আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ দ্বাদশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ জুন, ২০২৩ ● ১-১৫ আষাঢ়, ১৪৩০

সম্পাদকীয়

ছুটি ছুটি খেলা


একসময় বাংলার স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা ছুটির আগাম খবরে উল্লসিত হয়ে উঠত। বিশেষত গরম বা পুজোর সময় এককালীন লম্বা ছুটির জন্য ছাত্র-ছাত্রীর দল দিন গুণত। মধ্যবিত্ত ঘরে ঘুরতে যাওয়ার তোড়জোড় শুরু হত। নিম্নবিত্ত ঘরে অবশ্য তেমন কোনো আলাদা প্রভাব না পড়লেও অন্তত ছোটদের কাছে ছুটি একটা মুক্ত হাওয়ার মতো ছিল। কিন্তু আজকের সময়ে বাংলায়, বিশেষত সরকার পরিচালিত বা সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলে দীর্ঘ ছুটি ছাত্রজীবনে আনন্দের বদলে যে সবিশেষ দুঃখের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে তা বলাই বাহুল্য। বস্তুত অত্যধিক ছুটির ঠেলায় ছাত্র-ছাত্রীরা নিজেরাই হাঁপিয়ে উঠছে। এ রাজ্যে সরকারি বা সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলে ছুটিটাই আজ দস্তুর। মাঝেমধ্যে সময় পেলে সেখানে পড়াশোনার একটা চেষ্টা চলে বটে, কিন্তু সেই অভ্যাস থিতু হতে না হতেই আবার ছুটির নির্ঘন্ট ঘোষণা হয়ে যায়। চক্রবৎ এই ছুটি ছুটি খেলায় রাজ্যের স্কুলশিক্ষা যে লাটে উঠতে বসেছে সে বিষয়ে সরকারের হুঁশ নেই।

এ রাজ্যে বর্তমানে সরকারি ও সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলগুলোতে গরমের ছুটি চলছে। এই বছর গ্রীষ্মের ছুটি শুরু হওয়ার কথা ছিল ২৪শে মে থেকে। কিন্তু অত্যধিক গরমের কারণে তড়িঘড়ি সরকার ২রা মে থেকে স্কুলে ছুটি ঘোষণা করে দেয়। একমাসের ওপর অতিক্রান্ত। এখনো অবধি সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা স্কুল খুলতে পারে ১৪ই জুন থেকে। যদিও সেই ঘোষণার ভরসা নেই। এর আগে ৫ই জুন স্কুল খুলবে ঘোষণা হওয়ার পরেও আবার গরমের কারণে ছুটি বাড়িয়ে দেওয়া হয়। যদিও এই প্রশ্নের উত্তর মেলে না যে, স্কুলে না এলেই কি ছাত্র-ছাত্রীরা গরমের থেকে সুরক্ষিত থাকবে? দরকারে স্কুলের সময় আগুপিছু করে এই গরমজনিত সমস্যার সমাধান কি করা যেত না? আর যদি আবহাওয়ার স্থায়ী পরিবর্তনে গরম চলতেই থাকে তাহলে কি স্কুলগুলো বরাবর বন্ধই থাকবে? যদিও এইসব প্রশ্নের কোন উত্তর রাজ্যের শিক্ষাদপ্তর, তার মন্ত্রী, শিক্ষাপর্ষদ এমনকি মুখ্যমন্ত্রীর কাছেও নেই। কিন্তু তাঁরা কবেই বা সমস্যার সমাধান খুঁজেছেন। বরং সমস্যার সমাধানের নামে কিছু তাৎক্ষণিক মনোমহিনী ঘোষণা করে নাম কুড়োনোর ধান্দায় আছেন।

যদি এই রাজ্যের সরকার মনেই করেন যে ছাত্র-ছাত্রীদের অত্যধিক গরমে কষ্ট হবে স্কুলে বসে পড়াশোনা চালাতে তাহলে তারা সরকারি স্তর থেকে আগাম পরিকাঠামো গড়ে তুলতে আগ্রহী হচ্ছেন না কেন? সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত স্কুলে এইরকম আপৎকালীন পরিস্থিতি মোকাবিলায় যেই পরিকাঠামোর অভাব আছে তা চিহ্নিত করে সেগুলো পূরণ করার লক্ষ্যে কী পদক্ষেপ তারা গ্রহণ করেছেন? বিগত দুটি অর্থবর্ষে স্কুল শিক্ষায় সরকারি খরচের নমুনা থেকেই এই ধারণা পাওয়া সম্ভব। বাজেট তথ্য বলছে ২০২০-২২ এই দুই বছরে রাজ্যে প্রাথমিক স্কুলগুলির ভবন সংস্কারে খরচ হয়েছে বাজেটের ২০ শতাংশেরও কম। শিক্ষার পরিকাঠামো উন্নয়ন খাতে খরচ হয়েছে বরাদ্দের মোটে ১%। অর্থাৎ পরিকাঠামো নির্মাণে সরকার যে সম্পূর্ণ উদাসীন তা বলাই বাহুল্য। সুতরাং অস্বাভাবিক ক্ষেত্রে কোনো দ্রুত সমাধান স্কুলগুলো নিতে পারেনা। ফলে গরম বাড়ুক বা ঠান্ডা, মহামারী হোক বা বন্যা, সরকারের কাছে শিক্ষাক্ষেত্রের জন্য একটিই সমাধান - ছুটি, ছুটি এবং আরও ছুটি।

এই ছুটি সংস্কৃতির সরাসরি প্রভাব পড়ছে গ্রামীণ অঞ্চলে শিশুদের স্বাস্থ্যের বিকাশে। হাজার সমালোচনা থাকলেও এটি প্রমাণিত যে মিড-ডে মিল, গ্রামের বাচ্চাদের, বিশেষত প্রান্তিক অংশের শিশুদের জন্য এক আশীর্বাদ স্বরূপ। রাজ্যের গ্রামে শিশুদের অপুষ্টির সমস্যার সমাধান কিছুটা হলেও মিড-ডে মিলের মাধ্যমে করা সম্ভব। কিন্তু এই দীর্ঘকালীন ছুটিতে সবার আগে কোপ পড়েছে এই প্রকল্পের ওপরেই। বরং উল্টো প্রশ্নটাই আজ করা চলে যে ঋণের দায়ে জর্জরিত এই পরিকল্পনাহীন সরকার বাঁচার এক রাস্তা হিসাবে মিড-ডে মিলের বরাদ্দ ছাঁটাই করে সাময়িক সুরাহা খুঁজতে চায় আর তার জন্যই স্কুল বন্ধ রাখা হচ্ছে? বাজেটের তথ্য সেই আশঙ্কাই খুঁচিয়ে তোলে। ২০২০-২১ সালে রাজ্য এই খাতে খরচ করে প্রায় ৫২৪ কোটি টাকা সেখানে ২০২১-২২ এই খরচ নেমে আসে ৩৪২ কোটি টাকায়। অর্থাৎ খরচ প্রায় অর্ধেক ছাঁটাই করে ফেলা গেছে। খেয়াল করলে দেখা যাবে তার আগের বছর থেকেই স্কুলে ছুটির হার বেড়েছে। ২০২০-২১ সালে এক দীর্ঘ সময় করোনা মহামারীর অজুহাতে স্কুলগুলো বন্ধ রাখা হয়েছিল। ২০২০-২১-এর ব্যয় তাও তুলনায় বেশী কারণ ২০২১-এ রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনের জন্য অতিরিক্ত মিড-ডে মিলের ঘোষণা করা হয়। ২০১৯-২০-তে এই খাতে খরচ হয় কেবল ১৬৮ কোটি টাকার মত। প্রশ্ন হল এই বছর মিড-ডে মিলের খাতে খরচ কমিয়ে সরকার কোন খাতে খরচ করলেন? নাকি সেই টাকায় শাসকদলের নবজোয়ার অনুষ্ঠিত হল?

এ তো গেল সরাসরি যে ক্ষতি আমরা দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু এই ছুটি ছুটি খেলায় যে এক গভীর রোগ বাংলার শিক্ষাব্যবস্থায় ছড়িয়ে পড়ছে সে বিষয়ে আলোচনা কম। কোভিড মহামারীর সময় এ রাজ্যের সরকারি ও সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলগুলো প্রায় ১ বছর বন্ধ ছিল (যা বিশ্বের অন্য কোন দেশেই ঘটেনি। বস্তুত কোভিডে শিশুদের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কম বলে স্কুলগুলোই বরং খোলা রাখা ছিল উন্নত দেশগুলোতে)। গতবছর রাজ্যের সরকারি স্কুলগুলোতে গ্রীষ্মের ছুটিই ছিল প্রায় ৪৫ দিন। অনলাইন ক্লাসের কথা হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোনো কার্যকরী শিক্ষা এই ব্যবস্থায় দেওয়া যায়নি পরিকাঠামোর অভাবে। অন্যদিকে রাজ্যের বেসরকারি স্কুলগুলো অনেক সময়ই (মহামারীর সময় বাদ দিয়ে) নিজেদের মতো স্কুল খোলা রাখতে পেরেছে। ফলে রাজ্যের ছাত্র-ছাত্রীদের ভেতর একটা স্পষ্ট বিভাজন গড়ে উঠেছে। একদিকে আর্থিকভাবে সম্পন্ন বাড়ির ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য একটি কার্যকরী, নিয়মতান্ত্রিক শিক্ষাব্যবস্থা। অন্যদিকে আর্থিকভাবে দুর্বল ঘরের ছাত্র-ছাত্রী, যাদের উপায় নেই পয়সা দিয়ে শিক্ষা কেনার, তাদের জন্য একটা খামখেয়ালি শিক্ষাব্যবস্থা। এতে যে কেবল তারা সুযোগে পিছিয়ে পড়ছে তাই নয়, গোটা সরকারি স্কুল শিক্ষাব্যবস্থা থেকেই মানুষ মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছে। স্কুলে নতুন ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা কমছে। ফলে রাজ্যের সরকার এ বছর সাড়ে ৬ হাজারের বেশী প্রাথমিক ও ১,৪০০-এর মত উচ্চপ্রাথমিক স্কুল বন্ধ করার কথা ঘোষণা করেছে। এ বছর মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় হ্রাস পেয়েছে। সরকারি স্কুলশিক্ষা যে আজ খাদের কিনারে তা আজ সচেতন মানুষ মাত্রেই বোঝেন।

প্রশ্ন হল, সরকার কি এই বিপদ বুঝছেন না? নাকি তারা আদতেই সরকারি শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করতে চাইছেন? একথা অনস্বীকার্য যে আজও শিক্ষা এক লোভনীয় ব্যবসা। বারেবারে বেসরকারি স্কুলগুলির বিরুদ্ধে অতিরিক্ত বেতন নেওয়ার অভিযোগ ওঠে। সম্প্রতি হাইকোর্ট অবধি বলতে বাধ্য হচ্ছে যে শিক্ষা কেবল মুনাফা লোটার রাস্তা নয়। কিন্তু রাজ্যে সরকারি শিক্ষাব্যবস্থা লাটে উঠলে মানুষ বাধ্য হবেন এইসব বেসরকারি স্কুলের দরজায় যেতে। কিন্তু ততক্ষণই যাওয়া চলে যতক্ষণ এইসব প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা কেনার রেস্ত আছে। ফলে দ্রুতই আবার শিক্ষার অধিকার সঙ্কুচিত হবে। কেবল ধনীর জন্যই থাকবে শিক্ষা। আর দিদিমণি ও দাদামণি সেটাই চান। শিক্ষার ব্যবসা থাকবে তাদের আর্থিক প্রভুদের হাতে। আর বাকি জনতার জন্য হয় ধর্মের বুলি নয়ত রাজনৈতিক নেতার লেজুড়বৃত্তি। আজকের পশ্চিমবঙ্গে সেই সংস্কৃতি বেড়ে উঠছে। নতুন প্রজন্ম যারা শিক্ষার আঙিনা থেকে সরে যাচ্ছে তারাই আজ শাসকদলের তাজা সম্পদ, নয়ত পরিযায়ী শ্রমিক। বিপদ ক্রমেই বাড়ছে। রাজ্যের সচেতন মানুষ, সর্বোপরি শিক্ষকসমাজকে আজকে এই ছুটি ছুটি খেলার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতেই হবে। নয়ত সমাজের অবক্ষয় নিয়ে বিলাপ করা ছাড়া তাঁদের আর কিছুই করার থাকবে না।