আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ ত্রয়োদশ সংখ্যা ● ১-১৫ জুলাই, ২০২৩ ● ১৬-৩১ আষাঢ়, ১৪৩০

সম্পাদকীয়

মোদীর আমেরিকা সফর


সম্প্রতি আমাদের প্রধানমন্ত্রী, শ্রী নরেন্দ্র মোদী, ভারত সরকারের প্রতিভূ হিসাবে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র সফর সেরে ফিরেছেন। ২১ থেকে ২৪ জুন অবধি দুই দেশের প্রধানদের ভিতর আলোচনা চলেছে। অতঃপর মিশর সফর সেরে প্রধানমন্ত্রী ২৬ জুন দেশে ফিরেছেন। বিমানবন্দরে নেমেই তিনি দেশের হল হকিকত জানতে চান। যদিও বিরোধীরা তাতে বিস্মিত হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর সাথে তার প্রায় অর্ধেক দপ্তর ভ্রমনসঙ্গী হলেও মাননীয় যে দেশের খবর পাননি এটা সবার কাছে খুবই অদ্ভুত ঠেকেছে। তবে সে আলোচনা থাক। মধ্যবিত্ত ভারতবাসীর স্বপ্নের দেশ আমেরিকা থেকে প্রধানমন্ত্রী এ দেশের জন্য কি আদায় করে আনলেন সেই আলোচনাতেই সীমাবদ্ধ থাকা যাক। এ যাবৎ নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ৫ বার আমেরিকা সফর করেছেন, যদিও রাষ্ট্রীয় আমন্ত্রণে এই প্রথমবার। তাই এই সফর ঘিরে সরকারি স্তর থেকে অনেক ঢক্কানিনাদও হয়েছে। কিন্তু দেখার বিষয় এই সফর কি ভারতকে উন্নতির দিকে নিয়ে গেল নাকি এই দেশকে আমেরিকার ভূরাজনীতির অংশীদার করে নিল?

সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমের প্রচার অনুযায়ী এই সফর থেকে ৪টি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। প্রথমটি হল আমেরিকার জেনারেল ইলেকট্রিক ও ভারতের হ্যাল একসাথে ভারতে তেজস যুদ্ধবিমানের জন্য ইঞ্জিন তৈরী করবে। দ্বিতীয় হল এই দুই দেশের যৌথ প্রকল্প হিসাবে 'ইনদাস ১০' অনুযায়ী প্রতিরক্ষা শিল্প ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করবে। তৃতীয় হল আমেরিকার মাইক্রন টেকনোলজি যারা বৈদ্যুতিন চিপ তৈরী করে তারা গুজরাটে ৮২৫ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে চিপ সংযোজন বা এসেম্বলি ও পরীক্ষার পরিকাঠামো নির্মাণ করবে। আর শেষ গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি হল ভারত ও আমেরিকা দুই দেশ যৌথভাবে মহাকাশ গবেষণায় অংশ নেবে। খুব স্বভাবতই দেশের সরকার ও তার বশংবদ সংবাদমাধ্যম উল্লসিত যে এই প্রথম এই দেশের জন্য আমেরিকা এভাবে প্রযুক্তি ও বিনিয়োগের চুক্তি স্বাক্ষর করল। নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে এই গোটা ঘটনা ঘটল। গোটা দেশ এবার তরতর করে উন্নতির রাস্তায় এগোবে। সবার উন্নতি তো হল বলে, বাকি শুধু সবার সঙ্গ।

আপাতদৃষ্টিতে একথা অনস্বীকার্য যে এবারের সফরে আমেরিকা নরেন্দ্র মোদীর জন্য বাস্তবিক অর্থেই দরাজহস্ত। কিন্তু প্রশ্ন হল, একদা যে ব্যক্তিকে মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময় আমেরিকা নিজের দেশে ঢুকতে দেয়নি, আজ এমন কি ঘটল যে সব বিরোধ মিটিয়ে আমেরিকা তার জন্যই মুক্তহস্ত হয়ে উঠেছে। এমনটা তো নয় যে ভারত গোটা বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত অর্থনীতি হয়ে উঠেছে। এমনও নয় যে প্রধানমন্ত্রী, যিনি একদা দাঙ্গার অভিযোগে বিদ্ধ, বা তাঁর দল নিজেদের সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করা ছেড়ে দিয়েছেন। বস্তুত এবারের আমেরিকা সফরে এই নিয়ে বিস্তর হইচই হয়েছে। আমেরিকার সংসদের চাপে নরেন্দ্র মোদীকে প্রথমবার বিদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে সাংবাদিক সম্মেলন করতে হয়েছে, সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়েছে, যা একেবারেই তাঁর নীতিবিরুদ্ধ।

এমন ঘটনা নজিরবিহীন, যেখানে বিদেশে গিয়ে দেশের প্রধানমন্ত্রীকে বাধ্য হতে হচ্ছে সাংবাদিক সম্মেলন করতে। এ ঘটনা গর্বের না লজ্জার তা অবশ্য ওঁনার সর্মথকেরাই বলতে পারবেন। সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে প্রধানমন্ত্রী দাবি করেছেন যে তিনি ও তাঁর দল এদেশে গণতন্ত্রকে মর্যাদা দেন, গণতন্ত্র নাকি তাঁদের শিরায় শিরায়। যদিও পরবর্তীতে প্রশ্নকর্তা সাংবাদিককেই বিজেপির আইটি বাহিনীর সম্মিলিত আক্রমণের মুখে পড়তে হয়েছে। অবস্থা এমন হয়েছে যে আমেরিকার সদর দপ্তর হোয়াইট হাউসকে অবধি বিবৃতি দিতে হয়েছে যে এই আক্রমণ কুরুচিকর এবং তা বরদাস্ত করা হবে না। সুতরাং প্রধানমন্ত্রীর দাবি যে কেবল মিথ্যাভাষণ তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এমনকি দেশের উত্তর-পূর্বে মণিপুর রাজ্য যখন জাতি হিংসায় জ্বলছে তখনও নরেন্দ্র মোদীর মৌনী ভাঙেনি, গণতন্ত্র রক্ষা করার কথা বলার সময়েও এই ঘটনার উল্লেখ অবধি তিনি করেননি। এমনকি আমেরিকার বেশ কিছু সাংসদ সেখানকার পার্লামেন্টে নরেন্দ্র মোদীর বক্তৃতা বয়কট করেন কারণ এদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর দলের হাতে নির্যাতিত হচ্ছে বলে। এমনকি আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা অবধি এ বিষয়ে সোচ্চার হন।

কিন্তু এতকিছুর পরেও নরেন্দ্র মোদীর জন্য আমেরিকার এই ঔদার্য নিতান্ত সৌজন্য নয়। বস্তুত এই সফর যে আদতে ভারতকে আমেরিকার ভূরাজনীতির অংশীদার বানিয়ে দিচ্ছে তা একটু তলিয়ে ভাবলেই বোঝা যায়। বর্তমান সময়ে বিশ্ব রাজনীতিতে আমেরিকার মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হল চিন এবং রাশিয়া। এক সময় ছিল যখন ভারত তার বরাবরের জোট নিরপেক্ষ রাজনীতির আদর্শ থেকে কোনো শিবিরেই নাম লেখায়নি। কিন্তু মনমোহন সিংহ সরকার বা তারও আগে থেকে ভারত সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘জুনিয়র পার্টনার’ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে চলেছে। ২০০৮ সালের ভারত-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক চুক্তি এই প্রক্রিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এই প্রেক্ষাপটে, বিগত কিছু বছর ধরে চিন ও ভারতের সীমান্ত দ্বন্দ্ব ভারতকে আরো বেশি করে আমেরিকার কোলঘেঁষা করেছে। অবশ্য উল্টো যুক্তিটাও ফেলনা নয় যে ভারত আমেরিকার প্রতি বেশী ঝুঁকছে বলেই চিন সীমান্তে সমস্যা তৈরী করেছে। কারণ যাই হোক, আমেরিকার চিন বিরোধী নীতিরই ফল এবারের ভারত আমেরিকার চুক্তিগুলি।

প্রথমত আমেরিকা আজকে চিনের একটি বিকল্প দেশ চায় যেখানে সস্তায় উৎপাদন করা যাবে। ভারত তার বিপুল অভ্যন্তরীণ বাজার ও বেকারবাহিনীর জন্য এক আদর্শ বিকল্প। তাই ভারতের মাটিতে বৈদ্যুতিক চিপের এসেম্বলি ও পরীক্ষার চুক্তি। খেয়াল করলে দেখা যাবে এক্ষেত্রে কিন্তু চিপ তৈরীর প্রযুক্তি হস্তান্তর হবে না। কেবল আমেরিকা থেকে তৈরী হয়ে আসা চিপগুলি এখানে বিভিন্ন যন্ত্রাংশে বসানোর কাজ হবে। এতে ভারতে কিছু দক্ষ শ্রমিকের কর্মসংস্থান হবে, কিন্তু এই প্রযুক্তিতে ভারত স্বনির্ভর হওয়ার ক্ষেত্রে এগোবে কিনা তা বলা মুশকিল।

এই একই সূত্র ধরে অন্যান্য চুক্তিগুলি সম্পন্ন হয়েছে। আজকে গোটা বিশ্বের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হল যুদ্ধ ও তাকে ঘিরে সমরাস্ত্রের ব্যবসা। আজকে বিশ্বযুদ্ধ না হলেও সিরিয়া, প্যালেস্টাইন, রাশিয়া-ইউক্রেন জুড়ে যুদ্ধ চলেছে। তার সাথেই চলছে সমরাস্ত্রের বাণিজ্য। ভারত এই যুদ্ধের সরাসরি অংশীদার না হলেও চিনের সাথে সীমান্ত সংঘাত ও ভারত মহাসাগর অঞ্চলে আধিপত্য বজায় রাখতে বিপুল সামরিক আয়োজন করতে বাধ্য হয়। ভারত বিশ্বে সবচেয়ে বেশি যুদ্ধাস্ত্র কিনে থাকে। এর বেশিটাই যোগায় রাশিয়া। ২০১৬-তে ভারতের আমদানিকৃত যুদ্ধাস্ত্রের ৬৫% এসেছিল রাশিয়া থেকে। কিন্ত ২০২২ সালে তা নেমে এসেছে ৪৫%-এ। আর ঠিক এই কারণেই আজকে আমেরিকা আগ্রহী এই বাণিজ্যের দখল নিতে। ঠিক সেই কারণেই তারা ভারতকে নজরদারি ড্রোন বিমান দিচ্ছে। যদিও অভিযোগ ভারত এই বিমান অন্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি দামে কিনছে। ইংল্যান্ড এই ড্রোন কিনেছিল একেকটি ১২ মিলিয়ন ডলারে, সেখানে ভারত কিনছে একেকটি ১১০ মিলিয়ন ডলারে। আবারও একটি দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। ভারতে জেট ইঞ্জিন তৈরীর চুক্তিও এই একই যুক্তিতে। ভারতের সমরাস্ত্রের বাজারের ফায়দা তুলতেই এই চুক্তি। এমনকি মহাকাশ বিজ্ঞানের প্রযুক্তির আদানপ্রদানও মূলত এই একই লক্ষ্যে উন্নত উপগ্রহ তৈরী ও কক্ষে প্রতিস্থাপনের উদ্দেশ্যে।

অন্যদিকে ভারতের অর্থনীতির উন্নতির কোন দিশা এই সফর থেকে উঠে আসেনি। বাণিজ্যিক লেনদেন, পারস্পরিক বাজার উম্মুক্তকরণ, আমদানি রপ্তানি শুল্ক বা নীতি নিয়ে কোন আলোচনা এই সফরে হয়নি। অস্ট্রেলিয়া, দুবাই, কানাডা, ইউরোভুক্ত দেশগুলি ও ইউনাইটেড কিংডমের সাথে ভারতের এরকম বাণিজ্যচুক্তি থাকলেও এই সফরেও এরকম কোন চুক্তি ভারত ও আমেরিকার মধ্যে হয়নি।

ভারতকে আরও বেশী করে সমর বাণিজ্যের বাজারে পরিণত করা এবং চিনের বিকল্প এক উৎপাদক ঘাঁটি হিসাবে গড়ে তোলার লক্ষ্যেই আমেরিকার এই সফরের আমন্ত্রণ। অন্যদিকে নরেন্দ্র মোদী, যতই নিজেকে একজন সফল প্রধানমন্ত্রী দাবি করুন না কেন, দেশের দীর্ঘমেয়াদি আর্থিক ও প্রযুক্তিগত স্বনির্ভরতার জন্য তিনি কিছুই এই সফর থেকে আদায় করে আনতে পারেননি। ভারতের বাজার এখনও বড় রয়েছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রচুর ভারতীয় থাকেন এবং এখনও যাচ্ছেন। এই পরিস্থিতিতে একদিকে আমেরিকা ভারতের বাজারের দিকে হাত বাড়াচ্ছে। অন্যদিকে, চিনের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বিশ্বরাজনীতিতে তারা ভারতকে নিজেদের মিত্র হিসেবে চাইছে। উভয় ক্ষেত্রেই মোদী সরকারের কোনো সমস্যা নেই। চিন লাদাখের বিস্তীর্ণ প্রান্তর অধিগ্রহণ করে থাকলেও প্রধানমন্ত্রী রা কাড়েন না। কিন্তু চিনের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে মার্কিন রাষ্ট্রপতির বাড়তি সৌহার্দ্য উপভোগ করতেও তিনি ছাড়েন না। এই সফরকে কেন্দ্র করে বিজেপি আগামী লোকসভা নির্বাচনের লক্ষ্যে মানুষকে নানা মিথ্যা প্রচার করবে। প্রশ্ন হল, বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো এই প্রচারের ঢক্কানিনাদকে মোকাবিলা করে দেশের মানুষকে সত্যদর্শন করাতে পারবে কি?