আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ চতুর্দশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ জুলাই, ২০২৩ ● ১-১৫ শ্রাবণ, ১৪৩০
প্রবন্ধ
অ্যামাজন অরণ্যে চার খুদের চল্লিশ দিন
স্বপন ভট্টাচার্য
জঙ্গলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এক আধটা সংকেত। যেমন, আধখাওয়া ফল যার গায়ে স্পষ্ট বাচ্চার দাঁতের দাগ, একটা দুধের বোতল, একটা কাঁচি, জঙ্গলের মাটিতে প্রায় মিশে থাকা ন্যাপি, গুঁড়ো ময়দার অবশেষ ইত্যাদি। এ’সবই ইঙ্গিত করছিল হয়তো বাচ্চারা বেঁচে রয়েছে। বাচ্চারা চারজন। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বড়জন তেরো বছর বয়সের কিশোরী লেসলি মুকুতিই। বাকিরা হল যথাক্রমে নয় বছর বয়সী সোলেনি রানোক মুকুতিই, চার বছর বয়সী তিয়েন নোরিয়েল রানোক মুকুতিই এবং সবচেয়ে ছোটটি - ক্রিস্টিয়ান রানোক মুকুতিই - তার বয়েস দুর্ঘটনার সময় ছিল মাত্র এগারো মাস। অ্যামাজনের বৃষ্টিবিঘ্নিত ঘন এবং ভার্জিন অরণ্যে এরা কীভাবে চল্লিশ দিন বেঁচে রইল তা আক্ষরিকভাবেই ‘মিরাকল’ বলে আখ্যাত হয়েছে এই কারণে যে অরণ্যের মানুষের বিশ্বাস ‘মাদার আর্থ’ তাদের বাঁচিয়ে রেখেছিল বলেই তারা বেঁচেছে, ফিরিয়ে দিয়েছে বলেই তারা ফিরেছে এবং এই কারণেও যে তাদের দেখা মেলার পরে যে কোড সংকেত হিসেবে উদ্ধারকারী দলের সরকারি স্তরে পাঠিয়ে দেবার কথা ছিল তা হল তিনবার উচ্চারিত একটিমাত্র ইংরেজি শব্দ - মিরাকল্, মিরাকল্, মিরাকল্।
অতিমারি ও যুদ্ধক্লান্ত এই বিষণ্ণ পৃথিবীতে এই খুদেদের বেঁচে থাকার কাহিনির থেকে আত্মশক্তির বড় নজির আমার জানা নেই। বাচ্চারা এখনও দুর্বল এবং হাসপাতালে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে উঠছে। এখনও নিজেদের কথা বিবৃত করার মতো অবস্থায় পৌঁছোয়নি তারা, অথবা অত্যন্ত বিবেচনার সাথেই তাদের নিকটাত্মীয় ছাড়া বাকিদের সঙ্গে যোগাযোগে নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা হয়েছে। তারা বলবার মতো অবস্থায় এলে আমরা পুরোপুরি বুঝতে পারবো বিষাক্ত কীটপতঙ্গ, হিংস্র জাগুয়ার বা অ্যানাকোন্ডার বাসভূমি শেয়ার করে এক দুই দিন নয়, এক দুই সপ্তাহও নয়, পুরো চল্লিশ দিন কীভাবে দিন গুজরান করেছিল তারা!
কিন্তু জঙ্গলে তাদের ভয় যতটা জীবজন্তুজনিত ছিল তার চেয়ে অনেক বেশি ছিল মানুষের। কেন না তাদের চার বন্ধুকে তারা জঙ্গলের মধ্যেই কলম্বিয়ার জঙ্গি ড্রাগ ব্যবসায়ীদের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যেতে দেখেছে। হয়ত এই গেরিলাদের দলে যোগ দিতে তারা অস্বীকার করেছিল অথবা অপহরণের পর দাবিমতো মুক্তিপণ পায়নি গেরিলারা। অরণ্যের আদিবাসী যুবক এবং বাচ্চাদের জোর করে দলে ভিড়িয়ে নিয়ে এরা ব্যবসাটা চালিয়ে যাবার মত লোকবল পেয়ে থাকে। এই ড্রাগ ট্র্যাফিকাররা আমাজন অরণ্যের হুইতোতো আদিবাসী গোষ্ঠীর এই পরিবারটিকে কার্যত উৎখাত করে। বাচ্চাদের বাবা ম্যানুয়েল রানোক এই হুইতোতো গোষ্ঠীর একজন নেতা। খেতাবী নাম গভর্নর। কিন্তু বাচ্চা ও পরিবারকে রেখে তাকে জঙ্গলের বাস ছাড়তে হয় জঙ্গিদের ভয়ে। বাচ্চাদের আকাশসফর এই প্রথমবার নয়। মাত্র একমাস আগেই এই রকম এক সেসনা প্লেনে তারা তাদের আরারাকুয়ারা গ্রাম থেকে উড়ে সান হোসে দেল গুয়াভিয়েরে-তে ঘুরে আসে। তাদের বাবা ম্যানুয়েলের সাময়িক নিবাস সেখানেই। পয়লা মে তারা দ্বিতীয়বার চার্টার্ড করা ছোট্ট সেসনা ২০৬ আকাশযানে সওয়ার হয়। অনুমান করা যায় আদিবাসী হলেও গভর্নর ম্যানুয়েল কিছুটা সম্পন্ন নিশ্চয়ই ছিলেন।
প্লেনে প্রাপ্তবয়স্ক বলতে পাইলট ছাড়াও ছিল বাচ্চাদের মা এবং অপর একজন। কিছুটা ওড়ার পর প্লেনটির ইঞ্জিন বিগড়োয় এবং গভীর জঙ্গলে ভেঙে পড়ে সেটি। হেলিকপ্টারে জঙ্গলের ওপর লাগাতার চক্কর দেবার পর উদ্ধারকারী দল ভেঙে পড়া সেসনা-র হদিশ পায় মে মাসের ৬ তারিখ। প্লেনে পাইলটসহ তিন প্রাপ্তবয়স্কের দেহও মেলে, কিন্তু বাচ্চাদের কোথাও পাওয়া যায় না। প্লেন থেকে নামা ওঠার কিছু কচি কচি পায়ের ছাপ কাদামাটিতে এবং প্লেন থেকে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া কাসাভা ময়দার গুঁড়ো - এ ছাড়া এমন কোন সংকেত ছিল না দুর্ঘটনাস্থলে যা থেকে অনুমান করা যেতে পারে তারা হয়ত বেঁচে আছে, তবে প্রায় নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছিল যে বাচ্চারা দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায়নি। এক মাসেরও বেশি দিন ধরে চলা এই রেসকিউ অপারেশনের নেতৃত্বে শুরুতে ছিল কলম্বিয়ার সেনা ও আধাসেনাদের নিয়ে তৈরি বিশেষ উদ্ধারকারী দল। জঙ্গলের এই অংশটি কাকোতা এবং আমাজোনাস অংশের অন্তর্বর্তী চিরিবিকেতে ন্যাশানাল পার্ক এরিয়ার মধ্যেই পড়ে কিন্তু এই অংশের মধ্যেই রয়েছে অরণ্যজীবী একাধিক উপজাতি গোষ্ঠী যারা এখনও ‘আনকন্ট্যাক্টেড’ অর্থাৎ নিয়মিতভাবে তথাকথিত সভ্যতার সংস্পর্শে এরা নেই। বাসস্থান থেকে খাদ্য - সবকিছুর জন্যই এরা অরণ্যের উপর নির্ভরশীল। আরারাকুয়ারার এই বাচ্চারাও শিশুকাল থেকেই অরণ্যকে মাতারূপে দেখে। উদ্ধারকারী দলের পক্ষে কেবল হেলিকপ্টার টহলে এই চিরহরিৎ এবং ঘন সুউচ্চ অরণ্যক্যানোপী ভেদ করে ভূমিতে নজর রাখা অসম্ভব ছিল। বাচ্চাদের উদ্ধার করা হয় ভেঙে পড়া সেসনা আকাশযানের থেকে মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূরে এক অপেক্ষাকৃত পরিষ্কার জায়গাতে। দ্বিশতাধিক সশস্ত্র মানুষের সেখানে পৌঁছোতে মাসাধিককাল সময় লেগেছিল - শুধু এই একটা তথ্যই বলে দেয় কতটা বিপজ্জনক এবং নিবিড় এই অরণ্য। পরে তাঁরা বলেছেন - আমরা একজন আর একজনের থেকে দশ-পনের মিটার বা চোখের নজরের চেয়ে বেশি দূরত্বে কখনও যাইনি, কেন না যে কোনো মুহূর্তে আলাদা হয়ে গেলেই এই জঙ্গলে চিরকালের জন্য হারিয়ে যাবার সম্ভাবনা, যেমন হারিয়ে গেছে উদ্ধারকারী দলের সঙ্গে আসা বেলজিয়ান কুকুর ‘উইলসন’। বস্তুতপক্ষে, উদ্ধারকাজ শুরু হওয়ার অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই সে নিখোঁজ হয়েছিল। মনে করা হয়েছিল তাকে হয় সাপে গিলেছে নয় জাগুয়ারের শিকার হয়ে থাকবে সে। কিন্তু পরে জানা গেছে, সে বাচ্চার ছোট্ট জুতোর ঘ্রাণ থেকে ক্লু পেয়ে বেশ কয়েকদিন আগেই পৌছে যেতে পেরেছিল বাচ্চাদের সাময়িক ডেরায়। এমন কি বাচ্চাদের সঙ্গে তার বেশ ভাবও হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ডেরা ছেড়ে বেরিয়ে অরণ্যে বেহদিশ হয়ে যায় উইলসন, বাচ্চাদের দেখা মেলার কয়েকদিন আগেই, তাকে আর পাওয়া যায়নি যদিও বাচ্চাদের উদ্ধারের পরেও কুকুরটির জন্য খোঁজ জারি ছিল।
যাই হোক, কেবল সেনা আর আধাসেনাদের নিয়ে এই উদ্ধারপ্রচেষ্টা ‘অপারেশন হোপ’ যে সমুদ্রকে না চিনে ডুবুরির মুক্তো তোলার সামিল তা সেনারা সপ্তাহখানেক পরেই বুঝে গিয়েছিলেন এবং বোঝেন তেমন মানুষদের সার্চ অপারেশনে জুড়ে নেওয়া দরকার যারা জঙ্গলটাকে চেনে। অরণ্যের সঙ্গে অরণ্যবাসীদের সম্পর্ক মাতা ও সন্তানের। সার্চে নামার আগে বড়রা জঙ্গলের স্পিরিটের কাছে অনুমতি চেয়ে নেয় ‘to open the way to be able to be in the territory’ - যাতে অরণ্যমাতা জঙ্গলের সেই অঞ্চলে তাদের পৌঁছানোর জন্য পথ করে দেন যেখানে বাচ্চারা রয়েছে। তাদের কাছে জঙ্গলের প্রতিটি উপাদানের রয়েছে নিজ নিজ আত্মা - নদী, গাছ, জন্তু এবং পাহাড় - সকলের। উদ্ধারকার্যে নামার আগে অরণ্যের প্রাচীন বিশ্বাস থেকে এই আদিবাসী সহায়করা নিশ্চিত ছিল যে, বাচ্চাদের আশ্রয় দিয়েছে জঙ্গল এবং তাদের যে পাওয়া যাচ্ছে না, সেটা আদিবাসীদের বিশ্বাস, জঙ্গল তাদের বেরোতে দিচ্ছে না, তাই। উদ্ধারের পরে, এদের নেতা, ইউল যার নাম, বলেছেন - বাচ্চারা অরণ্যের, অরণ্যমাতা তাদের আশ্রয় দিয়েছিলেন, তিনিই তাদের সন্ধান দিয়েছেন। তাঁর কথায় “indigenous children must be protected because they are badly beaten” - আদিবাসী বাচ্চাদের রক্ষা করুন, কেন না তারা বাজেভাবে মার খাচ্ছে।
সরকারী সেনাবাহিনী আর ড্রাগ ব্যবসায়ী ডনদের ভাড়াটেবাহিনী - এই দু’য়ের মধ্যে পড়ে আদিবাসী কিশোর-কিশোরীদের প্রতিদিনকার জীবনে ভয় আর কিছু নয়, বারুদকে। অরণ্যকে ভয় পায় না তারা, তবু, প্রাণের দায়ে তারা বাধ্য হয় অরণ্য ছেড়ে শহরের ঘেটোয় আশ্রয় নিতে, যেমন এই বাচ্চাদেরও হয়ত চিরকালের জন্য জঙ্গল ছেড়ে চলে যেতে হবে। ড্রাগ ট্র্যাফিকারদের হাতে ধরা পড়বার ভয় এই বাচ্চাদের এত গভীরভাবে গ্রাস করেছিল যে জঙ্গলে রেসকিউ টিমের লোকজনের গলার স্বর পেয়ে তারা ভেবে নিয়েছিল এরা নিশ্চয়ই সেই মাফিয়ারা যারা তাদের বন্ধুদের মেরে ফেলেছে এবং এখন তাদের খুঁজে বেড়াচ্ছে। ফলে, আরও গভীরতর বনভূমির দিকে পালিয়ে যায় তারা। এক সময় হেলিকপ্টারে জঙ্গলের ওপর থেকে তাদের ঠাকুরমার রেকর্ড করা বার্তা সম্প্রচার করা হয় তাদের নেটিভ ভাষায়। বার্তা তাদের কানে পৌঁছায় ঠিকই কিন্তু তখনও তাদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে এসব নেহাতই গেরিলাদের কারসাজি, ফলে তারা সাড়া দিতে ভয় পাচ্ছিল। উদ্ধারকারী দল তাদের দুর্ঘটনার চল্লিশ দিন পরে, একটি শিশুর কান্নার আওয়াজ লক্ষ্য করে এগিয়ে গিয়ে যখন তাদের খুঁজে পায় শেষ পর্যন্ত, তখন প্রথম কথা বলে ওঠে চার বছর বয়সী তিয়েন, বলে - "আমার মা মরে গেছে"। উদ্ধারকারী দল অবশ্য তা আগেই জানতো, কেন না তারা যখন ভেঙে পড়া সেসনার ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পায় তখন তিন জন পরিণতবয়স্ক মানুষের দেহও পাওয়া গিয়েছিল যাদের মধ্যে ছিলেন বাচ্চাদের মা ম্যাগদেলেনা। লেসলি’র প্রথম কথা ছিল - "আমার খিদে পেয়েছে"। বাচ্চারা তখন কঙ্কালসার, দুর্বল, কিন্তু চল্লিশ দিন জঙ্গলে কাটিয়ে দেবার পরে মেডিক্যাল পরিভাষায় ‘ইন অ্যাকসেপ্টেব্ল কন্ডিশন’।
তাদের হেলিকপ্টারে এয়ারলিফ্ট করে নিয়ে আসা হয় বোগোটার সেনা হাসপাতালে। বস্তুত এই লেখা লেখার সময় পর্যন্ত তারা সেখানেই সুস্থ হচ্ছে ধীরে ধীরে, এবং এখনও প্রেসের সামনে তাদের আনা হয়নি। তারা যখন নিজেদের কথা বলতে পারবে তখন সারা পৃথিবী জানবে ঠিক কোন কোন অবস্থার মধ্যে দিয়ে তাদের যেতে হয়েছিল, কিন্তু একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় অরণ্যের সন্তান বলেই তারা নিজেরা তো বেঁচেছেই, বাঁচিয়েও রাখতে পেরেছে মাত্র এগারো মাস বয়সী কনিষ্ঠতম সহোদরটিকেও। আমাদের দিনাতিপাতের সাধারণ অভিজ্ঞতায় এখনও আমি চেষ্টা করেও কল্পনা করতে পারি না কী ভাবে সম্ভব হয়েছিল সেটা! বাচ্চাদের ঠাকুরমা ফতিমা ভ্যালেন্সিয়া-র কথায় ওদের বাঁচিয়ে রেখেছে অরণ্যের ‘দুয়েন্দে’। 'দুয়েন্দে' কথাটা স্প্যানিশ কবিতার সূত্রে জেনেছি আমরা, স্প্যানিশ কথকতার অদৃশ্য আত্মা সেটা। ফতিমা-র কথায় অরণ্যের দুয়েন্দে সতত বিচরণশীল এক প্রাণী - আইরিশ গাথার লেপ্রেকন সদৃশ বুঝি তা, জঙ্গলের নিহিত সম্পদ পাবার জন্য যাঁর আশীর্বাদ পেতে হয়। এসবই লৌকিক বিশ্বাসের কথা যা অরণ্যবাসী আদিবাসী চেতনায় প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে লালিত হয়ে এসেছে এবং তাদের রোজকার জীবনযাত্রার চালিকাশক্তিই হল এই আস্থা যে অরণ্যমাতা তাদের প্রতিপালক। সেই মাতাকে বিপন্ন করার মত কাজ তারা করে না। বনভূমি ধ্বংস করে মারিজুয়ানার চাষ জোর না করলে এদের দিয়ে করানো যাবে না।
বাচ্চাদের বস্তুত এই চল্লিশ দিন ধরে বাঁচিয়ে রেখেছে অরণ্য, কিন্তু তার জন্য দরকার ছিল প্রজন্মান্তরে সঞ্চারিত ওই ট্রাডিশন। শহুরে বাচ্চাদের পক্ষে তা অসম্ভব ছিল। এদের ক্ষেত্রে তা সম্ভব হয়েছে। এই জীবনগাথার মূল চরিত্র বলে কাউকে যদি চিহ্নিত করতে হয় সে হল লেসলি। তার পরিস্থিতিকে অনুধাবন করবার ক্ষমতা, সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা, জিজীবিষার পরিপূরক ধীশক্তি এবং নেতৃত্ব দেবার ক্ষমতা অবাক করেছে কলম্বিয়ার প্রতিটি মানুষকে এবং একই সঙ্গে সারা বিশ্বকে। “We have to recognise not only her bravery but also her leadership,” হাসপাতালে বাচ্চাদের সঙ্গে কথা বলার পর বলেছেন ইভান ভ্যালেস্কুয়েজ, কলম্বিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যিনি। “We can say that it was because of her that her three younger siblings could survive by her side, thanks to her care and her knowledge of the jungle.” - আমরা কেবল বলতে পারি শুধু তার (লেসলি) জন্যই তার তিন সহোদর জঙ্গলে প্রাণে বেঁচে ছিল, তার পরিচর্যা এবং জঙ্গলের জ্ঞানকে আমাদের ধন্যবাদ জানাতেই হবে!
এক ইঞ্জিনের সেসনা গভীর জঙ্গলে ভেঙে পড়ার পর প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে উঠে লেসলি দেখতে পায় তিন মৃত বা অর্ধমৃত আরোহীর দেহের তলায় চাপা পড়ে থাকা একজোড়া ছোট্ট পা তখনও নড়ছে। সে টেনে বার করে প্রথম জন্মদিন কাটাবে যে শিশু লোকপৃথিবী থেকে অজ্ঞাতবাসে - সেই ক্রিস্টিনকে। এবং অবাক হয়ে সে দেখে আরোহী চার খুদেই জীবিত এবং তাদের মা তখনও বেঁচে রয়েছে। চারদিন এই ভাঙা প্লেনের আশেপাশেই ছিল তারা, মা ম্যাগদালেনাকে ছেড়ে আসতে তাদের মন চায়নি। চারদিন কেটে যাবার পর, যখন কোনো সহায়তার চিহ্ন আশেপাশেও নেই, তখন মা বাচ্চাদের বলে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ কোন আশ্রয়ের খোঁজে যেতে। অনুমান করতে পারি মৃতপ্রায় মা’কে ছেড়ে দূরে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নেওয়াটা লেসলির পক্ষে কতটা কঠিন ছিল! কিন্তু উদ্ধারের কোনো আশা যখন নেই তখন এই সিদ্ধান্ত তাকে নিতেই হতো কেননা ক্রমশ পচে উঠতে থাকা মৃতদেহের গন্ধ হিংস্র জন্তুদের আকর্ষণ করতে পারতো। তবে, আগেই বলেছি, তাদের সবচেয়ে বেশি ভয় ছিল শহুরে সভ্য মানুষকে।
ভেঙে পড়া প্লেন থেকে লেসলি পায় কয়েক বস্তা ‘ফারিনা’ - কাসাভা স্টার্চের ময়দা। কাসাভা মূল থেকে পাওয়া যায় স্টার্চ। গ্রীষ্মমন্ডলীয় দেশে অন্যতম প্রধান খাদ্য কাসাভা। এই অজ্ঞাতবাসে লেসলিদের মুখ্য খাবার ছিল এটাই তবে কেবল কাসাভা ময়দায় চল্লিশ দিন কাটিয়ে দেওয়া হয়ত বা সম্ভব ছিল না যদি না অরণ্যের সঙ্গে তার প্রজন্মান্তরের সখ্য তাকে চিনিয়ে দিত কোন ফলটা খাবার আর কোনটা বিষাক্ত এবং বর্জনীয়। সৌভাগ্য এটাই যে অরণ্য এই সময় ছিল পূর্ণগর্ভা - ‘ইন ফুল হারভেস্ট’ যাকে বলে। সাদা রঙের এক রসালো আমাজন ফলন Couma macrocarpa তারা কুড়িয়ে পেত প্রভূত পরিমাণে। এছাড়া ছোট ছোট লাল রঙের চেরিসদৃশ একটা ফল Oenocarpus bacaba তাদের জন্য অরণ্যের উপহার। যে একশোর বেশি ফুড প্যাকেট তাদের জন্য এয়ারড্রপ করা হয়েছিল তার মধ্যে একটিমাত্র কুড়িয়ে পেয়েছিল তারা। শুধু তাই নয়, জলের উৎস বেছে নেওয়াতেও লেসলি বিবেচনার পরিচয় দিয়েছিল। ঠাকুমা ফতিমা ভ্যালেন্সিয়ার কাছ থেকে সে জেনেছিল অনবরত বৃষ্টিবিঘ্নিত গভীর এই অরণ্যে প্রাকৃতিক জলের অজস্র সাময়িক উৎস তৈরি হয়ে যায় বটে কিন্তু সেগুলো বাচ্চাদের পক্ষে মারাত্মক হতে পারত। অদূষিত জল সঞ্চয়ের জন্য তার এই ট্রাডিশনাল জ্ঞান ভীষণভাবে কাজে লেগেছে, নতুবা এগারো মাসের শিশুকে বাঁচানো সম্ভব হত না।
ভাঙা প্লেন ছেড়ে আসার আগে লেসলি ধ্বংসস্তুপ থেকে একটা ব্যাগে গুছিয়ে নেয় কাপড়চোপড় যা নিয়ে হয়ত বা তারা রওনা হয়েছিল, গুছিয়ে নেয় টাওয়েল, একটা টর্চ, দুটো মোবাইল ফোন এবং একটা মিউজিক বক্স এবং ফিডিং বটল। ঘটনাস্থল থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে যেখানে তাদের পাওয়া গেল সেটা একটা টিলার ওপর কিছুটা ফাঁকা গোছের জায়গা। গাছের পাতা দিয়ে সেখানে একটা সাময়িক আস্তানা বানিয়েছিল লেসলি তার অর্জিত জ্ঞান থেকেই। কিন্তু গেরিলা ট্র্যাফিকারদের ভীতি এতোটাই পেয়ে বসেছিল তাদের যে এক আধবার উদ্ধারকারী দলের পঞ্চাশ মিটার দূরত্বেও গাছের গুঁড়ির মধ্যে আত্মগোপন করেছে তারা তবু সাড়া দেয়নি। শেষ পর্যন্ত শিশু ক্রিস্টিনের কান্নার আওয়াজে তাদের হদিশ মেলে। জঙ্গলের এই অংশে শাসন চলে ক্যারোলিনা রামিরেজ-এর নেতৃত্বে ‘ফার্ক’ জঙ্গিদের এবং বাচ্চাদের যেখানে পাওয়া গেল তার মাত্র আড়াই কিলোমিটারের মধ্যে এদের একটা পরিত্যক্ত ক্যাম্পও পাওয়া গেছে। এরা তখন সে অঞ্চলে থাকলে বাচ্চাদের সহজেই অপহরণ করতে পারতো।
এই উদ্ধারকার্য সম্পন্ন হতে দেরি হয়েছে ঠিকই কিন্তু কলম্বিয়ার মিলিটারি চেষ্টার কসুর করেনি। এগারোটা হালকা বিমান ও কপ্টারের সাহায্য নিয়েছিল তারা। তিনশো মিলিমিটারের বেশি অঞ্চলের মাথার ওপর দিয়ে উড়েছে সেগুলি। দশ হাজারের বেশি লিফলেট বিলি করেছে, একশোর বেশি সারভাইভাল কিট নামিয়েছে জঙ্গলে, দেড়শো সেনা ও দুশো স্থানীয় এবং স্বেচ্ছায় যোগ দেওয়া ভলান্টিয়ারকে নিয়ে মাসাধিককালের এই উদ্ধারকাজে অরণ্যের মানুষদেরই বারবার ব্যর্থ হতে হয়েছে। বোঝা যায় বৃষ্টিস্নাত আমাজন অরণ্য ঠিক কতটা নিবিড় ও দুর্গম হতে পারে! বাচ্চাদের ঠাকুরমা ফতিমার মত আমাদেরও বিশ্বাস করতে ভালো লাগে ‘মাদার আর্থ’ ওদের ফিরিয়ে দিয়েছে আর বিশ্বাস রাখতেই হয় তাদের আত্মশক্তিতে। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বেঁচে থাকবার সহজাত প্রবৃত্তি নিয়েই তাদের জন্ম ও বেড়ে ওঠা। ‘সারভাইভাল ইনস্টিংক্ট’ থেকে মানুষ অনেক অসাধ্য সাধন করতে পারে, কিন্তু একটা দুধের বাচ্চাকেও এতদিন ধরে বাঁচিয়ে রাখতে পারে, এমন ঘটনার নজির আর একটিও রয়েছে কিনা জানি না। তাই আরও অনেকের মতো তাদের মুখ থেকে তাদের কথা শোনবার প্রত্যাশায় রয়েছি আমরাও।