আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ পঞ্চদশ সংখ্যা ● ১-১৫ আগস্ট, ২০২৩ ● ১৬-৩২ শ্রাবণ, ১৪৩০

সম্পাদকীয়

বিরোধী ঐক্য প্রসঙ্গে


২০২৪ সালের নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকারকে পরাজিত করা ভারতের যেকোনো গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ দল তথা ব্যক্তির প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত। বিগত ৯ বছর ধরে ভারতের রাজনীতিতে যে ফ্যাসিবাদের উত্থান আমরা প্রত্যক্ষ করেছি, ভারতের সংবিধান তথা গণতন্ত্রের উপর যে নিরন্তর প্রহার নরেন্দ্র মোদী তথা বিজেপি সরকার করে চলেছে তা দেখে আমরা বারবার শিউড়ে উঠেছি। এই সরকারকে গদিচ্যুত করা যেখানে ভারতের গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহের অবশ্যকর্তব্য, সেখানে এই প্রশ্ন বারংবার উঠেছে যে মোদীকে হারানোর জন্য বিরোধীদের তরফে কোনো গঠনমূলক এবং বড়ো কর্মসূচী গ্রহণ করতে দেখা যাচ্ছে না।

অবশেষে জুলাই মাসের মাঝামাঝি বেঙ্গালুরু শহরে দেশের ২৬টি বিরোধী দল একসঙ্গে একটি মঞ্চে সমবেত হয়ে ঘোষণা করল যে তারা বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে লড়াই করবে, মঞ্চের নাম দেওয়া হল 'ইন্ডিয়া' (Indian National Developmental Inclusive Alliance)। সন্দেহ নেই যে নামটি আকর্ষণীয়, বিশেষ করে বিজেপি-র উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে 'ইন্ডিয়া' নামটি একটি বাড়তি বার্তা রাজনৈতিকভাবে দিয়েছে। কিন্তু শুধুমাত্র নাম দিয়েই কি রাজনীতিতে সাফল্য পাওয়া যায়?

এখানেই এই জোট বা মঞ্চের পরবর্তী পদক্ষেপগুলির গুরুত্ব অপরিসীম। প্রথমত, সংসদের মধ্যে আপাতত দেখা যাচ্ছে যে এই জোট ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করছে। বিশেষ করে মণিপুর সংক্রান্ত বিষয়ে সরকারের জবাবদিহি আদায় করার জন্য যেভাবে বিরোধীরা সরকারপক্ষকে চাপ দিচ্ছে, যেভাবে সম্মিলিতভাবে প্রতিবাদ সংগঠিত হচ্ছে, অনাস্থা প্রস্তাব এনে সরকার, বিশেষ করে নরেন্দ্র মোদীকে বাধ্য করা হচ্ছে মণিপুর প্রসঙ্গে দেশের সামনে মুখ খোলার জন্য, তা দেখে দেশের বিরোধী শিবিরের কর্মী সমর্থক তথা গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষের মনে আশার সঞ্চার হতে বাধ্য।

কিন্তু সংসদের ভিতরে সরকারকে কোণঠাসা করা বা তাদের জবাব চাওয়া গুরুত্বপূর্ণ হলেও রাজনৈতিক এবং নির্বাচনী ক্ষেত্রে নির্ণায়ক নয়। রাজনীতির বৃহৎ পরিসর অর্থাৎ রাস্তায়, ক্ষেতে, কল-কারখানায়, গ্রাম-শহরে এই জোট কীভাবে বিজেপি-র রাজনীতিকে চ্যালেঞ্জ জানায় তার উপর নির্ভর করবে আগামীদিনের নির্বাচনী লড়াইয়ের ভবিষ্যৎ। এই রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান অবশ্যই হতে হবে মানুষের জন্য একটি গ্রহণযোগ্য এবং জনমুখী কর্মসূচী। যদি কর্মসূচীগত ঐক্য, অথবা একটি অভিন্ন ন্যূনতম কর্মসূচী মানুষের সামনে তুলে ধরা হয় তাহলে আগামীদিনে এই বিকল্প কর্মসূচীর ভিত্তিতে বিজেপি তথা আরএসএস-এর ঘৃণ্য রাজনীতির বিরুদ্ধে লড়াই জোরদার করা সম্ভব হবে।

এই কর্মসূচী কোন আকার ধারণ করবে তা ভবিষ্যৎ আমাদের জানাবে। কিন্তু কয়েকটি সাধারণ কথা বলা যেতেই পারে। প্রথমত, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং গণতন্ত্রকে এই কর্মসূচীর গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হতে হবে তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু বর্তমান ভারতের রাজনীতি যেখানে দাঁড়িয়েছে সেখানে শুধুমাত্র গণতন্ত্র অথবা ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে জ্ঞানগর্ভ কথা বললে বা আকাদেমিক ভাষণ দিলে জনগণের মনে দাগ কাটা যাবে না। ধর্মনিরপেক্ষতা এবং গণতন্ত্রের আধারে জনকল্যাণমূলক কর্মসূচী মানুষের সামনে তুলে ধরতে হবে। বিশেষ করে বেকারত্ব, মূদ্রাস্ফীতি, আর্থিক বৈষম্য, আর্থিক দুর্নীতি, জাতিভিত্তিক জনগণনা, এনআরসি-সিএএ বিরোধী কর্মসূচী ইত্যাদি বিষয়ে এই নতুন জোট কী বিকল্প নিয়ে মানুষের সামনে হাজির হচ্ছে তার উপরে অনেকটাই নির্ভর করবে ২০২৪ সালের নির্বাচনী ভবিষ্যৎ।

এই ন্যূনতম কর্মসূচী তৈরি করা এবং তাকে গ্রহণযোগ্যভাবে বাস্তবায়িত করা হবে - এই বিশ্বাস মানুষের মনে প্রোথিত করা সহজ কাজ হবে না। কাজটি বিবিধ কারণে জটিল এবং কঠিন। প্রথমত, যেই সমস্ত দলগুলি একজোট হয়ে বিজেপি-র বিরুদ্ধে লড়াইয়ের বার্তা দিচ্ছে তাদের রাজনৈতিক অবস্থান স্বাভাবিকভাবেই এক নয়। নবউদারবাদী নীতি এবং বিশ্বায়নের প্রশ্নে দলগুলির বিবিধ অবস্থান রয়েছে। কংগ্রেসের মতো দল নবউদারবাদী অর্থনীতির জন্ম দিয়েছে ভারতে। তাই কোনো বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প কর্মসূচী গড়ে তুলতে হলে প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলকেই তাদের প্রথাগত অবস্থান থেকে কিছুটা হলেও সরে আসতে হবে। জাতীয় স্বার্থে নিজেদের অবস্থান থেকে সরে এসে একটি সর্বজনগ্রাহ্য অবস্থানে দলগুলি এসে পৌঁছতে পারবে কি না তার উপরে অনেকটাই নির্ভর করবে ভারতের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ।

দ্বিতীয় এবং অধিক গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হল এই দলগুলির অভ্যন্তরীণ বিরোধিতা। এই বিরোধিতার একটি প্রান্তে রয়েছে কেরলে কংগ্রেস এবং সিপিআই(এম)-এর মধ্যে বৈরিতা, অন্যদিকে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস-বাম-কংগ্রেসের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব। বেঙ্গালুরুতেই এই নিয়ে কিছু বাকবিতণ্ডা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের সঙ্গে বামেদের ঐক্য হওয়া সম্ভব নয়, হওয়া উচিতও নয়। কেরলের মতো রাজ্যে কংগ্রেস এবং সিপিআই(এম) এক জোটের অঙ্গ হিসেবে লড়াই করবে এও সম্ভব হবে না। কিন্তু কিছু প্রশ্নে ঐক্যমত্য হওয়া আবশ্যিক। প্রথমত, পশ্চিমবঙ্গে একদিকে বিজেপিকে রুখতে হবে এবং অন্যদিকে তৃণমূল বাম এবং কংগ্রেস সমর্থক ও কর্মীদের উপর আক্রমণ শানাবে এটা মেনে নেওয়া যায় না। তাই রাজনৈতিক বিরোধিতা রাজ্যে হলেও অন্তত এই তিনটি দল ঐক্যমত্যে পৌঁছোনোর চেষ্টা করুক যে নিজেদের মধ্যে হানাহানি অবিলম্বে বন্ধ হবে।সাধারণ কর্মী সমর্থকদের পুলিশ প্রশাসনের মদতে হয়রানি করে অথবা দামাল ছেলেদের দিয়ে হত্যা করে কোন বিজেপি বিরোধী লড়াই করতে চাইছেন মাননীয়া? এইসব স্বৈরাচার বন্ধ না করে শুধু মোদী বিরোধী স্লোগান দিলেই হবে না। রাজ্য রাজনীতিতে যেভাবে গণতন্ত্রকে ভূলুন্ঠিত করা হয়েছে তা আর পুনরায় হবে না - এই বার্তা তৃণমূল নেত্রী কি আদৌ দেবেন?

অন্যদিকে, বামপন্থীদের বুঝতে হবে যে আপাতদৃষ্টিতে বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে ২০০৪ সালের মিল থাকলেও আসলে দুইয়ের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ফারাক রয়েছে। সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ফারাক এই যে ২০০৪ সালে বামফ্রন্ট সরকার পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় ছিল। ত্রিপুরাতে বামেদের সরকার ছিল, কেরলে কংগ্রেস ক্ষমতায় থাকলেও বামপন্থীরা যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল। সংসদে বামপন্থীদের ৪০-এর বেশি সাংসদ ছিল। কিন্তু বর্তমানে কেরল বাদ দিয়ে বামপন্থীরা কোনো রাজ্যে ক্ষমতায় নেই, লোকসভা আসনের নিরিখে বামেদের উপস্থিতি তলানিতে এসে ঠেকেছে। এই পরিস্থিতিতে ২০০৪ সালে যেই অনুঘটকের কাজ বামপন্থীরা করতে পেরেছিলেন, ২০২৪ সালে তার পুনরাবৃত্তি হওয়ার আশা করা যায় না। কিন্তু বিজেপি-র বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বামপন্থীরা বরাবর সামনের সারিতে থেকে লড়াই করেছেন, এবারেও তার অন্যথা হবে না। সেই লড়াইয়ে যদি তৃণমূল বা শিবসেনা বা নীতিশ কুমার এসে সামিল হয় তাহলে বামপন্থীদের নিজেদের অবস্থানকে আরো জোরদার করার লক্ষ্যে বিজেপি বিরোধী লড়াইকেই তীব্র করা প্রয়োজন।

এই বিবিধ প্রকারের রাজনৈতিক দলগুলিকে নিয়ে জোট অবশ্যই নানা প্রশ্নের জন্ম দেবে এবং দিচ্ছে। কিন্তু বিজেপি যে এই জোট নিয়ে যথেষ্ট চিন্তিত তা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিভিন্ন উক্তি থেকেই পরিষ্কার। 'ইন্ডিয়া' নামটি নিয়ে মোদী যা বলছেন তা শুনে চমকে উঠতে হয়। 'ইন্ডিয়া' নাম নিয়ে বিরোধীরা রাস্তায় নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে তা দেখে বিজেপি-র গাত্রদাহ হবে তা স্বাভাবিক। কিন্তু 'ইন্ডিয়া' বলতে প্রধানমন্ত্রী যদি ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন বা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উদাহরণ টানেন তাহলে বুঝতে হয় যে কতটা বিষ তাদের রাজনীতিতে রয়েছে। 'ইন্ডিয়া' জোট-টি ভারতের সংবিধান স্বীকৃত রাজনৈতিক দলগুলি তৈরি করেছে, তাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক লড়াই করার অধিকার প্রধানমন্ত্রীর রয়েছে, কিন্তু তাদেরকে দেশের প্রধান শত্রুদের সঙ্গে তুলনা করা একটি ভয়ংকর স্বৈরাচারী মানসিকতার পরিচয় দেয়। আসলে মানুষকে আবার বিভ্রান্ত করার জন্য বিজেপি এই কথাগুলি বলছে। এই নিয়ে খুব বেশি বিচলিত না হয়ে বিরোধী দলের নেতৃবৃন্দের উচিত অবিলম্বে ভারতের মানুষের সামনে তাদের বিকল্প কর্মসূচী পেশ করা।

বেঙ্গালুরুর সমাবেশ থেকে একটি লড়াইয়ের সূচনা হয়েছে। একটি আলোর রেখা ঘন তমশার মধ্যে দেখা দিয়েছে। তা আগামীদিনে দাবানলে পরিণত হবে নাকি ক্ষণিকের আলেয়ার মত নির্বাপিত হবে তা নির্ধারিত হবে আসন্ন কয়েকটি মাসে।