আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ ত্রয়োদশ সংখ্যা ● ১-১৫ জুলাই, ২০২৩ ● ১৬-৩১ আষাঢ়, ১৪৩০

সমসাময়িক

মণিপুর জ্বলছে


ষাট দিন। মোটেও কম সময় নয়। এই সময়ে দেশ-দুনিয়ায় কত কিছু ঘটে গেছে। দিনের পর দিন গলা ফাটিয়ে, কন্ঠস্বর কাঁপিয়ে অজস্র নির্বাচনী প্রচারসভা হয়েছে। এখানে ওখানে অনেক শিল্যান্যাস হয়েছে। সংবিধান এড়িয়ে রীতিমতো হিন্দু শাস্ত্রমতে উদ্বোধন হয়েছে নতুন সংসদ ভবনের। আর ভার্চুয়াল জগতে রয়েছে নিরন্তর বিচরণ। কখনও 'বন্দে ভারত' ট্রেনের উদ্বোধন আবার কখনও তীর্থস্থানে যাত্রা শুরুর সম্ভাষণ। সর্বত্রই তিনি উপস্থিত। প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো অনুষ্ঠানে প্রচারিত হয় বিভিন্ন ধরনের ভাষণ। হয়েছে বিদেশ ভ্রমণ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংসদে উচ্চারিত হয়েছে গণতন্ত্রের বন্দনা। এমনকি প্রথমবারের মতো সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন হয়েছে। টেলিপ্ৰম্পটার যন্ত্রের সহায়তায় এবং পূর্ব নির্ধারিত একজন সাংবাদিকের একটিমাত্র প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে। তাতেই অস্বস্তি। ভক্তদের হতাশা গোপন থাকেনি। সাংবাদিকের জাতি-ধর্ম নিয়ে প্রশ্ন তুলে শুরু হয়েছে আগ্রাসী প্রচার। জুন মাসের শেষ রবিবার দেশে উপস্থিত না থাকার কারণে এগিয়ে আনা হয়েছে ১০২তম 'মন কী বাত'। তবে সেখানেও মণিপুর বাদ।

মণিপুর নিয়ে কোনো কথা নেই। ভাষণপ্রিয় এবং ভাষণপটু বলে দুনিয়াজোড়া পরিচিতি থাকার কথা বারেবারেই উল্লিখিত হলেও মণিপুরের ব্যাপারে কিন্তু মৌনতা অক্ষুণ্ণ রয়েছে। অথচ মণিপুর কোনও অজানা জায়গা নয়। প্রয়োজনে গুজরাটের রাজধানী আহমেদাবাদ থেকে বন্ধুদের নিজস্ব বিমানে সরাসরি মণিপুরের রাজধানী ইম্ফলে নিয়মিত যাতায়াত করা যায়। ডাবল ইঞ্জিন সরকার প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে বারেবারেই ইম্ফলে যাওয়া যায়। কিন্তু ধারাবাহিকভাবে হানাহানি চলতে থাকা এই প্রান্তিক রাজ্যর সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। একটিও শব্দ শুনতে পাওয়া যায়নি।

গত ৩ মে থেকে জ্বলছে মণিপুর। সেইদিন মণিপুরের জনজাতি ছাত্র সংগঠন ‘অল ট্রাইবাল স্টুডেন্টস ইউনিয়ন অফ মণিপুর’ (এটিএসইউএম)-এর বিক্ষোভ-মিছিল ঘিরে উত্তর-পূর্বের ওই রাজ্যে অশান্তির সূত্রপাত। ২৭ মার্চ মণিপুর হাইকোর্ট মেইতেইদের তফসিলি জনজাতির মর্যাদা দেওয়ার বিষয়টি রাজ্য সরকারকে বিবেচনা করার নির্দেশ দিয়েছিল। এর পরেই জনজাতি সংগঠনগুলি তার বিরোধিতায় পথে নামে। আর সেই ঘটনা থেকেই সংঘাতের সূচনা হয় সেখানে।

মণিপুরের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাসিন্দা হিন্দু ধর্মাবলম্বী মেইতেই জনগোষ্ঠীর সঙ্গে কুকি, জো-সহ কয়েকটি তফসিলি জনজাতি সম্প্রদায়ের (যাদের অধিকাংশই খ্রিস্টান) সংঘর্ষ ঠেকাতে গত ৬ মে মণিপুরের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকার। নামানো হয় সেনা এবং অসম রাইফেলস্ বাহিনীকে। বিশেষ ক্ষমতা দিয়ে সামগ্রিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা তদারকির ভার দেওয়া হয় সিআরপিএফের প্রাক্তন প্রধানকে। কিন্তু তাতেও তেমন ফল মেলেনি।

জাতিগত হিংসায় শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন কয়েক হাজার মানুষ। ঘরছাড়া অবস্থায় অন্য রাজ্যের ত্রাণশিবিরে আশ্রয় নিয়েছে অন্তত ৫০ হাজার মানুষ। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নামানো হয়েছে সেনা। সেনা ও আধা-সেনা মিলিয়ে প্রায় ৫০ হাজার উর্দিধারী নিয়মিত টহল দেওয়া সত্ত্বেও মণিপুরে শান্তি ফেরানো যাচ্ছে না। মারা যাচ্ছে অসহায় মানুষ। রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময় গাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রীর বাড়ি ভস্মীভূত। রাজ্য সরকারের একাধিক মন্ত্রীর গৃহ আক্রান্ত। গির্জা ভেঙে দেওয়া হচ্ছে। অস্ত্র লুট হয়ে যাচ্ছে। রাজ্য পুলিশের অনেকেই ছুটিতে চলে গেছেন। অর্থাৎ মণিপুর এখন ডাবল ইঞ্জিনের নিয়ন্ত্রণে নেই। এবং ঘটনাপ্রবাহ দেখে মনে হচ্ছে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার প্রয়াস অনুপস্থিত।

মে মাসের শেষ কয়েক দিনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিবাদমান দুই গোষ্ঠী কুকি এবং মেইতেই অধ্যুষিত এলাকা সফর করে কিছু পদক্ষেপ করার পরেও পরিস্থিতি বদলায়নি। তিনি বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছিলেন যে সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে যাবে। একই সময়ে দেশের সামরিক বাহিনীর সর্বাধিনায়ক বা চীফ অফ ডিফেন্স স্টাফ (সিডিএস) বলেছিলেন যে মণিপুরের পরিস্থিতি শান্ত হতে সময় লাগবে। এই পরিস্থিতিতে মেইতেই সামাজিক সংগঠনগুলির যৌথমঞ্চ ‘থৌবাল আপুনবা লুপ’ বিবৃতি দিয়ে মণিপুরে শান্তি ফেরানোর বিষয়ে ভারত সরকারের সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল।

ইতিমধ্যে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে যে মণিপুরে বিগত বিধানসভা নির্বাচনের আগে কুকি জনগোষ্ঠীর সঙ্গে আসামের মুখ্যমন্ত্রীর একটা লিখিত সমঝোতা হয়েছিল। সংখ্যাগুরু মেইতেই জনগোষ্ঠীর মানুষের উষ্মা এর ফলে স্বাভাবিকভাবেই তীব্রতা পায়। পাশাপাশি সরকারি স্তরে প্রচার শুরু হয়েছে যে কুকি জনগোষ্ঠীর কিছু মানুষ পাহাড়ে অবৈধভাবে পপি চাষ শুরু করেছে। পপি ফলের দানা পোস্ত। কিন্তু ফলের ভিতরকার যে আঠার মধ্যে পোস্ত দানা আটকে থাকে সেটা হল আফিম। আর আফিম হল মাদকদ্রব্যর মৌলিক উপকরণ। কাজেই অভিযোগ উঠেছে যে কুকি জনগোষ্ঠীর মানুষ মাদকদ্রব্য উৎপাদন করছে। একই সঙ্গে অভিযোগ উঠেছে কুকি জনগোষ্ঠীর সমর্থনে মায়ানমারের উগ্রপন্থী সন্ত্রাসবাদীরা মণিপুরের পাহাড়ে আশ্রয় নিয়েছে। হানাহানির প্রেক্ষাপটে এই ধরনের প্রচার স্বাভাবিক পরিস্থিতি সৃষ্টির পক্ষে হানিকর। তা সত্ত্বেও মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী যে কোনো কারণেই হোক না কেন দাবি করেছেন শরণার্থী কুকি জনগোষ্ঠীর জন্য মিজোরাম নিরাপত্তা নিশ্চিত করলেও তাদের স্থায়ী বসবাসের বন্দোবস্ত করার জন্য বাড়তি জমি চাই। দরকার কুকি জনগোষ্ঠীর জন্য নিজস্ব প্রশাসন। একেবারে সাম্প্রতিক সংযোজন মেইতেই-দের একটি নতুন গোষ্ঠী গঠন করে কুকি জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক আক্রমণ। জাতীয় কংগ্রেস দলের প্রাক্তন সভাপতি ও প্রাক্তন সাংসদ জুন মাসের শেষ লগ্নে ইম্ফলে উপস্থিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই নতুন গোষ্ঠীর সদস্যরা রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ শুরু করে। মুখ্যমন্ত্রী পদত্যাগ করতে উদ্যোগী হওয়ার চেষ্টা করলেও ভক্তদের আপত্তিতে পিছিয়ে আসেন।

সবমিলিয়ে এ এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি। ভাষা-জাতি-ধর্ম ভিত্তিক এই বহুমাত্রিক সংঘাত-সংঘর্ষে নিত্য নতুন উপাদান সংযুক্ত হচ্ছে। ছলে-বলে-কৌশলে ডাবল ইঞ্জিন সরকার প্রতিষ্ঠায় ব্যস্ত শাসকদলের পক্ষে সত্যিই এ এক বিড়ম্বনার বিষয়। ভাষা-জাতি-ধর্ম ভিত্তিক বিভাজন প্রক্রিয়ার যে বীজ আগ্রাসী আধিপত্যবাদ বপন করেছিল এখন তার ফসল ফলছে। মণিপুর বিভাজনের প্রস্তাবও আলোচিত হচ্ছে। মণিপুরের জনা দশেক বিধায়ক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার জন্য দিল্লিতে অবস্থান করছেন। তাঁরা কেউ বিরোধী দলের সদস্য নয়। তবুও দেখা হয়নি। তিনি 'মন কী বাত' শোনাতে উদগ্রীব। তাঁর কী জানা নেই যে ১০২তম 'মন কী বাত' অনুষ্ঠান সম্প্রচারের সময় ইম্ফলের রাস্তায় অসংখ্য রেডিও ভেঙে ফেলা হয়। মন কী বাত অনেক হয়েছে। এবার মণিপুরের কথা একটু ধৈর্য ধরে শোনা দরকার। বিদেশের মাটিতে গণতন্ত্র নিয়ে উচ্চকিত হলেও লাভ নেই। ভাষা-ধর্ম-জাতি ভিত্তিক বৈষম্য বাড়িয়ে স্বৈরশাসন প্রবর্তনের প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। অন্যথায় মণিপুরের মতো অন্যান্য প্রান্তেও এইরকম অশান্তির আগুন ছড়িয়ে পড়ে দেশের শান্তি-সম্প্রীতির পরিবেশ ধ্বংস করে দিতে পারে।