আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ ত্রয়োদশ সংখ্যা ● ১-১৫ জুলাই, ২০২৩ ● ১৬-৩১ আষাঢ়, ১৪৩০

প্রবন্ধ

গীতা প্রেসের গান্ধী শান্তি পুরস্কার লাভঃ কীসের কর্মফল?

প্রবীর মুখোপাধ্যায়


'গান্ধী শান্তি পুরস্কার' প্রদান শুরু হয় মহাত্মা গান্ধীর ১২৫তম জন্মবার্ষিকী উদযাপনের সময় ১৯৯৫ সাল থেকে। অহিংসা ও গান্ধীর ভাবধারা অনুসরণ করে দেশে বা বিদেশে সমাজ সংস্কারের কাজ করছেন যেসব ব্যক্তি বা সংস্থা তাঁদের মধ্য থেকে কাউকে এই সম্মানের জন্য মনোনীত করা হয়। পাঁচজনের মনোনয়ন কমিটির শীর্ষে থাকেন দেশের প্রধানমন্ত্রী। অন্য সদস্যরা হলেন ভারতের প্রধান বিচারপতি, লোকসভার বিরোধী দলের নেতা, অন্যথায় সংখ্যাগরিষ্ট বিরোধী দলের নেতা, এবং দেশের দু'জন বিশিষ্ট নাগরিক - বর্তমানে এই পদে আছেন লোকসভার স্পীকার ওম বিড়লা এবং বিন্দ্যেশ্বর পাঠক, যিনি 'সুলভ ইন্টারন্যাশনাল-এর পক্ষে এই পুরস্কার আগে পেয়েছেন।

১৮ জুন বিকেল ৪টেয় প্রকাশিত ভারত সরকারের 'প্রেস ইনফরমেশন ব্যুরো'র কলকাতা শাখার প্রতিবেদনে জানা গেল যে ২০২১ সালের 'গান্ধী শান্তি পুরস্কার' দেওয়া হচ্ছে গোরক্ষপুরের 'গীতা প্রেস'-কে। দ্য হিন্দু লিখেছে, “প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি-র সভাপতিত্বে মনোনয়ন কমিটির সদস্যরা প্রয়োজনীয় বিচার-বিবেচনার পরে রবিবার [১৮ জুন] সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে ২০২১ সালের গান্ধী শান্তি পুরস্কার গীতা প্রেস-কে প্রদান করা হবে।” সংস্কৃতি মন্ত্রক এক বিবৃতিতে জানিয়েছেঃ “অহিংস ও অন্য গান্ধীবাদী পন্থায় সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক বিবর্তনে আসামান্য অবদানের স্বীকৃতি হিসাবে” এই প্রকাশনা সংস্থা-কে পুরস্কার প্রদান করা হচ্ছে। শান্তি ও সামাজিক সম্প্রীতির গান্ধীবাদী আদর্শ প্রসারের কাজে গীতা প্রেসের অবদানের কথা উল্লেখ করে মোদি বলেছেন, এই সংস্থা গত ১০০ বছর ধরে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক যেসব কাজ করে চলেছে তার স্বীকৃতি স্বরূপ এই পুরস্কার। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এ বছর গীতা প্রেসের শতবর্ষ। মনোনয়ন কমিটির সিদ্ধান্ত 'সর্বসম্মত' বলা হলেও এই কমিটির সদস্য, লোকসভায় কংগ্রেস দলের নেতা অধীররঞ্জন চৌধুরি সংবাদ মাধ্যমকে জনিয়েছেন, তাঁকে মনোনয়ন কমিটির এই মিটিং-এ আমন্ত্রণই জানানো হয়নি।

এই পুরস্কার যে প্রতিবাদের সৃষ্টি করবে এটা সবাই জানে। প্রথমত, উত্তর-১৯৪৭ ভারতে প্রথম ‘টেররিস্ট’ আক্রমণে মহাত্মা গান্ধী হত্যাকান্ডের ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত বলে অভিযুক্ত হয়ে যারা জেলবন্দী হয়ে ছিল তাদের তালিকায় গীতা প্রেসের দুই প্রতিষ্ঠাতা হনুমান প্রসাদ পোদ্দার এবং জয়দয়াল গোয়ান্দকা-র নাম ছিল। দ্বিতীয়ত, ‘গীতা’ নামে এই প্রকাশন সংস্থা ভগবতগীতা প্রসঙ্গে-ই মহাত্মা গান্ধীর লেখা বই প্রকাশ করতে অস্বীকার করেছিল। গান্ধীজির মতামতের সঙ্গে কারও বিরোধ থাকতেই পারে, সেটা তার গণতান্ত্রিক অধিকার; কিন্তু যার মতের সঙ্গে বিরোধিতা তারই নামাঙ্কিত পুরস্কার হাতে তুলে দেওয়াটা নিশ্চয়ই উদ্দেশ্যমূলক।

১৯৯৫ সালে প্রথম 'গান্ধী শান্তি পুরস্কার' পেয়েছিলেন তানজানিয়ার জুলিয়াস কে ন্যায়ারেরে। পরবর্তী সময়ে এই পুরস্কার পেয়েছেন নেলসন ম্যান্ডেলা, আর্চবিশপ ডেসমন্ড টুডু এবং শেখ মুজিবর রহমান - যাঁরা সবাই উপনিবেশবাদ-বিরোধী মুক্তিযুদ্ধের জননায়ক। কুষ্ঠ রোগ নির্মূল করার আন্দোলনের নেতা গেরহার্ড ফিশার, বাবা আমতে এবং ইয়োহেই সাসাকাওয়া-ও এই পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। কিন্তু ১৯৯৮ সালে এই পুরস্কার পেয়েছিল 'রামকৃষ্ণ মিশন' আর ২০০২ সালে 'ভারতীয় বিদ্যাভবন', যাদের চিন্তাধারা ও কর্মকান্ডের সঙ্গে গান্ধীজির দর্শনের কোনো মিল নেই। কেন তারা এই পুরস্কার পেল সেই প্রশ্নের সদুত্তর কারুরই জানা নেই। আর উত্তর-মোদিকালের ছবি তো আরো মজাদার - ২০১৪ সালে এই পুরস্কার পেলেন ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা 'ইসরো', ২০১৫ সালে কন্যাকুমারিকার 'বিবেকানন্দ কেন্দ্র', ২০১৬ সালে 'অক্ষয়পাত্র ফাউন্ডেশন' আর ২০১৭ সালে 'একল অভিযান ট্রাস্ট!' আরও অবাক কাণ্ড, ২০১৯ সালে এটি পেয়েছেন মধ্যপ্রাচ্যের উপসাগরীয় ওমান রাজ্যের রাজা সুলতান ক্যাবুস বিন সৈয়দ আল সৈয়দ! ওমানের সুলতান আর ইসরো কীভাবে গান্ধীজির আদর্শের প্রতিনিধিত্ব করেন সেটা আমরা বুঝে উঠতে পারছি না। তবে পুরস্কার-প্রাপক অন্য সংস্থাগুলির কিন্তু একটা সাধারণ পরিচয় প্রকট - এরা সবাই তথাকথিত ‘হিন্দু’ ভ্রাতৃসমাজের অঙ্গ।

মোদি সরকারের অন্য সব কাজকর্মের ধারার সঙ্গে তাল মিলিয়ে এই ঘোষণাটিও আকস্মিক এবং বিদঘুটে। নাকি এই 'ম্যাডনেস'-এর মধ্যেও আছে 'মেথড'? যৌন উৎপীড়নের বিরুদ্ধে মহিলা কুস্তিগীরদের প্রতিবাদ যখন ক্রমশ জোরালো হচ্ছে, মণিপুরে সাম্প্রদায়িক সংঘাতের আবহাওয়া যখন চলেছে অবাধে, সেই সময়ে জনগণের দৃষ্টি ঘোরানোর তাগিদেই হয়তো এমন একটি ঘোষণা করা হল।

আফিমের ব্যবসা ও সনাতন ধর্ম

এবার গীতা প্রেসের ইতিহাসের দিকে একটু নজর দেওয়া যাক। ১৯২৩ সালে কলকাতার আফিম, সোনা-রুপো আর তৈরি পোশাকের কারবারি দুই ব্যবসায়ী, জয়দয়াল গোয়ান্দকা এবং ঘনশ্যামদাস জালান সনাতন ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে ‘গোবিন্দ ভবন কার্যালয়’ নামে এক সোসাইটি নথিভুক্ত করেন ১৮৬০ সালের সোসাইটি্জ রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্ট-এর অধীনে (বর্তমানে ওয়েস্ট বেঙ্গল সোসাইটিজ রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্ট ১৯৬০-এর অধীনে পরিচালিত)। বলা হয়, গীতা, রামায়ণ, উপনিষদ, পুরাণ ইত্যাদি প্রকাশের মাধ্যমে সনাতন ধর্মের প্রচার ও প্রসার এবং প্রখ্যাত সাধুসন্তদের সঙ্গে আলোচনা, চরিত্র-নির্মাণ সহায়ক পুস্তক ও পত্রিকা প্রভৃতি ছেপে জনসাধারণের কাছে কম দামে বিক্রি করা এই সোসাইটির মূল উদ্দেশ্য। জানানো হয়, এই সংস্থা কোনোরকম চাঁদা বা অনুদান গ্রহণ করে না; সংস্থার অন্যান্য শাখা জনগণের মধ্যে বিভিন্ন ধরণের সেবামূলক কাজের ন্যায্যমূল্যের মাধ্যমে যা আয় করে তা দিয়েই সব খরচ মেটানো হয়। এই প্রেস থেকে ১৯২৭ সালে 'কল্যাণ' নামে একটি পত্রিকা প্রকাশন শুরু হয়, যার প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক হনুমানপ্রসাদ পোদ্দার, যিনি ‘ভাইজি’ নামে পরিচিত ছিলেন, ‘শিব’ ছদ্মনামে প্রবন্ধ লিখতেন।

সহজ কথায় সরকারি খাতায় কলমে 'গীতা প্রেস' একটি মুনাফা না-করা সংস্থা। অথচ ২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাসে কয়েকদিনের জন্য এই 'গীতা প্রেস' বন্ধ হয়েছিল; কারণ, তিন জন কর্মীকে ছাঁটাই করার বিরুদ্ধে আর বেতন বৃদ্ধির দাবিতে কর্মীরা ধর্মঘট করেছিলেন । ছাঁটাই আর লক-আউট বে-আইনি ঘোষণা করেন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। সরকারি আদেশে ছাঁটাই কর্মীদের পুনর্বহাল করে প্রেস চালু হয় তিন দিনের মধ্যে। আর বেতন ও অন্যান্য প্রশ্নের সমাধানের জন্য লেবার কমিশনারের সভাপতিত্বে ত্রিপাক্ষিক মিটিংর-এর ব্যবস্থা হয়। বর্তমানে এই সংস্থায় প্রায় সাড়ে চারশো বেতনভুক কর্মচারি কাজ করেন বলে শোনা যায়। খবরটা এই কারণে জানা প্রয়োজন যে নামে অ-ব্যবসায়ী হলেও গীতা প্রেসের সঙ্গে অন্য ব্যবসায়ী সংস্থার পার্থক্যটা বোঝা যাচ্ছে না। তবে কি ট্যাক্সের আওতার বাইরে থাকার জন্য এটিকে জনকল্যাণমূলক মুনাফা-না-করা সোসাইটি হিসাবে চালানো হচ্ছে? [১]

স্বল্পস্থায়ী গান্ধী-প্রীতি

শুরু থেকেই ‘ভাইজি’ হনুমানপ্রসাদ পোদ্দার ছিলেন 'গোবিন্দ ভবন কার্যালয়'-এর মুখপত্র 'কল্যাণ' পত্রিকার সম্পাদক ও প্রধান লেখক এবং গীতা প্রেসের নীতিনির্ধারক। গান্ধীর সহজ-সরল জীবনযাত্রা, আত্ম-নির্ভরতা, ধর্মপ্রবণতা এবং স্বদেশী-র প্রতি ভালবাসা এসব দেখে হনুমানপ্রসাদজি গান্ধীজির প্রতি আকৃষ্ট হন। 'কল্যাণ' পত্রিকায় গান্ধীজির ৫৪টি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে, যার মধ্যে কয়েকটি আবার গান্ধীজি মারা যাওয়ার পর প্রকাশিত। 'হরিজন' ও 'নবজীবন' পত্রিকায় প্রকাশিত কিছু প্রবন্ধ এখানে পুনঃপ্রকাশিত হয়েছে। এগুলি পেয়ারেলালজি গান্ধীজির অনুমোদন ক্রমে পাঠিয়েছিলেন। যমুনালাল বাজাজ ও মহাদেব দেশাই-এর মাধ্যমে অনুরোধ আসায় কিছু প্রবন্ধ 'কল্যাণ' পত্রিকার জন্যই লিখেছিলেন গান্ধীজি। ব্যক্তিজীবনে ভগবানের গুরুত্ব, পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাব, হিন্দু বিধবাদের অবস্থা, গো-রক্ষার প্রয়োজনীয়তা এমন নানা বিষয়ের ওপর গান্ধীজি এই পত্রিকায় লিখেছেন।

গীতা প্রেস আর গান্ধীজির এই সুসম্পর্ক কিন্তু বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। বর্ণবৈষম্য আর সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে, বিশেষ করে হরিজনদের মন্দিরে প্রবেশের অধিকার এবং ‘পুনা প্যাক্ট’-এর প্রশ্নে, উভয়ের মধ্যে গভীর মতপার্থক্যের সূচনা হয়। গান্ধীজি আর হনুমানপ্রসাদজির মধ্যে ব্যক্তিগত সম্পর্ক বজায় থাকলেও মতাদর্শগত প্রশ্নে উভয়ের মধ্যে সম্পর্কের ফাটল অনেক সময়েই প্রকাশ্যে এসেছে। এসব সত্ত্বেও ১৯৪০ সাল অবধি গান্ধীজির লেখা 'কল্যাণ' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ঐ সালে গান্ধীজি ‘গো-সেবা সঙ্ঘ’ প্রতিষ্ঠা করেন। যমুনালাল বাজাজ তাঁকে এক চিঠিতে লেখেন যে এই সঙ্ঘে হনুমানপ্রসাদজিকে যুক্ত করার ভাবনা স্বয়ং গান্ধীজির, তিনি যেন এক সাধারণ সদস্য হিসাবে যোগ দিয়ে কিছু দায়িত্ব গ্রহণ করেন। গোরক্ষপুর থেকে বাজাজ-কে পোদ্দার লিখলেনঃ “বাপুর অনেক ধ্যান-ধারণা আর কর্মকান্ড আমি বুঝতে পারি না। অনেক সময়েই আমার হৃদয় এগুলির সরাসরি বিরোধিতা করে। এর ফলে আমার সমস্যা সৃষ্টি হয়। তবুও, বাপু তো বাপু-ই। যাই হোক না কেন, বাপুর প্রতি ভক্তির প্রশ্নে মহাত্মা গান্ধীর মতামত প্রসঙ্গে কোনো এক ব্যক্তির নিজস্ব মতের কোনো ভূমিকাই নেই।” [২]

গান্ধীহত্যা ও হনুমানপ্রসাদ [৩]

১৯২১ সালের আহমেদাবাদ কংগ্রেস অধিবেশনের পর থেকেই হনুমানপ্রসাদজি সচেতনভাবে কংগ্রেসের থেকে দূরত্ব বাড়িয়ে ক্রমে 'হিন্দু মহাসভা'র সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা বাড়াতে থাকেন। ১৯৪৬ সালে 'হিন্দু মহাসভা'র বার্ষিক অধিবেশন গোরক্ষপুরে করার ব্যাপারে প্রধান ভূমিকা নেন তিনি। একই সঙ্গে 'কল্যাণ' পত্রিকায় গান্ধীজি সম্পর্কে বিদ্বেষপূর্ণ সব লেখা প্রকাশিত হতে থাকে। দিল্লীতে ৩০ জানুয়ারি ১৯৪৮ গান্ধী হত্যার পরে হনুমানপ্রসাদ পোদ্দার বেশ ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েন। আরএসএস নিষিদ্ধ ঘোষণা হয়, সারা দেশে 'আরএসএস' ও 'হিন্দু মহাসভা'র সঙ্গে যুক্ত প্রায় পঁচিশ হাজার ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তার হওয়ার তালিকায় ছিলেন গীতা প্রেসের হনুমানপ্রসাদ পোদ্দার আর তাঁর বিজ্ঞ পরামর্শদাতা জয়দয়াল গোয়ান্দকা। স্যার বদ্রিদাস গোয়েঙ্কা এদের মুক্তি দেওয়ার কথা বলায় ঘনশ্যামদাস বিড়লা তার প্রতিবাদ করেন। বিড়লা বলেন যে এরা সনাতন ধর্ম প্রচার করছে না, ‘শয়তান ধর্ম’ প্রচার করছে। গান্ধী হত্যার মতো এত বড়ো খবর 'কল্যাণ' পত্রিকায় পরের দু’মাসের সংখ্যায় প্রকাশিত হল না। হনুমানপ্রসাদ পোদ্দার সংক্রান্ত কোনো রচনাতেই গান্ধী হত্যার কোনো কথাই নেই। কেবলমাত্র পোদ্দারজির জীবনী নিয়ে অপ্রকাশিত এক পান্ডুলিপিতে গান্ধী হত্যা নিয়ে কিছু কথা আছে। তাতে দেখা যায় যে গান্ধীহত্যার দিন পোদ্দারজি দিল্লীতেই ছিলেন। এই পান্ডুলিপিতেই অভিযোগ করা হয়েছে যে হনুমানপ্রসাদ আর গোয়ান্দকা যে গান্ধী হত্যাকান্ডের ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারেন, সেই সন্দেহ প্রকাশ করেন উভয়েরই খুব ঘনিষ্ট সহযোগী, গীতা প্রেসের এক প্রাক্তন ম্যানেজার মহাবীরপ্রসাদ পোদ্দার। আগের কয়েকমাস ধরে এই মহাবীরপ্রসাদ অনেক কংগ্রেস নেতাকে বিদ্বেষপূর্ণ পত্রের মাধ্যমে জানিয়েছিলেন যে ‘ভাইজি’ (হনুমানপ্রসাদ), 'গীতা প্রেস' আর 'কল্যাণ' পত্রিকা গান্ধী হত্যাকান্ডের জন্য দায়ী হতে পারেন।

পোদ্দারজির জীবনীর অপ্রকাশিত এই পান্ডুলিপি থেকে জানা যাচ্ছে যে গান্ধীহত্যার ঠিক পরেই হনুমানপ্রসাদ একটু অসুবিধার মধ্যে পড়েছিলেন। কিন্তু তার পরে তিনি লক্ষ্ণৌ, এলাহাবাদ, কলকাতা, দিল্লি, রতনগড় ও অন্যান্য স্থানে অকুতোভয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন। গোরক্ষপুরের ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট তাঁকে গ্রেপ্তার করা হতে পারে বলে সতর্ক করে কিছুদিনের জন্য গোরক্ষপুরে আসতে নিষেধ করেছিলেন। এই পাণ্ডুলিপিটির খুব নজরকাড়া দিক হল, এই লেখাতে গান্ধী হত্যাকান্ডকে খুবই চাপা স্বরে ‘ঐ দুর্ভাগ্যপূর্ণ ঘটনা’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। হনুমানপ্রসাদের জীবনীকার গম্ভীরচাঁদ দুজারি ১৯৪৮ সালে গোরক্ষপুরে ছিলেন না বলে তাঁর লেখা থেকে নতুন কিছু তথ্য পাওয়া যায় না। 'গীতা প্রেস' গান্ধীহত্যা প্রসঙ্গে সে সময়ে এক অদ্ভুত নীরবতা পালন করেছিল। একদিন যাঁর আশীর্বাদ ও রচনা 'কল্যাণ' পত্রিকার কাছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তারা ১৯৪৮ সালের এপ্রিল মাসের আগে গান্ধীজির হত্যাকান্ড প্রসঙ্গে কিছুই লিখে উঠতে পারল না! 'কল্যাণ' পত্রিকার ঐ এপ্রিল সংখ্যায় পোদ্দারজি গান্ধীজি প্রসঙ্গে বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে লিখলেন, তারপর থেকে গান্ধীজির কিছু রচনা আবার 'কল্যাণ' পত্রিকায় স্থান পেতে লাগল। কিন্তু ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি আর মার্চ মাসে 'কল্যাণ' পত্রিকায় গান্ধীজির উল্লেখমাত্র পাওয়া গেল না কী কারণে তার উত্তর পাওয়া গেল না।

সিআইডি’র মহাফেজখানার কাগজপত্র থেকে এই প্রশ্নের কিছু উত্তর পাওয়া যাচ্ছে। গান্ধী হত্যাকান্ডে জড়িত থাকতে পারে এই সন্দেহে আরএসএস নিষিদ্ধ ঘোষণা হয় ৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৮ তারিখে। তখন থেকেই হনুমানপ্রসাদ আরএসএস-কে সাহায্য করতে তৎপর হন। সরকার ১৫ জুলাই, ১৯৪৯ এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করার চারদিনের মধ্যে তিনি অটলবিহারী বাজপেয়ীর সঙ্গে গোরক্ষপুরে এক জনসভায় যোগ দেন। বাজপেয়ী তখন আরএসএস-এর সাপ্তাহিক মুখপত্র 'পাঞ্চজন্য' পত্রিকার সম্পাদক। ‘হিন্দুদের জন্য কিছু করতে পারে যে একমাত্র সংগঠন’ সেই আরএসএস-কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার জন্য বাজপেয়ী তৎকালীন সরকার ও কংগ্রেসের নিন্দা করে সভায় বক্তব্য রাখেন। সিআইডি’র রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, ঐ সভায় ঐ একই সুরে বক্তব্য রাখেন হনুমানপ্রসাদ। হনুমানপ্রসাদ শুধু যে সভায় যোগদান করতেন তাই নয়, সরসঙ্ঘচালক গুরু গোলওয়ালকর ১৯৪৯ সালে জেল থেকে ছাড়া পেলে তাঁর সঙ্গে যুক্ত প্রদেশের (তখনকার ইউনাইটেড প্রভিন্স) বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করেন। শুধু তাই নয়, বেনারসে গোলওয়ালকরকে স্বাগত জানিয়ে এক সভায় সভাপতিত্ব করেন। টাউন হলের ঐ সভায় ত্রিশ হাজার লোক এসেছিল। প্রাচীন হিন্দু সংস্কৃতির পুনর্জাগরণ, ভারতের সংহতিসাধন আর রাষ্ট্রভাষা হিসাবে হিন্দীকে গ্রহণ করার কথা গোলওয়ালকর তাঁর বক্তৃতায় বলেন। ঠিক সেই সময় সভার বাইরে সমাজবাদী আর কমিউনিস্ট সমর্থকরা স্লোগান দিচ্ছিল ‘গোলওয়ালকর লউট যাও’ এবং ‘বাপু কী হত্যারা সঙ্ঘ’। গোলওয়ালকরকে কালো পতাকা দেখানোর অপরাধে কয়েকশো’ বিক্ষোভকারীকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছিল।

সনাতন ধর্মশিক্ষাঃ সতীদাহ ও নারীবিদ্বেষ

গীতা প্রেসের ঘোষিত কর্মসূচি ছিল সনাতন ধর্ম প্রচার ও প্রসার। হিন্দুদের জীবনধারা কেমন হওয়া উচিত সেই প্রসঙ্গে লিখিত অসংখ্য পুস্তিকা রেলস্টেশনের স্টলে, শহরে ও গ্রামেগঞ্জে ছড়িয়ে থাকা দোকানে, এমনকী ফেরিওয়ালাদের কাছ থেকে খুব সস্তায় কিনতে পাওয়া যেত। বহুল প্রচারিত এইসব বইয়ের কয়েকটিঃ হনুমানপ্রসাদের লেখা নারী শিক্ষা, স্বামী রামসুখ দাসের লেখা 'গৃহস্থ মেঁ কেইসে রহেঁ', জয়দয়াল গোয়ন্দকা-র লেখা 'স্ত্রীয়োঁ কে লিয়ে কর্তব্য শিক্ষা এবং নারী ধর্ম'। শিব পুরাণ, মনুস্মৃতি এই সব থেকে অনেক উদ্ধৃতি সংকলিত করেও পুস্তক প্রকাশিত হয়েছে। প্রশ্নোত্তরের ঢঙে লেখা স্বামী রামসুখ দাসের 'গৃহস্থ মেঁ কেইসে রহেঁ' পুস্তিকার একটি অংশঃ “প্রশ্ন - স্বামী যদি স্ত্রী-কে প্রহার করে বা কষ্ট দেয় তাহলে স্ত্রী-র কী করা উচিত? উত্তর - স্ত্রী-র মনে করা উচিত যে সে পূর্বজন্মের কোনো ঋণ শোধ করছে। আর এইভাবে তার [পূর্বজন্মকৃত] অপরাধ বিনষ্ট হয়ে সে ক্রমশ শুদ্ধ হয়ে উঠছে। তার পিতামাতা এই [প্রহার করা বা কষ্ট দেওয়ার] কথা জানতে পারলে তারা তাদের সন্তানকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যেতে পারে কারণ এই ধরণের খারাপ ব্যবহার সহ্য করার জন্য তারা তাদের কন্যার বিবাহ দেয়নি।” কিন্তু যদি তার পিতামাতা কন্যাকে নিজেদের বাড়িতে ফিরিয়ে না নিয়ে যায় তাহলে? স্বামীজির ধার্মিক উপদেশঃ “এই পরিস্থিতিতে ...নিজের [পূর্বজন্মের] কৃতকর্মের ফল তাকে সহ্য করতে হবে। ধৈর্যের সঙ্গে শান্তভাবে স্বামীর প্রহার মেনে নিতে হবে। আর এইভাবে সহ্য করলে সে পাপমুক্ত হবে এবং হয়তো তার স্বামী তাকে ভালবাসতে শুরু করবে।”

এখানেই শেষ নয়। “প্রশ্ন - বাড়িতে থাকে যেসব ইঁদুর, টিকটিকি, মশা আর ছারপোকা তাদের প্রতি কেমন ব্যবহার করা উচিত? উত্তর - এদের পরিবারের সদস্য হিসাবে গণ্য করা উচিত কারণ এরা ঐ স্থানকে নিজেদের বাড়ি ভেবে সেখানে বাস করছে। সুতরাং তাদের এখানে বাস করার অধিকার আছে। অর্থাৎ এদের যথাসম্ভব লালন করা উচিত... লোকেরা এদের যেরকমভাবে মেরে ফেলে সেটা একেবারেই উচিত নয়।” স্বামী বৌ পেটালে স্বামীজির কোন মতে সেটা স্বর্গীয় আদেশ; কিন্তু তিনি পোকামাকড়ের প্রতি দয়াশীল!

আরেকটি নমুনাঃ ধর্ষিতা এক নারী আর তাঁর স্বামীর প্রতি স্বামীজির ধার্মিক উপদেশঃ “যত দূর সম্ভব মহিলার (ধর্ষণ-পীড়িতা) পক্ষে সবথেকে ভালো হবে চুপ করে থাকা। তাঁর স্বামীও যদি এই ঘটনার কথা জেনে ফেলেন তাহলে তাঁরও মৌন থাকাই উচিত। চুপচাপ থাকা দুজনের পক্ষেই লাভজনক হবে।”

একজন মহিলা কি পুনর্বিবাহ করতে পারে? স্বামীজির সরাসরি উত্তরঃ “বিবাহের মাধ্যমে কন্যাদান করে পিতামাতা একবার তার কন্যাকে দিয়ে দিলে সে আর কুমারী থাকে না। তাহলে অন্য ব্যক্তিকে কী করে সেই কন্যাকে দান করা যেতে পারে? তাকে পুনর্বিবাহ দেওয়া পাশবিক কাজ।” বেশ, কিন্তু একজন পুরুষ কি পুনর্বিবাহ করতে পারে? স্বামীজি বলছেনঃ “প্রথম স্ত্রী কোনো সন্তান দিতে না পারলে শাস্ত্রের বিধান অনুসারে পূর্বপুরুষের কাছে তার যে পিতৃঋণ আছে সেই ঋণ শোধ করার জন্য একজন পুরুষ দ্বিতীয় বিবাহ করতে পারে।” কিন্তু পুরুষের পুনর্বিবাহ করার এটাই একমাত্র কারণ নয়। স্বামীজির কথা অনুসারেঃ এক ব্যক্তি, “যার আনন্দ উপভোগের সমাপ্তি হয়নি, সে পুনর্বিবাহ করতে পারে, কারণ সে পুনরায় বিবাহ না করলে ব্যভিচারে লিপ্ত হবে, বেশ্যাবাড়ি যাবে আর নিজের ওপর কদর্য পাপের বোঝা চাপাবে। সুতরাং, সেই পাপ থেকে রক্ষা পেতে এবং শিষ্টতা বজায় রাখতে শাস্ত্র অনুসারে তার পুনর্বিবাহ করা বিধেয়।” তাই বলে কোনো বিধবা মহিলাকে কিন্তু পুনর্বিবাহ করতে অনুমতি দেওয়া যায় না, যদিও তাঁকে অন্য পুরুষের রক্ষিতা হবার অধিকার দেওয়া যেতে পারে - “এখানে সেখানে ব্যভিচারে লিপ্ত হয়ে যদি সেই মহিলা নিজের চরিত্র বজায় রাখতে না পারেন, তাহলে সে এক পুরুষের প্রতি তার আকর্ষণ বজায় রেখে সেই পুরুষের তত্ত্বাবধানে বাস করতে পারবে।”

মহিলাদের পক্ষে পুরুষদের সম-অধিকার দাবি করা কী যুক্তিযুক্ত? স্বামীজির স্পষ্ট জবাব - “না, এটা আদৌ যুক্তিযুক্ত নয়। প্রকৃতপক্ষে একজন মহিলার পুরুষের মতো অধিকার নেই... মহিলাদের মনে পুরুষের সঙ্গে সম-অধিকার লাভের আকাঙ্ক্ষার তাড়না আসে অজ্ঞানতা অথবা নির্বুদ্ধিতা থেকে। জ্ঞানবান সেই পুরুষ বা মহিলা স্বল্প অধিকার আর অধিকতর কর্তব্য নিয়ে যিনি তৃপ্ত থাকেন।”

হিন্দু মহিলাদের ভয়ংকর সতীদাহ প্রথার পক্ষে প্রকাশ্য প্রচার আর তাকে গৌরবান্বিত করার প্রচেষ্টা এই ধরণের পুস্তিকাতে করা হয়। যথা - প্রশ্নঃ “সতী প্রথা (অর্থাৎ স্বামীর মৃতদেহের সঙ্গে স্ত্রী-কে চিতায় জ্বালিয়ে দেওয়ার যে প্রথা) কী উচিত না অনুচিত?” স্বামীজির উত্তরঃ “স্বামীর মৃতদেহের সঙ্গে স্ত্রী-কে জ্বালিয়ে দেওয়াটা কোনো প্রথা নয়। যে-স্ত্রীর মনে সত্য ও উৎসাহ জাগরিত হয় তিনি আগুন না থাকলেও জ্বলতে থাকেন আর যখন পুড়তে থাকেন তখন তিনি কোনো যন্ত্রণা অনুভব করেন না। তাঁকে যে এমনটা করতে হবে এরকম কোনো প্রথা নেই, কিন্তু শাস্ত্রীয় ঔচিত্য অনুসারে এমনটাই তাঁর জন্য সত্য, ন্যায়নিষ্ঠা এবং বিশ্বাস... এর অর্থ, এটা কোনো প্রথা নয়। এটা তাঁর একান্ত নিজস্ব ধর্মীয় উৎসাহের প্রকাশ। এই বিষয়ে প্রভুদত্ত ব্রহ্মচারীজি একটি বই লিখেছেন যার নাম 'Cremation of a Wife with her Husband’s Dead Body is the Backbone of Hindu Religion', বইটি পড়া উচিত।”

যেসব রচনায় সতীদাহ প্রথা পুনরায় শুরু করার কথা বলা হয়েছে সে প্রসঙ্গে স্বামীজি বলছেনঃ “এতে কোন সন্দেহের অবকাশমাত্র নেই যে যে-স্ত্রী আনন্দিত চিত্তে মৃত স্বামীকে শ্মশানে অনুসরণ করেন তিনি তাঁর প্রতি পদক্ষেপে অশ্বমেধ যজ্ঞ করার সুফল লাভ করেন... একজন সতী মহিলা তাঁর স্বামীকে যমদূতের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে স্বর্গলোকে নিয়ে যান। এই পতিব্রতা রমণীকে দেখে যমদূতেরা নিজে থেকেই পালিয়ে যায়।” হনুমানপ্রসাদজির নিজের লেখা পুস্তক 'নারী শিক্ষা' শুরু হচ্ছে ‘সতী মাহাত্ম্য’ অধ্যায় দিয়ে। গীতা প্রেসের মুখপত্র 'কল্যাণ' পত্রিকায় সতী প্রথাকে মহিমান্বিত করে এক বিশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল। মহিলারা স্বাধীন সত্তা উপভোগ করার অধিকারী নন এটা প্রমাণ করার জন্য বিভিন্ন ‘হিন্দু’ ধর্মগ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতি সংগ্রহ করে 'নারী ধর্ম' নামে পুস্তিকা রচনা করেন জয়দয়াল গোয়ান্দকা। তার প্রথম অধ্যায়ের শিরোনাম - 'স্বতন্ত্রতা কে লিয়ে স্ত্রীয়োঁ কী আযোগ্যতা'। ‘বুদ্ধিদীপ্ত, প্রতিভাবান, সাহসী ও ধার্মিক’ সন্তানলাভ করার জন্য গর্ভবতী মহিলাদের কী কী রীতিনীতি পালন করা উচিত তার দীর্ঘ তালিকা এইসব রচনাবলীতে পাওয়া যায়।

এই ধরণের নারী-বিদ্বেষী, অবৈজ্ঞানিক, কট্টর সাম্প্রদায়িক পত্রপত্রিকা ও পুস্তিকা অবাধে বিক্রয়ের জন্য ভারতীয় রেল 'গীতা প্রেস'কে বিভিন্ন রেলস্টেশনে স্টল দিয়েছে। রাজ্যসভায় রাষ্ট্রমন্ত্রী মনোজ সিনহা ২০১৪ সালের ৮ অগস্ট জানিয়েছিলেন যে বিভিন্ন রেলস্টেশনে বইয়ের মোট ১৬৫টি স্টলের মধ্যে শুধু 'গীতা প্রেস'কেই দেওয়া হয়েছে ৪৫টি স্টল। দিল্লীর কাশ্মীরি গেট বাস টার্মিনাসে গীতা প্রেসের স্টল আছে। গীতা প্রেসের ভ্যান সুপ্রীম কোর্ট, সেন্ট্রাল সেক্রেটারিয়েট ও অন্যান্য অফিসের আশেপাশে বই বিক্রি করে। এছাড়াও 'রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ'র বইয়ের স্টলে এইসব বই পাওয়া যায়। 'গীতা প্রেস' আজকে এই ধরণের ‘হিন্দু’ ধর্ম সংক্রান্ত বইয়ের বৃহত্তম বিক্রেতা। এদের প্রকাশিত পুস্তকের মোট সংখ্যা ১৮৫০, ছাপা হয় ৭০ কোটি কপি।

রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রপতি

'গীতা প্রেস'কে প্রায়-দেবত্বর পর্যায়ে উন্নীত করার কাজ শুরু হয়েছে ২০২২ সাল থেকে। ঐ বছরের ৪ জুন গীতা প্রেসের গোরক্ষপুরের প্রধান কেন্দ্রে রাষ্ট্রপতি ব্যক্তিগতভাবে উপস্থিত হয়ে এদের শতবার্ষিকী উৎসবের সূচনা করেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন উত্তরপ্রদেশের রাজ্যপাল এবং মুখ্যমন্ত্রী। 'প্রেস ইনফর্মেশন ব্যুরো' তার প্রতিবেদনে জানাচ্ছে যে রাষ্ট্রপতি তাঁর ভাষণে ‘প্রকাশনার মাধ্যমে জনগণের মধ্যে ভারতের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক জ্ঞান পৌঁছে দেওয়ার জন্য’ এবং বিশ্বে ‘হিন্দু’ ধর্মীয় গ্রন্থের বৃহত্তম প্রকাশক হওয়ার জন্য গীতা প্রেসের অকুন্ঠ প্রশংসা করেন। [৪]

আশ্চর্য, ভারতীয় রাষ্ট্রের প্রধান নাগরিক এমন এক সংস্থাকে মহিমান্বিত ও গৌরবান্বিত করছেন যারা নারী-বিদ্বেষী, অবৈজ্ঞানিক, কট্টর হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক পত্রপত্রিকা ও পুস্তিকা প্রকাশ করে চলেছে! মনে হয় না কি, এই সংস্থার প্রশংসা করে রাষ্ট্রপতি নিজে সংবিধানের প্রতি আনুগত্যের যে-শপথ নিয়েছিলেন সেটা ভঙ্গ করেছেন? ধর্মীয় সাহিত্যের খোলস পরে অমানবিক প্রচার যারা চালিয়ে যাচ্ছে তাদের সম্বন্ধে বিচারব্যবস্থাই বা নীরব কেন এ প্রশ্নও সামনে আসে। সর্বোপরি এই সংস্থাকে গান্ধীজির নামাঙ্কিত পুরস্কার প্রদান করে শুধু গান্ধীজিকে নয়, সারা দেশের মানবিক মূল্যবোধকে অপমান করছে বর্তমান ভারতীয় জনতা পার্টির সরকার আর তার নেপথ্য-চালক রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ। 

সব মিলিয়ে মূল কথাটা শামসুল ইসলামই বলেছেন। [৫] আজ থেকে পঁচাত্তর বছর আগে ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি বিড়লা হাউসে যে ঘটনা ঘটানো হয়েছিল এ বছরের ১৮ জুন সেই ঘটনারই পুনরাবৃত্তি হল গীতা প্রেসকে গান্ধী পুরস্কার প্রদান করার মাধ্যমে। আর কত নীচে নামব আমরা?


সূত্রনির্দেশঃ

১) https://economictimes.indiatimes.com/industry/media/entertainment/media/historic-geeta-press-shuts-down-indefinitely/articleshow/45536129.cms

২) Seema Chisti, ‘Swallowing Gandhi and Peace in One Prize’.
[https://thewire.in/politics/swallowing-gandhi-and-peace-in-one-prize]

৩) Akshaya Mukul, Gita Press and the Making of Hindu India, 2017, pp. 57-59 and 174-175.

৪) The Telegraph, Kolkata; 22-06-2023; Editorial: ‘Centre bestowing Gandhi Peace Prize for 2021 to Gita Press’.

৫) Shamsul Islam, ‘Gandhi Peace Prize to Gita Press: RSS-BJP ulers leading India to the lower-depths of Human Debasement’.
[https://countercurrents.org/2023/06/gandhi-peace-prize-to-gita-press-rss-bjp-rulers-leading-india-to-the-lower-depths-of-human-debasement/]