আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ চতুর্দশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ জুলাই, ২০২৩ ● ১-১৫ শ্রাবণ, ১৪৩০

সম্পাদকীয়

জাতীয় গবেষণা পরিষদ


সম্প্রতি দেশের প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন যে ২০২৩-২৮ এই পাঁচ বছরে দেশে গবেষণা খাতে অর্থসংস্থান ও খরচের বিষয়টি দেখাশোনা করবে 'জাতীয় গবেষণা পরিষদ' বা 'ন্যাশনাল রিসার্চ ফাউন্ডেশন'। এই ৫ বছরে তারা মোট ৫০ হাজার কোটি টাকা খরচ করবে, হয়ত বছরে গড়ে ১০ হাজার কোটি হিসাবে। এর মধ্যে ১৪ হাজার কোটি টাকা দেবে কেন্দ্রীয় সরকার আর বাকি ৩৬ হাজার কোটি টাকা দেবে বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান বা বেসরকারি সংস্থা। এই পরিষদের প্রশাসনিক কাজ পরিচালিত হবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দপ্তর তথা ডি.এস.টি. দ্বারা। যেহেতু এই গবেষণার কাজ কেন্দ্রীয় সরকারের সমস্ত দপ্তরের কাজকেই প্রভাবিত করবে তাই এই পরিষদের পরিচালন সমিতির সভাপতি হবেন প্রধানমন্ত্রী এবং সহ সভাপতি হবেন কেন্দ্রের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী। এই পরিষদের পরিচালনার জন্য যে কার্যকরী কমিটি হবে তার মাথায় থাকবেন ভারত সরকারের বিজ্ঞান উপদেষ্টা। যেহেতু কাজটি শিক্ষাজগতের সাথে যুক্ত তাই সরকারের বাছাই করা বিশিষ্ট বিজ্ঞানীরা থাকবেন এই কার্যকরী কমিটিতে। ২৮ জুন, ২০২৩ ভারত সরকারের ক্যাবিনেট এই প্রস্তাব মঞ্জুর করেছে। এই পরিষদের মূল লক্ষ্য হবে বাজারের কাজে লাগবে এমন গবেষণায় অর্থ বরাদ্দ করা।

সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী এই পরিষদ আগামী ৫ বছরে ৫০ হাজার কোটি টাকা খরচ করবে দেশের বিভিন্ন গবেষণা চালানোর কাজে। এই পরিষদ গঠন হওয়ার সাথে সাথেই এতদিন দেশে গবেষণায় অর্থ বরাদ্দের নিয়ন্ত্রক সংস্থা 'বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গবেষণা বোর্ড' বা এস.ই.আর.বি.-র অস্তিত্ব বিলুপ্ত হবে। এবার থেকে যাবতীয় অর্থ বরাদ্দ এই এন.আর.এফ.-এর মাধ্যমেই হবে। কেন্দ্রের শিক্ষা মন্ত্রকের দাবী অনুযায়ী, নয়া শিক্ষানীতির থেকে উঠে আসা প্রতিষ্ঠানগুলি এর মাধ্যমে লাভবান হবে। মন্ত্রক ঘোষণা করেছে সাধারণ বিজ্ঞান, অঙ্ক, প্রযুক্তি, পরিবেশ ও পৃথিবীবিদ্যা, সমাজবিজ্ঞান, কলা ও মানববিজ্ঞান, ভারতীয় ভাষা ও জ্ঞান, স্বাস্থ্য, কৃষিবিদ্যা এবং উদ্ভাবন ও উদ্যোগ এই ক্ষেত্রের গবেষণায় অর্থ বরাদ্দ করা হবে। তারা অর্থ বরাদ্দের একটা আনুপাতিক হিসাবও দিয়েছেন। এই ক্ষেত্রগুলোতে বরাদ্দের অনুপাত হবে ৮:৪:৮:৪:২:১:১:৮:৪:৪। যদিও তারা বলেছেন যে এই অনুপাত মোটেই বিষয়গুলির গুরুত্বক্রমে নয়, বরং এ যাবৎ অর্থব্যয়ের হিসাব দেখে তৈরী। সরকারের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি উপদেষ্টার আশা এর ফলে দেশের গবেষণাক্ষেত্রের চিত্র পাল্টাবে। তারা পরিসংখ্যান দিয়ে দাবি করেছেন যে এদেশে প্রতি ১ লক্ষ মানুষে মাত্র ১৫ জন গবেষক, যা চিনে ১১১ আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৪২৩ জন। এই বিকট বৈষম্য এই নতুন উদ্যোগে দূরীভূত হবে। আর এই গবেষণালব্ধ ফল থেকে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য উপকৃত হবে। সরকারের লক্ষ্য হল দেশের গবেষণাক্ষেত্রের সাথে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের সমন্বয় গড়ে তোলা।

স্বভাবতই এই ঘোষণা দেশের শিক্ষাজগতে একটা আলোড়ন ফেলেছে। পক্ষে-বিপক্ষে একাধিক যুক্তি-তর্ক উঠে এসেছে। যথারীতি দেশের সরকার দাবি করেছেন যে এই পরিষদ গঠন এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। এই পরিষদ কার্যকরী হলেই দেশের গবেষণাক্ষেত্র একলাফে সামনের সারিতে চলে আসবে। ভারত আবার জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ না হলেও সামনের আসন লাভ করবে। কিন্তু ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়। এযাবৎ দেশজোড়া 'আচ্ছে দিনের' আশায় জনতা কেবল কৃচ্ছসাধন করতেই অভ্যস্ত হল। নোটবন্দী থেকে জিএসটি লাগু সবই যে ভালো দিনের আশায় হল, সেই ভালো দিন আমজনতার কপালে জুটল না। মোদি, মালিয়া, আম্বানি, আদানীদেরই কেবল কপাল ভালো। তাই চোরা না শুনে ধর্মের কাহিনি। উদ্বাহু হয়ে এই পরিষদের স্তুতির আগে কিছু প্রশ্ন তাই নেড়েচেড়ে দেখা ভালো।

সরকারি ঘোষণা থেকে বোঝা যায় যে এই পরিকল্পনার পিছনে কিছু বাস্তব ও কিছু প্রচলিত ভাবনা কাজ করেছে। একথা ঠিক যে আমাদের দেশে পেশাদার বৈজ্ঞানিক গবেষণা থেকে দেশের শিল্পক্ষেত্র দারুণ মাত্রায় উপকৃত হয়না। সরকারের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী ভারতে ২০০০ সালে অনুমদিত পেটেন্টের সংখ্যা ছিল ১,০০০-এর মতো। সেই সংখ্যা ২০২২-এ এসে দাঁড়িয়েছে ৬৬,৪৪০টি, যার মধ্যে ৪৪% ভারতীয়দের দ্বারা দাখিল হয়েছে (তথ্যসুত্রঃ ভারত সরকারের রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট স্ট্যাটিটিক্স ২০২২-২৩)। ডবলুআইপিও-র তথ্য অনুযায়ী ভারতের পেটেন্ট অফিস বিশ্বের প্রথম ৬টি পেটেন্ট গ্রাহক অফিস। ২০২১-২২ সালে এদেশে দাখিল ৬৭% পেটেন্টই আমেরিকা, জাপান, চিন, জার্মানি ও সুইজারল্যান্ডের গবেষকদের। ফলে একথা ঠিক যে ভারতীয় প্রযুক্তিপণ্য উৎপাদন ও বাজারের সিংহভাগ লাভই যায় বিদেশিদের কাছে এই মেধাস্বত্ত্বের মাধ্যমে। অর্থনীতির দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখলে অবশ্যই এই শুন্যস্থান পূরণের উদ্যোগ নেওয়া সরকারের কর্তব্য। কিন্তু এই অবস্থা কেন? এখানেই সমাজে জন্ম নেয় এক অলীক বিশ্বাসের যে আমাদের দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাথে ব্যবসায়িক উদ্যোগের সমন্বয় নেই। আর সব ক্ষেত্রেই প্রায় দায়ী করা হয়ে থাকে শিক্ষক বা গবেষকদের। এই অভিযোগ প্রায় প্রতিষ্ঠিত যে এদেশে শিক্ষক বা গবেষকরা বাস্তব বিবর্জিত গবেষণা করে থাকেন। এর মাধ্যমে তারা কেবল নিজেদের স্বার্থপূরণ করেন। দেশের মানুষের কোনো কাজে লাগেনা এইসব গবেষণা। বস্তুত সেই ধারণার প্রতিফলন হয়েছে এনআরএফ-এর ঘোষণায়। কিন্তু এই অভিযোগ কি সত্যি?

সরকারের প্রকাশিত তথ্যই বলছে (রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট স্ট্যাটিটিক্স ২০২২-২৩) এদেশে ২০০৫ সালের পর থেকে গবেষণায় সরকারি অর্থবরাদ্দ লাগাতার কমেছে। বর্তমানে তা জাতীয় আয়ের ০.৬৪%। অন্যদিকে চিন ও আমেরিকায় এই খাতে খরচ যথাক্রমে ২.১ ও ২.৮%। বলাই বাহুল্য কেন এদেশে দাখিল হওয়া পেটেন্টের ভেতর ৩২% আমেরিকার আর ১০% চিনের। এবার যদি টাকার অঙ্কে ধরা হয় তাহলে চিনের জাতীয় আয় ভারতের প্রায় ৫ গুণ। ফলে টাকার হিসাবে চিনে গবেষণায় সরকারি বিনিয়োগ ভারতের ১ লক্ষ ২৭ হাজার কোটি টাকার থেকে অনেক বেশী। এই তথ্য অনুযায়ী বিগত ৫ বছরে ভারতে গবেষণা খাতে বিনিয়োগ হয়েছে গড়ে ১ লক্ষ কোটি টাকার উপর। তাহলে এনআরএফ-এর মাধ্যমে যদি বছরে গড়ে ১০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হয় তাহলে কি বিনিয়োগ বাড়ল? অন্যদিকে এতদিন ভারতে গবেষণায় সরকারি অনুদানের পরিমাণ ছিল ৪৩%, যা এনআরএফ-এ দাঁড়াবে ২৮%। তাহলে সরকার গবেষণায় নিজের বিনিয়োগের ভাগ কমিয়ে কোন উদ্দেশ্য সাধন করবে? অন্যদিকে ভারতে গবেষণায় বরাদ্দ সরকারি অর্থের ৩০ শতাংশই যায় সামরিক গবেষণা বা ডিআরডিও-তে। আর বাকি ৭০% যায় ৮টি অসামরিক ক্ষেত্রে গবেষণা সংসদগুলির কাছে। ফলে দেশের শাসকরা যে আর্তনাদ জুড়েছেন যে এদেশের বিজ্ঞানী বা গবেষকরা সমাজের কাজে আসেন না তার দায় কাদের?

সীমিত অর্থে গবেষণা চালানো, অনিয়মিত অর্থ বরাদ্দের মাঝেও যে এদেশের গবেষকরা কাজ করে চলেছেন এর জন্য তাদের কৃতিত্ব প্রাপ্য। অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোনো অসামরিক উদ্ভাবনী কাজের জন্য বরাদ্দ মেলেনা। মিললেও তা পর্যাপ্ত নয় কোন সুষ্ঠু গবেষণা গড়ে তোলার জন্য। আর এ দেশের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের মালিকেরা কেবল ভাবেন গবেষণায় অর্থ দিয়ে মুনাফা আসবে কিনা। ফলে কোনো ঝুঁকিপূর্ণ কাজ, যেখানে চটজলদি ফল পাওয়া মুশকিল সেখানে তারা বিনিয়োগ করেননা। কিন্তু এর সাথে গুরুত্বপূর্ণ আরও একটি বিষয়, তা হল বিজ্ঞান গবেষণার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি। বিজ্ঞানচর্চার সাথে যুক্ত মানুষ মাত্রেই জানেন যে সমস্ত বিজ্ঞান গবেষণার লক্ষ্য পণ্য বা প্রযুক্তি উৎপাদন নয়। বিজ্ঞানের তাত্বিক গবেষণা ছাড়া নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন কোনদিনই সম্ভব নয়। কিন্তু দেশের শাসক বা ব্যবসায়ীরা এই সত্যটি আজ অবধি বুঝে উঠলেন না। তাই বিজ্ঞানের তাত্বিক বিষয়ের চর্চাকে তারা অনাবশ্যক মনে করেন। ফলে গবেষণা আর বাজারের মেলবন্ধন গড়ে ওঠেনা। আজকে গুগলের মত বহুজাতিক কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরীর গবেষণায় বিনিয়োগ করে তাৎক্ষণিক কোন ফল পাওয়ার আশা না রেখে তাত্বিক গবেষণায় বিনিয়োগ করছেন - এদেশে এইরকম শিল্পপতি কি আছেন?

যদি উন্নত দেশগুলোর সাথে প্রতিযোগিতা করতেই হয় তাহলে অন্তত তাদের পরিকল্পনা অনুসরণ করেই করা উচিত। শতাংশের বিচারে ভারতে গবেষণায় সরকারি বিনিয়োগ বেশী। কিন্তু টাকার অঙ্কের বিচারে তা উন্নত দেশগুলোর তুলনায় বহু পেছনে। তা স্বত্বেও বিগত ২০ বছরে ভারতীয় গবেষকদের দ্বারা আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রকাশনার সংখ্যা ৮ গুণ বেড়েছে। ফলে এদেশের গবেষকদের দক্ষতা বাকি জায়গার চেয়ে কম কিছু নয়। বিভিন্ন সময়ে বিদেশে গবেষণারত ভারতীয় বৈজ্ঞানিকদের সাফল্যের খবরে আমার উল্লসিত হই। কিন্তু আলোচনার সময় একথা বলতে ভুলে যাই যে যথাযথ সাহায্য পেলে এদেশে কর্মরত বিজ্ঞানীরাও সেই কৃতিত্ব দেখাতে পারেন। ফলে প্রশ্ন যোগ্যতার নয়, প্রশ্ন সঠিক পরিকল্পনার। এযাবৎ সরকারি পরিকল্পনা আদৌ এদেশে গবেষণাকে উন্নত করার মতো নয়। বরং বাজারের কথা বলে আসলে সরকার একদিকে যেমন নিজের দায় কমাতে চাইছে অন্যদিকে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলি যে ছিঁটেফোঁটা বরাদ্দ পায়, সেটাও বেসরকারি সংস্থার জন্য উম্মুক্ত করে দেওয়া হচ্ছে ওই এনআরএফ-এর মাধ্যমে।

এনআরএফ-এর ঘোষণা একদিকে যেমন এদেশের স্বতঃস্ফূর্ত বিজ্ঞান গবেষণার মৃত্যুঘন্টা বাজাবে বাজারের নাম করে, অন্যদিকে গোটা উচ্চশিক্ষাকে এক কর্তৃত্ববাদী পরিচালনার দিকে নিয়ে যাবে। কোনো উন্নত দেশে গবেষণায় অর্থবরাদ্দ সংস্থার মাথায় রাষ্ট্রপ্রধান থাকেন না। কিন্তু এনআরএফ-এর মাথায় প্রধানমন্ত্রীকে বসানো এই কর্তৃত্ববাদেরই এক উৎকট প্রদর্শন, যেখানে গোটা দেশের গবেষকদের একজনের মর্জি ও ভাবনার মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে। যদি তাঁর মনে হয় তবেই সেই গবেষকের ভাগে সিকে ছিঁড়বে। আর সেই ব্যক্তি যদি রাজনৈতিক হন তাহলে তার রাজনীতির প্রভাব যে সিদ্ধান্তে থাকবে না এমন কথা কি কেউ জোর দিয়ে বলতে পারেন? তাই অবিলম্বে এই এনআরএফ বাতিল করার জন্য এদেশের শিক্ষিত সমাজ এবং জনগণকেও সংগঠিত হতে হবে। এ কেবল উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিপদ নয়। যদি এদেশে গবেষণা কেবল বাজারের চাহিদাতেই নিয়ন্ত্রিত হয় তাহলে অচিরেই দেশে খাদ্যের বদলে বারুদ আর ওষুধের বদলে ভোগ্যপণ্যেরই উন্নয়ন ঘটবে। সরকার চাইছে দেশের মেধা পরিচালিত হবে বড় শিল্পপতিদের জন্যই। তাই এবার দেশের জনতাকেই ঠিক করতে হবে তাঁরা কি চান।