আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ পঞ্চদশ সংখ্যা ● ১-১৫ আগস্ট, ২০২৩ ● ১৬-৩২ শ্রাবণ, ১৪৩০

সমসাময়িক

'মহারাজ' এখন সাংসদ


আর রাখঢাক নেই। স্বঘোষিত 'মহারাজ' এখন কেন্দ্রের শাসকদলের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। দীর্ঘদিন ধরে দুই ফুলের সঙ্গে দর কষাকষির পর তিনি শেষ পর্যন্ত জোড়াফুলকে পরিহার করেছেন।

জনসমক্ষে তিনি কম আসেন। বেশি কথা বলায় তাঁর আগ্রহ না থাকলেও তিনি সোজাসাপ্টা কথা বলেন। তাঁর মন্তব্যে কোনো ধোঁয়াশা নেই। নিজের দাবিতে তিনি অবিচল। কোচবিহার নামের পৃথক রাজ্য নিদেনপক্ষে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল স্থাপন তাঁর লক্ষ্য। এবং এই বিষয়ে তিনি স্থিরপ্রতিজ্ঞ। তিনি স্বঘোষিত 'মহারাজ'।

কেন্দ্র ও রাজ্যের শাসকদলগুলি তাঁর সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। দেশের অমিত পরাক্রমশালী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গুয়াহাটিতে রাত কাটিয়ে সকাল সকাল হেলিকপ্টার চড়ে বঙ্গাইগাঁও পৌঁছে গাড়িতে চড়ে চলে যান আসামের চিরাং জেলার প্রান্তিক গ্রাম সতিবরগাঁও। আলোচনা ও প্রাতঃরাশ সেরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিদায় নেওয়ার পর 'মহারাজ' কথা প্রসঙ্গে সেদিন সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন যে হঠাৎ করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরসূচি নির্ধারিত হয়নি। ২০২১-এর জানুয়ারিতে তিনি দিল্লি গিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছিলেন। তখনই উনি মহারাজের কিছু কিছু দাবি মেনে নেওয়ার বিষয়ে নাকি সম্মতি দিয়েছিলেন। সেইদিনই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, ফেব্রুয়ারির ১১ তারিখ চিরাং জেলার সতিবরগাঁও গ্রামে এসে বিস্তারিত কথা বলবেন। দিল্লিতে কথা হয়ে যাওয়ার পরেও শুধুমাত্র প্রাতঃরাশ সহযোগে মাত্র আধ ঘণ্টার আলোচনার জন্য এত পরিশ্রম? এত অর্থ ও সময় বিনিয়োগ?

রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীও পিছিয়ে নেই। 'মহারাজ' আয়োজিত চিলা রায়ের ৫১২তম জন্মবার্ষিকী উদযাপনের অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রীকে বিশেষ অতিথি হিসেবে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সেই মঞ্চ থেকেও আলাদা রাজ্যের প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়।

রাজ্য সরকার আয়োজিত বিজয়া সম্মিলনীর অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির আসন অলঙ্কৃত করেছিলেন 'মহারাজ' ও দার্জিলিং-এর বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতৃবৃন্দ। ভাইফোঁটাতেও 'মহারাজ'-এর জন্য উপহার পাঠিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। আবার 'মহারাজ' মুখ্যমন্ত্রীকে পাল্টা উপহার পাঠিয়ে তাঁর বাড়িতে আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। কোচবিহার শহরের রাসমেলায় পুরসভার পক্ষ থেকেও 'মহারাজ'কে অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ করা হয়। এবং তিনি উপস্থিত ছিলেন।

রাসমেলার অনুষ্ঠানের দিনকয়েক আগে (৩ নভেম্বর, ২০২২) কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রীর বাড়িতে গিয়েছিলেন 'মহারাজ'। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক শেষে তিনি বলেন, ‘‘পৃথক রাজ্য হয়ে গিয়েছে। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা।’’ যদিও পৃথক রাজ্যের বিষয়ে কোনও মন্তব্যই করেননি স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘‘মহারাজের সঙ্গে দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। এই বৈঠক ছিল সৌজন্যমূলক সাক্ষাৎ।’’ বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতার সঙ্গে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রীর দীর্ঘদিনের সম্পর্কের প্রসঙ্গে রাজ্যের শাসকদলের কোনো প্রতিক্রিয়া নেই।

এই শতাব্দীর সূচনালগ্ন থেকেই কোচবিহার জেলাকে পশ্চিমবঙ্গের থেকে বিচ্ছিন্ন করে আলাদা রাজ্য গড়ে তোলার দাবি নিয়ে গড়ে তোলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ‘গ্রেটার কোচবিহার পিপলস্ অ্যাসোসিয়েশন’ (জিসিপিএ) বা চলতি কথায় গ্রেটার। সংগঠনের মূল দাবি, ১৯৪৯ সালে কোচবিহারের ভারতভুক্তির সময় যে চুক্তি হয়েছিল সেটা নাকি মানা হয়নি। ভারত সরকার কোচবিহারকে জেলা করে রেখেছে। কোচবিহারকে আলাদা রাজ্য বা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করার দাবিতে তিনি অবিচল। শুধু কোচবিহার জেলা নয়, নরনারায়ণ রাজা থাকাকালীন রাজ্যের যে আয়তন ছিল, সেটাই ফেরাতে চায় জিসিপিএ। সংগঠনের দাবি অনুযায়ী, উত্তরবঙ্গের করতোয়া নদী থেকে আসামের বেশ কিছু অংশ নিয়ে গ্রেটার কোচবিহারের দাবিদার তারা। সবমিলিয়ে আসাম, বিহার এবং পশ্চিমবঙ্গের তো বটেই বাংলাদেশেরও দুটি জেলা নিয়ে 'নতুন রাজ্য' তৈরির দাবি নিয়ে গ্রেটার যাত্রা শুরু করেছিল।

স্বঘোষিত 'মহারাজ' গ্রেটারের অন্যতম নেতা। অন্য শীর্ষ নেতা বংশীবদন বর্মণ এখন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের 'রাজবংশী আকাডেমী'র অধ্যক্ষ। আপাততঃ রাজনীতি থেকে অনেক দূরে তাঁর অবস্থান। 'মহারাজ' কিন্তু সক্রিয়।

গ্রেটারের নেতা স্বঘোষিত ‘মহারাজ’ কোচবিহার শহরের কাছেই চকচকা গ্রামে একটি রাজবাড়িও বানিয়েছিলেন। তাঁর আয়ের উৎস অজ্ঞাত। একটা সময় পর্যন্ত রাজকীয় জীবনযাত্রায় তিনি অভ্যস্ত ছিলেন। তাঁর অধীনে ‘নারায়ণী সেনা’ নামে পৃথক বাহিনী রয়েছে বলে খবর পায় পশ্চিমবঙ্গের প্রশাসন। সেই বাহিনী ২০১৬-র ২৮ অগস্ট (কোচবিহারের ভারতভুক্তি হওয়ার তারিখ) তাঁকে ‘গার্ড অব অনার’ দেওয়ার পরিকল্পনা করলে তাতে বাধা দেয় রাজ্য সরকার। ‘নারায়ণী সেনা’কে সীমান্ত সুরক্ষা বাহিনী (বিএসএফ) প্রশিক্ষণ দেয় বলেও অভিযোগ করা হয়। যদিও সে অভিযোগ বরাবরই নাকচ করেছে বিএসএফ। তাঁর বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি ফৌজদারি মামলা দায়ের করা হয়। ফলে ২০২০-র আগস্ট মাসের পর থেকে 'মহারাজ' আর সেখানে থাকতে পারেন না। নানা অভিযোগে তাঁকে গ্রেপ্তারের জন্য সেই সময় পুলিশ রাজবাড়িতে হানা দিলে তিনি সপরিবারে পালিয়ে যান। তারপর থেকে আসামের চিরাং জেলার সতিবরগাঁও গ্রামে তাঁর বসবাস। তখন থেকেই সাধারণের সঙ্গে যোগাযোগ একেবারে বন্ধ। অর্থাৎ আইনের ভাষায় 'মহারাজ' একজন ফেরারি ব্যক্তি।

কেন্দ্র ও রাজ্যের শাসকদলের তাঁকে এত প্রশ্রয় দেওয়ার কারণ স্বচ্ছ নয়। একজন ফেরারি ব্যক্তিকে রীতিমতো তোয়াজ করার বিষয়ে দুইপক্ষের প্রতিনিয়ত প্রতিযোগিতা চলছে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বিচ্ছিন্নতাবাদের বিরুদ্ধে হুঙ্কার দিলেও জনৈক বিচ্ছিন্নতাবাদীর সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলেছেন। এমন আচরণ রহস্যজনক।

কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে 'মহারাজ'-এর দাবিদাওয়া নিয়ে এখনও পর্যন্ত সরকারিভাবে কোনো মন্তব্য করা হয়নি। কেন্দ্রের শাসকদলের স্থানীয় নেতাদের একাংশ পশ্চিমবঙ্গের বিভাজনের বিষয়ে মুখর। আবার তাদেরই রাজ্য ও কেন্দ্রীয় স্তরের নেতৃত্ব নীরব। 'মহারাজ' মাঝেমধ্যেই দাবি করেন যে কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে তাঁর নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে। সরকারের তরফে এ বিষয়ে কোনো স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শিলিগুড়ি হয়ে সুকনা গিয়ে যখন সরকারি সভায় উপস্থিত হয়েছিলেন তখন 'মহারাজ' তাঁর সঙ্গে একান্তে আলোচনা করেছিলেন বলে সংবাদ প্রচারিত হয়। কাজেই কেন্দ্রীয় সরকার ও শাসকদলের আচরণও সন্দেহজনক।

দৈনন্দিন জীবনের হাজারো একটা সমস্যায় জর্জরিত রাজ্যবাসী হয়তো এই ভয়ঙ্কর বিপদের দিকে নজর দেওয়ার অবকাশ পাচ্ছেন না। আর যাঁরা বিষয়টি নিয়ে অবহিত তাঁদের অনেকে মনে করছেন রাজ্য সরকারের অনুমোদন ব্যতিরেকে রাজ্যভাগের সিদ্ধান্ত কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে একতরফাভাবে নেওয়া সম্ভব নয়। তাঁরা বোধ হয় ভুলে গেছেন ২০১৯-এ সংসদে সংখ্যাধিক্যের সুবাদে জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যকে ভেঙে তিনটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করা হয়েছিল। তেমন কিছু ঘটে গেলে তখন হয়তো সেইসব প্রাজ্ঞ মানুষেরা নির্লিপ্ত হয়ে মন্তব্য করবেন, শেষ পর্যন্ত কোচবিহার নামের একটি নতুন রাজ্য (বা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল) তৈরি হয়েছে! টাকার দাম কমে যাওয়ার প্রসঙ্গে যেমন দেশের অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, ডলারের দাম বেড়েছে, টাকার দাম কমেনি - ঠিক তেমনই আর কী!

এ এক ভয়ঙ্কর প্রবণতা। বিষয়টি নিয়ে সংবাদমাধ্যমের নৈর্ব্যক্তিক আচরণ লক্ষণীয়। এই পরিসরে কেন্দ্র ও রাজ্যের শাসক আরও বেশি করে বিচ্ছিন্নতাবাদের সঙ্গে সমঝোতার সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে। বিচ্ছিন্নতাবাদের দাবিদারকে নিজেদের প্রতিনিধি হিসেবে রাজ্যসভায় পাঠিয়ে কোন বার্তা দিল কেন্দ্রের শাসকদল? তাঁর নাম প্রার্থী হিসেবে ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই তো রাজ্যের শাসকদলের প্রশ্ন তোলা উচিত ছিল। 'মহারাজ'-এর বিরুদ্ধে যে ফৌজদারি মামলাগুলি চলছিল সে সম্পর্কেও রাজ্য সরকার নীরব। আয়ের উৎস, সম্পদ বৃদ্ধি ইত্যাদি প্রশ্নের কোনো উত্তরের অনুসন্ধান করা হয়েছে কি না বলা মুশকিল। সংবাদমাধ্যমে কিছুই প্রকাশিত হয়নি। মনোনয়নপত্র পেশ করার সময় আয়-সম্পত্তি সংক্রান্ত যে হলফনামা জমা দিতে হয় সেখানে কী বলা হয়েছে? কোনো রাজনৈতিক দল বা সংবাদমাধ্যম এই প্রশ্ন তুলেছে কি?

এখন অবশ্যি আর কোনো প্রশ্ন করা যাবে না। রাজ্যসভার নির্বাচন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সম্পন্ন হয়ে গেছে। এই প্রথম পশ্চিমবঙ্গ থেকে গেরুয়া শিবিরের প্রার্থী রাজ্যসভায় নির্বাচিত হয়েছেন। এতদিনের পরিচিত 'মহারাজ' এখন মাননীয় সাংসদ নগেন্দ্র রায়।