আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ দ্বাদশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ জুন, ২০২৩ ● ১-১৫ আষাঢ়, ১৪৩০
প্রবন্ধ
পরিবেশ পাঠ ও 'শেষ রূপকথা'
রত্না রায়
ফেব্রুয়ারী ৬, ২০২৩ - ভয়াবহ ভূমিকম্পে তুরস্ক ও সিরিয়ায় হারিয়ে গেল প্রায় পঞ্চাশ হাজার মানুষ। জুন ১৫, ২০২২ - সমুদ্রে বাড়তে থাকা তাপমাত্রার জেরে নিউজিল্যান্ডের সমুদ্রসৈকতে শয়ে শয়ে ভেসে আসছে লিটল ব্লু পেঙ্গুইনের মৃতদেহ। অগাস্ট ২২, ২০২২ - আমাজনে রেইন ফরেস্টে প্রায় ২,২৪০,০০০ একর সবুজ আগুনে পুড়ে পৃথিবীর অক্সিজেন ভাণ্ডারকে নিঃস্ব করে দিল। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় প্রকৃতির কী ভয়ানক লীলাখেলা। কিন্তু না, আসলে এসবের মাঝে রয়েছে কিছু 'কালোপুরুষের' সুগভীর পরামর্শ। তেলের খোঁজে যথেচ্ছ খনন, বর্জ্য জলের বেগবান পাথরফাটানো ফল্গুধারা, নির্বিচার নগরায়ন ও শিল্পায়ন পৃথিবীকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে ধ্বংসগহ্বরের শেষ কিনারে। 'পাতলা বরফের উপরে দাঁড়িয়ে রয়েছে মানবসভ্যতা' - সাম্প্রতিক পরিস্থিতিকে টাইম বম্ব-এর সাথে তুলনা করেছেন রাষ্ট্রপুঞ্জের বর্তমান মহাসচিব। বিশ্ব উষ্ণায়নকে একটি অনতিক্রম্য সীমায় বেঁধে ফেলতে হবে, কয়লা বা পেট্রোলের মতো ফসিল জ্বালানির হার কমাতে না পারলে পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাবে - এসবই ২০১৫ সালে নেওয়া সিদ্ধান্ত। কিন্তু কার্বনজনিত দূষণের মাত্রা এতটুকুও কমেনি। ফলতঃ ২০২৩ সালে এসে বিশ্বজুড়ে গ্লেসিয়ারের গলন এক বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে এনে দাঁড় করিয়েছে বিশ্ব পরিবেশ ও প্রকৃতিকে। মানবাত্মার এই বিপন্ন আকুতি, পরিবেশের সর্বাত্মক দূষণ আমায় অলখ টানে নিয়ে যায় একটি উপন্যাসের দিকে - যার নাম 'শেষ রূপকথা'।
'ইরিথিজম্' - এই শব্দটি দিয়ে 'শেষ রূপকথা' উপন্যাসের প্রস্তাবনা অথবা নান্দীপাঠ করেছেন গ্রন্থকার আবুল বাশার। এটি একটি মারাত্মক অসুখের নাম, যে রোগে মানুষের স্নায়ুতন্ত্রী ধীরে ধীরে আলগা হয়ে যেতে থাকে এবং তার আচরণে চূড়ান্ত অসামঞ্জস্য প্রকাশ পায়। হ্যালুসিনেশন ও সাইকোসিস-এর শিকার হয়ে পড়ে সেই ব্যক্তি। আক্রান্ত হয় তার মস্তিষ্ক ও ফুসফুস। কিছু প্রত্যঙ্গ বিশেষতঃ যৌনাঙ্গ ও লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অসুখটিকে চিনে উঠতে উঠতেই শেষ হয়ে যায় মানুষটি। এটি মার্কারি পয়জনঘটিত একটি নিঃশব্দ ঘাতক - যন্ত্রসভ্যতার উপহার। উপন্যাসের নায়ক কৃষ্ণ যার পোশাকি নাম শুভেন্দু, সে এ রোগে আক্রান্ত। এই চেতাবনী নিয়েই উপন্যাসে প্রবেশ করব আমরা।
উপন্যাসে যাওয়ার আগে একবার চোখ বুলিয়ে নেব জলবায়ু পর্যালোচনা সংস্থা (IPCC)-এর শেষ রিপোর্টে (২০২৩, ২১শে মার্চ প্রকাশিত)। এখানে কয়েকটি বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে - বিশ্ব উষ্ণায়ন, ভূত্বকে জমা প্লাস্টিকের পাহাড়, বিশ্বজুড়ে হিমবাহের গলন, কয়লা বা পেট্রোলের মতো ফসিল জ্বালানির অতিরিক্ত ব্যবহার। এসব মানুষেরই অবিবেচনার ফসল। উষ্ণায়নের মাত্রা অবিলম্বে কমাতে না পারলে লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যুর আশংকা, দেখা দিতে পারে বিশ্বব্যাপী দুর্ভিক্ষ। বরফ গলে যাওয়ার ফলে সমুদ্রের জলস্তর বেড়ে গেলে কলার মান্দাসে ভাসবে মানবসভ্যতা। ফলে আবার চলে আসবে হিমযুগ। বিশ্বস্বাস্থ্য দপ্তর (WHO)-এর অতিসাম্প্রতিক সমীক্ষায় জানা যায় তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে জলদূষণ ও বায়ুদূষণ-এর কারণে বছরে প্রায় পাঁচ লক্ষেরও বেশি শিশু মারা যায়। পৃথিবীতে ফুসফুসের সমস্যায় ভোগা শতকরা তিরিশ জন মানুষ ভারতবর্ষেই বাস করেন। বায়ুদূষণ তথা রসায়নদূষণ নিয়ে পৃথিবীতে বহু গবেষণাধর্মী তথ্যনিষ্ঠ গ্রন্থ রচিত হয়েছে। এ বিষয়ে উন্নতমানের কল্পবিজ্ঞানের কাহিনীও আমরা পেয়েছি। মারলা কোন রচিত 'Silent Snow' বা ক্যাপ্টেন চার্লস মূর-এর 'Plastic Ocean' দুটি মূল্যবান সায়েন্স ফিকশন। কিন্তু দূষণ নিয়ে লেখা উপন্যাসের সংখ্যা তত বেশী নয়। নাইজিরিয়ান লেখক হেলন হাবিলা-র 'Oil on Water' (প্রকাশকাল ২০১০) বা ব্রাজিলীয় লেখিকা ন্যান্সী বার্ক-এর 'Undergrowth' (প্রকাশকাল ২০১৭) উপন্যাসদুটির কথা বলা যেতে পারে। কিন্তু বাংলা তথা ভারতীয় সাহিত্যে 'শেষ রূপকথা' (প্রকাশকাল ১৯৯৯) ব্যাতিরেকে রসায়নঘটিত দূষণ নিয়ে কোন উপন্যাস পড়ার অভিজ্ঞতা আমাদের হয়েছে কিনা জানা নেই। প্রকাশকালের নিরিখে বিশ্বসাহিত্যের আঙিনায় 'শেষ রূপকথা' দূষণ নিয়ে একটি পথিকৃৎ উপন্যাস এমনটাও বোধহয় দাবী করা অসঙ্গত নয়। 'ফুলবউ'-এর লেখক আবুল বাশার তাঁর প্রতিটি লেখায় পরীক্ষা নিরীক্ষায় বিশ্বাসী। 'শেষ রূপকথা'ও তাঁর একটি ব্যতিক্রমী প্রয়াস।
উপন্যাসটি আবর্তিত হয় একটি ছোট কারখানাকে কেন্দ্র করে। এস. এস. আই. স্কিমে তৈরী তিন শরিকের কারখানা - কেমিলিংক ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল। কৃষ্ণের বাড়ীর গায়ে লাগা দেড় কাঠা জমিতে, অ্যাসবেস্টসের ছাউনী দেওয়া প্রায় অন্ধকার একটি ঘর। সেখানে না আছে অটোমেটিক সেন্ট্রিফিউজ, আই-প্রোটেকটিং গ্লাস বা গ্যাসমাস্ক - সেফটি কিট বলতে প্রায় কিছুই এদের নেই। অথচ এই আলো আঁধারিতে প্রস্তুত হয় ধাতুযৌগ মার্কিউরাস ক্লোরাইড, চালান যায় বিভিন্ন কোম্পানিতে। কৃষ্ণ হ্যালুসিনেট করে ধোঁয়া ধোঁয়া ধাতুবিষ সাপের চেরা জিভের মতো সবকিছু চেটে দিয়ে যাচ্ছে। মহাভারতে শ্রীকৃষ্ণ ত্রিকালদর্শী, তিনি ভালোমন্দ সবকিছুর নিয়ন্তা। কার্য ও কারণের সম্পর্ক ও ফলাফল সমস্ত কিছুই তিনি আগে থেকে দেখতে পান। 'শেষ রূপকথা' উপন্যাসে কৃষ্ণ ওরফে শুভেন্দু নিজেই দূষণের স্রষ্টা, দূষণঘটিত বিষ-শৃঙ্খলকে সে অনুভব করতে পারে, অসুস্থ হয় ও অদ্ভূত অপরাধবোধে ভোগে।
কারখানার জমি শংকরের। ওর বাবা হলেন মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান। মূলধনের বেশিরভাগটাই আরেক বন্ধু সুদেবসুন্দরের। কৃষ্ণের অনুদান খুবই সামান্য। তাই সে বারো আনা শ্রমিক ও চার আনা মালিক। অথচ তারই বিদ্যাবুদ্ধি ও পরিশ্রমে কারখানাটি চলে। এম. এস. সি. পড়ার সময় নকশাল আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে কৃষ্ণ। পুলিশের হাতে ধরা পড়ে, জেলও খাটে। ভদ্র আচরণের জন্য নির্দিষ্ট সময়ের আগেই জেল থেকে ছাড়া পায়। কিন্তু জীবিকার জন্য মাথা খুঁড়ে মরে। অবশেষে তার কলেজের অধ্যাপক অমরেন্দ্র বসুর পরামর্শে এই কারখানাটি জন্ম নেয়। অধ্যাপক বসুর নির্দেশানুযায়ী কারখানাটিকে নিষ্পাপ রাখতে উদ্যোগী হয় কৃষ্ণ। প্রথম দু'বছর কারখানা ছিল সম্পূর্ণ নির্বিষ। স্কুল কলেজের ল্যাবে যোগান দেওয়ার জন্য তৈরী হত ডিস্টিল্ড ওয়াটার, পটাশিয়াম ক্লোরাইড, সিলভার নাইট্রেট ইত্যাদি। শুভেন্দু চায়নি তার কারখানা সমাজের কোন ক্ষতি করুক।
কিন্তু অন্য দুই শরিক শুনবে কেন? যাদের মূলধন বেশি, তাদের জোরও বেশি, আর বেশি লোভ। নিষ্পাপ কারখানা কলুষে ভরে উঠল। অতঃপর লাগাতার মার্কারি পয়জনিং-এ আক্রান্ত হতে থাকে কৃষ্ণ ও তার সহকারী প্রকাশ। কারখানা সংলগ্ন পুকুরের জলে মিশে যেতে থাকে কারখানার বর্জ্য পদার্থ। আক্রান্ত হয় পুকুরের জল, পুকুরপাড়ে গজানো লতাগুল্ম। সেই জল, সেই ঘাসপাতা খেয়ে হেমোল্যাকটিয়া রোগে আক্রান্ত হয় খাটালের গরুগুলি। গোরুর বাঁটে দুধের বদলে রক্ত উঠে আসে। মহাভারতে শ্রীকৃষ্ণ যদুকুলপতি। যাদবরা গোরুর রক্ষক। কিন্তু এই উপন্যাসে কৃষ্ণের কারখানার দূষণে উজাড় হয়ে যায় একটি খাটাল। গোরুর দুধ খেয়ে উল্টোদিকের বাড়ীর ছোট্ট মৌ ধীরে ধীরে তার দৃষ্টিশক্তি হারাতে থাকে। জটিল অসুখ তার প্রাণকে কুরে কুরে খায়। কৃষ্ণের সহকারী প্রকাশ রাজরোগে আক্রান্ত হয়, সেইসঙ্গে তার মস্তিষ্কবিকৃতির লক্ষ্মণ দেখা দেয়। কৃষ্ণের মাথার চুল সাদা হয়ে যেতে থাকে, মূত্রদ্বারে জ্বালা, আচরণে অস্বাভাবিকতা ফুটে উঠতে থাকে। শ্রমিক কৃষ্ণ দূষণের কারিগর আর শিক্ষক শুভেন্দু মরে পাপবোধে। উপন্যাসের এ এক অদ্ভূত বুনোট।
মিউনিসিপ্যালিটির লোক পরেশ সামন্ত ঘুষের বিনিময়ে কারখানাকে পাসমার্ক দিতে প্রতিশ্রুত হয়। ঘুষ চাইতে এসে বিবেকের মতো ভোপাল গ্যাস ট্র্যাজেডির কথাও স্মরণ করিয়ে দেয়। বন্ধুরা কৃষ্ণের হাত দিয়েই সেই ঘুষের টাকা পাঠায়। সুদেব, শংকরেরা পাপবোধ মুক্ত। তারা দুজনে কারখানার দুনম্বরী খাতা বানিয়ে রাখে কৃষ্ণের অগোচরে, যেখানে কেবল নিরীহ উৎপাদনের হিসেব নিকেশই লেখা থাকবে। সামন্তের কোন পাপবোধ নেই। সামন্তের ঘরে আসা পরনারী মঞ্জুরও কোনো পাপবোধ নেই। গোটা সমাজকে নাগপাশে বেঁধে রাখে এক আশ্চর্য নির্বিবেক শৃঙ্খল। কৃষ্ণের অন্তরাত্মা পুড়ে খাক হয়ে যায়, সে মনে করে এই দূষণের জন্য একমাত্র সে-ই দায়ী। যখন তখন নানাকিছু হ্যালুসিনেট করে, অদ্ভূত অদ্ভূত স্বপ্নও দেখে কৃষ্ণ। কিন্তু এই কারখানা যে তার অন্নদাতা!
উপন্যাসটিকে লেখক বিন্যস্ত করেছেন বারোটি পর্বে। প্রথম পর্বের নাম 'প্রকাশ কেন লুকিয়ে থাকে।' বিহারি যুবক প্রকাশ প্রথমে খাটালে কাজ করতো। পরে কৃষ্ণের সহকারী হয়ে কারখানায় যোগ দেয়। প্রকাশ দেখেছে কিভাবে খাটালে গোরুদের বাঁটে দুধের বদলে রক্ত আসে, দুধে মাছি পড়ে, সেই দুধ মৌ খায়। প্রকাশের দৃঢ় বিশ্বাস কারখানার সোকপিট উপচে পড়া বিষাক্ত তরল পুকুরের জলকে দূষিত করেছে। তার নিজেরও যক্ষ্মা হয়েছে। অন্য দুই শরিক প্রকাশকে নিয়ে অস্বস্তিতে থাকে। অতএব প্রকাশকে লুকিয়ে রাখতে হবে। কারখানার সামগ্রিক দূষণ সে যে তার শরীরে ও মনে ধারণ করে বসে আছে। প্রায়ান্ধ মৌ-এর মা সবিতাও সন্দেহ করে কারখানাকে। মৌ-এর চোখের ডাক্তারকে প্রেসক্রিপসনে কারখানার কথা উল্লেখ করতে অনুরোধ করে সবিতা। কিন্তু শংকরের বাবা ডাক্তারবাবুর পেশেন্ট, তাই এ কাজ সম্ভব হয়না তাঁর দ্বারা। কৃষ্ণের মা মহিমাও দুঃখ করেন - একদিকে সংসারের বিপুল চাহিদা অন্যদিকে মারাত্মক কেমিক্যালস্ কিভাবে খেয়ে ফেলছে তাঁর ছেলেকে। সংসার কৃষ্ণকে জ্ঞানপাপী করে রেখে দেয়, কিন্তু তার শুভেন্দুসত্তা তাকে শান্তি পেতে দেয়না।
'খোঁচা' পর্বে সংলাপের বিনিময় চলে একই মানুষের দুই সত্তার মধ্যে। শুভেন্দু ও কৃষ্ণ - সু আর কু, তারা দুইজনে কথা বলে চলে, দোষারোপ করে পরষ্পরকে, দোষক্ষালনের চেষ্টাও করে। জেল থেকে বেরোনোর পর প্রিয় ছাত্রকে অধ্যাপক বসু তাঁর ভাগ্নী উর্বীকে পড়ানোর দায়িত্ব দেন। স্যারের পড়ানোর স্টাইল, জেলজীবনের গল্প একটু একটু করে উর্বীর কিশোরী মনকে আকৃষ্ট করে। শুভেন্দু ব্যঙ্গ করে কৃষ্ণকে বলে উর্বীর চোখে নিজেকে মহাপুরুষ সাজিয়েছ তুমি! কৃষ্ণের জবাব, ছাত্রীটি গরীব জেনেই সে এগিয়েছে। এক্ষেত্রে সিকোয়েন্স প্রেমকে সাহায্য করেছে। শুভেন্দুর মতে একটা মস্ত মরুভূমির তলায় ছোট্ট নদী হল উর্বী। কারখানার দূষণে পাপী কৃষ্ণ তাকে গ্রাস করে নিতে উদ্যত। কৃষ্ণ সংসারের প্রয়োজনের দোহাই দেয়। এভাবেই দ্বন্দ্বে মাতে একই মানুষের দুটি সত্তা। বড়ো বড়ো দুর্নীতির নেতারাও যদি কখনো সখনো এমনভাবে পাপবোধে আক্রান্ত হতেন...!
মহাভারতে ভূমিসূতা জানকীর সম্মানরক্ষা করেন তাঁর সখা শ্রীকৃষ্ণ। এই উপন্যাসে কিন্তু উর্বীই আশ্রয় দেয় তার স্যার কৃষ্ণকে। মিথ ভেঙে জন্ম নেয় নতুন গল্প। মিথ নিয়ে এমন ভাঙাগড়া বাশার তাঁর গল্প উপন্যাসে অনেক করেছেন। উর্বী তো পৃথিবীর আরেক নাম। জননী বসুন্ধরা যেমন করে সীতাকে আশ্রয় দেন, তেমনভাবেই তার স্যারকে ঢেকে রাখে উর্বী, স্যারের পাপ সে গোপন রাখতে চায়। দূষণের গ্লানিতে ক্ষতবিক্ষত কৃষ্ণ যে অন্তরের গভীরে এক পবিত্র মানুষ তা সে অনুভব করে। তাই পাখির মতো বাহু মেলে আশ্রয় দিতে চায় তার শিক্ষককে। উপন্যাসের 'রূপকথা' নামাঙ্কিত পর্বে বিজ্ঞানের ছাত্রী উর্বী তার স্যারকে শোনায় বিশুদ্ধ জলের গল্প। একটি জার্নালে সে পড়েছে, একদল বিজ্ঞানীর গবেষণার কাজে বিশুদ্ধ বৃষ্টির জলের প্রয়োজন হয়। আজকের পৃথিবীর বৃষ্টির জলের ওপর তাঁরা নির্ভর করতে পারেন না। গ্রীনল্যান্ডে বরফের অনেক নীচে পঞ্চাশ বছরের পুরনো জমাটবাঁধা বৃষ্টির জল তাঁরা পেয়ে যান। এটাই হল এই পৃথিবীর শেষ রূপকথা। উর্বীর কথা বিশ্বাস করতে চায় কৃষ্ণ, তাকে জড়িয়ে বাঁচতে চায়। দূষিত পৃথিবীতে জন্ম নেয় এক আশ্চর্য ভালোবাসার গল্প।
মৌ-এর মৃত্যুর পর স্থানীয় নাগরিক সমিতি ডঃ অমরেন্দ্র বসুর কাছে কারখানা সংলগ্ন পুকুরের জল পরীক্ষা করবার আবেদন জানায়। উর্বীকে চিঠি পাঠিয়ে নির্দেশ দেন তার মামা সঠিকভাবে দুটি বোতলে ঐ পুকুরের জল সংগ্রহ করতে। কৃষ্ণ নিজে পুকুর থেকে স্যাম্পলিং-এর জল তুলে দেয়। খবর পেয়ে অন্য দুই শরিক তার ওপর চড়াও হয়, পুকুরের জলে তাকে নাকানি চোবানি খাওয়ায়। উর্বীও চরম নিগৃহীত হয়। শুভেন্দু তার গুরু ডঃ বসু-কে একটি স্বীকারোক্তিমূলক চিঠি লিখে জানায় - সকল বিপর্যয়ের মূলে এই কারখানা। সে নিজেও নানান অসুখে আক্রান্ত। তাই উর্বীকে ভালবাসলেও তাকে বিয়ে করতে সে অপারগ। ক্ষমা চায় তার সামগ্রিক অপরাধের জন্য। এ চিঠি ঊর্বী ছিঁড়ে ফেলে কৃষ্ণের অলক্ষ্যে।
অস্ত্রাগারের স্বপ্ন দেখে কৃষ্ণ, পুলিশের হাতে ধরা পড়ার আগে যেখানে সে ফেলে এসেছে তার অস্ত্র, একটি বন্দুক। পুলিশের কাছ থেকেই ছিনিয়ে নেওয়া। সেই বন্দুক কি পারবে পৃথিবীকে পাপমুক্ত করতে? এক ঝড়জলের রাতে প্রকাশকে কে বা কারা বিষ খাইয়ে হত্যা করে যায়। মৃত প্রকাশের পায়ে ছিল নতুন গামবুট, মুখে গ্যাস মাস্ক, চোখে আই প্রটেকটিং গ্লাস - জীয়ন্তে যা সে পায়নি! মৃত্যুর আগে কি অপরূপ সাজে তাকে সাজিয়ে গেছে খুনীরা! এটা যে তার বন্ধুদের কাজ বুঝতে পারে কৃষ্ণ। পাগলের মতো বেরিয়ে পড়ে তার নিজস্ব বিভ্রান্ত জগতে পৃথিবীর শেষ বিশুদ্ধ অস্ত্রটিকে উদ্ধার করে আনতে। জানেনা কিভাবে কতজনের বিরুদ্ধে তার লড়াই। বড়ো দেরী হয়ে গেছে, দূষণ যে ছড়িয়ে গেছে পৃথিবীর শিরা উপশিরায়! সামান্য লাভের জন্য নিজের ধ্বংস নিজেই ডেকে আনছে মানুষ। গ্রীনহাউস গ্যাস এফেক্ট, দীর্ঘ দাবানল, ঘন ঘন বজ্রপাত, আবহাওয়া পরিবর্তন - এ সবই তো মানুষের নিজেরই তৈরী করা। অস্ত্র দিয়ে কি এর মোকাবিলা করা সম্ভব? তবু নিজের লুকোনো অস্ত্রের খোঁজে পাড়ি দিল কৃষ্ণ। অস্ত্র উদ্ধার করতে এসে কঠোর বাস্তবের মুখোমুখি হল সে - অস্ত্রাগার কোথায়, এ যে মাস্কেট তৈরীর কারখানা! তার শুভেন্দু সত্তা দুয়ো দিয়ে বলে - পঞ্চায়েত ভোটে এইসব মাস্কেট নিয়ে ঘোরে লুম্পেনবাহিনী। হাহাকার করে ওঠে তার মন। শত সহস্র মানুষের আত্মত্যাগের এই পরিণতি! তবু নিজের অস্ত্রটিকে তুলে নেয় সে। কিন্তু একা কি করবে পাগল! কৃষ্ণের নিয়তি তাকে মহাশূন্যে নিক্ষেপ করে। ধ্বংসোন্মুখ মানবজাতির এক অসহায় প্রতিনিধিমাত্র কৃষ্ণ। উর্বী শাশ্বত রাত্রির বুকে অনন্ত সূর্যোদয়ের মতো জেগে থাকা একটি প্রাণ।
১৯৬২ সালে প্রকাশিত রেচেল কারসন-এর 'সাইলেন্ট স্প্রিং' বইটিকে পরিবেশ পাঠের আকর গ্রন্থ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। পরবর্তীকালের পরিবেশ বিজ্ঞানীদের অনুপ্রাণিত করেছে এই মহাগ্রন্থ। ডি. ডি. টি.-র মতো পেস্টিসাইডের যথেচ্ছ প্রয়োগের ফলে উইলো গাছের পাতা খেতে এসে কিভাবে রবিন পাখিরা অসুস্থ হয়ে পড়লো, তাদের ডিম নষ্ট হয়ে যেতে লাগলো, আশপাশের কৃষিজমি, গৃহপালিত পশু এমনকি মানুষজনও কিভাবে আক্রান্ত হলো - এই বিষশৃঙ্খলের এক মর্মস্পর্শী বাস্তবচিত্র ফুটে উঠেছে এই গ্রন্থে। বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিগুলো থেকে প্রবল বাধার সম্মুখীন হন শ্রীমতী কারসন। অবশেষে প্রেসিডেন্ট কেনেডি আকাশপথে কৃষিজমির ওপর ডি. ডি. টি. নিক্ষেপ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। 'শেষ রূপকথা' উপন্যাসের 'ভিতরকণিকা' পর্বটি আমাদের রেচেল কারসনের কথা মনে করিয়ে দেবেই। বঙ্গোপসাগরের তীরে ওড়িশার সংরক্ষিত অরণ্য ভিতরকণিকার গহিরমাথা উপতটে দুর্লভ প্রজাতির সামুদ্রিক কচ্ছপ অলিভ রিডলের প্রজনন ও সংরক্ষণ করা হয়। কৃষ্ণ তার স্বপ্নে দেখে কুয়াশামথিত সমুদ্রতটে রাশি রাশি শকুন অলিভ রিডলের ডিম খেয়ে বেড়াচ্ছে। বিশাল আকৃতির শকুনচঞ্চু দানব কৃষ্ণের কাছে এসে বলে - "সব সময় যে কোনো মালের ভিতরটা খাবে। ভিতরকণিকা মানে হচ্ছে ভিতরের মাল। খাও। আমি সব সময় চোখ দিয়ে শুরু করি।" তন্মুহূর্তে মনে পড়ে যায় শিশু মৌ-এর ধীরে ধীরে অন্ধ হয়ে যাওয়ার ঘটনা। যখন দানব বলে ওঠে - "একদিন দুনিয়ার সব ডিম খেয়ে নেবো আমরা" - প্রকৃতিমায়ের কান্না সরাসরি আমাদের বুকে এসে আছড়ে পড়ে। দূষণ তার বীভৎস অবয়ব নিয়ে যেন চোখের সামনে এসে দাঁড়ায়। ঝুঁটি ধরে নাড়িয়ে দেয় আমাদের অস্তিত্বকে।
প্রাবন্ধিক বা বিজ্ঞানীদের লেখা, অভিজ্ঞতা ও তথ্যে সমৃদ্ধ। সেই তথ্যকেই কল্পনায় নিষিক্ত করে এক মরমী বাস্তব সৃষ্টি করেন লেখক, কবি, শিল্পীরা - যেখানে আমরা রক্ত, মাংস, প্রাণের অস্তিত্বকে অনুভব করতে পারি। গোইয়ার আঁকা 'Saturn devouring his son' কিংবা ইয়েটস-এর 'The second coming'-এর মতো কবিতা, যে মারাত্মক অভিঘাত সৃষ্টি করে পাঠকমনে তা আসলে সেই কঠোর বাস্তবকে আরো ভালো করে বুঝে নিতেই সাহায্য করে আমাদের, যাকে প্রতিনিয়ত দেখেও ঠিক ঠিক চিনে উঠতে পারিনা আমরা। দূষণ তার সামগ্রিক ভয়াবহতা নিয়ে জীবন্ত ও প্রাঞ্জল হয়ে উঠেছে 'শেষ রূপকথা' উপন্যাসে। দূষণ আক্রান্ত আধমরা মানুষদের খুঁজে পেতে হয়তো সহায়ক হবে এই গ্রন্থ। উপন্যাসের নায়ক কৃষ্ণ তো আমাদেরই মতো একজন সাধারণ মানুষ। তার করুণ পরিনতি আরো অনেকের জীবনে প্রতিদিন ঘটে চলেছে! উইলিয়াম ব্লেক-এর 'The Sick Rose' কবিতার কীটদষ্ট গোলাপের মতো কত মৌ-এর প্রাণ যে অকালে ঝরে চলেছে তারই বা কে হিসেব রাখে? সভ্যতার এক ভয়ঙ্কর সাবধানবানী পৃথিবীর মানুষকে ব্যাকুলহৃদয়ে শোনাতে চেয়েছেন মরমী সাহিত্যিক আবুল বাশার। দুর্ভাগ্য আমাদের এমন একটি প্রয়োজনীয় গ্রন্থ এতদিন ধরে অনালোচিত এবং অবহেলিত হয়েই পড়ে রইল!