আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ চতুর্দশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ জুলাই, ২০২৩ ● ১-১৫ শ্রাবণ, ১৪৩০

প্রবন্ধ

ডারউইন তোমায় দিলাম আজকে ছুটি

অর্ধেন্দু সেন


যদি বলি বিশ্ব-জগতের সৃষ্টিতে ঈশ্বরের কোনও হাত নেই, কোনওদিন ছিল না? যদি বলি এই সুবিশাল জগত নিজেই চলে নিজের নিয়মে, ভগবানের দায়িত্ব নয় একে চালানো? অনেকেই ভাববেন পঞ্চায়েত নির্বাচনে টিকিট চেয়ে পাইনি। তাই অমন কথা বলছি। ইট কাঠ বালির বস্তুজগৎ নাহয় ছেড়েই দিলাম। কিন্তু জীবজগত? প্রাণের পরশ তো ভগবানই দিয়েছেন? মাইকেলেঞ্জেলোর 'গিফট অফ লাইফ' দেখার পর সন্দেহের অবকাশ থাকে?

প্রায় দু'হাজার বছর ধরে এ বিষয়ে শেষ কথা বলেছে খ্রিস্টান চার্চ। চার্চের মত ছিল যে দয়াময় ঈশ্বর বিশ্বের সৃষ্টি করেছেন ছয় দিনে। সপ্তম দিনে তিনি বিশ্রাম নিয়েছেন। এই কারণেই এখনও আমরা রবিবার ছুটি পাই। ছয় দিনেই তৈরি হয়েছে বস্তুজগৎ আর জীবজগত। সৃষ্টির কিছুদিনের মধ্যেই এল প্রলয়। ভারী বর্ষণে ডুবে গেল পৃথিবী। নোয়া তখন প্রতিটি প্রজাতির দুজনকে উদ্ধার করে তুলে নিলেন তাঁর জাহাজে। দুজন মানুষ দুটি করে বাঘ ভাল্লুক জিরাফ ইত্যাদি। সেই ছবি যারা দেখেছে তারা জানে যে এখন যে প্রজাতি আমরা দেখি গোড়াতেও তারাই ছিল। ছয় দিনে বিশ্ব সৃষ্টি করতে হলে রেডিমেড প্রজাতি ছাড়া উপায় কী?

১৮৫৯ সালে ডারউইন তাঁর বই 'অন দ্য অরিজিন অফ দ্য স্পিসিজ' প্রকাশ করেন। প্রকাশ হয় তাঁর 'বিবর্তনবাদ'। প্রাকৃতিক নির্বাচন-এর তত্ত্ব। ডারউইন চার্চের 'সৃষ্টিবাদ' নাকচ করে দিলেন। তিনি বললেন কোনও প্রজাতিই সনাতন নয়। পরিবেশে পরিবর্তন হলে প্রজাতিকে মানিয়ে নিতে হয়। প্রয়োজনে নিজেকে বদলে নিতে হয়। কোনও প্রজাতি তা পারে। কোনও প্রজাতি পারেনা। যারা পারেনা তারা লুপ্ত হয়। আজ পর্যন্ত যত প্রজাতি জন্ম নিয়েছে তার শতকরা ৯৯ ভাগের বেশি এখন লুপ্ত।

এর প্রধান কারণ মনুষ্য সভ্যতার বিস্তার যার স্বার্থে লক্ষ লক্ষ একর বনভূমি কেটে পরিষ্কার করা হয়েছে। এখনও হচ্ছে। পরিবর্তন আকস্মিক হলে অবশ্য কিছু করার থাকে না। ছয় সাত কোটি বছর আগে ডাইনোসরদের অবলুপ্তি হয় এক অতিকায় উল্কা 'অ্যালভারেজ' আর পৃথিবীর সংঘাতে। অন্যদিকে প্রশান্ত মহাসাগরের এক দ্বীপে 'ডোডো' পাখির অবলুপ্তির কৃতিত্ব আঠারো শতকের সাম্রাজ্যবাদীদের। সে সময়ে ন্যারেটিভ তৈরি হয়েছিল এই যে ডোডো মারা পড়েছে তার নিজের নির্বুদ্ধিতার জন্য। একটা পাখি আক্রান্ত হলে অন্যরা ছুটে আসে তাকে সাহায্য করতে!

পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেবার উদাহরণ অবশ্যই জিরাফ। গাছের নিচের দিকের পাতা সবার নাগালে। উপরের দিকে প্রতিযোগিতা কম। জিরাফ তার ছয় ফুট লম্বা গলার সাহায্যে প্রতিদ্বন্দীদের পিছনে ফেলে যায়। অনেকের মত লড়াইটা পাতার জন্য নয়। অপর লিঙ্গের পার্টনারকে আকর্ষণ করার জন্য। তাতে ডারউইনের তত্ত্ব ভুল প্রমাণিত হয় না। ব্যাপারটা কি তাহলে ইচ্ছাশক্তির জয়? তাই হলে তো সৃষ্টিকর্তায় ফিরে যেতে হয়! ডারউইন বললেন তা নয়।

বলে রাখা উচিত চার্চকে ভুল প্রমাণ করবার উদ্দেশ্য নিয়ে কিন্তু ডারউইন মাঠে নামেননি। তিনি পর্যবেক্ষণ করেছেন বহুদিন ধরে বহু দেশ ঘুরে। যা দেখেছেন তার নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ থেকে যে তত্ত্ব বেরিয়ে এসেছে তাই গ্রহণ করেছেন। বৈজ্ঞানিক গবেষণার যাকে বলা হয় প্রথম শর্ত তা পূরণ করেছেন তিনি। তিনি দেখলেন কোনও প্রজাতির বিবর্তন হয় খুব ধীরে। কোথাও লক্ষ বছর কোথাও কোটি বছর ধরে। বিবর্তনের প্রতিটি ধাপ ছোট এবং অসংবদ্ধ। এর মধ্যে কারও ইচ্ছাপূরণ বা উদ্দেশ্যসিদ্ধির কথা ধোপে টেকে না।

এমন নয় যে জিরাফ বুঝেছে তার গলা লম্বা হলে সে খাবার পাবে বেশি তাই ইষ্ট দেবতার জপ করেছে প্রাণপণে। তা করলে কোনও কাজ হতো না। ডারউইন জিনতত্ত্ব জানতেন না। তা এসেছে তাঁর তত্ত্বের পঞ্চাশ বছর পরে। আমরা জানি জিরাফের এবং সব প্রাণীর গঠনতন্ত্র লিপিবদ্ধ করা আছে তার জিনে। কোটি কোটি অণু মিলিয়ে তৈরি এই জিনে ছোটখাটো পরিবর্তন আপনি ঘটে যায়। তাই ভিন্ন প্রজন্মে কিছু তফাত থাকেই। কখনও সখনও এমনও হয় যে জিনের উদ্দেশ্যবিহীন পরিবর্তন আর পরিবেশের পরিবর্তন একে অন্যের পরিপূরক হয়। হয়তো জিনের হেরফেরে জলের প্রয়োজন কমে গেল। বিশ্ব উষ্ণায়নের কালে সেটাই হয়ে উঠল এক বিরাট সুবিধা। দু'য়ে মিলিয়ে সেই ধানের ফলন গেল বেড়ে।

আমাদের নিয়তিকে 'ঈশ্বরের নিয়ন্ত্রণ' থেকে বার করে আনার এই প্রয়াস কোনও ধর্মের যাজকদের পছন্দ হয়নি। খ্রিস্টান চার্চ এর বিরোধিতা করেছে। বেশিরভাগ ইসলামীয় রাষ্ট্রে ডারউইনের তত্ত্ব নিষিদ্ধ। তাই হিন্দু রাষ্ট্রেও যে তিনি নিষিদ্ধ হবেন তা যুক্তিযুক্ত। এর আগে চার্চ নিদান দিয়েছিল যে পৃথিবী বিশ্বের কেন্দ্রে অবস্থিত। পৃথিবী সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে না। সূর্য পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে। উলটো কথা বলার জন্য জিওরদানো ব্রুনোকে পুড়িয়ে মারা হয়। কোপারনিকাস তাঁর সূর্যকেন্দ্রিক তত্ত্ব প্রকাশ করেন ভয়ে ভয়ে। গ্যালিলিও বলেন পৃথিবী ঘুরছে সূর্যের চারিদিকে কিন্তু সে কথা তিনি প্রত্যাহার করেন। আমেরিকা যদি বলে বিজ্ঞানের প্রসারে হিন্দুত্ববাদ বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে তাহলে আমাদের বিদেশমন্ত্রী জানেন কী বলতে হবে।

ডারউইনের কীর্তি শুধু জীবনবিদ্যার সম্পদ নয়। বিজ্ঞানের সম্পদ। ভবিষ্যতে যারাই বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করবেন গবেষণা করবেন তাদের জন্য ডারউইন হবেন নিউটন আইনস্টাইনের মতো পথ প্রদর্শক। ভারতে আমরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ে গবেষণায় ব্যয় করি জিডিপির শতকরা এক ভাগেরও কম। তাছাড়া আমাদের ইশকুল কলেজে মুখস্থবিদ্যার দাম বেশি। কৌতূহল বা মুক্ত চিন্তার দাম কম।

সেই কারণে আমরা বিজ্ঞান গবেষণায় চিন বা অন্যান্য দেশের তুলনায় পিছিয়ে রয়েছি। কিন্তু আমরা তো পিছিয়ে থাকার পক্ষে নই। তাই প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে 'ন্যাশনাল রিসার্চ ফাউন্ডেশন' গঠন করা হয়েছে গবেষণাকে ঠিক পথে চালাবার জন্য। অবাক হয়ে দেখলাম দুটো ঘটনা ঘটল প্রায় একই সময়ে। ফাউন্ডেশন তৈরি হল আর ইস্কুলের পাঠ্যসূচি থেকে বাদ পড়লেন বিজ্ঞানের এক উজ্জ্বল তারকা। এই প্রথম কেউ বাদ পড়লেন 'ভুল' কথা বলার জন্য। সাধারণত তাঁরা বাদ পড়েন ঠিক কথা বলার জন্য। সহজেই প্রমাণ হয় কথাটা প্রাচীন ভারতের কোনও পুঁথি থেকে নেওয়া।

ধরা যাক রাশিয়ান বিজ্ঞানী মেন্দেলেভের কথা। তাঁর পিরিয়ডিক টেবিলের কথা কে না জানে? কিন্তু কম লোকই জানেন যে তাঁর এক ঘনিষ্ট বন্ধু ভারতীয় পণ্ডিতদের কাছে সংস্কৃত শেখেন। সংস্কৃত ভাষার গঠন দেখেই পিরিয়ডিক টেবিলের কথা তাঁর মনে আসে। তিনি কিন্তু সংস্কৃত ভাষার কাছে তাঁর ঋণ কোনোদিন স্বীকার করেননি। পিথাগোরাস ছিলেন গ্রিসের গণিতজ্ঞ এবং বিজ্ঞানী। হিন্দুরা জানতেন সমকোণীয় ত্রিভুজের একটা বাহুর বর্গ অন্য দুই বাহুর বর্গের যোগফল। পিথাগোরাস বিশ্ব ভ্রমণকালে ভারতে আসেন। উপপাদ্যটি তাঁর পছন্দ হয়। তিনি সেটি তাঁর নিজের নামে চালিয়ে দেন। এরা তো নিশ্চয়ই বাদ পড়বেন। শোনা যাচ্ছে নিউটনও নাকি? কি কাণ্ড!

কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সত্যপালই ডারউইনের ভুলটা ধরিয়ে দেন। প্রসঙ্গত বলা যায় তিনি মন্ত্রী হবার আগে মুম্বাইয়ের পুলিশ কমিশনার ছিলেন। তিনি প্রশ্ন করেন মানুষ কি চিরকালই মানুষ হয়ে দেখা দেয়নি? বানরকে মানুষ হতে কেউ দেখেছে? আমরা যারা ডারউইন পড়েছি তারা সেদিন মুখ লুকিয়ে হেসেছিলাম। এ কি মুহূর্তেকের ব্যাপার যে কেউ দেখে ফেলবে? বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে কিন্তু অনেক স্কলারও প্রশ্ন তুলেছেন যে সব পরিবর্তনই কি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র এবং সময়সাপেক্ষ? প্রকৃতির পরিবর্তে চাষি যদি নিজেই মাঠে নামেন ধানের ফলন বাড়াতে? তিনি তো অনন্তকাল অপেক্ষা করবেন না। দ্রুত এবং বড় পরিবর্তনের কথা পুরোপুরি বাদ দিয়ে কি ডারউইন ভুল করেছিলেন? বিষয়টি এখনও অমীমাংসিত। ঘটে কিস্যু না থাকলে কি কেন্দ্রে মন্ত্রী হওয়া যায়?