আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ দ্বাদশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ জুন, ২০২৩ ● ১-১৫ আষাঢ়, ১৪৩০

প্রবন্ধ

এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না

পার্থপ্রতিম বিশ্বাস


মৃত্যুর নিরিখে এই শতাব্দীর ভয়াবহতম দুর্ঘটনায় নাম জড়াল ভারতীয় রেলের। রাজ্যের সীমানা ঘেঁষা ওড়িশার বালাসোরের কাছে এই দুর্ঘটনার বলি হয়েছে ২৮৮ জন মানুষ। আহতের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়েছে। ভয়াবহ রেল দুর্ঘটনায় সারি সারি লাশের সামনে নবারুণ ভট্টাচার্যের সেই কবিতার শিরোনাম ভেসে আসছে আবার ভিন্ন প্রেক্ষিতে ‘এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না‘। দুর্ঘটনাগ্রস্ত করমণ্ডল এক্সপ্রেসের সংখ্যাগরিষ্ঠ যাত্রীরা ছিলেন এই রাজ্যের বাসিন্দা যারা কেউ কাজের খোঁজে দক্ষিণের ভিন রাজ্যে পাড়ি দিয়েছিলেন কিংবা চিকিৎসার প্রয়োজনে প্রিয়জনকে নিয়ে ছুটছিলেন হাসপাতালের সন্ধানে। স্বভাবতই এমন দুর্ঘটনার পর শুরু হয়েছে রাজনৈতিক চাপান-উতোর। এমন দুর্ঘটনার পেছনে রেল সুরক্ষার ত্রুটি নিয়ে মানুষ সরব হলেও দেশের শাসক এর মধ্যে ষড়যন্ত্র এবং নাশকতার গন্ধ আবিষ্কার করেছে। রেলের নিজস্ব তদন্ত ‘কমিশনার অফ রেলওয়ে সেফটি‘ শেষ করার আগেই দেশের সরকার এই দুর্ঘটনার তদন্তভার সিবিআই-এর হাতে তুলে দিয়েছে। সিবিআই-এর দক্ষতা সাধারণভাবে ফৌজদারি অপরাধ অন্বেষণের ক্ষেত্রে প্রমাণিত কিন্তু রেলের এই দুর্ঘটনার পেছনে পরিকাঠামো এবং প্রযুক্তিগত ত্রুটির কাঙ্খিত অনুসন্ধানের পরিবর্তে শাসকের নিয়ন্ত্রণে থাকা সিবিআই সত্য উদঘাটনে কতটা উদ্যোগী হবে সেই প্রশ্ন এখন জোরালো হচ্ছে।

প্রযুক্তি বিভ্রাট নাকি অন্তর্ঘাত

ইতিমধ্যে এই দুর্ঘটনার পেছনে যান্ত্রিক ত্রুটির কথা স্বীকার করেছেন রেল কর্তৃপক্ষ। ‘লুপ’ এবং 'মেন' লাইনের সংযোগস্থলের ‘পয়েন্ট‘ ব্যবস্থার ত্রুটির কারণে বিপথে পরিচালিত হয়ে করমণ্ডল এক্সপ্রেস পাশের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা মালগাড়ীতে ধাক্কা মারার ফলেই ঘটে এই দুর্ঘটনা। ট্রেনের যাত্রাপথে ট্রেন তার গতিপথ পরিবর্তন করে ভিন্ন ভিন্ন লাইনে যেতে পারে বর্তমানে চালু উন্নত প্রযুক্তিনির্ভর 'রিলে ইন্টারলকিং‘ ব্যবস্থার মাধ্যমে। সড়কপথ, জলপথ কিংবা আকাশপথের যান চালকেরা নিজের গতিপথ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেও ট্রেনের ক্ষেত্রে ট্রেনের চালক তা পারে না। ফলে ট্রেনের বাইরে থাকা রেল কর্মীদের সাজিয়ে রাখা লাইনের ওপর দিয়ে সিগন্যাল দেখে তাকে ছুটতে হয়। এক অর্থে চালকের আসনে বসে ট্রেনের গতি নিয়ন্ত্রন ছাড়া চালকের বিশেষ কিছু করার থাকে না।

মেন লাইনে উচ্চগতিতে ট্রেন যাওয়ার জন্য সিগন্যাল হয়ে আছে সবুজ, অথচ পয়েন্ট বিভ্রাটে লাইন তৈরি হয়ে আছে পাশের ‘লুপ‘ লাইনের দিকে। এই অবস্থায় রেলের সিগন্যাল মেনে ছুটতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পড়ে সেই অভিশপ্ত ট্রেন। ভেবে দেখা দরকার এমন ভয়াবহ পরিস্থিতিতে রেলের চালকেরা ট্রেন চালাবেন কিংবা যাত্রীরা ট্রেনে চড়বেন কোন ভরসায়! টিকিট কেটে ট্রেনে চড়ে নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছানোর নিশ্চয়তা রেলের মতো গণপরিবহণ ব্যবস্থায় না থাকলে বিপদ উত্তরোত্তর বাড়বে বই কমবে না। এই প্রেক্ষিতে এমন প্রাণঘাতী দুর্ঘটনার পর রেলের চালু প্রযুক্তিনির্ভর ব্যবস্থার মধ্যের ফাঁক বেরিয়ে এসেছে। প্রযুক্তির এমন ফাঁকের কথা ইতিমধ্যে দক্ষিন-পশ্চিম রেলের ম্যানেজার চার মাস আগেই তাঁর রিপোর্টে রেলমন্ত্রকের কর্তাদের জানালেও তাঁরা উপেক্ষা করেছেন তাঁর সেই সাবধানবাণী, যার পরিণতিতে ঘটল এই ভয়াবহ বিপর্যয়। ফলে এমন ত্রুটি প্রযুক্তির ভুলে নাকি পয়েন্ট মেরামতির ভুলে সেই প্রশ্ন এখন ওঠা অসংগত নয়।

কর্মী সংকটে রেল সুরক্ষা

এদেশে এখন প্রতিদিন গড়ে আড়াই কোটি মানুষ প্রায় ১৬,০০০ ট্রেনে চড়ে যাতায়াত করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে এদেশে রেলের সুরক্ষার মান উন্নয়নের মাপকাঠি হিসাবে বিবেচিত হয় না বরং মাপকাঠি হয় নতুন গতিতে চলা নতুন নতুন ট্রেনের উদ্বোধনের সংখ্যা। সন্দেহ নেই যে দেশের বাড়তি যাত্রী চাহিদা সামাল দিতে প্রয়োজন নতুন ট্রেন রুটের পরিকল্পনা। এমনকি দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছতে চালু ট্রেনের গতি বৃদ্ধিরও প্রয়োজন। কিন্তু এর কোনোটাই কাঙ্খিত সুরক্ষার মান বিসর্জন দিয়ে নয়। ফলে একশো চল্লিশ কোটি মানুষের দেশে মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত মানুষের ‘লাইফ লাইন’-কে বাঁচিয়ে রাখতে প্রয়োজন সঠিক অগ্রাধিকারের। এদেশে রেল দুর্ঘটনার অন্যতম বড় কারণ হল রক্ষীবিহীন লেভেল ক্রসিং। এছাড়াও রেল লাইনের তদারকি এবং রক্ষণাবেক্ষণের কাজ মূলত শ্রমনিবিড় প্রযুক্তি নির্ভর। ফলে এদেশের প্রায় ১,২৬,০০০ কিলোমিটার দীর্ঘ রেলপথে স্বাভাবিক কারণেই প্রয়োজন বিপুল পরিমাণ দক্ষ কর্মীবাহিনীর। অথচ দেশে এই মুহূর্তে রেলে শূন্যপদের সংখ্যা প্রায় ৩,১২,০০০ যার মধ্যে ১,২৫,০০০-এর বেশি পদ রেলের পরিকাঠামোর সুরক্ষার সাথে সম্পর্কিত। সম্প্রতি রেলের স্ট্যান্ডিং কমিটির রিপোর্টে প্রকাশিত যে রেলসেতু পর্যবেক্ষণ এবং মেরামতির কাজে প্রয়োজনীয় কর্মীর ৬০% পদ খালি। অথচ এদেশের ১৪৫,৫২৩টি রেলসেতুর মধ্যে ৩৭,৬৮৯টি সেতুই শতাব্দী প্রাচীন যার অর্থ প্রতি চারটি সেতুর মধ্যে একটির বয়স একশো বছরের বেশি। ফলে রেল সেতুর সুরক্ষা সমেত সার্বিক রেল পরিকাঠামোর সুরক্ষা আজ এই কর্মী সংকটে বড় প্রশ্নের মুখে।

অরক্ষিত রেল পরিকাঠামো

অপ্রতুল কর্মী সংখ্যার পাশাপাশি অপরিকল্পিতভাবে ছুটছে ট্রেন পুরোনো রেললাইনের ওপর দিয়েই। মানুষের জীবনের মতো রেললাইনের নির্দিষ্ট আয়ুষ্কাল থাকে। সেই আয়ু শেষের মুখে ক্ষয়প্রাপ্ত রেললাইনের বদল প্রয়োজন হয়, সমীক্ষায় প্রকাশ দেশের ‘এ‘ এবং ‘বি‘ গ্রুপের লাইনের ধারণক্ষমতা ছাপিয়ে ৪০% বেশি ট্রেন ছুটছে ক্ষয়ে আসা রেললাইনের ওপর দিয়েই। ফলে বাড়ছে বিপদের আশঙ্কা। এমন দুর্বল রেললাইনের কারণে ২৬% বেলাইনের ঘটনা ঘটেছে। রেললাইনের আকার-আকৃতির বিকৃতি এবং তার শক্তিক্ষয়ের পরিমাণ মাপার জন্য থাকা প্রযুক্তিনির্ভর ‘কার ইন্সপেকশন ইউনিট‘-এর ঘাটতি রয়েছে গড়ে ৬৫%। চালু এবং দুর্বল রেললাইন পরিবর্তনের জন্য ২০১৮-১৯-এর নির্ধারিত সরকারি বরাদ্দ ৯,৬০৭ কোটি টাকা থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ৭,৪১৭ কোটি টাকা। ২০২২-এর সিএজি রিপোর্টে রেলের পরিকাঠামোর ত্রুটির কথাই উঠে এসেছে জোরালোভাবে। ঐ রিপোর্ট অনুযায়ী রক্ষণাবেক্ষণের ত্রুটিতে ৪০% ট্রেনের বেলাইন হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। ৩৬% দুর্ঘটনা ঘটেছে চালকের ভুলে। পয়েন্ট সেটিং-এর ভুলের মতো রেলের ‘অপারেশন‘ বিভাগের ভুলে সিংহভাগ বেলাইন হওয়ার ঘটনা ঘটছে। দেশের ৬২% রেল কোচে কোনো অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র নেই। রেললাইনের এবং রেল জয়েন্ট-এর ফাটল বোঝার জন্য যে ‘ultrasonic flaw detector' মেশিন প্রয়োজন, দেশের ১৬টা রেল জোনে সেগুলি প্রয়োজনের তুলনায় ঢের কম। ফলে সবমিলিয়ে রেল পরিকাঠামোর কঙ্কালসার চেহারাটা ধরা পড়েছে সিএজি রিপোর্টে।

বেসরকারিকরণে বিপন্ন রেল

রেললাইনের স্বাস্থ্য পরীক্ষা, ট্রেনের ‘Anti-collision Device' (ACD) সিগন্যালের মতো প্রযুক্তিনির্ভর রেলের সুরক্ষার সিংহভাগ এখন বেসরকারি সংস্থার হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি কর্মী সংকটের কারণে ট্রেনের ‘অপারেশন’-এর সাথে যুক্ত চালক, সহ-চালক, গার্ড, টিকিট পরীক্ষক, ওয়ার্কশপের কর্মীদের কাজের চাপ বেড়ে চলেছে ভয়াবহভাবে। গত তিন মাসে ৪০% ট্রেন চালকদের গড়ে প্রায় বারো ঘণ্টার বেশি কাজ করতে হয়েছে। অনিয়মিত এবং কাঙ্খিত বিশ্রামের অভাবে ক্লান্তি গ্রাস করছে এমন চালকদের। ফলে মানসিক অবসাদগ্রস্থ হয়ে সিগন্যাল ফেল করার ঘটনা বাড়ছে। গত এক বছরে ঘটা দুর্ঘটনার ৭০%-এর বেশি ঘটেছে মানুষের ভুলেই। এমন প্রেক্ষিতে দেশে রেলের নিয়োগ বন্ধ রাখার অর্থ জেনেশুনে কেন্দ্রের সরকার সজ্ঞানেই দেশের রেলকর্মী এবং রেলযাত্রীদের প্রাণঘাতী বিপদের মুখে ফেলার ব্যবস্থা করছে। স্বাধীনতার পর থেকেই সামাজিক দায়বদ্ধতার নজির গড়েছিল রেল এদেশের মানচিত্রে তাঁর নিজস্ব দক্ষ কর্মীবাহিনীর সাহায্যে। কিন্তু এখন দায়বদ্ধতার ক্ষেত্রে রেলের নিজস্ব কর্মী নয় বরং অনেক বেশি নির্ভরশীল হতে হচ্ছে বেসরকারি সংস্থার কর্মদক্ষতা এবং তাদের দায়বদ্ধতার ওপরে। প্রধানমন্ত্রী মুখে আত্মনির্ভরতার কাহিনি প্রচার করলেও মনোযোগ দিয়ে রেল ব্যবস্থাকে কর্পোরেট নির্ভর করে তুলতে চাইছেন রেলের বিরাষ্ট্রীয়করণের মাধ্যমে। আর এই বেসরকারিকরণের পথ ধরে বাড়ছে টিকিটের দাম, স্টেশনে এবং ট্রেনে বিভিন্ন পরিষেবার দাম, তুলে নেওয়া হচ্ছে বয়স্ক নাগরিকদের ট্রেনের টিকিটে ভর্তুকি। ফলে নিত্যদিন বাড়তি ভাড়ার চাপ বাড়ছে মানুষের ওপর আবার তার সাথে বেড়ে চলেছে ট্রেন যাত্রার ঝুঁকি।

গতি মোহে আক্রান্ত রেল

গরিব দেশে গণপরিবহণ পরিবেশবান্ধব আর সুলভ যানের ভূমিকায় রেল অদ্বিতীয়। কিন্তু পরিবহণের দুই মূল সূত্র দ্রুত এবং নিরাপদ পরিবহণের ক্ষেত্রে রেলের কাঙ্খিত ভূমিকা এদেশের মাটিতে এখনও অধরা। ফলে ‘বন্দে ভারত’-এর মতো হাতে গোনা দ্রুতগামী ট্রেনের গতি কিংবা সুরক্ষা দেশের স্বনির্ভর প্রযুক্তির পরিচয় ঘটালেও প্রশ্ন ওঠে মেদিনীপুর লোকাল থেকে হাসনাবাদ প্যাসেঞ্জারের মতো আমজনতার রেলের গতি, সুরক্ষা এবং স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে। কিন্তু গালভরা মুখে 'বন্দে ভারত'-এর মতো - বাহারি ট্রেনের সংখ্যা বাড়িয়েও কি এদেশে উন্নত রেলযাত্রার মাপকাঠি হিসাবে রেলের গতি বেড়েছে?

এদেশে মাত্র ২% ট্রেনের গড় গতি ঘণ্টায় ৭৫ কিলোমিটারের ওপরে। ট্রেনের ইঞ্জিনের কিংবা কোচের দৌড়ের ক্ষমতা যতই বাড়ুক না কেন যাত্রাপথের সার্বিক রেললাইনের হাল, রেলসেতুর হাল, ট্রেনের সংখ্যা, সিগন্যাল, স্টেশনের সংখ্যা এবং নিরাপত্তার আনুষঙ্গিক বিষয়গুলি ব্যতিরেকে যাত্রার সময় কমানো যায় না। কারণ খেয়াল রাখতে হবে যে দ্রুতগতির ট্রেন চালানোর জন্য ভূপৃষ্ঠ থেকে বেশ খানিক ওপরে তুলে রেললাইন পাতা না হলে সেক্ষেত্রে ট্রেনের দুর্ঘটনার সম্ভাবনা বাড়ে বই কমে না । ইতিমধ্যে আহমেদাবাদ, বারাণসি কিংবা কাটরাগামী ‘বন্দে ভারত’ এক্সপ্রেস বেশ কিছু দুর্ঘটনার মুখে পড়েছে রেললাইনের ওপরে চলে আসা গবাদি পশুদের সাথে সংঘাতে। ফলে যতক্ষণ পর্যন্ত ট্রেনের যাত্রাপথের জনবহুল অংশগুলিতে লাইনের দুই পাশ নিরাপত্তা বলয়ের ঘেরাটোপে না আনা যাবে ততক্ষণ পর্যন্ত ট্রেনের গতিবৃদ্ধি ঝুঁকির সাথে জুড়বে দুর্ঘটনার ঝুঁকিও।

পণ্য পরিবহনে রেলের ভবিষ্যৎ

এদেশে রেলের আয়ের সবচেয়ে বড়ো সূত্র পণ্য পরিবহণের ভাড়া। পণ্য পরিবহণ থেকে লাভের টাকায় রেল, যাত্রী পরিবহণে ভর্তুকি জোগাতে পারে বলেই আমজনতার ট্রেনে যাত্রী ভাড়া নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকে। ফলে পণ্য পরিবহণ থেকে রেলের আয় উত্তরোত্তর না বাড়াতে পারলে আখেরে যে সুলভে যাত্রী পরিবহণ বিপর্যস্ত হবে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। স্বাধীনতার পর দেশের ৮৫% পণ্য পরিবহণ হতো রেলের মাধ্যমে বাকিটা মূলত সড়কপথে। কিন্তু গত কয়েক দশকে উত্তরোত্তর সড়ক ব্যবস্থার উন্নতির কারণে রেলের পণ্য পরিবহণের ভাগ কমে এসে দাঁড়িয়েছে ২৭%। এর ফলে রাজস্ব ঘাটতিতে ধুঁকছে রেল, যার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ছে রেলের ভাড়া এবং মাসুলে। রেলের সাম্প্রতিক পরিকল্পনা অনুযায়ী পণ্য পরিবহণের ভাগ আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে ২৭% থেকে ৪৫%-এ বাড়ানোর লক্ষ্য স্থির করা হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে রেল পরিবহণে মালগাড়ি সবচেয়ে বেশি উপেক্ষিত অথচ এটি রেলের আয়ের মেরুদণ্ড। ২০১২-১৩ সালে দেশে মালগাড়ির গড়পড়তা গতি ছিল ২৫.১ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টায় যেটা ২০১৯-২০-তে কমে দাঁড়িয়েছে ঘণ্টায় ২৩.৬ কিলোমিটার। কার্যত সড়ক পরিবহণের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ সময় লাগছে এখন রেলে পণ্য পরিবহণে। ফলে রেলপথে পণ্য পরিবহণের গতি বৃদ্ধির লক্ষ্যে এখন আশু প্রয়োজন মালগাড়ী চলাচলের জন্য আলাদা নির্দিষ্ট রেলপথ ‘Dedicated Freight Corridor‘। এটা বোঝা দরকার যে মালগাড়ির গতি দ্রুত বৃদ্ধি করে রেলের আয় না বাড়ালে কার্যত সুলভে আম জনতার ট্রেনযাত্রা অচিরেই বিপন্ন হবে।

প্রয়োজন রেলের রক্ষা ‘কবচ’

দেশজুড়ে গাল ভরা বিজ্ঞাপন চলছে ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া’র। অথচ ট্রেনের সুরক্ষায় উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার চলছে শম্বুক গতিতে। এখন কৃষ্ণপক্ষ-শুক্লপক্ষের বিভিন্ন দিনক্ষণ দেখে ‘তাবিজ-কবজ‘-এ বিশ্বাসী রেলমন্ত্রী কিংবা প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করে চলেছেন 'বন্দে ভারত এক্সপ্রেস'-এর। ট্রেনের গতি যত উচ্চ হবে তত উচ্চগ্রামে পৌঁছাতে পারে যাত্রাপথে বিপদের মাত্রা। সেই নিরিখে উচ্চগতির ট্রেন চলাচলের পথে ট্রেনের সংঘর্ষরোধী প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রয়োজন বাড়ছে প্রতিদিন। অথচ দেশের মোট ৬৭,০০০ কিলোমিটার ট্রেন রুটের কেবল ২% অংশে দুর্ঘটনারোধী রক্ষা কবচের প্রয়োগ হয়েছে। দেশের রেল বাজেটে এই খাতে উল্লেখ করার মতো অর্থ বরাদ্দ করা হয়নি। ট্রেনের দুর্ঘটনা ঠেকাতে উচ্চপ্রযুক্তি রেললাইন, লেভেল ক্রসিং এবং স্টেশন প্লাটফর্মেও প্রয়োগ করতে হবে। ট্রেনের গোটা যাত্রাপথজুড়ে এমন প্রযুক্তি প্রয়োগের কোনো পরিকল্পনা অন্তত সরকারের ব্যয় বরাদ্দ দেখে বোঝা যাচ্ছে না। এর অর্থ দাঁড়ায় মুখে 'ডিজিটাল ইন্ডিয়া'র স্লোগান দিলেও রেলের সুরক্ষায় ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রয়োগ দূর অস্ত। দেশের মানুষের কাছে ‘সেমি-হাই স্পিড‘ চালিয়ে কিংবা আধুনিক ভারতের 'বুলেট ট্রেন'-এর স্বপ্ন ফেরি করে বেড়াচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী অথচ দেশজুড়ে চলা ট্রেন পরিষেবার হাঁড়ির হাল। বালাসোরের ভয়াবহ রেল দুর্ঘটনা সেটাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখাল। কিন্তু সরকার দেখতে পেল কি না তা সময়ই বলবে!