজেপিকে ঘিরে তৈরি হওয়া মোহ থেকে মানুষকে মুক্ত করার জন্যেই বামপন্থীদের প্রচারের মূল বিষয় হয়ে ওঠে তৃণমূল ও বিজেপি-র অতীতের প্রকাশ্য ও বর্তমান গোপন রাজনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে প্রচারের ওপর গুরুত্ব প্রদান। এই প্রচারই একটি পর্যায়ে গিয়ে 'বিজেমূল' তত্ত্বের জন্ম দেয়। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের মূল প্রচারই হয়ে দাঁড়ায় বিজেমূল ও সেটিং। এই প্রচারের দুর্বলতার দিকটি হল বিজেপির তুলনায় তৃণমূলের ওপর অধিকতর মাত্রায় আক্রমণ কেন্দ্রীভূত হয়ে যাওয়া। লক্ষ্যণীয় বিষয় হল, এই বিজেমূল ও সেটিং-এর তত্ত্ব বামপন্থী কর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে বিপুল গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করে এবং এর মধ্য দিয়েই ২০১৭ সালের পৌর নির্বাচন, ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচন ও ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে একদিকে সীমাহীন রাজনৈতিক সন্ত্রাস ও অন্যদিকে নির্বাচনী শক্তির ক্রমক্ষয়ের ফলে ঝিমিয়ে পড়া বামপন্থী কর্মী সমর্থকরা নতুন করে উজ্জীবিত হয়। এর সরাসরি প্রভাবে ছাত্র-যুবদের আন্দোলনে প্রাণ সঞ্চারিত হয় এবং জনসমক্ষে অনেক তরুণ বামপন্থী কর্মী উঠে আসে। ২০২১ সালের নির্বাচনে এই উজ্জীবিত বামপন্থী কর্মী সমর্থকরাই একটি প্রাণবন্ত নির্বাচনী প্রচারাভিযানের জন্ম দিয়েছিল। অন্যদিকে সাধারণ বিজেপি বিরোধী মানুষেরা বিজেমূল তত্ত্বকে মেনে নিতে পারেনি। মেনে নিতে পারেনি রাজ্যের সংখ্যালঘু মানুষও। তারা এই তত্ত্বের মধ্যে তৃণমূলকে বড়ো করে বিজেপিকে খাটো করে দেখা প্রত্যক্ষ করেছে। এরই প্রভাবে রাজ্যের নির্বাচকমণ্ডলী তৃণমূল ও বিজেপির মধ্যে মেরুকৃত হয়ে বামপন্থীদেরকে স্মরণাতীত কালের সবচেয়ে রাজনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে দাঁড় করিয়ে দেয়।

২০২১ সালের নির্বাচনী ফলাফলের পর সিপিআই(এম)-এর রাজ্য কমিটির বৈঠকের পর একটি ফেসবুক লাইভ বক্তৃতায় সে সময়ের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র অকপটে বলেন যে 'বিজেমূল' তত্ত্বের প্রচার ভুল ছিল। তৃণমূল ও বিজেপির মধ্যে অসংখ্য গোপন ও প্রকাশ্য মিতালীর দৃষ্টান্ত থাকলেও এভাবে একটি অভিন্ন নামের মধ্যে তাদের একাকার করে দেওয়া যায় না। তৃণমূল ও বিজেপি, দু’টি ভিন্ন রাজনৈতিক দল। দু’টির বিরুদ্ধেই লড়তে হবে, কিন্তু সমদূরত্বের নীতিও এক্ষেত্রে চলে না। এই নীতিগত অবস্থান পরবর্তী সময়ে রাজ্য ও সর্বভারতীয় সম্মেলনে গৃহীত হলেও কিছুদিন পর থেকেই মুখে 'বিজেমূল' তত্ত্বের উল্লেখ না থাকলেও, কালীঘাট বললেই এক শ্বাসে নাগপুর বা নাগপুর বললেই একশ্বাসে কালীঘাট, মোদী বললেই দিদি এবং দিদি বললেই মোদী উচ্চারিত হয়ে 'বিজেমূল' তত্ত্ব কার্যত বামপন্থীদের রাজনীতিতে প্রত্যাবর্তন করে। এখন যেমন আদানী বললেই এসএসসি এবং সাম্প্রতিকতম সময়ে মনিপুর বললেই মালদা বলাটাও নিয়মেই দাঁড়িয়েছে। ফলে কার্যত সমদূরত্বের রাজনীতিই হচ্ছে। এর প্রধানতম কারণ হয়তো বামপন্থী কর্মী সমর্থকদের মধ্যে 'বিজেমূল' তত্ত্বের বিপুল জনপ্রিয়তা। জেলা বা মফস্বলে কোনো দলীয় সাধারণসভা বা জনসভায় আলাদা করে নরেন্দ্র মোদী বা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আক্রমণ করে বক্তব্য রাখলে যতটা করতালি পাওয়া যায়, তার বিপরীতে 'বিজেমূল' তত্ত্বের মতো করে দিদি-মোদী বা কালীঘাট-নাগপুর এক বন্ধনীতে এনে আক্রমণ করলে সভায় করতালির ঝড় ওঠে। মূল রাজনৈতিক লাইনকে জনপ্রিয় করার বদলের জনপ্রিয় বক্তব্যের পেছনে এই গ্যালারি প্লেয়িংই আজ পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থী কর্মী সমর্থক ও নিচের তলার নেতৃত্বের একাংশের মধ্যে এই অভূতপূর্ব ক্ষোভ বিক্ষোভ ও সমালোচনার পরিস্থিতির প্রধান কারণ।

বিজেপির সাথে কখনও মিতালী কখনও যুদ্ধং দেহি মনোভাব দেখানো রাজনৈতিক দল বললে একমাত্র তৃণমূল কংগ্রেসের নামই আসবে না। বামপন্থীরা ছাড়া 'ইন্ডিয়া' জোটের সমাজবাদী দল, আরজেডি বাদ দিলে প্রায় সমস্ত দলই কোনো না কোনো সময়ে বিজেপি-র জোটে ছিল। আবার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিজেপি-র প্রার্থীকে সমর্থন করায় শামিল হয়েছে সমাজবাদী দলও। আম আদমি পার্টি তো জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের অবলুপ্তি থেকে রাম মন্দির নির্মাণ, সিএএ ইত্যাদি প্রশ্নে বিজেপিরই সঙ্গ দিয়েছে। বিজেপি বিরোধী জোটের সবচেয়ে বিস্ময়কর অন্তর্ভুক্তি উদ্ধব ঠাকরের নেতৃত্বাধীন শিবসেনা। তাদের রাজনীতি শুরু হয়েছিল দক্ষিণ ভারতীয়দের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ও আক্রমণের রাজনীতি দিয়ে। তারপর সেটার রূপান্তর ঘটে উত্তর ভারতীয়, মূলত বিহার, ইউপি-র বহিরাগত বিরোধী রাজনীতিতে। নয়ের দশকে সেই রাজনীতি বিজেপির চেয়েও উগ্র হিন্দুত্বের চেহারা নেয়। মহারাষ্ট্রের ইতিহাসে অসংখ্য মুসলিম বিরোধী দাঙ্গার রক্ত লেগে আছে শিবসেনার হাতে। পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিস্ময়কর হলেও এখন শিবসেনা ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের জোটে এসে শামিল হয়েছে। কট্টরবাদী দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে এই জোটকে বিবেচনা করলে শুধু তৃণমূল নয়, তার চেয়েও বেশি সোচ্চার হতে হয় শিবসেনার বিরুদ্ধে। এভাবে দেখতে গেলে শেষ পর্যন্ত কম্বল উজাড় হয়ে যাওয়ারই সম্ভাবনা। সর্বভারতীয় লড়াইয়ে যারাই যতক্ষণ বিজেপির বিরুদ্ধে বলবে ততক্ষণ তাদেরকে নিয়েই জোট গঠিত হতে হবে। প্রকৃত লক্ষ্য হচ্ছে শক্তির সমাবেশ করা। সর্বভারতীয় রাজনীতিতে প্রধান শত্রুকে ঠেকাতে তৃণমূলের সাথে বৈঠকে শামিল হলে একইভাবে রাজ্যের প্রধান শক্তি তৃণমূলকে ঠেকাতে নিচের তলায় পঞ্চায়েত বা অন্য কোথাও বিজেপিকে জায়গা ছেড়ে দিতে হবে, এটাও চলবে না। কারণ রাজ্যস্তরে তৃণমূল যত বড় বিপদই হোক, বিজেপির বিপদ কখনোই কোনো জায়গাতেই একচুলও কম নয়। তৃণমূলের গণতন্ত্র হত্যাকারী ভূমিকার বিরোধিতার নাম করে বা বিচার বিভাগের ওপর তৃণমূলের আক্রমণের বিরোধিতার নাম করে এমন কোনো অবস্থান কখনোই নেওয়া যাবে না যার মাধ্যমে বিজেপি একটু হলেও পরিসর পেয়ে যায়।

স্বাধীনতা পরবর্তী দশকগুলির দ্বিমেরুকেন্দ্রিক রাজ্য রাজনীতির অভ্যেস পরিত্যাগ করে বহুমেরু রাজনীতির চর্চাকে বামপন্থী রাজনৈতিক চর্চার কেন্দ্রে প্রতিস্থাপিত করতে হবে। বহুমেরু রাজনীতির চর্চার অভাবে অনেক ক্ষতিস্বীকার করতে হয়েছে অতীতে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে মিত্রপক্ষের সমর্থন করতে গিয়ে ঔপনিবেশিক শাসন বিরোধী সংগ্রামে ঢিলে দেওয়া হয়েছিল। সাম্প্রতিক ইতিহাসে, বিহারে জোট রাজনীতির বাধ্যবাধকতায় পার্টি বিধায়কের খুনিকে সমর্থন করতে হয়েছিল লোকসভা নির্বাচনে। এ ধরনের যান্ত্রিক দ্বিমেরুকেন্দ্রিক রাজনীতি অপরিসীম ক্ষতি করে।

পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য রাজনীতিতে তৃণমূলের বিরোধী সংগ্রামে ভাঁটা দেওয়ার প্রশ্নই নেই। এই সংগ্রাম করতে গিয়ে বিজেপিকে জায়গা ছাড়ার কোনো অবকাশ নেই। সর্বভারতীয় রাজনীতিতে বিজেপি বিরোধিতায় সবাইকে এককাট্টা করতে হবে, তৃণমূল সহ। এটা ঝগড়া নয়, লড়াই। ঝগড়ায় আবেগ সব, কৌশলের ভূমিকা থাকে না। লড়াইয়ে আবেগ থাকে, কৌশলও থাকে।

চটজলদি হাততালি কুড়োনোর রাস্তা পরিহার করে প্রকৃত রাজনীতির চর্চাই জোটের জট কাটাবে বামপন্থী কর্মী সমর্থকদের মনে। নান্য পন্থা বিদ্যতে।