আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ দ্বাদশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ জুন, ২০২৩ ● ১-১৫ আষাঢ়, ১৪৩০

প্রবন্ধ

রেখো না বাঙালি করে

সুগত ত্রিপাঠী


এক শ্রেণীর বাঙালিকে দেখি, তাঁরা নিজেরা কেবল বাঙালি বলেই পরম গৌরব বোধ করেন। বঙ্গ-সমাজ, বঙ্গ-সংস্কৃতি নিয়ে তাঁদের গর্বের সীমা-পরিসীমা নেই। বিষয়টা ভেবে একটু অবাক লাগে আজকাল।

এ প্রসঙ্গের প্রেক্ষিতে প্রথমেই যে কথাটা বলব, একজন মানুষকে তার নিজস্ব পরিচয় প্রদানে তার সম্প্রদায়গত পরিচিতি-আনয়ন কি খুব জরুরি? মানুষের মূল্য বিচার হয় তার কাজের দ্বারা। তিনি বাঙালি কি ইংরেজ, কলকাতায় থাকেন নাকি ক্যালিফোর্নিয়ায় - এগুলো ধর্তব্যের ভেতরে আসে না। আর বঙ্গ-সংস্কৃতি যে একটা বিরাট কিছু উৎকৃষ্ট বস্তু - এ জাতীয় ভাবনার কোনও যৌক্তিকতা আছে বলে মনে হয় না। বিশ্বের প্রায় প্রতিটি সম্প্রদায়ই তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি নিয়ে গর্ববোধ করে। জুলু-রা (আফ্রিকার জনজাতি সম্প্রদায়বিশেষ) বলে, তাদের নাচ সর্বোৎকৃষ্ট; সে নাচ অন্যদের কাছে যতই অর্থহীন, হাস্যকর হোক-না-কেন। 'আরণ্যক' উপন্যাসে সাঁওতাল রাজা দোবরু পান্নাকে বলতে শোনা গিয়েছে, "আমাদের বংশ সূর্যবংশ।" জার্মানের (অর্থাৎ জার্মানির অধিবাসী) কথামতো, তাদের সঙ্গীতের তুল্য সঙ্গীত দুনিয়ায় নেই। ইংরেজ নিজের সাহিত্যশ্লাঘায় স্ফীত।

একই রকমভাবে বহু বাঙালি আপন সংস্কৃতি নিয়ে গর্ববোধ করেন। আবার বাঙালিদের মধ্যেই এমন অনেকে আছেন, যাঁদের এসব বিষয়ে বিশেষ মাথাব্যথা নেই। ভারতীয় রাগ-রাগিণী কিংবা বাংলা গান (রবীন্দ্রসঙ্গীত-নজরুলগীতি-অতুলপ্রসাদী-কীর্তন-বাউল থেকে শুরু করে তথাকথিত স্বর্ণযুগের আধুনিক গান ইত্যাদি) বহু ইউরোপিয়ানের কানে নাকী, বেসুরো, একঘেয়ে হিসেবে প্রতিভাত হয়। বাংলা সিনেমা অবাঙালিরা ভালো করে ছুঁয়েও দেখেননি কোনওদিন। আবার অধিকাংশ ভারতীয় তথা বাঙালির কাছে পাশ্চাত্য-কণ্ঠসঙ্গীত বিশেষ কোনো আকর্ষণ তৈরি করে না।

'বাঙালি' সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত একজন মানুষ, তিনি স্বদেশেই থাকুন কিংবা প্রবাসে, তাঁকে যে বঙ্গ-সংস্কৃতি আঁকড়ে ধরে থাকতে হবে, এমন কোনও মানে নেই। কারণ বঙ্গীয় সংস্কৃতি থেকে বিচ্যুত হলে কেউ হীন হয়ে যায় না, আবার 'বাঙালি' পরিচয়ে কেউ উজ্জ্বলও হয়ে ওঠে না। শেষ কথা বলে তাঁর কাজ, তাঁর অবদান। বঙ্গ-সংস্কৃতির বিরাট কিছু গুণগান না করেও চিরস্মরণীয় মহামানব হিসেবে পূজিত শ্রীচৈতন্য, শ্রীরামকৃষ্ণ, শ্রীঅরবিন্দ, নেতাজি সুভাষ, রামমোহন, বিদ্যাসাগর প্রমুখ। বলা বাহুল্য, এঁরা প্রত্যেকেই বাঙালি, কিন্তু তাঁদের পরিচয় হিসেবে সেটি তুলে ধরা একান্ত নিরর্থক।

প্রকৃতপক্ষে, 'বঙ্গ-সংস্কৃতি' বস্তুটা কী, তার নির্দিষ্ট সংজ্ঞা কিছু হওয়া সম্ভব বলে মনে হয় না। রবীন্দ্রনাথ নাকি সত্যজিৎ রায়, বঙ্গ-সংস্কৃতি বলতে কি আমরা এঁদের বুঝব? নাকি ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান? নাকি ধুতি-পাঞ্জাবি? মাছ-ভাত? উত্তম-সুচিত্রা-সৌমিত্র? দুর্গাপুজো? কৃত্তিবাস-কাশীরাম? হেমন্ত-মান্না? অবনীন্দ্র-নন্দলাল? অভিধান লেখে, 'শিক্ষা বা চর্চা দ্বারা লব্ধ বিদ্যা বুদ্ধি শিল্প কলা রুচি নীতি ইত্যাদির উৎকর্ষ হইল সংস্কৃতি।' ক'জন বাঙালি এই উৎকর্ষ অর্জন করেছেন কিংবা এই উৎকর্ষের প্রতি মনোযোগী?

রবীন্দ্রনাথ অনেকের মতে বঙ্গ-সংস্কৃতির সর্বশ্রেষ্ঠ পুরোধা। এঁদের মত মেনে নিলে বলতে হয়, বঙ্গ-সংস্কৃতির 'শ্রেষ্ঠকাল' বয়সে নিতান্তই অর্বাচীন। রবীন্দ্রনাথের আগে কি বঙ্গ-সংস্কৃতিতে ঘাটতি পড়েছিল? প্রকৃতপক্ষে এ জাতীয় মূল্যায়ন কিংবা বক্তব্য বহুলাংশে অর্থহীন।

বাঙালি হোন কিংবা অন্য যে-কোনও জাতির মানুষ যদি নিজের সংস্কৃতিকে সবার সেরা বলে মনে করেন, সেক্ষেত্রে তাঁর পরিধি বৃত্ত থেকে বিন্দুতে আসতে বেশি সময় নেবে না। সভ্যতা-সংস্কৃতির আদান-প্রদানেই কোনও জাতির স্বাস্থ্যোন্নতি ঘটে। যদি কেউ সদাসর্বদা আপন সংস্কৃতিতে বিভোর থাকেন, তিনি খুব সমর্থনযোগ্য-প্রশংসনীয় কাজ করছেন বলে মনে হয় না। তাঁর অবস্থা তখন 'রেখেছ বাঙালি (কিংবা অন্য কোনও সম্প্রদায়) করে মানুষ করনি'-ই হবে।

দুঃখের বিষয় - যে-সব বাঙালি প্রবাসী, তাঁদের একটা অংশকে দেখি বিচিত্র মনোভাবাপন্ন। এঁদের শরীরটা ইউরোপ কিংবা আমেরিকায় থাকে ঠিকই, কিন্তু মনটা পড়ে আছে পশ্চিমবঙ্গ বা কলকাতায়। ফলতঃ, নিউইয়র্ক কিংবা লণ্ডনেও তাঁরা একটি বাঙালি ঘেটো (ghetto) বানানোর চেষ্টা করেন এবং সেই খোলের মধ্যে নিজেদের আবৃত রেখে পরম গৌরবান্বিত তথা নিশ্চিন্ত হন। বিদেশে গিয়েই প্রথমে ছোঁকছোঁক করেন - ধারেকাছে কোনও বাঙালি আছে কিনা; যেন যে দেশে যাচ্ছেন সে দেশবাসী সব ভিনগ্রহী, 'মানুষ' একমাত্র বাঙালিরাই। কতখানি কূপমণ্ডূক মনোভাব, ভাবলে বাঙালি হিসেবে লজ্জিত হতে হয়। বিদেশীদের সঙ্গে তাঁরা কোনও এক অজানা কারণে - ভয়ে কিংবা ঘৃণায় বা অন্য কী জন্য জানা নেই - একটা দুর্লঙ্ঘ্য প্রাচীর তুলে রাখেন। বিদেশে বড়ি দিচ্ছেন, আচার বানাচ্ছেন, লক্ষ্মী ঠাকুর-মনসা ঠাকুরের ছবির কম্পিউটার-প্রিন্টআউটের পুজো করছেন, দোল খেলছেন, ভাইফোঁটা-জন্মাষ্টমী পালন করছেন; আবার ফলাও করে সে-সব সমাজ মাধ্যমে উগরে পরম তৃপ্তিলাভ করছেন এই ভেবে যে - দেখো বন্ধুরা, আমরা এত দূরে থেকেও কী সুন্দর বঙ্গীয় সংস্কৃতি, ভারতীয় সংস্কৃতিকে 'ধরে রেখেছি'। ভাবটা এমন, যেন এগুলি না-করলে সাংস্কৃতিক হানি বিরাট কিছু হয়। কেমন বোকা বোকা! ফলে এরকম একজন মানুষ যখন তিরিশ কি পঞ্চাশ বছর বিভুঁইয়ে কাটিয়ে এখানে ফিরে আসেন, তাঁর কাছ থেকে না-জানা যায় সে দেশের সমাজব্যবস্থা সংক্রান্ত কোনও সুনির্দিষ্ট তথ্য, না-পাওয়া যায় সে-সব দেশের রাজনীতি-অর্থনীতি-সভ্যতা- ধর্মাচরণ সম্পর্কিত শিক্ষিত আলোচনা।

কোনও সংস্কৃতির সবকিছু খারাপ আর কোনও সংস্কৃতির সবকিছু ভালো - এমন হতে পারে না। প্রতিটি সভ্যতা-সংস্কৃতিই ভালো-মন্দের মিশ্রণ। বাঙালি স্বাধীনতা সংগ্রাম করেছে অসামান্য বীরত্বের সঙ্গে, ঊনবিংশ শতাব্দীতে নবজাগরণ ঘটিয়েছে; আবার সেই বাঙালিই অন্যের উন্নতিতে ঈর্ষার জ্বালায় দগ্ধ হয়েছে, পরনিন্দা-পরচর্চায় মশগুল থেকেছে, রাজনীতি করতে এসে বিরোধী পক্ষের ওপরে অকথ্য অত্যাচার চালিয়েছে। একই রকমভাবে - ইতালিয়ান, রাশিয়ান, ফরাসি, গ্ৰীক পৃথিবীকে উপহার দিয়েছে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-দর্শনের অনন্য নিদর্শন, আবার এইসব সম্প্রদায়ের মধ্য থেকেই উদ্ভূত হয়েছে নরঘাতক শাসকের দল।

এমন অসংখ্য বাঙালি ইউরোপ-আমেরিকা-আফ্রিকা-অস্ট্রেলিয়ায় রয়েছেন যাঁরা প্রভূত আর্থিক উন্নতি করেছেন চাকরি-ব্যবসা ইত্যাদি বিবিধ কাজের মাধ্যমে, কিন্তু কখনও এ প্রশ্ন নিজেকে করার প্রয়োজন বোধ করেন না - তিনি কি শিকড়চ্যুত, নাকি নিজের বাঙালি পরিচয়ে গর্বিত? অথচ তিনি জীবনে যথেষ্ট সফল। একই রকমভাবে বহু বাঙালি বিজ্ঞানী-গবেষক, অর্থনীতিবিদ, সাহিত্যসেবী প্রবাসী; কিন্তু উপরোক্ত প্রশ্নটি করার ফুরসত পাননি, ইচ্ছা প্রকাশ করেননি। এতে না হয়েছে তাঁদের মনুষ্যত্বের হানি, না হয়েছে কাজের ক্ষতি।

বাঙালির মস্তিষ্ক খুব উন্নত - এরকম একটা মতে অনেকে বিশ্বাসী। কোনও কোনও মনীষী, মহাপুরুষও এ মত সমর্থন করেছেন। এ প্রসঙ্গে প্রথমেই আনব ভারতীয় দর্শন তথা অধ্যাত্মবাদের কথা, যেহেতু ভারতবর্ষের অধ্যাত্মবাদ-ই বিশ্বের কাছে এদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার। অধ্যাত্মবাদী দার্শনিকদের মধ্যে যাঁরা খুব উল্লেখযোগ্য তাঁদের কয়েকজন - সায়ন আচার্য, মহর্ষি কপিল, শঙ্করাচার্য, নিম্বার্কাচার্য, আচার্য রামানুজ, যামুনাচার্য, বল্লভাচার্য, মধ্বাচার্য প্রভৃতি। বলতে হবে গৌতম বুদ্ধ, তীর্থঙ্কর মহাবীর-এর নামও। বলা বাহুল্য, এঁদের একজনও বাঙালি নন। সম্ভবত শ্রীচৈতন্যের আগে আমরা সেই অর্থে কোনও বাঙালি অধ্যাত্ম-দার্শনিককে পাইনি। তারপরে পেয়েছি শ্রীরামকৃষ্ণ, স্বামী বিবেকানন্দকে। আরও কেউ কেউ এসেছেন। অতএব দেখা যাচ্ছে অধ্যাত্ম-পথে উল্লেখযোগ্য বাঙালি দার্শনিকের সংখ্যা যথেষ্ট কম।

প্রসঙ্গত - আর্যভট্ট, বরাহমিহির, ব্রহ্মগুপ্ত, কালিদাস - এঁরাও কেউ বাঙালি ছিলেন না। একমাত্র অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান-ই যা বাঙালি ছিলেন।

বাঙালি বৈজ্ঞানিকদের মধ্যে ঘুরেফিরে কয়েকজনের কথাই আসে - জগদীশচন্দ্র বসু, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, মেঘনাথ সাহা, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, প্রশান্ত চন্দ্র মহলানবিশ প্রভৃতি। আর সমগ্র বিশ্বে আজ পর্যন্ত কত হাজার উল্লেখযোগ্য বিজ্ঞানীকে পাওয়া গিয়েছে? কাজেই দেখা গেল, বাঙালিদের মধ্যে বড় বিজ্ঞানীর সংখ্যাও যথেষ্ট অল্প। এরপরেও বলব বাঙালি-মস্তিষ্ক বিরাট উন্নত?

ক'জন বাঙালি সাহিত্যিক বিশ্বের দরবারে প্রতিনিধিত্ব করার যোগ্য? মাইকেল মধুসূদন, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। এখানেই মোটামুটি তালিকা সম্পূর্ণ। কেউ কেউ অবশ্য মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং জীবনানন্দ দাশকে এই সারিতে অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করেন। সে যাই হোক, তাহলে বাঙালি সাহিত্যিকের সংখ্যাও বিশ্বের অগ্রগণ্য সাহিত্যিকদের তুলনায় একান্তই অপ্রতুল।

বাঙালি চিত্রশিল্পী? গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নন্দলাল বসু, যামিনী রায়। ব্যস, এরপরে নাম খুঁজে পাওয়াই কঠিন; অন্তত লিওনার্দো দা ভিঞ্চি, মাইকেলএঞ্জেলো, রাফায়েল, ভিনসেন্ট ভ্যান গগ, পিটার পল রুবেন্স প্রমুখের সঙ্গে এক আসনে বসার যোগ্য শিল্পী।

এরকম অজস্র ক্ষেত্র উল্লেখ করতে পারি, যেখানে মস্তিষ্ক-চালনের প্রয়োজন হয়, সেখানে বাঙালিরা বিশেষ কিছু সুবিধা করে উঠতে পারেনি। প্রকৃতপক্ষে, বুদ্ধিবৃত্তিতে অর্থাৎ বৌদ্ধিক ক্ষেত্রে বাঙালি ভারতবর্ষের অন্যান্য সম্প্রদায়ের চেয়ে হয়তো কিছুটা এগিয়ে, কিন্তু বিশ্বের সঙ্গে তুলনা করলে এ কথার পেছনে বিশেষ সত্যতা কিছু খুঁজে পাওয়া কঠিন।