আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ ত্রয়োদশ সংখ্যা ● ১-১৫ জুলাই, ২০২৩ ● ১৬-৩১ আষাঢ়, ১৪৩০

প্রবন্ধ

ফিরে দেখা - ২০শে জুন, ১৯৪৭

দেবকুমার সোম


১৯৪৭ সালের ২০শে জুন বঙ্গীয় আইন পরিষদের বিশেষ অধিবেশনে অখণ্ড বাংলার পক্ষে ভোটাভুটি হয়। বক্ষ্যমান নিবন্ধ সেই রাজনৈতিক ঘটনাকে ফিরে দেখার চেষ্টা মাত্র। এই আলোচনায় আমি মূলত তিনটে প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করবঃ
ক) ২০শে জুন ১৯৪৭ সালের সেই অধিবেশন কি সত্যিই অনিবার্য ছিল?
খ) ১৯০৫ সালের বাংলাভাগের সঙ্গে ১৯৪৭ সালের ভাগের তফাত কোথায়?
গ) ২০শে জুনের সেই অধিবেশনের আজ কি আর কোনো ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে?

১৯৪৭ সালের ২০শে জুন বঙ্গীয় আইন পরিষদের যৌথ অধিবেশনে সদস্যরা ভোটাভুটির মধ্যে দিয়ে (পক্ষে ১২৬, বিপক্ষে ৯০) এই মত দিয়েছিলেন যে বাংলাভাগ হবে না। এই সিদ্ধান্ত মুসলিম লীগকে খুশি করলেও কংগ্রেস কিংবা হিন্দু মহাসভার সদস্যদের পছন্দ হয়নি। ফলে তাঁরা বাংলাভাগ করে 'পশ্চিমবঙ্গ' নামে একটা আলাদা রাজ্য গঠনের জন্য ফের ভোট দিলেন। এই প্রস্তাবে ৯০ জনের মধ্যে (যাঁরা মূল প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দিয়েছিলেন) ৫৮ জন 'পশ্চিমবঙ্গ' নামে নতুন রাজ্য গঠনে মত দিলেও ২১ জন সহমত হননি; একজন ভোটদানে বিরত ছিলেন। অংকের হিসাবে দেখা যাচ্ছে পরিষদের মোট ২৫০ জন সদস্যর মধ্যে সেদিন ৫৮ জন অর্থাৎ ২৩.২০% সদস্য পশ্চিমবঙ্গ নামের আলাদা রাজ্য গঠনে মত দিয়েছিলেন। আমি হিসাবটাকে যদি আরও ছোট করে আনি তবে দেখতে পাবো ২৫০ জন সদস্যের মধ্যে ১১৩ জন মুসলিম লিগের, কংগ্রেসের ৮৬ জন, ইউরোপীয় ২৫ জন, নির্দল ১৪ জন আর অন্যান্য ১২ জন। এই অনান্যদের মধ্যে কমিউনিস্ট পার্টির তিন জন আর হিন্দু মহাসভার মাত্র ১ জন প্রতিনিধি ছিলেন। ফলে সামান্য পাটিগণিতের হিসাবেই বোঝা যাচ্ছে যে ২৩.২০% সদস্য বাংলা-ভাগের পক্ষে ছিলেন, তাঁরা সংখ্যালঘু শুধু নন, মূলত নির্দিষ্ট দুটো দলের (কংগ্রেস আর হিন্দু মহাসভা) প্রতিনিধি।

১৯৪৬ সালে দেশজুড়ে যে নির্বাচন হয়, বাংলায় সেই নির্বাচনের ফলাফল কংগ্রেসের অনুকূলে এল না। মুসলিম লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হল। কংগ্রেস গোড়ার দিকে (১৮৮৫ সাল নাগাদ) পার্সিদের মুখপাত্র থাকলেও পরে তিলক, সুরেন্দ্রনাথ কিংবা মালব্যদের নেতৃত্বে উঁচুজাতের হিন্দুদের দল হিসেবেই প্রতিষ্ঠা পায়। ১৯১৮ সাল থেকে গান্ধির প্রভাবে কংগ্রেস একটা ধর্মনিরপেক্ষ দল হিসেবে তাদের অবস্থান জোরদার করেও ১৯৪০ সালে এসে জিন্নার দ্বি-জাতি তত্ত্বের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ল। এর পাশাপাশি দলিত এবং নীচুজাতের হিন্দুদের কাছে আম্বেদকরের গ্রহণযোগ্যতা ভারতীয় রাজনীতিতে কংগ্রেসের নিরঙ্কুশ প্রভাবকে প্রশ্নচিহ্নের মুখে এনে দেয়। এর সঙ্গে সমাজতান্ত্রিক দলগুলোর উত্থান, বিপ্লবীদের গান্ধি-বিরোধীতা আর সুভাষচন্দ্রের আজাদ হিন্দ বাহিনীর লড়াই স্পষ্ট করে দিল দেশের রাজনৈতিক ক্ষমতা হস্তান্তরে কংগ্রেস একমাত্র প্রতিনিধি হতে পারে না। লক্ষ করলে দেখা যাবে ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগ বাংলা, পাঞ্জাব, সিন্ধ প্রদেশে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা যেমন পেয়েছে, তেমন অসম, বিহার, নর্থ-ওয়েস্ট ফ্রন্টিয়ার আর যুক্ত প্রদেশে তাদের সাফাল্য ছিল চোখে পড়ার মতো। এর মধ্যে বিহার, নর্থ-ওয়েস্ট ফ্রন্টিয়ার আর যুক্ত প্রদেশে গান্ধি-নেহেরু-র প্রভাব যথেষ্ট ছিল। কমিউনিস্ট পার্টি-র ভোটে বিপর্যয় ঘটায় (তারা মাত্র ৮টা সিট পায়, যার মধ্যে বাংলায় ৩টে, মাদ্রাজে ২টো) কংগ্রেসের আসন বেড়েছিল। কারণ কংগ্রেসের ৪২-এর আন্দোলনের সাফল্য আর কমিউনিস্টদের আন্তর্জাতিক রাজনীতির বাধ্যবাধকতার কারণে বিরোধীতা এই নির্বাচনে ছাপ ফেলেছিল। স্বাভাবিকভাবেই অখণ্ড ভারতের পক্ষে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের অধিকাংশের ভোট গিয়ে পড়েছিল কংগ্রেসের ঝুলিতে। বাংলায় হিন্দু মহাসভা একটা মাত্র আসনে জিতেছিল।

ভোটের ফল প্রকাশ পাওয়ার পর ২৩শে মার্চ ক্যাবিনেট মিশন-এর তিন সদস্য ভারতে এলেন। তাঁদের চাপে রাখতে জিন্না ৭-৯ এপ্রিল দিল্লিতে মুসলিম লিগের কেন্দ্রীয়-প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের কনভেনশন ডাকলেন। সেই অধিবেশনে পাশ হলঃ

Whereas the Muslims are convinced that with a view to saving Muslim India from the domination of the Hindus and in order to afford them full scope to develop themseves according to their genius. It is necessary to constitute a sovergain, independent state comprising Bengal and Assam in the North-East zone... [১]

ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাবে দু-পক্ষই রাজি হলে ঠিক হয় কংগ্রেসের ৬ জন, লীগের ৫ জন, শিখ, পার্সি এবং খ্রিস্টানদের ১ জন করে প্রতিনিধি নিয়ে অন্তর্বর্তী মন্ত্রিসভা গঠন করা হবে। এই প্রস্তাবে গান্ধি জানালেন কংগ্রেসের ৬ জনের মধ্যে মুসলমানদের প্রতিনিধিও থাকবে, যেহেতু কংগ্রেস সারা ভারতের একমাত্র ধর্মনিরপেক্ষ দল। গান্ধির এমন দাবি জিন্না মানলেন না, তিনি স্পষ্ট জানালেন ভারতের মুসলমানদের একমাত্র প্রতিনিধি মুসলিম লীগ। এই বিতণ্ডার ফল ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাব থেকে লীগের বেরিয়ে যাওয়া এবং ১৬ অগস্ট কলকাতায় 'ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে'-এর ঘোষণা।

১৯৪৬ সালের শেষ ভাগে দাঙ্গা শুরু হলে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সরকারের প্রায় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। এর মধ্যে ১৫ই জুলাই ব্রিটিশ পার্লামেন্ট 'দ্য ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেডেন্স অ্যাক্ট ১৯৪৭' ঘোষণা করে। ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য মাউন্টব্যাটন-কে দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হয় ভারতে। মাউন্টব্যাটন ভারতে আসতেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাঁর ওপর চাপ বাড়াতে লাগল। জিন্না যেমন তাঁর দাবি থেকে সরলেন না, তেমন ৪ এপ্রিল তারকেশ্বর থেকে শ্যামাপ্রসাদ বাংলাভাগের দাবি তুললেন। এই আবহাওয়ায় শরৎচন্দ্র বসুর উদ্যোগে তাঁর উডবার্ন পার্কের বাড়িতে সোহরওয়ার্দী, আবুল হাশিম, কিরণশংকর রায়-এর মতো কয়েকজন নেতা মিলে অবিভক্ত এবং স্বতন্ত্র বাংলার এক বিকল্প প্রস্তাব আনেন। এই তৃতীয় প্রস্তাব নিয়ে প্রাথমিকভাবে জিন্নার যেমন আপত্তি ছিল না, তেমন গান্ধিও তাঁর কলকাতা বাসের সময় বিরূপ কোনো মন্তব্য করেননি। সমস্যা ছিল মূলত লীগ আর কংগ্রেসের সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতাদের মধ্যে। একদিকে কংগ্রেস সহ বিভিন্ন হিন্দু নেতারা ভারত থেকে বেরিয়ে আলাদা রাষ্ট্র গঠনে রাজি ছিলেন না, কারণ তাঁদের মনে হয়েছিল এভাবে ক্ষমতার হস্তান্তর ঘটলে হিন্দুরা সংখ্যালঘু হয়ে যাবে। অন্যদিকে মুসলিম লীগের দাবি ছিল অবিভক্ত বাংলা পাকিস্তানের সঙ্গে মিশে যাক। সেদিন বাংলাভাগের পক্ষে শ্যামাপ্রসাদ কিংবা হিন্দু রাজনৈতিক নেতারা ছাড়াও মেঘনাদ সাহা, রমেশচন্দ্র দত্ত, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় কিংবা যদুনাথ সরকারের মতো শিক্ষাবিদেরা মত দিয়েছিলেন। এসব সত্ত্বেও শরৎচন্দ্র আর আবদুল হাশিমের সক্রিয়তায় অবিভক্ত বাংলার একটা শেষ চেষ্টা হয়, যেখানে ছোটলাট বারোজও সহমত ছিলেন। কিন্তু রাজনৈতিক নেতাদের ব্যক্তিগত ক্ষমতার লোভে অবিভক্ত বাংলা বাস্তবায়িত হল না। এমন অস্থির সময়ে মাউন্টব্যাটেন ৩ জুন, ১৯৪৭ সালে তাঁর রেডিও ভাষণে প্রথম সরকারিভাবে জানালেন দেশভাগের কথাঃ

It has been impossible to obtain agreement on any plan that would preserve the unity of India. But there can be no question of coercing any large areas in which one community has a majority to live against their will under a Government in which another commounity has a majority. The only alternative to coercion is partition. [২]

এর ফলে শরৎচন্দ্র আর আবদুল হাশিমরা মুসলিম লীগ সরকারের সহযোগে ২০শে জুন যে যুগ্ম অধিবেশনে ভোটাভুটি করলেন তার কোনো যৌক্তিকতা ছিল না। কারণ তাঁদের সমীকরণ যেমন শেষ সময় বাঙালির আবেগকে ভিত্তি করে তৈরি হয়েছিল, তেমনই তাঁদের সমীকরণের বিরুদ্ধ-শক্তি ছিল অনেক সংঘবদ্ধ এবং শক্তিশালী। অধিবেশনে প্রথম যে প্রস্তাব আনা হয় সেখানে বলা হয় বাংলাভাগের বিরুদ্ধে ভোট নেওয়া হবে। যার অর্থ মুসলিম লীগের পক্ষে যাঁরা পাকিস্তানপন্থী তাঁরাও এই মোশানের পক্ষে ভোট দিলেন। এমন ফলাফল স্বাভাবিকভাবেই কংগ্রেস এবং অন্য হিন্দু নেতাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হল না। তাঁরা নিজেদের মধ্যে (অর্থাৎ ৯০ জন) ফের ভোট করলেন। এবার প্রস্তাব রাখা হল আলাদা 'পশ্চিমবঙ্গ' তৈরি এবং ভারত অন্তর্ভূক্তি। এই অধিবেশন সেদিন আত্মবিলাপের বিক্ষিপ্ত স্বর ছাড়া আর কিছুই ছিল না। কারণ তারই আগে ৩ জুনের রেডিও ভাষণে প্রথমে মাউন্টব্যাটন পরে নেহেরু বাংলা আর পাঞ্জাব ভাগের কথা স্পষ্ট জানিয়েছিলেন।

এখন মজার ব্যাপার হল বঙ্গভাগের কথা এর আগেও উঠেছিল। ১৯০৫ সালের ১৯ জুলাই কার্জন বাংলা-প্রদেশকে ভাগ করার প্রস্তাব রাখেন। সেই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে যাঁরা সেদিন প্রতিবাদে গর্জে উঠেছিলেন, তাঁরাই কিংবা তাঁদের সমর্থিত রাজনৈতিক দল সাতচল্লিশে এসে সম্পূর্ণ ভিন্ন মেরুতে দাঁড়িয়ে গেলেন!

১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গকে কলকাতার কিছু খবরের কাগজ সমর্থন করেছিল। তাদের যুক্তি এর ফলে পূর্ববঙ্গে আলাদা শাসনব্যবস্থায় সেখানকার মুসলমানদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিকাশ ঘটবে। অনুমান করে নেওয়া যায় এই কাগজগুলো মুসলমানদের পরিচালিত ছিল। খবরের কাগজের কথা বাদ দিলেও পণ্ডিত মদনমোহন মালব্য স্পষ্ট জানিয়েছিলেন বাংলার অঙ্গচ্ছেদ বাকি প্রদেশের সমস্যা নয়। [৩] এদিকে মাত্র চার দশকে রাজনীতির পাশাখেলা এমন বদলে গেলে যে সেই কংগ্রেসই বাংলাভাগে সোচ্চার হয়েছিল। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে হিন্দু জমিদারেরা জনমত গঠন করেন। কারণ সেই প্রস্তাব ছিল তাঁদের মৃত্যুবাণ। তখন বাংলায় হিন্দু জমিদারেরা যেমন ছিলেন সমাজ আর রাজনীতির মাথায়, তেমন মুসলমান মধ্যবিত্ত শ্রেণি তখনও সংঘবদ্ধ হতে পারেনি। এর চার দশকের মধ্যে হিন্দু জমিদারেরা যখন তাঁদের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা হারাতে লাগলেন, ঠিক তখনই মুসলমান জমিদারেরা রাজনীতিতে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হলেন; মুসলমান মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ হল। রাজনীতিতে ফজলুল হক, মুজাফফর আহমদ যেমন নেতৃত্বে এলেন, তেমন শেখ মুজিবুরের মতো ছাত্ররাও পিছিয়ে থাকলেন না। কাজী নজরুলের উত্থানে সংগীত কিংবা সাহিত্যে মুসলমান মধ্যবিত্ত শ্রেণি অংশগ্রহণ করল। এমনকি গোঁড়া খান সাহেবের মেয়ে হয়ে ফিরোজা বেগম গ্রামোফোনে আধুনিক গান রেকর্ড করে তাক লাগিয়ে দিলেন। বাঙালি মুসলমান মেয়েরা পর্দানসীন রইলেন না। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর মতো যুবকেরা 'দ্য স্টেটসম্যান'-এর মতো সাহেবি খবরের কাগজের সাংবাদিক হলেন। এই উত্থান হিন্দুদের চোখের সামনে ঘটলেও তাদের চোখে পড়েনি। ১৯৪৬-এর ভোটে পরিষ্কার হয়ে গেল বাংলায় হিন্দু-মুসলমান সমান শক্তিধর। ভোটের রাজনীতি বড়োই নির্মম। সেখানে সম্রাট আকবর কিংবা হরিপদ কেরানির মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। ৪৬-এর নির্বাচনে শুধু জিন্নার পালে বাতাস লাগেনি, হিন্দু রাজনীতিকদের বুকে ভয় এনে দিয়েছিল। দাঙ্গার মধ্যে দিয়ে বহু বছরের লাঞ্ছনা-অপমানকে যেমন রাজনৈতিক হাতিয়ার করতে পারলেন ফান্ডামেন্টালিস্টরা, ঠিক তেমনই দুই ধর্মের মধ্যে রেষারেষি সপ্তমে উঠল।

ফলে ১৯০৫-এর অবস্থান থেকে হিন্দু রাজনীতিকরা ১৯৪৭ সালের অখণ্ড বাংলার প্রস্তাবে একশো আশি ডিগ্রি বেঁকে গেলেন। তাঁরা বুঝতে পারলেন অখণ্ড বাংলার অর্থ মুসলমানের শাসন। তা সে বাঙালির হোক, কিংবা পাঞ্জাবিদের। একদিন যে আশঙ্কায় তাঁরা হিন্দু-মুসলমানের যৌথ প্রতিরোধে ডাক দিয়েছিলেন, সেই আশঙ্কা মাত্র চার দশকেই ব্যুমেরাং হল। এই হল ইতিহাসের নির্মম বিচার। হিন্দু সমাজ-সংস্কারের (যাকে 'নবজাগরণ' বলে প্রচার করা হয়) সময় থেকে আনন্দমঠ হয়ে বিপ্লববাদ সবখানেই মুসলমানহীন এক দেশের কথা বলেছেন হিন্দু নেতারা। এর ফলে অনিবার্য হয়ে উঠেছিল দাঙ্গা, ভাগাভাগি।

দেশভাগের পঁচাত্তর বছর কাটিয়ে পশ্চিমবাংলা যেমন আর সেই ঊজ্জ্বল নীলকান্ত মণি নয়, যার আর্থ-রাজনীতি কিংবা সমাজ-সংস্কৃতির প্রভাব ছিল পুরো দেশে, ঠিক তেমনই পূর্ববাংলার আজ আর কোনো অস্তিত্বই নেই। বাংলাদেশ আজ স্বাধীন-সার্বভৌম এক রাষ্ট্র; পশ্চিমবাংলা ভারতের এক পিছিয়ে পড়া রাজ্য। [৪] ইতিহাসে কী হলে কী হতে পারত এমন বিলাপের কোনো জায়গা নেই। তাই হা-হুতাশ নয়, অতীত ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়া সংকটকালে যে কোনো জাতির একমাত্র অনুশীলন হতে পারে। দেশভাগের সময় অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতায় সারা দেশের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ ছিল দ্বিতীয়, ২০২২ সালে তা কুড়ি নম্বরে নেমে গেছে ফলে আজ আর ২০শে জুন উদযাপনে আলাদা কোনো তাৎপর্য নেই।


তথ্যসূত্রঃ

১) শেখ মুজিবুর রহমান; অসমাপ্ত আত্মজীবনী; দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড; ঢাকা; জুন ২০১২; পৃষ্ঠাঃ ৫৩।
২) Barney White-Spunner; 'Partition The Story of Indian Independence and the Creation of Pakistan in 1947'; Simon & Schuster; London; 2017; পৃষ্ঠাঃ ১৬৫।
৩) অমলেন্দু দে; বাঙালি বুদ্ধিজীবী ও বিচ্ছিন্নতাবাদ; প্রতিভাস; কলকাতা; জানুয়ারি ২০১২; পৃষ্ঠাঃ ১৬৩।
৪) States and Union Territories, ranked by nominal domestic product per capita, at the start of each decade; 'The Times of India'; Kolkata Edition; Dated: 05.05.2023.