আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ ত্রয়োদশ সংখ্যা ● ১-১৫ জুলাই, ২০২৩ ● ১৬-৩১ আষাঢ়, ১৪৩০

প্রবন্ধ

কর্তার ভূত

প্রবুদ্ধ বাগচী


স্বাধীনতালাভের এক দশকের মধ্যে কলকাতার রাস্তায় যেসব সরকার-বিরোধী গণ-আন্দোলনগুলি আছড়ে পড়েছিল তার মধ্যে উল্লেখ্য ১৯৫৩-এর ট্রামভাড়া-বৃদ্ধি বিরোধী আন্দোলন (জুলাই, ১৯৫৩)। এই আন্দোলন ঘিরে সারা কলকাতা শহরে যে জনজোয়ার উঠেছিল তার খবর সংগ্রহ করতে যাওয়া কলকাতার সাংবাদিকদের বিধান রায়ের পুলিশবাহিনী নির্মমভাবে যথেচ্ছ লাঠিপেটা করে আহত করে (২২ জুলাই, ১৯৫৩)। এর প্রতিবাদে তৎকালীন ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’র সম্পাদক সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার তার সম্পাদকীয় নিবন্ধে পুলিশ-বাহিনীকে আখ্যা দেন ‘ইহারা জননীর গর্ভের লজ্জা’। সম্পাদকীয় লিখে পুলিশি-সন্ত্রাস সত্যি সত্যি আটকানো যায় কি না সেই বিষয়ে আমাদের কোনো স্থির সিদ্ধান্তে আসার উপায় নেই। তবে সংবাদপত্র যদি জনমতের প্রতিফলন হয় তাহলে একটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচিত সরকারের জনমতকে গুরুত্ব দেওয়ার দায় নিশ্চয়ই আছে আর সেই জনমতকে প্রতিফলিত করার দায়বদ্ধতা সংবাদমাধ্যম এড়িয়ে যেতে পারে না।

অন্য আরও অনেক কিছুর মতো আমাদের সংবাদপত্রের ব্যবস্থাটাও শুরু হয়েছে উপনিবেশের শাসনের অধীনে। কিন্তু তার মধ্যে যেটা উল্লেখ করার মতো বিষয় তা হল, সংবাদপত্র মূলত কিন্তু তুলে ধরেছে তখনকার ‘কোম্পানি আমল’ বা ‘মহারাণীর শাসন’-এর ‘নেতিবাচক’ দিকগুলিই। ‘নেতিবাচক’ অর্থে প্রশাসনের দুর্নীতি, অনাচার, রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রতি নিপীড়ন ইত্যাদি - আসলে যা সরকারের চোখে ‘নেতিবাচক’ - যে বিষয়গুলি প্রকাশ্যে না এলেই ভাল হয়। এটাও খেয়াল করা দরকার, একটা পর্যায়ে সংবাদপত্র- প্রকাশ হয়ে উঠেছিল আসলে একরকমের ‘পলিটিক্যাল স্টেটমেন্ট’। জেমস হিকি এদেশের মানুষ ছিলেন না, তবু তার ‘ক্যালকাটা গেজেট’ প্রকাশ করে তিনি তুলে ধরছিলেন কোম্পানির আধিকারিকদের অপশাসন ও দুর্নীতি। যার মূল্য তাঁকে চোকাতে হয়েছিল কোম্পানির রোষানলে পড়ে এই দেশ ছেড়ে চলে গিয়ে। এটা অবশ্য জাতীয়তাবাদ বিকাশের আগের কথা। আবার হরিনাথ মজুমদার (কাঙাল হরিনাথ) তার ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’তে কৃষকদের ওপর স্থানীয় জমিদারদের অত্যাচারের বিবরণ তুলে ধরায় ‘জমিদার’ দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিরাগভাজন হন, লেঠেল পাঠিয়ে তার প্রেস ভেঙে দেওয়া হয়। কিন্তু উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে মূলত ব্যক্তিগত বা কোনো সংগঠনের উদ্যোগে যেসব সংবাদপত্রের প্রকাশ তার মূল ভাবনাই ছিল বৃটিশ সরকারের বিরোধিতা। হরিশ মুখার্জীর ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ থেকে সুরেন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বেঙ্গলি’, যশোরের ঘোষ- ভাইদের ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’, ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ের ‘সন্ধ্যা’, এরপরে অরবিন্দ ঘোষের ‘বন্দেমাতরম’, বারীন ঘোষের ‘যুগান্তর’ হয়ে পরের পর্বে, ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’, নতুন পর্বের ‘যুগান্তর’ সবগুলিই পরিচালিত হয়েছে জাতীয়তবাদের প্রচার প্রসারে। এই প্রচারের তীব্রতা এতটাই ছিল যে একসময় ‘ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট’ জারি করে সরকার দেশীয় সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা করে। পরে অবশ্য জনমতের চাপে তা প্রত্যাহৃত হয়।

মোটের ওপর কথাটা হল, প্রাক-স্বাধীনতাকালে মূলত ব্যক্তিমালিকানা ও অসংগঠিত ব্যক্তি-পুঁজির হাতে যে সংবাদপত্র পরিচালনার রাশ ছিল, তাদের ভিত্তি ছিল সরকারের বিরোধিতা এবং সরকারি ব্যবস্থার ভুল-ত্রুটি-অবহেলা প্রকাশ্যে আনা, কখনো সরাসরি জাতীয়তাবাদের কাঁধে কাঁধ মেলানো। সরকারের গুণ গাওয়ার মঞ্চ যে ছিল না তা নয় - সেই আমলে ‘ইংলিশম্যান’ (অধুনা ‘স্টেটসম্যান’) ছিল সরকারপক্ষের সমর্থক। অনেকেই আমরা জানি, সুভাষচন্দ্র বসু একবার কোথাও বলেছিলেন, ‘স্টেটসম্যান’ তাঁর কাজের সমালোচনা করলে তিনি বুঝতে পারেন আসলে তিনি সঠিক পথেই এগোচ্ছেন। বিশ শতকের প্রথমার্ধেও মূলত বিষয়টা এইরকমই ছিল। তবে যত রাজনৈতিক স্বাধীনতার মুহূর্ত কাছে আসতে থাকে, তত দেশের রাজনীতির উঠোনে জমতে থাকে নানা তর্ক-প্রতর্ক - একেক সংবাদপত্র তখন একেক রাজনৈতিক মঞ্চের সমর্থক বা বিরোধী অবস্থান নেয়। অবশ্য, ছাপার অক্ষরে স্বাধীনতার সমর্থক হলেও ব্যক্তি-পুজি যে নিজেদের মুনাফার জন্য কখনো কখনো ‘বিপথে’ যায়নি এমন নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যখন রেশনিং চালু হয়, তখন কলকাতার দুই প্রধান বাংলা সংবাদপত্র ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’ ও ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’র কর্তৃপক্ষ তাদের নিউজপ্রিন্ট রাখার গুদামে বেআইনিভাবে খাদ্যশস্য ও পোশাক মজুত করেন। কেন্দ্রের আয়কর দফতর এই খবর পেয়ে গিয়েছিল কিন্তু তখন তাদের কিছু বলেনি। পরে যুদ্ধ থামলে তাদের বাড়তি আয়ের জন্য নোটিশ দেওয়া হলে দুই সংবাদপত্রের প্রধান শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের দ্বারস্থ হন। শ্যামাপ্রসাদের মধ্যস্থতায় কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বল্লভভাই প্যাটেল তাদের দিল্লি ডেকে পাঠান - সেখানে প্যাটেলের হাতে-পায়ে ধরে তারা এই বিড়ম্বনা থেকে মুক্তি পান।

স্বাধীনতা-উত্তরকালে দেশীয় সংবাদপত্র বা সংবাদ প্রতিষ্ঠানগুলি আরও বিকশিত হয়। সারা দেশেই তৈরি হয় নতুন সংবাদপত্র, তার সবটাই মূলত ব্যক্তিপুঁজি বা প্রতিষ্ঠানের আওতায়। বিষ্ণু দে যতই বলুন, ‘সংবাদ মূলত কাব্য’ আসলে সংবাদ মূলত বাণিজ্য - ফলে সংসদীয় গণতন্ত্রে ‘চতুর্থ স্তম্ভ’ নামক অভিধা পেলেও প্রকাশক প্রতিষ্ঠানগুলির বাণিজ্যের স্বার্থে সরকারি নানান লবি বা উচ্চতর বাণিজ্য সংস্থার বিজ্ঞাপন পাওয়ার আশায় সংবাদপত্র গোষ্ঠীগুলি নানা উঞ্ছবৃত্তি করতে পেছপা হয়নি। ইউরোপে বা মার্কিন দেশে একসময় কথা উঠেছিল সংবাদপত্রের সম্পাদকীয় নিবন্ধগুলিকে কী বলা হবে - এডিটোরিয়াল না অ্যাডভার্টোরিয়াল? যদিও পাশ্চাত্যে সংবাদমাধ্যম আমাদের দেশের থেকে অনেক স্বাধীন ও শক্তিধর। কিন্তু এইসব ত্রুটি ও আপোশ থাকলেও গড়পড়তা ভারতীয় সংবাদমাধ্যম (অন্তত যতদিন শুধু প্রিন্ট-মিডিয়া ছিল) অনেক ক্ষেত্রেই সরকারি ব্যবস্থার গুণগান করার থেকেও তার সমালোচনা করেছে বেশি। আমরা মনে করতে পারি, বিভিন্ন সংবাদপত্র একসময় রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে কার্টুন প্রকাশ করত, স্বয়ং নেহেরুজি সেইসব ব্যঙ্গচিত্রের গুণগ্রাহী ছিলেন। কলকাতা শহরের কাগজেও রাজ্যের নেতাদের নিয়ে প্রচুর সমালোচনা প্রকাশ হয়েছে - কিন্তু তৎকালীন নেতা-নেত্রীরা এগুলোকে নিয়ে তেমন কুপিত ছিলেন বলে মনে হয় না।

সংবাদমাধ্যমের ওপর প্রথম আঘাত এল ইন্দিরা-জমানায়। জরুরি অবস্থায় সারা দেশে নেমে এল প্রেস সেন্সরশিপ। তখনো কিন্ত এই নিপীড়নকে সংবাদপত্রজগৎ ভালোভাবে নেয়নি। মনে পড়বে, প্রেস সেন্সরশিপ-এর প্রথম দিন দিল্লির সবক'টি সংবাদপত্রের অফিসে মাঝরাতে বিদ্যুতের লাইন বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয় যাতে পরের দিন কোনো কাগজ প্রকাশিত হতে না পারে। তবুও ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’ পরের দিনের সংস্করণে রবীন্দ্রনাথের ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য’-র ইংরিজি অনুবাদ ছেপে দেয় ও সম্পাদকীয়-র জায়গা সাদা রাখা হয়। শেষ অবধি এই সেন্সরশিপ যে হিতে বিপরীত হয়েছিল তা ইন্দিরা বুঝেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর দেশের গোটা সংবাদমাধ্যম ‘মা-হারা পুত্র’ রাজীবের পক্ষে ভোটের হাওয়া তৈরিতে নেমে পড়ে আর তার ডিভিডেন্ড পান রাজীব গান্ধী তাঁর বিপুল জয়ে। তবে এই হাওয়া বেশিদিন চলেনি - প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ‘বোফর্স’ দুর্নীতির অভিযোগ প্রথম প্রকাশিত হয় সংবাদমাধ্যমেই। পরের দশকগুলিতে নরসিমহা রাও সরকারের মন্ত্রীদের নানা দুর্নীতি, অটলবিহারীর আমলের কিছু কিছু ‘ভ্রষ্টাচার’ এবং তারপরে মনমোহন সিং আমলের নানা ‘কেলেঙ্কারি’ সবই প্রকাশ্যে এসেছে সংবাদ-মাধ্যমের সৌজন্যে। ইতিমধ্যে সংবাদমাধ্যম প্রিন্ট মিডিয়া থেকে ছড়িয়ে পড়েছে অডিও-ভিসুয়ালে - শয়ে শয়ে বৈদ্যুতিন চ্যানেল, উন্নত টেলি-প্রযুক্তি, স্যাটেলাইট সম্প্রচার একেবারে খোলনলচে বদলে দিয়েছে এই ব্যবস্থার।

আমাদের রাজ্যেও বাংলা সংবাদপত্রগুলি রাজ্যের সরকারের ঠিক হোক বেঠিক হোক সমালোচনা করেই নিজেদের জনপ্রিয়তা ও অস্তিত্ব বজায় রেখেছে। সাড়ে তিন দশকের বামফ্রন্টের শাসনে সরকারের সঙ্গে সংবাদপত্রের কখনোই ‘মধুর সম্পর্ক’ ছিল না। আশির দশকে জ্যোতিবাবু প্রায়ই বলতেন, কিছু সংবাদপত্র তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও সমালোচনা করছে। ষড়যন্ত্র কি না জানা নেই, তবে প্রধান সংবাদপত্রগুলি সেই সময় বামফ্রন্টের বিরুদ্ধেই মূলত লিখতেন। অবশ্য, প্রবীণ সাংবাদিক সুমন চট্টোপাধ্যায় একবার বলেছিলেন, খবরের কাগজে বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে লিখে যদি সরকার ফেলে দেওয়া যেত, তাহলে তো বামফ্রন্টের এত বছর থাকারই কথা নয়! সেই সময় রাজ্যের মন্ত্রী বা অন্য রাজনৈতিক কর্ণধাররা কখনোই সাংবাদিক বা সংবাদমাধ্যম সম্বন্ধে ভাল কথা বলতেন না। এমনকি কিছু কিছু সংবাদপত্র বিষয়ে তাদের স্পষ্ট আপত্তি তারা প্রকাশ্যেই বলে ফেলতেন - মহাকরণের ‘প্রেস কর্ণার’ ভেঙে দেওয়া থেকে ওই বাড়ির অলিন্দে হেঁটে যাওয়া প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেববাবুকে একবার ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’র সাংবাদিককে উদ্দেশ্য করে বলতে দেখা ও শোনা গিয়েছিল - ‘ও, আপনি আনন্দবাজার? কথা বলি না!’

বাংলা সংবাদমাধ্যম ঘিরে সরাসরি শাসক আর বিরোধী আড়াআড়ি প্রকাশ্যে আসতে দেখা গেল ২০০৬-এর পরের সময়সীমায়। সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম জমি আন্দোলনের সময় বেশিরভাগ বাংলা সংবাদমাধ্যম সরকারের বিরোধী অবস্থান নিলেও প্রথম দিকে ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’ ও তাঁদের বাংলা সংবাদ চ্যানেল বামফ্রন্ট সরকারের ‘শিল্পায়ন প্রচেষ্টা’-র অকুণ্ঠ সমর্থনই জানিয়েছিল, শোনা যাচ্ছিল ‘টিম বুদ্ধ’ বা এই ধরনের প্রচার। ‘আজকাল’ পত্রিকায় সেই সময় একটা দিনও যায়নি যেদিন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধবাবুর কোনও ছবি ও সংবাদ ছাপা হয়নি। অন্যদিকে ‘কলকাতা টিভি’ বা ‘তারা টিভি’ যখন সরকার-বিরোধী অবস্থানে পুলিশি নির্যাতন ইত্যাদি নিয়ে একটানা খবর করে চলেছে তখন সরকার পক্ষের হয়ে সওয়াল করছিল ‘চব্বিশ ঘণ্টা’, সাধারণ্যে তাঁদের নামই ছিল ‘সিপিএমের চ্যানেল’ - ১৪ মার্চ (২০০৭) সন্ধ্যায় সারা রাজ্যের চ্যানেল যখন নন্দীগ্রামে পুলিশি গুলিচালনা ও চোদ্দ জনের মৃত্যুর সংবাদে উত্তাল, ঠিক সেই সময় ‘২৪ ঘণ্টা’ চ্যানেলে অতিথি বক্তারা কথা বলছিলেন আসন্ন মাধ্যমিক পরীক্ষা নিয়ে! অবশ্য ওই একই সময়ে তৎকালীন বিরোধী নেত্রীর প্রচারের ফানুস আরও ফুলিয়ে তুলতে আসরে নেমেছিল বেশ কিছু বাংলা চ্যানেল ও সংবাদপত্র, পরে প্রমাণিত হয়েছে তাঁদের পেছনে ‘চিট ফান্ড’ এর কালো টাকা ছিল, ‘সারদা কাণ্ড’-র পরে তার কোনোটাই আজ আর নেই।

২০১১-য় রাজ্যে ও ২০১৪-তে কেন্দ্রে ‘পরিবর্তন’-এর পরে পুরো মিডিয়া সাম্রাজ্যের চেহারাটাই আমূল বদলে গেল। রাজ্যের ক্ষমতায় আসা বিরোধী দলের সুপ্রিমো তার রাজনৈতিক জীবনের গোড়া থেকেই মিডিয়ার অবাধ দাক্ষিণ্য পেয়ে এসেছিলেন। এবার বোধহয় এল তাঁর ফিরিয়ে দেওয়ার পালা। বেশ কয়েকটি সংবাদপত্র গোষ্ঠীর মালিক ও সম্পাদককে পাঠানো হল সাংসদ হিসেবে। যতদিন না পর্যন্ত সারদা-কেলেঙ্কারি প্রকাশ্যে আসে ততদিন ‘কৃপাধন্য’ সংবাদমাধ্যমগুলিকে বিতরণ করা হতে লাগল সরকারি বিজ্ঞাপনের দাক্ষিণ্য। কার্যত একটা তুলনামূলক খতিয়ান নিলে দেখা যাবে রাজ্যের তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরে বাজেট বরাদ্দ উত্তর-২০১১ বেড়ে গেছে কয়েকশো গুণ - এর বেশিটাই খরচ হয়েছে বিজ্ঞাপনে যার সিংহভাগ পেয়েছে সংবাদপত্র ও নিউজ চ্যানেল। যারা এরই মধ্যে কিছুটা সরকারি অনাচারের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন তাদের নাম করে আক্রমণ করা হয়েছে সাংবাদিক সম্মেলনে, বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে সরকারি বিজ্ঞাপন।

এরই একটা পরিবর্ধিত রূপ আমরা দেখেছি ২০১৪-উত্তর কেন্দ্রীয় সরকারের আচরণে। সংবাদমাধ্যমকে হয় তারা নামিয়ে এনেছেন ‘বেতনভুক স্তাবকে’ নয়তো সামান্য ‘বেচাল’ দেখলেই তাঁকে সবক শেখাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন সরাসরি। আমাদের মনে পড়তে পারে, দিল্লির ‘এনডি টিভি’ দফতরে সেই পুলিশি হানার ঘটনা, যার একমাত্র কারণ ছিল ‘এনডি টিভি’র কর্ণধার প্রণয় রায়ের সরকার বিরোধী অবস্থান। খুব সাম্প্রতিককালে গুজরাট-সংঘর্ষ বিষয়ক ‘তথ্যচিত্র’ প্রচার করার দায়ে একইভাবে বিবিসি-র অফিসে হানা দেয় আয়কর দফতর ও ইডি। আর সারা দেশেই তো সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিদের চূড়ান্ত লাঞ্ছনা, নির্যাতন আজ একদম গা-সওয়া ঘটনা। খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে রাজরোষে পড়া কাপ্পান আজ পরিচিত নাম, রাণা আয়ুবের ওপর নেমে আসা ‘রোমাঞ্চকর’ আক্রমণ আমরা পড়ে ফেলেছি ‘গুজরাট ফাইলস’-এর দুই মলাটে। সর্বভারতীয়স্তরে বিচার করে দেখলে দেশের বেশিরভাগ সংবাদমাধ্যমের মালিকানা আজ ‘সরকার-সমর্থক’ মিডিয়া ব্যারণদের হাতে যারা সরকারকে কোনোভাবেই চটাতে অনাগ্রহী। তাই সাম্প্রতিককালের সবচেয়ে উল্লিখিত গণ-জাগরণ ‘কৃষক আন্দোলন’ সর্বভারতীয় মিডিয়ার চোখেই পড়ল না দীর্ঘদিন। পরিবর্তে তারা ‘ধ্যানমগ্ন’ প্রধানমন্ত্রীর ছবি ছাপলেন, ছাপলেন তাঁর ‘দিগবিজয়ের কাহিনি’। গত মে মাসে (২৮ মে, ২০২৩) সংসদ ভবনে যখন যাগযজ্ঞ করে দুনিয়ার সবথেকে বড় গণতান্ত্রিক দেশের ‘প্রভুর রাজ্যাভিষেক’ হচ্ছিল ঠিক তখনই দিল্লির রাজপথে মহিলা কুস্তিগিররা যখন প্রশাসনিক নিপীড়নের শিকার হচ্ছিলেন, গোটা দিল্লির মিডিয়া তা দেখতেই পায়নি! একইভাবে ‘পেগাশাস সফটওয়্যার’ বা ‘রাফায়েল বিমানচুক্তি’ কিংবা ‘আদানির শেয়ার কারচুপি’ নিয়ে প্রাথমিকভাবে যেসব প্রশ্ন উঠেছিল, ‘বোফর্স কামান কেলেঙ্কারি’ বা হর্শদ মেহেতার ‘শেয়ার কেলেঙ্কারি’র সঙ্গে তার খুব একটা প্রভেদ নেই - কিন্তু এইসব নিয়ে প্রাথমিকভাবে শোরগোলের পরেই সব মিডিয়াই আশ্চর্যরকম নীরব হয়ে গেল!

তুলনা করলে, এই রাজ্যেও যে পরিস্থিতির ইতরবিশেষ আছে তা নয়। গত এক বছরে শিক্ষায় নিয়োগ সংক্রান্ত যে বিপুল দুর্নীতির খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে তা সংগঠিত হয়েছে গত সাত-আট বছরে। বাংলার মিডিয়া এই বিপুল বেআইনি লেনদেনের কিছুই জানত না? আজকে যা হাল দাঁড়িয়েছে তাতে বাংলার মিডিয়ার একটা বড় অংশই সরাসরি সরকারের সমর্থক তথা স্তাবকে রূপান্তরিত। সম্প্রতি এমন অভিযোগও শোনা গেছে যে কলকাতার ‘প্রেস ক্লাব’ নাকি আদপে এখন রাজ্যের তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরেরই একটা ‘শাখা’ হিসেবে কাজ করছে। কান পাতলে শোনা যায়, কলকাতার বেশকিছু সংবাদপত্রের পরের দিনের প্রথম পাতায় কী ছাপা হবে, তা আগের দিন অনুমোদন করিয়ে নিতে হয় শাসকের দলীয় সদর দফতর থেকে! তাই বোধহয় রাজ্যের সরকারি কর্মীদের ন্যায্য দাবিদাওয়ার আন্দোলন খবরের কাগজের পাতায় তেমন জায়গা পায় না, যতটা পায় কোনো এক ‘যুবরাজ’-এর ‘মৃগয়া’-র খবর। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া রেল দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলিকে কলকাতায় ডেকে এনে ‘নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে’ যেভাবে ঘটা করে তাদের হাতে সরকারি সাহায্য তুলে দেওয়া হল তা আমাদের সংবেদনশীলতাকে আহত করলেও এই সিদ্ধান্তের ন্যায্যতা নিয়ে কোনও সংবাদমাধ্যম ‘রা কাড়েনি’।

সমস্যা হল, সংবাদমাধ্যমের মাথায় এইরকম ‘কর্তার ভূত’ চাপলে সবচেয়ে বিপন্ন অবস্থায় পড়েন সাংবাদকর্মী ও সাংবাদিকরা। কারণ, স্বভাবগত সংবাদপত্রের পাঠক ও চ্যানেলের দর্শক পছন্দ করেন কিছুটা ‘উত্তেজক’ খবর - সরকারি ব্যবস্থায় কোনো দুর্নীতি বা কোনো প্রশাসনিক গাফিলতি এগুলো তাদের যত আকৃষ্ট করে তার চেয়ে ঢের কম করে কোথায় ফিতে কেটে কোন ব্রিজের উদ্বোধন হল বা কোন সরকারি প্রকল্পে কী নতুন কথা ঘোষিত হল ইত্যাদি ইত্যাদি। কার্যত এই কর্তাভজা মিডিয়ার চাপে সাংবাদিকরাও কিন্তু বিপন্ন। কোভিড-এর পরে প্রচুর সাংবাদিক কাজ হারিয়েছেন, এখনো অনেক চ্যানেলে স্থায়ী চাকরির বদলে তাদের খবর-পিছু পারিশ্রমিক দেওয়ার প্রথা চালু করা হচ্ছে, যার বিনিময়-মূল্য খবর সংগ্রহের বিনিয়োগের সঙ্গে আনুপাতিক নয়। অনেক বাংলা সংবাদপত্র তাদের পত্রিকার আয়তন কমাচ্ছেন, বিভাগ বন্ধ করে দিচ্ছেন, কর্মী ছাঁটাই করছেন। কিন্তু এইসব নিয়ে কোনো ‘ব্রেকিং নিউজ’ হওয়া আজ আর সম্ভব নয় - মিডিয়ার মাথায় চেপে বসেছে ‘কর্তার ভূত’।