আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ ত্রয়োদশ সংখ্যা ● ১-১৫ জুলাই, ২০২৩ ● ১৬-৩১ আষাঢ়, ১৪৩০

সম্পাদকীয়

পঞ্চায়েত ও হিংসা


কলকাতা হাইকোর্টের মাননীয় বিচারপতি ক্ষোভ প্রকাশ করে পর্যবেক্ষণে বলেছেন, “একটি নির্বাচন ঘিরে এত অভিযোগ! এটা রাজ্যের পক্ষে লজ্জার। রাজ্যের উচিত আইন শৃঙ্খলা রক্ষা করা। এত অশান্তি, হিংসা, জীবনহানি হলে নির্বাচন বন্ধ করে দেওয়া উচিত” (আনন্দবাজার পত্রিকা, ২২ জুন, ২০২৩)। হাইকোর্টের মাননীয় বিচারপতির মন্তব্যের দীর্ঘ ব্যাখ্যা দেওয়া নিষ্প্রয়োজন। বিগত কয়েক সপ্তাহ ধরে পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত নির্বাচনের মনোনয়ন পর্ব ঘিরে যে অশান্তি, হিংসা এবং মৃত্যুর ঘটনার সাক্ষী থাকল রাজ্যবাসী তা দেখে যে-কোনো সুস্থ মানুষ বিস্মিত এবং ক্রোধিত হতে বাধ্য। শাসকদলের নেতা-নেত্রী হলে অবশ্য লজ্জা-ঘৃণা-ভয় থাকতে নেই।

এই ঘটনা পরম্পরার দীর্ঘ বিবরণী দেওয়া নিষ্প্রয়োজন, কারণ তা বিবমিষার উদ্রেক করতে বাধ্য। বরং যে প্রশ্ন তোলা একান্ত জরুরি এবং যে প্রশ্ন মিডিয়ায় সচরাচর আলোচিত হয় না, তা হল এই যে পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এবং বিশেষ করে পঞ্চায়েত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বছরের পর বছর ধরে এই যে হিংসা এবং মৃত্যু হয় তার কারণ কী?

পঞ্চায়েতের মাধ্যমে রাজ্যের প্রান্তিক গরীব মানুষদের হাতে অধিক ক্ষমতা প্রদান করা ছিল জ্যোতি বসু সরকারের প্রধান উদ্দেশ্য। এই উদ্দেশ্য যে অনেকাংশেই সফল হয়েছিল, তা পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীণ মানুষ জানেন। কিন্তু পঞ্চায়েতের এই সাফল্যের সঙ্গে রাজ্যে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য আসেনি। প্রধানত রাজ্যে শিল্পায়নে ক্রমান্বয়ে পিছিয়ে পড়ার ফলে গ্রামীণ মানুষের রোজগার উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়েনি, গ্রাম থেকে বেরিয়ে শহরে কর্মসংস্থান পাওয়ার প্রবণতা অন্যান্য রাজ্যের মতন বাড়েনি। কিন্তু পঞ্চায়েতে টাকার পরিমাণ বাড়তে থেকেছে। ফলত, পঞ্চায়েতকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে বিভিন্ন অশুভ চক্র। এই কথা অস্বীকার করলে অপলাপ হবে যে বামফ্রন্ট সরকারের শেষ দশ বছরে এই প্রক্রিয়া প্রত্যক্ষ করা গেছে।

কিন্তু তৃণমূল আমলে এই অশুভ শক্তিদের মাফিয়াতন্ত্রই হয়ে উঠেছে গ্রামীণ বাংলার প্রধান ক্ষমতার উৎস। পঞ্চায়েতে টাকা আসবে। সেই টাকা আত্মসাৎ করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছে তৃণমূলের বড়-মেজো-ছোটো নেতা। আপনার আবাস যোজনার টাকা, আপনার ১০০ দিনের কাজের টাকা এবং অন্যান্য প্রকল্পের টাকা সরাসরি আপনার ব্যাংক একাউন্টে আসে। কিন্তু ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলতে গেলে আপনি দেখবেন ‘উন্নয়ন রাস্তায় দাঁড়িয়ে রয়েছে’! আপনার কষ্টার্জিত টাকার একটি বড় অংশ তৃণমূলের গুণ্ডারা পকেটস্থ করবেই। অন্যদিকে, গ্রামীণ পরিকাঠামো নির্মাণ, অন্যান্য প্রকল্পের টাকা ঘরে তোলার জন্য তৃণমূলের উচ্ছিষ্টভোগী কন্ট্রাক্টর, সিন্ডিকেট-রাজ এবং স্থানীয় গুণ্ডাবাহিনী সদা প্রস্তুত।

অতএব, কোনো অবস্থাতেই এই আয়ের উৎস থেকে দূরে থাকা যাবে না। কিন্তু দেশে আবার গণতন্ত্র বলে একটি বিষয় আছে। তার আওতায় প্রত্যেক পাঁচ বছর অন্তর নির্বাচন করতে হয়। এই নির্বাচনের মাধ্যমে বিরোধী শক্তিরাও পঞ্চায়েতের ক্ষমতা দখল করতে পারে। কিন্তু তাহলে তৃণমূলের মাফিয়াতন্ত্রের প্রধান যে শক্তির উৎস - টাকা - তা হাতছাড়া হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অতএব, কোনো অবস্থাতেই বিরোধীদের পঞ্চায়েতে জিততে দেওয়া যাবে না। জিততে না দেওয়ার সবচেয়ে সহজ পন্থা হল বিরোধীদের মনোনয়ন জমা করতে না দেওয়া। রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় তৃণমূল সেই চেষ্টাই করেছে। ২০১৮ সালে তার কদর্যতম নিদর্শনটি আমরা দেখেছিলাম। এই বছর হাইকোর্টের গুঁতো খেয়ে এবং বিরোধীদের আগাম প্রস্তুতির জন্য পঞ্চায়েতকে বিরোধী শূন্য করতে তৃণমূল এখনও অবধি ব্যর্থ। ভোটের দিনে তারা কোন রূপ ধারণ করে তা অবশ্য দেখা বাকি রয়েছে। একথা জোরের সঙ্গে বলাই যায় যে পঞ্চায়েতের ক্ষমতা যাতে তাদের হাতের থেকে চলে না যায় তার জন্য তারা হিংসার আশ্রয় আবার নিতেই পারে।

এই প্রসঙ্গে দুটি বিষয় নিয়ে আলোচনার বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে। প্রথমত, এই হিংসার ক্ষেত্রে শুধুমাত্র তৃণমূল বনাম বিরোধী পক্ষ ভাবলে ভুল হবে। এই সর্বব্যাপী হিংসার নেপথ্যে আরেক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান তৃণমূলের অন্তর্কলহ। ক ব্যক্তি যদি এখানে তৃণমূলের প্রার্থী হয়ে জিতে যায় এবং খ ব্যক্তি যদি সেখানে জিততে না পারে, তাহলে খ-এর তুলনায় ক’র গুরুত্ব বাড়বে দলে। শুধু তাই নয়, পঞ্চায়েতের টাকাও ঢুকবে ক-এর পকেটে। খ যদি নিশ্চিত করতে পারে যে বিরোধীদের মেরেধরে সে জিতবে, তাহলে তারও আয় এবং রাজনৈতিক গুরুত্ব দুই-ই বাড়বে। অতএব হেরে যাওয়ার ঝুঁকি কেউ-ই নিতে চাইবে না। তাই ক এবং খ উভয়েই হিংসার আশ্রয় নেবে। যুক্তি তাই বলে।

এই যুক্তিটি যাতে না খাটে, তার জন্য রয়েছে পুলিশ-প্রশাসন-নির্বাচন কমিশন। কিন্তু বিগত ১২ বছরে তারা তৃণমূলের দলদাসে পরিণত হয়েছে। তাই তারা নির্বিকার। ক বা খ যেই জিতুক, তৃণমূলের কর্তৃত্ব বজায় থাকবে এবং টাকার হিস্যা সর্বোচ্চ নেতৃত্বের কাছেও পৌঁছে যাবে। অতএব দলীয় নেতৃত্ব এইসব বিষয়ে হস্তক্ষেপ যে করবে না তা বলাই বাহুল্য। সব মিলিয়ে তাই শাসকদলের বাহিনী নির্বিচারে সন্ত্রাস চালাতে পারে।

দ্বিতীয় বিষয় হল এই যে, মানুষ এই পরিস্থিতিতে কী করছে বা করতে পারে। আমরা আগেই বলেছি যে রাজ্যে কর্মসংস্থানের অভাব রয়েছে। সেখানে সরকারী দাক্ষিণ্য অনেক মানুষের বেঁচে থাকার একমাত্র রসদ। এই রসদ সংগ্রহ করতে হলে আবার তৃণমূলের খাসনজরে থাকা চাই। অতএব যতক্ষণ না মানুষ কোনো প্রকৃত শক্তিশালী বিকল্পের প্রতি আস্থা রাখতে পারছে, ততক্ষণ অবধি তারা কিছুটা বাধ্য হয়েই তৃণমূলের প্রকাশ্য বিরোধীতা করার সাহস দেখাতে পারছেন না। আবার তৃণমূল তাদের বাহিনীর জন্য টাকা ছড়াচ্ছে। তাই ভাঙড়ে পাঁচ হাজার টাকার বিনিময়ে পিস্তল চালাতে রাজি হয়ে যাচ্ছেন যুবক। হয়ত চাকরি পেলে বা কোনো একটি কাজ পেলে তিনি গুলি চালাতেন না। কিন্তু রাজ্যে চাকরি বাড়ন্ত। সংসার চালাতে হলে যদি গুলি চালাতেই হয়, তাহলেও রাজি হয়ে যাচ্ছেন অনেকে। এই ভয়াবহ আগ্নেয়গিরির শিখরে বসে পিকনিক করছেন তৃণমূলের নেতারা এবং মাননীয়া।

তাহলে উপায় কী? উপায় একটাই তৃণমূলের এই বর্বরোচিত তন্ত্রের বিরুদ্ধে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে তীব্র লড়াই সংগঠিত করা। কিন্তু তাই বলে বিজেপি-র মতন ভয়ানক শক্তির পালে যাতে হাওয়া না লাগে তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাজ্যের বাম-প্রগতিশীল রাজনীতির। এইবারের পঞ্চায়েত নির্বাচনে এখনও পর্যন্ত বামেরা বহু আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। ভাঙড়ে আইএসএফ-এর মতন শক্তি লড়াই চালাচ্ছে, দেউচা পাঁচামিতে খনি বিরোধী আদিবাসী সমাজ তৃণমূলের চোখরাঙানিকে উপেক্ষা করে লড়াই চালাচ্ছে। এই লড়াইগুলি একদিন একত্রিত হয়ে তৃণমূলের মাফিয়াতন্ত্রের বিরুদ্ধে এক প্রবল আন্দোলন তৈরি করবে, যার ধাক্কায় ধুলোয় লুটিয়ে পড়বে তৃণমূল ও বিজেপি-র ঘৃণ্য রাজনীতি। এই পঞ্চায়েত নির্বাচন থেকেই শুরু হোক সেই মহান আন্দোলনের মহড়া।