আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ দ্বাদশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ জুন, ২০২৩ ● ১-১৫ আষাঢ়, ১৪৩০

প্রবন্ধ

বাংলা বানানবন্ধু বা ‘স্পেল চেকার’-এর কোনও খবর আছে কি?

পবিত্র সরকার


১) কম্পিউটারে ইংরেজি টাইপে একটা পরিচিত দৃশ্য

এটা একটা মূর্খের প্রশ্ন হতেই পারে। কিন্তু উত্তরটা এই মূর্খ লেখকের কাছে স্পষ্ট নয় বলেই এই লেখা। আমরা তো দেখি, যাঁরা ইংরেজিতে কম্পিউটারে লেখালেখি করেন, একেবারে প্রথম থেকেই তাঁদের এ বিষয়টা দেখা আছে যে, লেখার সময় কোনও বানান ভুল হলে নীচে একটা লাল দাগ পড়ে যায়। তখন টাইপ থামিয়ে ফিরে এসে সেই বানানটা ঠিক করে দিলে সেই লাল দাগ অদৃশ্য হয়, লেখকও স্বস্তি পান। এই লাল দাগটি পড়ে কেন? পড়ে এই কারণে যে, কম্পিউটারে ইংরেজি টাইপ করার প্রক্রিয়ার সঙ্গে একটি ব্যবস্থা লাগানো আছে, যার নাম স্পেল-চেকার, সে গুরুমশাইয়ের মতো নজর রাখছে যে টাইপে ভুল হচ্ছে কি না, ভুল হলে তার রক্তচক্ষুর ইশারা জেগে উঠছে শব্দটির নীচে। শব্দের মধ্যে ফাঁক না পড়লে, ছেদচিহ্ন দিতে ভুল হলেও ওই লাল দাগ পড়ে যায়। ধরা যাক, বাংলায় তার নাম হল ‘বানান-বন্ধু’।

আমাদের মতো যারা টেনেটুনে ইংরেজি শিখেছি তারা কম্পিউটারে ইংরেজি টাইপ করার সময়ে এই ব্যবস্থার কাছে কৃতজ্ঞ থাকি। আমি কম্পিউটারের যান্ত্রিক রহস্য সম্বন্ধে ডাহা অবিশেষজ্ঞ অর্থাৎ গণ্ডমূর্খ, আমি এই বহুসাধক যন্ত্রটিকে মূলত টাইপরাইটারের মতো ব্যবহার করি। অর্থাৎ তার বৈঠকখানা ছাড়িয়ে আর ভিতরে ঢুকি না। আর লিখি যে, তারও বেশিরভাগই লিখি বাংলায়। তাই আমার অতি সীমাবদ্ধ সক্রিয়তা থেকে বলি, বাংলা লেখার ব্যবস্থাতে একটা বাংলা ‘বানান-বন্ধু’ লাগানো থাকলে ভালো হত। তা ওই রকম বাংলা শব্দের নীচে লাল দাগ বসিয়ে দিত, আমরা সাবধান হয়ে আবার ফিরে টাইপ করতাম। অবশ্য এও দেখি যে, স্পেল-চেকার শুধু বানানই সংশোধন করে না, ব্যাকরণও সংশোধন করে, পর পর দুটো of বসালেও একটাতে লাল দাগ দেয়। সে তো আরও ভালো কথা, আরও নিশ্চিন্ত হয়ে আমরা ইংরেজি লিখতে পারি। কবে এইরকম নিশ্চিন্ত হয়ে বাংলা লিখতে পারব। ঘাড়ের পিছনে কেউ একজন ভুল ধরবার জন্য নজর রাখছে, জেনে?

২) আমার সমস্যা, ওঁদের সমস্যা

এখন এইটুকু কথাতেই অনেক কথা উঠে পড়বে। এক নম্বর, আমার মূর্খতাকে ধিক্কার দিয়ে। আমি জানি না, খবরও রাখি না — হয়তো এর মধ্যেই একাধিক বানানবন্ধু কাজ করছে নানা জায়গায়। কম্পিউটারে বাংলা লেখা প্রবর্তনের দিকপাল বন্ধুবর মুস্তাফা জব্বার এবং অন্যান্যরা আমার অজ্ঞতাকে নিশ্চয়ই উপহাস করবেন। কিন্তু আমি যে সব ফন্ট ব্যবহার করেছি, প্রথমে অভ্রের ‘বাংলা আকাদেমি’, আর এখন ভারতে তৈরি বৈশাখীর ‘বাংলা আকাদেমি’, তার কোনওটাতেই লাল দাগ পড়ে না। যদিও ই-মেলে লিখতে গিয়ে দেখি কখনও কখনও ভুল লিখলে শুদ্ধ বিকল্পটা ভেসে উঠছে, সেটায় টোক্কা দিলে তা এসে ঠিক জায়গায় বসে যায়। তাই মনে হয় তলে তলে কিছু কাজকর্ম চলেছে, কিন্তু আমার মতো সাধারণ গ্রাহকের কাছে সে খবরটা জানা নেই। তাহলে বাংলা খবরের কাগজে, এমনকি ‘সর্বাধিক প্রচারিত’, ‘সর্বাধিক জনপ্রিয়’ কাগজেও এত ভুল ঢুকে পড়ে কেন? পশ্চিমবাংলায় তো কাগজে প্রচুর বানান ভুল থাকে, বাংলাদেশের কাগজের রোজকার খবর তো জানি না। তাঁদের কর্মীদের কম্পিউটারে কি কোনও বানান-বন্ধু নেই? এমনিতে লালে যার যতই আতঙ্ক থাক, আমাদের কম্পিউটারে লেখার সময় ওই লাল দাগ একটা খুব বাঞ্ছিত ব্যাপার বলে আমরা মনে করি, ইংরেজির ক্ষেত্রে তা আমাদের প্রতিমুহূর্তে শিক্ষিত করে। বানান শেখায়, ব্যাকরণও শেখায় কিছুটা। বাংলার বেলায় সেটা হচ্ছে না কেন?

দু-নম্বর কথা, নিশ্চয়ই যাঁরা বাংলায় বানান-বন্ধু নিয়ে কাজ করেছেন তাঁরা এই প্রশ্নের মীমাংসা করেছেন যে, কোন অভিধানটা মানব, কার নীতি ধরে কাজ করব। কেউ 'পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি'র বানান, ‘সংসদ বাংলা অভিধান’-এর বানান, বা 'ঢাকা বাংলা একাডেমি'র বানানকে ভিত্তি করে হয়তো কাজ করেছেন। যদি এখনও কাজ বাকি থেকে থাকে তাহলে বলি যে, বিকল্পগুলিও যদি নতুন বানান-বন্ধুতে দেওয়া যায়। কারণ আমাদের বাংলায় তিন শ্রেণির বানান পাশাপাশি চলে: ১. ভুল বানান, যার সংখ্যা একাধিক হতে পারে। ২. প্রাচীন বর্জিত বানান, যাকে অশুদ্ধ বলার কোনও নৈতিক যুক্তি নেই, কারণ সেই বানানে অজস্র বই ছাপা আছে, পুরোনো বই খুললেই তাদের মুখোমুখি হতে হবে। এবং ৩. এখনকার কোনও গৃহীত নীতি অনুযায়ী (ঢাকা বাংলা একাডেমি, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, কোনও প্রতিষ্ঠিত সংবাদপত্র ইত্যাদিতে) গৃহীত শুদ্ধ বানান। তাই শুদ্ধ বানানও একাধিক হতে পারে। শুদ্ধ বানানের একটা নতুন, একটা পুরোনো। যেমন ‘ঊর্ধ্ব’ নতুন শুদ্ধ বানান, আর ‘ঊর্দ্ধ্ব’ পুরোনো শুদ্ধ বানান। কিন্তু ভুল বানানগুলো হল উর্ধ, উর্দ্ধ, উর্দ্ধ্ব, উর্ধ্ব, ঊর্ধ, ঊর্দ্ধ ইত্যাদি। আমার ‘বাংলা বানান সংস্কার’ বইটির প্রথম প্রবন্ধে, বানান ভুলের সম্ভাবনার কারণগুলির খোঁজ করে এইসব দেখিয়েছি।

আমাদের বানান-বন্ধু কি এই নতুন শুদ্ধ আর পুরোনো শুদ্ধ দু-ই বিকল্পই দেখাবে? দেখাতে পারবে? দেখানোর দরকার হবে? আমি জানি না, আমার সফটওয়্যারকুশলী বন্ধুরা তা আমাদের বলবেন।

৩) আরও সমস্যা কোথায়?

স্পেল-চেকার বাংলাতে তৈরি করার কিছু চেষ্টা হয়েছিল বলে খবর রাখি। যাঁরা করেছিলেন তাঁরা প্রথমে এই সমস্যায় পড়েছিলেন যে, কার বানাননীতি ধরে এই স্পেল-চেকার তৈরি হবে। যাদবপুরের মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক বন্ধুবর মনোজ পাল একটা কাজ করেছিলেন বলে জানি। অন্যদিকে কলকাতার সরকারি ভাষা-প্রযুক্তি গবেষণাকেন্দ্রেও শুনলাম একটি স্পেল-চেকার তৈরি আছে, সেটি সম্ভবত পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির বানানকে অনুসরণ করে তৈরি হয়েছিল। যাই হোক, একটা মোটামুটি অনেকের দ্বারা মান্য অভিধানকে অনুসরণ করলেই হয়, পশ্চিমবঙ্গে, ধরা যাক, বাংলা আকাদেমি, কিংবা বাংলাদেশে বাংলা একাডেমি। অন্যরা আপত্তি করতেই পারেন। কিন্তু যদি তাঁরা ভাবেন যে অসংখ্য নতুন শিক্ষার্থী বাংলা লিখতে আসছেন, অজস্র কর্মী কম্পিউটারে কম্পোজ করে জীবিকা নির্বাহ করবেন, তাঁদের জন্য ‘এক শব্দের এক বানান’ নীতিটি গ্রহণ করলে তাঁদের উপকার করা হবে, তা হলে আপত্তি সম্ভবত একটু নরম হতে পারে।

তাঁদের শুধু এইটুকু বলতে হবে যে, তাঁরা দেখবেন অনেক রকম বানান, কিন্তু লিখবেন যেটা শিখেছেন সেটা। অবশ্যই পুরোনো বইয়ের উদ্ধৃতি বা প্রাচীনত্ব বজায় রেখে কম্পোজ করতে গেলে পুরোনো বানানই রাখতে হবে।

এর মধ্যে একজনের কাছে আমি শুনলাম যে, যেহেতু আমরা মাইক্রোসফট ওয়ার্ডে সব টাইপ করি, ইংরেজি, বাংলা দুইই — তাতে বাংলা বানান-বন্ধু বসাতে গেলে একটা প্রোটোকলের দরকার হবে মাইক্রোসফটের সঙ্গে। তা সেটা করতে অসুবিধা কোথায় তাও তো জানা দরকার। ভারত/পশ্চিমবঙ্গ সরকার বা বাংলাদেশ সরকারের চেষ্টায় ওই প্রোটোকল চুকিয়ে ফেলা কি একেবারেই সম্ভব নয়?

৪) ভুল তো হচ্ছেই

ইদানীংকালের বাংলা খবরের কাগজ পড়ে মনে হচ্ছে, বানানের সঙ্গে একটা ব্যাকরণ-চেকারও তৈরি করা দরকার হয়ে পড়ছে। বড় বড় কাগজেও এত ‘সখ্যতা’, ‘মৌনতা’, ‘অধ্যায়ন’ প্রায়ই দেখি, খুব প্রতিষ্ঠিত খবরের কাগজেও। অর্থাৎ তাঁদের গৃহীত বানান-নীতি, যতই চমকপ্রদ হোক, বানানশুদ্ধির গ্যারান্টি হয়ে ওঠেনি। সাংবাদিকরা টাইপ করে অনলাইনে খবর পাঠান, তাঁদের পক্ষে সব বানান জানা সম্ভব নয়। কিন্তু মনে হচ্ছে, এই কাগজগুলিরও কোনও বানান-বন্ধু নেই, বা থাকলেও ব্যবহৃত হচ্ছে না।

সেই কারণেই, এক বানানপাগল বৃদ্ধ হিসেবে, শুদ্ধ বানানে ছাপা জিনিসপত্র একটা সংস্কৃতির আত্মসম্মানের চিহ্ন বলে, আমার কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ বন্ধুদের কাছে এই প্রশ্ন রাখছি। বাংলা বানান-বন্ধু কি দিগন্তে দেখা দিয়েছেন? নাকি এখনও সমুদ্রের ওপারে খেয়াডিঙি ধরতে পারেননি?