আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ চতুর্দশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ জুলাই, ২০২৩ ● ১-১৫ শ্রাবণ, ১৪৩০
প্রবন্ধ
ব্যক্তিগত-প্যানপ্টিকন
শ্রীদীপ
নজরদারির ব্যবস্থাপনা ও তার কাঠামো, সম্পূর্ণ পালটে গেছে গত এক দশকে। দানবীয় কয়েদ লাগবে না আর। প্রয়োজন নেই জায়গা-সাপেক্ষ, পরিকাঠামোর ভারে নুয়ে পরা ব্যবস্থাপনা, বা মাইনে-করা এক গুচ্ছ টহলদারের। পালটে গেছে টহলদারির আদল। আর প্রয়োজন নেই উঁচু দেওয়াল, ভারী তালা, মোটা শিকল।
অনুশাসন আর তত্ত্বাবধানের কাঠামোগত পরিবর্তন লক্ষণীয়। বাধ্যতা ও আনুগত্য নির্মাণ-প্রকল্পে, সর্বদা প্রয়োজন নেই ভারিক্কি আয়োজন। নাগরিকের শরীর-মন বিষয়ক আরো আরো জ্ঞান-উৎপাদন করা এবং সেই জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে, মানুষের ওপর অধিক নিয়ন্ত্রণ আরোপ করার দিন ফুরিয়েছে এমনটা নয়, তবে পালটেছে তার পদ্ধতি।
দৃষ্টি-শক্তি, তত্ত্বাবধান ও অবলোকন - যার উদ্দেশ্য আনুগত্য উৎপাদন - তা এখন স্বরচিত। স্বরচিত দৃষ্টিই, শক্তির উৎস। আবার সেই দৃষ্টিই ফাঁদ। আমরা স্বেচ্ছায়, যা কিছু ব্যক্তিগত, তা উজাড় করে দিচ্ছি দুনিয়ার সামনে। খাবার পেটে যাওয়ার আগে ছবি হয়ে ইন্সটাগ্রামে উঠছে। মুহূর্ত বা মতামত অনুভব করা মাত্র তা ফেসবুক-এ না দিলেই নয়। সবকিছুই সর্বদা দৃশ্য বা বিজ্ঞপ্তি হয়ে, বিতরণের অপেক্ষায়। আমরা সকলেই চলমান ও জ্যান্ত বিজ্ঞাপন। ক্রয়, ভ্রমণ, সোহাগ, প্রাপ্তি, প্রত্যাখ্যান - সকলই বৃথা, প্রদর্শিত ও বিতরণযোগ্য না হলে। আমরা সকলেই দৃশ্য-মুদ্রা। আমরা মিনিটে-মিনিটে, নির্দ্বিধায় সরবরাহ করছি নিজ শরীর, অবস্থান, আবেগ, অনুভব, মতামত ইত্যাদি। আমাদের সকলের হাতেই ‘ব্যক্তিগত-প্যানপ্টিকন' - মুঠোফোন। আদি প্যানপ্টিকন-এর তুলনায় এ অধিক অন্তরঙ্গ, নিকটস্থ, ঘনিষ্ঠ ও কার্যকরী। নিজেকে দৃশ্যপণ্যে পরিণত করার প্রবৃত্তি পূর্বে থাকলেও, সরল ও অবাধ হাতিয়ার ও মঞ্চ ছিল না। আজ সেই মঞ্চ, সেই অধিকার ও নিজেকে ক্ষণে ক্ষণে উন্মোচিত করার যন্ত্র সবার হাতে, পাতে, দিনে-রাতে।
সেই অধিকার লাভের সাথে সাথে, সূচনা হয়েছে, নানা প্রকারের তুলনা ও প্রতিযোগিতা যা আদতে চূড়ান্ত আত্মকেদ্রিক। যৌবন, ওজন, উপস্থিতি - সকলই সদা প্রশংসার অপেক্ষায়। উন্মোচন-কেন্দ্রিক ভীতির অবসান হয়েছে; এসেছে উন্মোচন-সুখ। ‘ব্যক্তিগত-প্যানপ্টিকন'-এর মূল শর্তই হলোঃ অনবরত আত্ম-সমীক্ষা ও আত্ম-বিতরণ - অর্থাৎ নিজেকে নিয়ে সর্বদা মেতে থাকা। নিজেকে সযত্নে চেটে, কেটে, ঘষে, মেজে প্রদর্শনের জন্য প্রস্তুত রাখা। এই ব্যবস্থার অন্তর্গত বহুবিধ নিয়ন্ত্রণ - খাদ্যাহার, প্রসাধন, শরীরচর্চা, প্রয়োজনে অস্ত্রোপচার। সেখানে অতিরিক্ত ওজন, বয়সের চিহ্ন, ত্বকের অবাঞ্ছিত ভাঁজ - এ সবের বিরুদ্ধে ঘোষিত বাজারি জেহাদ।
এই স্ব-দৃশ্যের রমরমা, এক ধরণের ফাঁদ। কারণ কোনো টার্গেট-এরই অন্তিম বলে কিছু নেই; থাকতে পারে না। মেদ ঝরিয়ে পেশী নির্মাণ; বা কালো থেকে ফর্সা; চুলের ঘনত্ব হোক বা ত্বকের জেল্লা; কোমরের বাঁক হোক বা স্তনের আঁটোসাঁটো ভাব - গোটা ব্যাপারটা দাঁড়িয়েই আছে অসন্তোষ ও অপ্রাপ্তির ওপর। এ সবের মূলে একটাই লোভী ভাবনাঃ আরো চাই, আরো চাই। আরো রোগা। আরো পেশীবহুল। আরো বাঁক। আরো ঝাঁক। আরো মসৃণতা। আরো জৌলুশ। এর কোনো শেষ নেই। তাই যেকোনো আকাঙ্ক্ষিত গন্তব্যই স্বল্পস্থায়ী। আর যেকোনো পূর্বনির্ধারিত গন্তব্যই একটি কল্পিত বাজারি মডেল।
বাজার ক্রমাগত অসন্তোষ নির্মাণ করে যাচ্ছে। আবার সেই বাজারই সমস্যার সমাধান হিসেবে আপনার আমার হাতে পণ্যদ্রব্য ধরিয়ে দেয়। আপনার আমার মধ্যে রোপন করা উদ্বেগ ও খামতিই তো পণ্য-সংস্কৃতির আসল মূলধন। সেটা জেনে বুঝেই আমরা আকৃষ্ট হই আরো একটা নতুন পণ্য বা প্রসাধন বা প্রণালীর প্রতি। আত্মবিশ্বাসের অভাব? এই নিন এক আত্মবিশ্বাস প্রদানকারী সুগন্ধি। নারী আকর্ষণে অক্ষম? এই কেতাদুরস্ত বাইকটা কিনে ফেলুন, ধারের টাকায়। ত্বকের ঔজ্জ্বল্য আরো দু-সেড ফরসা হলে তবেই উপযুক্ত পাত্র জুটবে পুরুষতান্ত্রিক নিয়ম মেনে? তেমন ক্রিম আছে তো। গালের চামড়া ঝুলে যাচ্ছে? সেকি চল্লিশেই যৌবনকে টাটা বলবেন কেন? বাজারে এলো আরো একটা চামড়া টানটান করার সেরাম। কোনো নির্দিষ্ট অঙ্গের আকার বা আয়তন সঠিক নেই? এই নিন সেটা ঢাকার জন্য বিশেষ আবরণ।
নিজেকে সাজিয়ে গুছিয়ে সমাজমাধ্যমে নিজের সাম্প্রতিকতম ছবিটির তৎক্ষণাৎ পরিবেশনটি না হলেই যে নয়। যার আদলে আমরা নিজেকে সাজাচ্ছি, সেটি কোনো সত্য নয়। সেটি একটা আলেয়া। একটা আদর্শ শরীরের রূপরেখা। সেটা নির্মাণ করে, তাকে লালিত পালিত শানিত করে, সুসজ্জিত করেছে বাণিজ্যিক সাম্রাজ্য। আমাদের শরীর-মন তাতে প্রলুব্ধ হয়। আমরা সেটা চড়া দামে কিনি, এক অলীক সাফল্যের আশায়।
উন্মুক্ত উরুবৃত্ত জুড়ে যে ঔদ্ধত্য, ওজন ছাড়া হারাবার কিই বা আছে তার?
জিম-সাধনার পরিচয়, নাভির চারিধারে।
কোমরবাঁকে, খাওয়া না খাওয়ার, নির্ধারিত ডায়েট উপত্যকা।
অস্ত্রোপচারের কারসাজি, শান দিয়েছে নাকে।
পুরু হয়েছে, ঠোঁটের উপরিভাগ।
ত্বকে - দুধতেল মাখানো শিবলিঙ্গের মসৃণতা।
চুলে - ঝরে-আক্রান্ত অভিসার-উচ্ছাস।
চোখেমুখে লালসার তপ্ত লাভা।
বুকের হাল্কা-গভীর ভাঁজে আমার পত্তন।
অবাঞ্ছনীয় মেদ ঝরিয়ে শানিত শরীর, সাফল্যের স্তম্ভ যেন।
কঠিন তপস্যার ফলস্বরূপ এ মায়াজাল, আমাকে টেনে নেয় তার নরমে।
আমি স্বেচ্ছায় প্রলুব্ধ হই প্রতিবার, অগোচরে সারা দেই দৃশ্য-আহ্বানে।
কোনো এক অদৃশ্য সত্তা, আমায় টেনে নিয়ে যায়।
স্পর্শ করা যায় এমন সব শরীর ফেলে, পড়ে থাকি এক অবাস্তবে।
ছবির-শরীর আর শরীর-ছবিরা মিলিত হয়।
আমি হয়ে উঠি আপাদমস্তক দৃশ্যগত।
কল্পনার প্রেক্ষাগৃহে দেহ ঢুকে যায় ছবির ভিতরে, ছবি ভেদ করে আমায়।
আমার পরমাণুরা ধাওয়া করে এক অলীক দেহ-লক্ষ্যকে।
ঘাম ছাড়ে রক্ত মাংসের শরীর।
শরীর হয় শক্ত-সুঠাম, পোক্ত, দৃশ্য মনোরম।
ভিন্ন মহাদেশ থেকে আসা আকৃতির আদলে,
অনুলিখিত হয় শ্যানেল, ভার্সাচে, আর্মানির শরীর - আমার শরীরে।
তাদের কাঠামো অনুকরণে প্রতিনিয়ত হই নতুন।
কেটে, ছেঁটে, ফিল্টার চাপিয়ে, ব্রণ মুছে, বিতরণ করি এ সামর্থ শরীর।
ছবি গিলে শরীর বানাই।
শরীর বানিয়ে তাকে অনুবাদ করি ছবিতে।
ছবির-শরীর, আর শরীর-ছবিদের মিলন-স্পর্শে গড়ে ওঠে, আরো এক ক্ষণস্থায়ী সত্তা।
ফেসবুকে খুঁজি ভালোলাগার নীল বৃদ্ধাঙ্গুল, প্রশংসাসূচক বাণী।
দৃশকে মনে হয় একমাত্র প্রচলিত মুদ্রা।
সদৃশ্য আমি,
ছবি তুলতে তুলতে অগ্রসর হই বিলুপ্তির পথে। [১]
______________________________
১) স্বরচিত কবিতাটি ‘আমি (ও) পণ্য’ কাব্যগ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত। ঋত প্রকাশনী। ২০২১।