আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ ত্রয়োদশ সংখ্যা ● ১-১৫ জুলাই, ২০২৩ ● ১৬-৩১ আষাঢ়, ১৪৩০

প্রবন্ধ

সাভারকরের ‘হিন্দুত্ব’ এবং ইতিহাস চর্চা (দ্বিতীয় ও অন্তিম পর্ব)

রঞ্জন রায়


সাভারকরের ‘হিন্দুত্ব’ লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯২৩ সালে, ‘এ মারাঠা’ ছদ্মনামে। দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৯৪২ সালে, ‘ভারত ছোড়ো’ আন্দোলনের সময়ে। তাতে প্রকাশকের বিস্তারিত ভূমিকা পড়লে বোঝা যায় যে সম্ভবতঃ এর প্রকাশক সাভারকর নিজে। প্রকাশন সংস্থা - ‘বীর সাভারকর প্রকাশন’ এবং ঠিকানা ‘সাভারকর সদন’, বোম্বে।

এর সঙ্গে যে এক পাতার ধন্যবাদপত্র বা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন লেখাটি রয়েছে তাতে নাম রয়েছে জনৈক S. S. Savarkar, Publisher of First Edition।

এই এস. এস. সাভারকরের আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। আজকের গবেষকরা মনে করেন যে ওটাও বিনায়ক দামোদর সাভারকরের ছদ্মনাম। ইংরেজ সরকার সাভারকরের সিপাহী বিদ্রোহের উপর লেখা প্রথম বইটি নিষিদ্ধ করে দিয়েছিল। কিন্তু ‘হিন্দুত্ব’ বা ‘হিন্দুপদ পাদশাহী’ বইদুটো নিষিদ্ধ হয়নি।

তবে এই বইটি হাতে নিলে কিছু জিনিস প্রথমেই চোখে পড়ে।

এক, বইটির ১৯৪২ সালের সংস্করণ-এর ভূমিকার প্রথম প্যারাতেই প্রকাশক বলছেন যে বীর সাভারকরের লেখা ‘রোমান্টিক হিস্ট্রি’ গোছের অধিকাংশ বই তার বিষয়ের মৌলিকত্ব, উৎকর্ষ এবং স্টাইলের জন্যে ‘ওয়ার্ল্ড ক্লাসিক্স’-এর মধ্যে গণ্য হওয়ার যোগ্য

দুই, সাভারকর নাকি ১৯০৬ থেকে ১৯১০ সাল, অর্থাৎ আইনের ছাত্র এবং 'অভিনব ভারত সংস্থা'র সংগঠক হিসেবে লণ্ডনবাসের সময়েই ‘হিন্দু’ ঠিক কাকে বলা যায় - এটা ভাবছিলেন।

কিন্তু লণ্ডনবাসের সময়ে ওঁনার কোনো লেখা বা প্যাম্ফলেটে ‘হিন্দুত্ব’ শব্দটি নেই বা হিন্দুর সংজ্ঞা নিয়ে কোনো চিন্তার প্রকাশ নেই।

তিন, ‘হিন্দুত্ব’ বইটির রূপরেখা, অধ্যায়গুলো এবং বক্তব্যের মুখ্য বিন্দুগুলো এবং হিন্দুত্বের সংজ্ঞার কাব্যরূপ - সব নাকি আন্দামানের নির্জন কারাবাসের সময়ে জেল-কুঠুরির চুনকাম করা দেওয়ালে লেখা হয়ে গিয়েছিল। [1]

অথচ সাভারকরের প্রথম জীবনীলেখক ধনঞ্জয় কীর এবং ইদানীং কালের বিক্রম সম্পতের মতে বইটি রত্নাগিরি জেলে বসে লেখা হয়েছিল। সাভারকরের অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে যে হ্যাঁ, বইটি রত্নাগিরি জেলে থাকার সময়ে ১৯২৩ সালে লেখা হয়েছিল। আবার ওয়েবসাইটের অন্য একটি অংশে লেখা রয়েছে যে বইটি আন্দামানে ১৯২১-২২ সালে লেখা হয়েছিল। [2]

চার, বইটির লেখকের ছদ্মনাম ‘এ মারাঠা’, ‘অ্যান ইন্ডিয়ান’ নয়। কারণ, সাভারকর মনে করতেন হিন্দুদের হৃতগৌরব ফিরে এসেছিল মারাঠা রাজত্বে, শিবাজীর পর পেশোয়াদের সময়। তারা দিল্লির মসনদে বসা মোগলদের ক্ষমতা খর্ব করেছিল।

এর প্রমাণ?

● সেলুলার জেলে বারীন ঘোষ এবং উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোর স্মৃতিকথা। যাতে ওঁরা উল্লেখ করেছেন যে সাভারকর স্বাধীন ভারতের মডেল হিসেবে পেশোয়ারাজকে আদর্শ মনে করতেন।
● সাভারকরের 'হিন্দুত্ব' বইটির পর দ্বিতীয় উল্লেখযোগ্য রচনা - 'হিন্দুপদ পাদশাহী', বইটি দু’বছর পরে ১৯২৫ সালে প্রকাশিত হয়। এর বিষয়বস্তু মারাঠা হিন্দু সাম্রাজ্যের গৌরবগাথা।
● সাভারকরের মূল রচনা ‘হিন্দুত্ব’ বইয়ের প্রায় এক পঞ্চমাংশ জুড়ে রয়েছে মোগল সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে মারাঠা পেশোয়াদের উত্থানের এবং বিজয়ের বর্ণনা।

আমরা আপাততঃ 'হিন্দুত্ব' বইটির বিষয় এবং সাভারকরের মতে ‘হিন্দুত্ব’ এবং ‘হিন্দুইজম’-এর ফারাক নিয়ে আলোচনা করব।

সে’সময় আর্যদের ভারত আগমনের তত্ত্ব এবং তার খন্ডন- এই দুটো বিরোধীমত নিয়েই বিতর্ক চলছিল। সাভারকর আর্যদের মধ্যপ্রাচ্য থেকে ভারত আগমনের তত্ত্বকে আশ্রয় করে তাঁর হিন্দুত্বের তত্ত্বকে দাঁড় করিয়েছেন। তাঁর হিন্দু ভারতে বহিরাগত ঔপনিবেশিক হিন্দু, যারা বলপ্রয়োগের মাধ্যমে এদেশের মূল নিবাসী পণি এবং দাসদের দমন করে হিন্দু সাম্রাজ্যের স্থাপন করেছিল। সাভারকরের মতে সাম্রাজ্যের বিস্তার এবং বলপ্রয়োগ অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত এবং কাম্য

সাভারকর সেই ঐতিহ্যে ফিরে গিয়ে সমগ্র বিশ্বে হিন্দু সাম্রাজ্যের বিস্তার দেখতে চান। তাঁর ‘হিন্দুত্ব’ বইটি শেষ হয় এই আশায় যে, একদিন ঐক্যবদ্ধ হিন্দুরা ‘can dictate their terms to the whole world. A day will come when mankind will have to face the force’. [3]

এ’নিয়ে গভীর পাণ্ডিত্যপূর্ণ আলোচনা করেছেন ডঃ বিনায়ক চতুর্বেদী [4] এবং ডঃ জানকী বাখলে [5]

আজকাল আমরা কথায় কথায় ভারতের 'বিশ্বগুরু' হবার সম্ভাবনা এবং আহ্বান শুনতে পাই।

আমরা ওই প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে সাভারকরের মূল অবধারণাকে বোঝার চেষ্টা করব - অবশ্যি তাঁর ‘হিন্দুত্ব’ বইটিকে নিয়ে।

কথা ওঠে যে সাভারকরের অনেক আগে চন্দ্রনাথ বসু (১৮৪৪-১৯১০) এবং লোকমান্য তিলক ‘হিন্দুত্ব’ শব্দটি নিয়ে কথা বলেছেন। বঙ্কিমচন্দ্রের সুহৃদ চন্দ্রনাথ বসু যখন তাঁর 'হিন্দুত্ব - হিন্দুর প্রকৃত ইতিহাস' (১৮৯২) বইয়ে হিন্দুত্বের ধারণা এবং তার মাহাত্ম্য নিয়ে চর্চা করছেন, তখন সাভারকর নয় বছরের বালক।

চন্দ্রনাথের চিন্তা অনুযায়ী হিন্দু বিশ্বের শ্রেষ্ঠ জাতি, হিন্দুধর্ম শ্রেষ্ঠ ধর্ম এবং হিন্দু সংস্কৃতি পাশ্চাত্ত্যের থেকে উন্নত। তাঁর মতে ভারতভূমিতে ক্রিশ্চান এবং ইসলামকে স্থান দেওয়া উচিত নয়। আমরা দেখতে পাব যে চন্দ্রনাথের 'হিন্দুত্ব' ধারণার সঙ্গে সাভারকরের কত মিল!

'হিন্দু' কে এবং ‘হিন্দুত্ব’ কাকে বলে?

সাভারকর প্রথমে প্রশ্ন তুললেন - নামে কিবা আসে যায়! উত্তরে বললেন - অনেক কিছু আসে যায়; জুলিয়েটকে যদি রোজালিন্ড বলে ডাকা হয় বা ম্যাডোনাকে ফতিমা, অথবা অযোধ্যাকে হনলুলু - তাহলে কি একই অনুভূতি প্রকাশ পাবে? অবশ্যই নয়। মহম্মদকে ইহুদী বললে কি তিনি খুশি হতেন? [6]

তাই 'হিন্দুত্ব', 'হিন্দু' এবং 'হিন্দুস্তান' শব্দগুলো নিয়ে তাঁর বিচার শুরু হল।

বললেন ‘হিন্দুত্ব’ একটি শব্দমাত্র নয়, এটি আমাদের ইতিহাস। [7] খালি আধ্যাত্মিক ইতিহাস নয়, বরং আমাদের সংস্কৃতি, যুগ যুগ ধরে জীবনযাপনের যে ঐতিহ্য যে মূল্যবোধ - তার পূর্ণরূপ। 'হিন্দুধর্ম' এর একটি সাবসেট, বা ক্ষুদ্র অংশ। আবার 'সনাতন ধর্ম' বলে যা চালানো হয় তা বিশাল বৈচিত্র্যময় হিন্দুধর্মের একটি অংশমাত্র, পুরোপুরি হিন্দুধর্ম বা তার একমাত্র রূপ নয়।

আগে 'হিন্দু' এবং 'হিন্দুস্তান'-এর উৎস বোঝা দরকার।

প্রচলিত মত হল মধ্য এশিয়া থেকে আগন্তুক তুর্কীদের আক্রমণের সময় থেকে ওদের মুখে সিন্ধু হয়েছে হিন্দু, যেমন কিনা সাভারকর নিজেই দেখেছেন 'জেন্দ - আবেস্তা' ধর্মগ্রন্থে ‘স’ কে ‘হ’ বলতে। কিন্তু সাভারকর খাপ্পা! আমাদের নামকরণ করবে আক্রমণকারী বিধর্মীরা?

যে হিন্দুধর্ম মানে সেই কি হিন্দু?

সাভারকর একেবারেই এই সংজ্ঞা মানতে রাজি নন। তাঁর মতে আর্যগোষ্ঠীর একটি অংশ সিন্ধুনদীর এবং সপ্তসিন্ধুর তীরে তাদের মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এক স্বতন্ত্র নদীমাতৃক কৃষিসভ্যতা স্থাপন করে এবং তাদের মধ্যে ক্রমশঃ এক জাতীয়তাবোধ জাগিয়ে তোলে। ওরা নদীর প্রতি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ নিজেদের এলাকার নাম দিল ‘সপ্তসিন্ধু’।

ঋগবেদে এর উল্লেখ আছে। এবং সাভারকরের মতে এটি আমাদের বিশিষ্ট জাতীয়তা এবং সংস্কৃতির দ্যোতক।

মুশকিল হল দুটো।

এক, ওই 'জাতীয়তা' ব্যাপারটি বেদে কোথাও নেই, পুরাণেও নেই। রয়েছে ‘জাতি’। এবং সেই জাতি বা বর্ণ নানান ভাগে বিভক্ত। সপ্তসিন্ধু এলাকা জুড়ে একটিমাত্র জাতি বা একটি রাষ্ট্র - এমন কোথাও বৈদিক বা বৌদ্ধ বা পুরাণ কথায় নেই। না ‘হিন্দু’ বলে কোনো জাতি বা রাষ্ট্রের কথা রয়েছে।

দুই, তার বদলে ঋগবেদে, মহাভারত, রামায়ণ সহ আদি সমস্ত পুরাণকথায় এবং বৌদ্ধ সাহিত্যে যত জনপদ এবং রাজত্বের বর্ণনা রয়েছে তাতে দেখি বিভিন্ন রাজার আলাদা আলাদা রাজ্য/রাষ্ট্র এবং শক্তি প্রদর্শনের মাধ্যমে তার এলাকা বাড়ানো কমানো। অশ্বমেধ যজ্ঞের ঘোড়ার কথা মনে করুন। পরাভূত রাজারা বশ্যতা স্বীকার করে এবং কর দিয়ে বা যুদ্ধের সময় সৈন্য সাহায্য দিয়ে রেহাই পেত।

খুঁজতে খুঁজতে সাভারকর বিষ্ণু পুরাণে পৌঁছলেন। বললেন - এই ছোট্ট দ্বিপদীতে আমাদের পরিচয় চমৎকারভাবে ধরা হয়েছে।

উত্তরং যতসমুদ্রস্য হিমাদ্রৈশ্চৈব দক্ষিণম্।
বর্ষ তদ্ভারতং নাম ভারতী যত্র সন্ততী।।
(বিষ্ণু পুরাণ)

যে ভূখণ্ড সমুদ্রের উত্তরে এবং হিমালয়ের দক্ষিণে স্থিত তাকে ভরতবংশীয়দের বাসস্থান হিসেবে 'ভারত' বলে অভিহিত করা হয়। [8] এখানেও মুশকিল, ভারত আছে, হিন্দু বা হিন্দুস্থান নেই।

প্রাচীন যুগে একটি কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রশক্তি, একটিমাত্র জাতি - কোথাও নেই। এবং ভারত রয়েছে কিন্তু হিন্দুস্থান বা হিন্দু নেই, সাভারকর অস্বস্তিতে পড়লেন।

ওঁনার উপপাদ্য হল ভারত নয়, হিন্দু এবং হিন্দুস্থান শব্দ দুটো; এবং এর ব্যবহার বিদেশী যবন-ম্লেচ্ছদের মুখে নয়, প্রাচীন বৈদিক সাহিত্যের সময় থেকে প্রচলিত বলে প্রমাণ করতে হবে।

দেখা যাক সেটা উনি কীভাবে করেন।

সাভারকর বললেন - সপ্তসিন্ধু বা সিন্ধুস্থান হল আমাদের হিন্দুদের আদি জাতি এবং রাষ্ট্রের রূপ। এটি প্রাচীন সাহিত্যে পাওয়া যাচ্ছে। সেটাই পরে প্রাকৃতে 'হিন্দুস্থান' হয়েছে।

কিন্তু বৈদিক এবং বৌদ্ধ সাহিত্যে যে ‘হিন্দু’ শব্দ নেই! উনি বললেন - সংস্কৃতের ‘স’ প্রাকৃত জিভে ‘হ’ হয়ে যায়। 'সপ্তাহ' হয়ে যায় 'হপ্তা'। পারসিক ভাষায় ‘আসুর’ হয় ‘আহুর’। এসব বলতে বলতে উনি আশ্রয় নিলেন সেই বিতর্কিত ভবিষ্যপুরাণের, তার প্রতিসর্গ পর্বের।

আগের পর্বেই দেখিয়েছি মূল শ্লোকটি হল -

জানুস্থানে জৈনু শব্দঃ সপ্তসিন্ধুস্তথৈবচ।
সপ্তহিন্দুর্যাবনী চ পুনর্জ্ঞেয়া গুরুন্ডিকা।।
(৩৬)

যবনী ভাষায় 'জানু'কে বলে 'জৈনু', আর 'সপ্তসিন্ধু'কে বলে ‘সপ্তহিন্দু’!

এবার ফিরে যান সাভারকরের ছ’লাইনের শ্লোকটিতে। প্রায় প্রতিটি শব্দ মূল পুরাণের ২১-২২ এবং ৩৫-৩৬ থেকে তোলা। কিন্তু একটা তফাৎ রয়েছে।

শেষ লাইনে সাভারকর লিখছেনঃ হপ্তহিন্দুর্যাবনী চ পুনর্জ্ঞেয়া গুরুণ্ডিকা।। অর্থাৎ ভবিষ্যপুরাণেও 'সপ্ত'কে 'হপ্ত' বলা হয়নি, ওটা সাভারকর একরকম জোর করে বলছেন।

এছাড়াও আর একটা প্রশ্ন না করেই পারা যাচ্ছে না। সাভারকরের উদাহরণ কি তাঁর তত্ত্বের বিরুদ্ধেই যাচ্ছে না? ভবিষ্যপুরাণের শ্লোকটি বলছে - 'স'-কে 'হ' বলা হয় যবনদের ভাষায়[9]

তাহলে কী দাঁড়াল? সিন্ধু থেকে হিন্দু বলা যবনদেরই বৈশিষ্ট্য, আমাদের নয়

কিন্তু সাভারকর নিজের পিঠ নিজেই চাপড়িয়ে বলছেন - এতক্ষণ আমরা পা ফেলেছি ‘on solid ground of recorded facts’ [10]

কিন্তু ভবিষ্যপুরাণের ভাষা ও উচ্চারণবিধি নিয়ে ঐ শ্লোকটি কি অমন শক্তপোক্ত প্রমাণ? দু’পাতা এগিয়ে সাভারকর যেন দ্বিধাগ্রস্ত। বলছেন - এমনও হতে পারে যে সিন্ধু এলাকার আদিম অধিবাসীরা সিন্ধুকে ‘হিন্দু’ বলত। আগন্তুক আর্যরা ওই একই নিয়মে সংস্কৃতে 'হ'-কে 'স' করে হিন্দুকে সিন্ধু করে নিয়েছে? [11] মানে, সিন্ধু থেকে হিন্দু হয়নি, উলটো পথে প্রাকৃত হিন্দু থেকে সিন্ধু হয়েছে!

এর থেকে কী বুঝব? আর্যদের 'স' প্রাকৃত জিভে 'হ' হল, নাকি আদিবাসীদের 'হ' আর্যদের জিভে 'স' হল? আমি হাল ছেড়ে দিলাম।

কিন্তু সাভারকর এবার বলছেন আমাদের দেশের আদি বৈদিক নাম হল ‘সিন্ধুস্তান’, ভারতবর্ষ নয়, - ‘Sindustan - the best nation of Aryans’.

প্রমাণ? কেন, সেই ভবিষ্যপুরাণের প্রতিসর্গ পর্ব! এবারেও কোনো শ্লোক সংখ্যা উল্লেখ করার প্রয়োজন বোধ করেননি।

চারটে শ্লোক উদ্ধৃত করেছেন যার সার হলঃ

বিক্রমাদিত্যের নাতি শালিবাহন তাঁর পূর্বজদের সিংহাসনে বসে শক, চৈনিক, তাতার, বালহিক, কামরূপ, খোরাজান এবং শঠদের পরাস্ত করে আর্য এবং ম্লেচ্ছদের মধ্যে সীমান্ত চিহ্নিত করে দিলেন। তখন থেকে আর্যদের শ্রেষ্ঠ দেশের নাম হল সিন্ধুস্থান এবং ম্লেচ্ছদের দেশ হল সিন্ধুনদের ওপারে। [12]

কিন্তু বিক্রমাদিত্যের শক-হুণদল-পাঠান-মোগল বিজয়ের আখ্যান কি আদৌ বৈদিক যুগের?

বার বার বৈদিক ইতিহাস বা সাহিত্যের উদাহরণের নামে কেবল ভবিষ্যপুরাণের উল্লেখের দুর্বলতা বোধহয় সাভারকরকেও চিন্তায় ফেলেছিল। তাই তিনি ভবিষ্যপুরাণের সাফাই দিয়ে দু’পাতার ফুটনোট দিলেন।

* The verses from Bhavishyapuran quoted above seem to be quite trustworthy so far as their general purport is concerned. [13]

ওঁনার তর্ক হল মানছি, ‘it contains some inaccuracies and even absurdities - and is Plutarch free from them? বিদেশি পণ্ডিতদের সার্টিফিকেট না পেলে আমাদের ঐতিহ্যকে খারিজ করতে হবে? আরও বলছেন যে এই যে শ্লোকটি ভবিষ্যপুরাণে রয়েছে -

চন্দ্রগুপ্তস্য সুতঃ পৌরস্যাধিপতি সুতাম্
সুলভস্য তথোদাহ্য যাবর্নী বৌদ্ধতৎপরঃ
,

- একে কি খারিজ করতে হবে?

শ্লোকটির অর্থ (সাভারকরের ইংরেজি, আমার বাংলা) ’তখন বৌদ্ধমতে প্রভাবিত চন্দ্রগুপ্তের পুত্রটি পুরু রাজ্যের অধিপতির কন্যা সুলভাকে বিয়ে করল’। [14]

না, কেন খারিজ করব? কিন্তু এই শ্লোকটি কি প্রমাণ করছে না যে ভবিষ্যপুরাণ আদৌ বৈদিক সাহিত্যের যুগে রচিত নয়, বরং অনেক পরবর্তী রচনা?

প্রশ্ন হল - ভবিষ্যপুরাণের প্রতিসর্গ পর্বের উলটোপালটা রাজবংশের বর্ণনা এবং ফেব্রুয়ারি, রবিবার বলতে সান্ডে - এসব শব্দ থাকার পরেও তাদের ইংরেজ আগমনের পরবর্তী না ভেবে প্রাচীন ৫,০০০ বর্ষ আগের ইতিকথা কী করে বলা যায়?

এটা কী ধরণের ইতিহাস চর্চা?

দুই, আর্যগোষ্ঠী আসার আগে যারা এই সপ্তসিন্ধু এলাকায় বৈদিক যুগে বাস করছিল তাদের কী দশা হবে? দাস বা পণিরা? তাদের কি হিন্দু বলা যায়?

বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ থেকে আজ অব্দি যত পুনর্মূদ্রণ হয়েছে তাতে মলাটের ভেতর দিকে ঋগবেদ থেকে একটি শ্লোক মুদ্রিত রয়েছেঃ

য ঋক্ষাদংহসো মুচদ্যো বার্যাত সপ্তসিন্ধুপু।
বধর্দাসস্য তুবিংলৃমণ লীলমঃ
।। (ঋগবেদ, ৮/২৪/২৭)

এর অর্থ, “আমাদের সপ্তসিন্ধুকে সম্পদশালী কে করেছে? তুমিই হে প্রভু। এখন আমাদের শত্রু দাসেদের ধ্বংস করতে তোমার বজ্র হানো”! অর্থাৎ, সপ্তসিন্ধু অঞ্চলে বহিরাগত আক্রমণকারী আর্যেরা ওখানকার মূল অধিবাসী দাসদের শত্রু ভাবছেন!

সাভারকর শ্লোকটির ইংরেজি অনুবাদে জুড়ে দিয়েছেন ‘Nation of Sapta Sindhus’, কিন্তু ঋগবেদের এই শ্লোকটিতে কোথাও জাতি বা জাতীয়তা গোছের নিকটতম সংস্কৃত শব্দ দেখা যাচ্ছে না।

শেষে সাভারকর হিন্দুর সংজ্ঞা নির্ধারিত করলেন এই শ্লোকটি রচনা করেঃ

আসিন্ধু সিন্ধু-পর্যন্তা যস্য ভারত-ভূমিকা,
পিতৃভূঃ পূণ্যভূশ্চৈব স বৈ হিন্দুরিতি স্মৃতঃ
।। [15]

সাভারকর এর ইংরেজি ব্যাখ্যা করেছেন সিন্ধুনদ থেকে সমুদ্র পর্য্যন্ত বিস্তৃত ক্ষেত্রকে যাঁরা ‘পিতৃভূ’ (পিতৃভূমি) এবং ‘পূণ্যভূ’ (পূণ্যভূমি) মনে করেন তাঁরাই হিন্দু। [16]

আগেই বলেছি যে এই সংজ্ঞাটি সাভারকরের রচনা, কিন্তু খুব মৌলিক নয়। এতে 'মনুস্মৃতি'র একটি শ্লোককে, যাতে আর্যাবর্তের ক্ষেত্র কতটা - তার বর্ণনা রয়েছে, সামান্য বদলে নেওয়া হয়েছে এবং 'হিন্দু' শব্দ জুড়ে দেওয়া হয়েছে।

"পূর্ব এবং পশ্চিম সাগরের অন্তর্বতী যে ভূমি দুই পর্বতের মধ্যে অবস্থিত, তাহাকেই বিদ্বদজ্জনেরা আর্যাবর্ত বলিয়া থাকেন", (মনুস্মৃতি ২/২২)।

এবার উনি ‘পিতৃভূমি’ এবং ‘পুণ্যভূমি’র তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেছেন।

সাভারকর বলছেন - পিতৃভূমি-র অর্থ যে অঞ্চলে (সিন্ধুনদ থেকে সমুদ্র পর্য্যন্ত) পিতৃপুরুষ পরম্পরায় একটি জনগোষ্ঠী বাস করছে এবং যাদের মধ্যে একই রক্তধারা প্রবহমান তারাই হিন্দু। যদিও সাভারকর রচিত শ্লোকে রক্তধারার কথা বলা হয়নি, কিন্তু সাভারকর ব্যাখ্যা করেছেন যে পিতৃভূমি অর্থে কেবল ভূখন্ড নয়, একই রক্তধারার ঐতিহ্যও বুঝতে হবে।

আবার পূণ্যভূ বা পূণ্যভূমি অর্থে কেবল ধর্ম অথবা ধর্মীয় আচার নয়, সেটা হিন্দুত্বের সংকীর্ণ ব্যাখ্যা হবে।

বরং ধর্ম, রাষ্ট্রনীতি, শাসনপ্রণালী, জীবনযাপন পদ্ধতি মিলিয়ে সম্পূর্ণ সংস্কৃতির ইতিহাসকে ধরতে হবে। তাতে বিশেষ করে হিন্দু রাজাদের বীর্য এবং তার জোরে সাম্রাজ্যের বিস্তারের ইতিহাসের বিশেষ প্রাধান্য থাকবে।

এইজন্যেই বৌদ্ধধর্মের ঐতিহ্যকে খারিজ করতে হবে। এই বিশ্বধর্ম যতই মহান হোক, অহিংসার ভুল নীতিশিক্ষা দিয়ে তলোয়ারের বদলে জপমালা ধরিয়ে আমাদের অসহায় নিবীর্য করে দিয়েছিল। তাই রাজনৈতিক কারণেই বৌদ্ধধর্ম এদেশ থেকে উঠে গেল। [17]

সাভারকর উদ্ধৃত করছেন একেবারে অন্য প্রসঙ্গে লেখা বিদ্যাসাগরের সতীর্থ বাংলার তারানাথ তর্কবাচস্পতির একটি লাইন যাতে উনি হিন্দু ও যবনকে একেবারে বিপরীত মেরুর ধরেছেন - “শিব শিব! না হিন্দুর না যবনের!” [18]

পিতৃভূমি বোঝা গেল - রাষ্ট্র এবং জাতির বসবাসের জন্যে পরম্পরাগত ভূখণ্ড।

কিন্তু রক্তধারা?

সাভারকর এই পরিচ্ছেদের নাম দিয়েছেন 'Bond of Common Blood' [19], বলছেন বুঝতে হবে কেন হিন্দু হতে গেলে বাপ-পিতামহর আমল থেকে ভারত নামের একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে বসবাস করছি। সুতরাং পরিচয়ই যথেষ্ট নয়, হতে হবে একই শোণিতস্রোতের বন্ধনে বাঁধা।

"হিন্দুরা একমাত্র ভারতের নাগরিকই নয়, এবং শুধু মাতৃভূমির ভালবাসার বন্ধনে আবদ্ধই নয়, তারা একই রক্তধারার ঐতিহ্যের বন্ধনে আবদ্ধও বটে।" "They are not only a Nation but also a race (jati)". [20]

উল্লেখযোগ্য, যে একই সময়ে, মানে ১৯২০-৪০ কালখণ্ডে জনৈক অ্যাডলফ হিটলার - আর্যজাতি, আর্যরক্তের বিশুদ্ধতা এবং তার সঙ্গে রাষ্ট্রের বিকাশ এবং সুরক্ষা নিয়ে তথা বীর্যবান রাষ্ট্রের অবধারণা নিয়ে - ইউরোপ এবং ক্রমশঃ গোটা বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন।

সাভারকরের মতে সমস্ত হিন্দুজাতি সেই সিন্ধুদেশ এবং বৈদিক কাল থেকে পিতৃপুরুষ ক্রমে একই রক্তধারার বন্ধনে আবদ্ধ। যদি কেউ প্রশ্ন করে যে সত্যিই কি সমস্ত হিন্দুদের শিরায় একই রক্তের ধারা বইছে? তাদের কি একটি জাতি বলা যায়? তো সাভারকরের উত্তর হল - আজকের বিশ্বে ইংলিশ, ফ্রেঞ্চ, জার্মান বা চাইনিজদের রক্তও কি আগের মত শুদ্ধ রয়েছে? ওরা যদি জাতি হয় তো হিন্দু কেন নয়? [21]

তারপর সাভারকর 'মনুস্মৃতি'র উদাহরণ দিয়ে বললেন যে প্রাচীন অনুলোম এবং প্রতিলোম বিবাহের নিয়মে উচ্চবর্ণের পুরুষ নিম্নবর্ণের নারীকে বিয়ে করতে পারত এবং উল্টোটাও হত। কিন্তু সবাই তো বৃহৎ হিন্দুজাতিই। ব্রাহ্মণ থেকে চণ্ডাল সবার মধ্যে একই রক্তের ধারা বইছে।

ওই জাতপাতের আঁটাপত্তি ছিল বিদেশীদের রক্ত (ম্লেচ্ছ, যবন) ঢুকতে না দেওয়ার জন্যে। তাই বৌদ্ধধর্মও দেশ থেকে জাতিভেদ দূর করতে পারেনি। আর ইউরোপীয় পণ্ডিতরা ভারতের জাতপাতের ভূমিকাটি ঠিক ধরতে পারেন না।

ব্রাহ্মণ এবং চণ্ডাল, দ্রাবিড় এবং নমশূদ্র - সব হিন্দু। মহাভারত থেকে উনি নিয়োগ প্রথা, কর্ণ, বভ্রুবাহন, ঘটোৎকচ এবং বিদুরের জন্মবৃত্তান্তের উল্লেখ করে বললেন - সবই হিন্দু রক্ত। [22]

রাক্ষস, যক্ষ, বানর, কিন্নর, শিখ, জৈন, আইয়ার - সবই হিন্দু রক্ত। আমরা শুধু নেশন নই, আমরা একটি জাতি। [23]

এরপর উনি কিন্তু বিরাট ডিগবাজি খেলেন।

“আসলে সমগ্র বিশ্বে একটিই জাতি - মানব জাতি। একই শোণিত বহমান - মানব রক্ত। বাকি সব রক্তের বন্ধন কাজ চালানোর জন্যে - provisional, a make shift and only relatively true. Nature is constantly trying to overthrow the artificial barriers between race and race. To try to prevent the co-mingling of blood is to build on sand. Sexual attraction has proved more powerful than all the commands of all the prophets put together.” [24]

তাহলে লাভ জিহাদ তত্ত্বের কী দশা হবে?

যা বাব্বা! তাহলে এতক্ষণ ধরে কী সব বলছিলেন? কিন্তু উনি থামতে পারেন না। বললেন - আন্দামানের আদি বাসিন্দাদের শরীরেও কয়েক ফোঁটা আর্য রক্ত রয়েছে এবং এর উল্টোটাও সত্যি। ইতিহাসের সাক্ষ্য আমাদের শুধু এইটুকু বলার অধিকার দেয় যে আমাদের শরীরে সমস্ত মানবজাতির রক্ত বহমান। এক মেরু থেকে অন্য মেরু পর্য্যন্ত মানবজাতির এই মৌলিক ঐক্যটুকুই সত্য। বাকিসব আপেক্ষিক সত্য। [25]

এ তো একেবারে ঘেঁটে ঘ!

কিন্তু পরিচ্ছেদের শেষে গিয়ে ফের কেঁচে গণ্ডুষ।

কিন্তু আপেক্ষিক অর্থেও, বিশ্বে শুধু হিন্দুদের, হয়ত ইহুদিদেরও, রক্ত অন্য সমস্ত জাতির চেয়ে শুদ্ধ। হিন্দুর ছেলেমেয়েরা অন্য জাতিতে বিয়ে করলে জাত খোয়াতে পারে, কিন্তু ধর্ম খোয়ায় না। সেই জন্যে পিতৃভূমি সপ্তসিন্ধুতে যুগ যুগান্তর থেকে নিবাস করা হিন্দুদের জন্যে - একই রক্তের ধারার শর্তটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। [26]

এবার পূণ্যভূমি

সাভারকর বলছেন - হিন্দু হওয়ার তিনটি শর্ত; এক পিতৃভূমি, একই রক্তের বন্ধন এবং একই পূণ্যভূমি। খালি প্রথম দুটো যথেষ্ট নয়।

যেমন কাশ্মীরের কোনো কোনো মুসলমান সম্প্রদায় এবং দক্ষিণের কিছু ক্রীশ্চান সম্প্রদায় পুরুষানুক্রমে হিন্দুস্থানকে পিতৃভূমি মানে এবং বিয়েশাদির ব্যাপারে জাতপাতের বন্ধন মেনে চলে। তাই ওদের শিরায় একই হিন্দুরক্ত বহমান। তবুও তারা হিন্দু হতে পারে না। কারণ ধর্ম পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ওদের পুণ্যভূমি পরিবর্তিত হয়ে গেছে, আর সেটা এখন যথাক্রমে আরব এবং প্যালেস্টাইন।

কাজেই এখানে ‘স্বার্থের সংঘাত’ হতে পারে। তাই পিতৃভূ এবং পূণ্যভূ এক হওয়া প্রয়োজন।

শুধু হিন্দু, বৌদ্ধ এবং জৈনদের পিতৃভূ এবং পুণ্যভূ এক - হিন্দুস্থান। মুসলিম ও ক্রীশ্চানদের দুই ভূমি আলাদা। তাই দেশ আক্রান্ত হলে ওদের থেকে বিপদ হতে পারে। সুতরাং সাভারকরের হিন্দুরাষ্ট্রে মুসলিম ও ক্রীশ্চনদের স্থান নেই। চন্দ্রনাথ বসুর ‘হিন্দুত্ব’-র সঙ্গে কী আশ্চর্য মিল!

পূণ্যভূমির ব্যাখ্যা

সাভারকর স্পষ্ট করছেন যে পূণ্যভূমির অর্থ একটি জাতির নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে উপার্জিত সংস্কৃতির উত্তরাধিকার, এবং মানসিক গঠনে সেই উত্তরাধিকারকে বহন করা। তাই শুধু ধর্ম নয়, ভাষা এবং ইতিহাস এর অন্যতম অঙ্গ। সেই সংস্কৃতিকেই উনি বলছেন ‘হিন্দুত্ব’। এর মুখ্য অঙ্গ হল ইতিহাস, তাতে বেদ এবং পুরাণকথাও সামিল। শুধু তাই নয়, বৈদিক সভ্যতা থেকে শুরু। এবং একই আইন-কানুন, আচার -অনুষ্ঠান, রীতি-রেওয়াজও এই সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।

এই কারণে উনি সংস্কৃতকে 'দেবভাষা' বলে সর্বোচ্চ স্থান দিতে চান এবং উর্দূকে বহিষ্কৃত করতে চান।

রামায়ণ-মহাভারতের কাহিনী সব তাঁর কাছে ইতিহাসের উপাদান মাত্র নয়, বরং জীবন্ত ইতিহাস। এবং মারাঠা পেশোয়ারাজের মধ্যে উনি দেখতে পান বহিরাগত আক্রমণকারী ম্লেচ্ছদের বিরুদ্ধে শেষ সফল প্রতিরোধ।

সীতা-সাবিত্রী-দময়ন্তীর মধ্যে যে একনিষ্ঠা ও পবিত্রতা (chastity), তাই তাঁর কাছে হিন্দুনারীর আদর্শ। যখন কোনো হিন্দু প্রেমিক তার প্রেমিকাকে চুম্বন করে তখন তার চেতনায় থাকে ‘গোকুলের সেই স্বর্গীয় রাখালে’র প্রতি রাধার প্রেমের অনুভব। [27]

দুটো কথাঃ

সাভারকর সম্ভবতঃ সচেতন ছিলেন যে তাঁর হিন্দু ও হিন্দুত্বের ধারণায় তিনটি পূর্বশর্তের মধ্যে সবচেয়ে দুর্বল অংশ হল পিতৃভূমি এবং রক্তধারার শর্ত, তাই তিনি জোর দিয়েছেন পূণ্যভূমির পর।

পিতৃভূমি

বৈদিক সাহিত্যে বা কোন ভারতীয় সাহিত্যে দেশ বা রাষ্ট্রের প্রতীক হিসেবে পিতৃভূমি শব্দটি নেই - আছে মাতৃভূমি, দেশমাতৃকা, ভারতমাতা। অর্থাৎ আমাদের ঐতিহ্যে দেশ বা দেশের মাটি হল মায়ের সমান।

সাভারকর এই 'Fatherland' শব্দটি আমদানী করেছেন ইউরোপ থেকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলার ও স্তালিনের বক্তৃতা দেখুন, বা শলোকভের উপন্যাস 'They Fought for our Fatherland’।

ওঁর নিজের কানে কি ভারতের সংস্কৃতি এবং ইতিহাসের আলোচনায় ওই 'Fatherland' শব্দটি বেখাপ্পা লাগেনি?

আর সিন্ধু থেকে হিন্দু খুঁজতে গিয়ে বেদ এবং বিষ্ণুপুরাণে এর ভিত্তি না পেয়ে আশ্রয় করলেন ভবিষ্যপুরাণ, যার ঐতিহাসিকতা সন্দেহের বাইরে নয়। নিজেই গুলিয়ে ফেললেন যে সংস্কৃতের ‘স’ থেকে প্রাকৃত ‘হ’ হয়েছে, নাকি উল্টোটা?

তাই ভবিষ্যপুরাণের শ্লোকেও 'সপ্তহিন্দু'কে বদলে 'হপ্তহিন্দু' লিখে ফেললেন। শেষে দেখা যাচ্ছে ভবিষ্যপুরাণের সাক্ষ্যও তাঁর নিজের মতের বিরুদ্ধে - যাবনিক ভাষায় ‘স’ থেকে ‘হ’ হয়। তাহলে বাইরে থেকে আসা যবন বা ম্লেচ্ছদের জিভে 'সিন্ধু' বদলে 'হিন্দু' হয়েছে মতটাই জোর পেয়ে গেল।

আর ‘স্বার্থের সংঘাত’? বিংশ ও একবিংশ শতাব্দীতে আমরা দেখি 'পূণ্যভূমি' এবং 'পিতৃভূমি'র সংঘাত হলে মানুষ রাষ্ট্রকেই প্রাথমিকতা দেয়, পূণ্যভূমিকে নয়।

ইরাক-ইরানের যুদ্ধ, ইউরোপের লড়াইগুলো, রুশ এবং পোল্যাণ্ড বা ইউক্রেনের সংঘাত এর সাক্ষী। সবচেয়ে বড় উদাহরণ ইউকে’র নব নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনক একজন হিন্দু, যাঁর পিতৃভূ এবং পূণ্যভূ সব ভারত, রক্তধারা এবং বৈবাহিক সম্পর্কেও তিনি ভারতের সঙ্গে যুক্ত।

রক্তের বিশুদ্ধতা

নিজেই শেষে বলছেন যে বিশ্বে কোনো জাতির মধ্যেই অবিমিশ্র বিশুদ্ধ রক্ত নেই। অথচ একটু গা-জোয়ারি ঢঙে শেষ করছেন এই বলে যে একমাত্র হিন্দুজাতির মধ্যেই তুলনামূলক বা আপেক্ষিকভাবে রক্তের বিশুদ্ধতা রয়েছে।

আজকের কোনো নৃতাত্ত্বিক মানবেন কি যে পাঞ্জাব এবং সিন্ধ প্রান্তের জনগোষ্ঠী, দক্ষিণ ভারতের দ্রাবিড় এবং আসাম, ত্রিপুরা, নাগাল্যাণ্ডের জনগোষ্ঠীর মধ্যে একই রক্তের ধারা বইছে? বাঙালীদের দেখুন। নীহাররঞ্জন রায়ের গবেষণা দেখিয়েছে যে তাতে প্রোটো-অস্ট্রোলয়েড এবং ভোট-মঙ্গোল জনগোষ্ঠীর রক্তের সংমিশ্রণ রয়েছে।

কে হিন্দু, আর কে হিন্দু নয়

এবার দেখা যাক, পিতৃভূমি, রক্তের বন্ধন এবং পূণ্যভূমির তিন শর্ত মেনে সাভারকর ভারতে কাদের 'হিন্দু' বলছেন এবং কাকে কাকে বাতিল করছেন।

যারা ভারতের নাগরিক শুধু নয়, একই সংস্কৃতি এবং ইতিহাসের উত্তরাধিকার বহন করে তারা সবাই হিন্দু, তাদের ধর্ম যাই হোক। অতএব হিন্দুধর্মের অনুগামী যত সম্প্রদায়, সনাতনী, আর্যসমাজী, নাথ সম্প্রদায়, শৈব, বৈষ্ণব, শাক্ত, ব্রাহ্মমত এমনকি নাস্তিক ও চার্বাকপন্থী সবাই হিন্দু। একই মাপদণ্ডে শিখ, জৈন, বৌদ্ধ সবাই সাংস্কৃতিক হিন্দু।

কারণ, তারা তিনটে পরীক্ষাতেই পাশ করেছে। হিন্দুস্থান তাদের পিতৃভূমি, বিবাহাদি মোটামুটি নিজেদের সম্প্রাদায়ের মধ্যেই হয় - অতএব ধরে নেওয়া যায় একই রক্তধারা প্রবাহমান। আর এদের ধর্ম বা সম্প্রদায় আলাদা হলেও প্রবর্তক বা গুরু হিন্দুস্থানেই জন্মেছেন।

অতএব, এঁদের পিতৃভূমি ও পূণ্যভূমি এক এবং অভিন্ন।

এইজন্যেই হিন্দুস্থানে বংশানুক্রমে বসবাস করেও যে বা যাঁরা ধর্ম পরিবর্তন করে মুসলমান এবং ক্রিশ্চান হয়েছেন তাঁরা হিন্দু নন। যদিও তাঁদের পিতৃভূমি হিন্দুদের সঙ্গে অভিন্ন, রক্তধারার ক্ষেত্রেও তাই। আচার আচরণ ঐতিহ্যও অনেকটা হিন্দুদের সঙ্গে মেলে, তাদের দেশপ্রেম নিয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু তাঁদের পূণ্যভূমি হিন্দুস্থানে নয়, আরব মরু ও প্যালেস্তাইনে।

কিন্তু কোনো বিদেশী এবং অন্য ধর্মের মানুষ যদি হিন্দুধর্ম গ্রহণ করেন? তাহলেও হবে না। তিনি ধার্মিক হিন্দু হতে পারেন, কিন্তু তাঁর মধ্যে হিন্দুত্ব নেই। কারণ, তাঁর পিতৃভূ এবং পূণ্যভূ আলাদা, রক্তধারা আলাদা।

মেয়েদের ক্ষেত্রে? যদি কোন বিদেশি নারী হিন্দুধর্ম গ্রহণ করেন এবং হিন্দু পুরুষকে বিয়ে করেন, তাহলে তিনি হিন্দু। কারণ, বিয়ের পর তাঁর স্বামীর দেশ, সমাজ সব তাঁরই হয়ে যায়।

স্পষ্টতঃ সাভারকর নারীর স্বতন্ত্র সত্তায় বিশ্বাসী নন। পতিনিষ্ঠা এবং পতির জন্যে ত্যাগ ও সতীত্বই তাঁর মতে হিন্দু নারীর আদর্শ, এ নিয়ে স্বতন্ত্র আলোচনা হতে পারে।

ওপরের নিয়মে একটি ব্যতিক্রমী উদাহরণ হলেন সিস্টার নিবেদিতা। তাঁর পিতৃভূমি ও পূণ্যভূমি আলাদা, রক্তধারাও। এবং তিনি কোন হিন্দু পুরুষকে বিয়ে করেননি।

কিন্তু তিনি হিন্দু আদর্শ ও সংস্কৃতিকে এমন নিবিড়ভাবে গ্রহণ করেছেন যে সব technicality অবান্তর এবং অনাবশ্যক হয়ে গেছে।

"for she had adopted our culture and come to adore our land as her Holyland. She felt she was a Hindu and that is, apart from all technicalities the real and most important test". [28]

তবে সাভারকর মনে করেন এরকম একটি ব্যতিক্রমী উদাহরণ সেই বহুপ্রচলিত ইংরেজি প্রবাদ অনুযায়ী মূল নিয়মের যথার্থতাই প্রমাণিত করে।

আবার উনি বলছেন যে বৈদিক যুগেও এমন লোকজন বা জনগোষ্ঠী ছিল যারা বৈদিক ধর্মের অনুগামী ছিল না, যেমন ঋগবেদে বর্ণিত ‘পণি, দাস ও ব্রাত্য’ (The Panees, the Dasas, the Vratyas). [29]

যদিও এরা সাভারকরের মতে, "racially and nationally they were conscious of being a people by themselves".

দেখাই যাচ্ছে যে, এখানে তিনটের মধ্যে দুটো শর্ত সিদ্ধ হচ্ছে, তৃতীয়টি নয়। কাজেই এরা নিঃসন্দেহে, সাভারকরের মতে, হিন্দু নয়।

তাই বোধহয়, 'হিন্দুত্ব' বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ (১৯৪২) থেকে সামনের মলাটের ভেতরে ঋগবেদের শ্লোক ৮-২৪-২৭ মুদ্রিত হয়ে চলেছে যার অর্থঃ

“আমাদের সপ্তসিন্ধুকে সম্পদশালী কে করেছে? তুমিই হে প্রভু। এখন আমাদের শত্রু দাসেদের ধ্বংস করতে তোমার বজ্র হানো”!

উল্লেখযোগ্য যে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের প্রয়াত প্রাণপুরুষ গুরুজী গোলওয়ালকর তাঁর 'We or Our Nationhood Defined' (1939) এবং 'Bunch of Thoughts' (1966) বইয়ে একই চিন্তার প্রতিধ্বনি করেছেন। একই যুক্তিতে হিন্দুজাতির এবং রাষ্ট্রের তিন শত্রুকে চিহ্নিত করেছেন - মুসলিম, ক্রিশ্চান এবং কমিউনিস্ট। এই তিন গোষ্ঠীর পিতৃভূমি ভারত হলেও পূণ্যভূমি আলাদা যে!

তত্ত্বকথা এবং ইতিহাসচর্চার শেষে উনি বলছেন যে হিন্দুস্থানে বাস না করেও বিদেশে থেকে বা বিদেশি বাবা-মার সন্তান হয়েও যদি কেউ হিন্দুস্থানকে পিতৃভূ এবং পূণ্যভূ মনে করে আমাদের দেশকে ভালবাসে তাহলে সে অবশ্যই হিন্দু। 
দেখাই যাচ্ছে, সাভারকর পিতৃভূ এবং রক্তের বন্ধনকে তাঁর তত্ত্বের দুর্বল অংশ বলে বুঝেছিলেন। এবার উনি বললেন যে, হিন্দুর জন্যে পিতৃভূ কোন ভৌগলিক সীমা বা নির্ণায়ক বাধা নয়। ডাক দিলেন - হিন্দুস্থানের এবং হিন্দু সংস্কৃতির প্রতি ভালবাসা নিয়ে তারা ছড়িয়ে পড়ুক উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণ মেরু, গড়ে তুলুক হিন্দু উপনিবেশ; সমগ্র বিশ্বই তাদের ভৌগলিক সীমা। [30]

তবে 'হিন্দুত্ব' (১৯২৩) বইটির কোথাও বৃটিশ উপনিবেশ বা ইংরেজদের ভারত অধিকার নিয়ে একটি পংক্তিও নেই। যদিও বইটি নিজের নামে নয়, লেখা হয়েছে ‘এ মারাঠা’ নামে এবং গোপনে ছাপা হয়েছিল।

(শেষ)


সূত্রনির্দেশঃ

1) সাভারকর, 'হিন্দুত্ব', দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকা (৮ম প্যারাগ্রাফ)।

2) অশোক কুমার পাণ্ডেয়, 'সাভারকর, কালাপানী অউর উসকে বাদ', পৃঃ ১১৩।

3) Savarkar, Hindutva, page-136.

4) Vinayak Chaturvedi, ‘Hindutva and Violence: V. D. Savarkar and the Politics of History’; Permanent Black, 2022.

5) Janki Bakhle, 'Savarkar (1883-1966), Sedition and Surveillance: The rule of law in a colonial situation', in Social History. Vol. 35, No.1, February, 2010.

'Country First? Vinayak Damodar Savarkar (1883-1966), and the Writing of Essentials of Hindutva', in Public Culture 22:1, February, 2010.

6) সাভারকর, 'হিন্দুত্ব', পৃঃ ১৭।

7) সাভারকর, ’হিন্দুত্ব’, পৃঃ ১৮।

8) ঐ, ১৯।

9) সাভারকর, ‘হিন্দুত্ব’, পৃঃ ২৭।

10) সংস্কৃত সাহিত্যের নিবিড় পাঠক প্রবাসী বাঙালী শুদ্ধব্রত সেনগুপ্ত ভবিষ্যপুরাণ নিয়ে সাভারকরের কথিত রিসার্চের বিরোধাভাস নিয়ে একটি প্রবন্ধে দৃষ্টি আকর্ষণ করে আমাদের সবার ধন্যবাদার্হ হয়েছেন।

11) সাভারকর, ‘হিন্দুত্ব’ পৃঃ ২৩।

12) ঐ, পৃঃ ২৪।

13) সাভারকর, ‘হিন্দুত্ব’, পৃঃ ৪২।

14) ঐ, পৃঃ ৪৫-৪৬।

15) সাভারকর, ‘হিন্দুত্ব’, পৃঃ ৪৬।

16) সাভারকর, 'হিন্দুত্ব', পৃঃ ১১৫, হিন্দি সাহিত্য সদন, নিউ দিল্লি, ২০১৭ সংস্করণ।

17) ঐ, পৃঃ ১১৪।

18) সাভারকর, ‘হিন্দুত্ব’, পৃঃ ৩৫।

19) সাভারকর, ‘হিন্দুত্ব’, পৃঃ ৭৭।

20) সাভারকর, ‘হিন্দুত্ব’, পৃঃ ৮৭।

21) ঐ।

23) ঐ, ৮৯।

24) ঐ, ৯১।

25) ঐ, ৯২।

26) ঐ, ৯৩।

27) সাভারকর, ‘হিন্দুত্ব’, পৃঃ ৯৫।

28) সাভারকর, ‘হিন্দুত্ব’, পৃঃ ১২৬।

29) সাভারকর, ‘হিন্দুত্ব’, পৃঃ ১০৭।

30) ঐ, পৃঃ ১১৭ এবং ১৩৬, বইটির শেষ পংক্তি।