আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ দ্বাদশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ জুন, ২০২৩ ● ১-১৫ আষাঢ়, ১৪৩০

সম্পাদকীয়

পরিযায়ী ট্রেন


প্রিয় পাঠক, সপ্তাহের যে-কোনো দিন চলে আসুন শালিমার স্টেশনে। দেখবেন বাস থেকে নেমে অসংখ্য সাধারণ গরীব মানুষ হাতে ব্যাগ নিয়ে ট্রেন ধরার জন্য হুড়োহুড়ি করছে। কোথায় যাচ্ছে তারা? দক্ষিণের কোনো রাজ্যে চলেছে কাজের সন্ধানে। কেউ এসেছে কোচবিহার থেকে, কেউ মুর্শিদাবাদ, কেউ সুন্দরবন, কেউ মেদিনীপুর, ইত্যাদি জেলা থেকে। পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সমস্ত জেলার মানুষকেই আপনি দেখতে পাবেন এই ট্রেনগুলিতে গাদাগাদি করে চড়তে।

এদেরই একটি অংশ বিগত ২ জুন করমণ্ডল এক্সপ্রেসে চেপে চেন্নাইয়ের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিল। সেই ট্রেনটির পরিণতি কী হয়েছে আমরা সবাই জানি। একবিংশ শতাব্দীতে একটি ট্রেন যেই লাইনে সিগন্যাল দেওয়া আছে, সেই লাইনে না গিয়ে পাশের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা মালগাড়িতে ধাক্কা মেরে লাইনচ্যুত হল। প্রাণ হারালেন ২৮৮ জন মানুষ, যাদের মধ্যে ১০০ জনের বেশি পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা। রুটিরুজির খোঁজে রাজ্য থেকে কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরে যেতে গিয়ে প্রাণ হারালেন পশ্চিমবঙ্গের বহু মানুষ।

কিন্তু এত মানুষ পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রতিদিন বিভিন্ন রাজ্যে কাজের সন্ধানে চলে যাচ্ছেন কেন? উত্তরটি সহজ। রাজ্যে কর্মসংস্থানের প্রভূত অভাব রয়েছে। বিগত বহু বছর ধরে রাজ্যে শিল্পের আকাল চলছে। কেন্দ্রীয় সরকারের পরিসংখ্যান জানাচ্ছে ২০২১ সালে রাজ্যে মোট বাস্তবায়িত বিনিয়োগের পরিমাণ ১,৯৬৭ কোটি টাকা, যা ২০২২ সালে বেড়ে হয়েছে ৩,৭৩৫ কোটি টাকা। এই দুই বছরে তামিলনাডুতে বিনিয়োগ হয়েছে যথাক্রমে ১৩,৬৪৬ কোটি টাকা এবং ৯,২৬৮ কোটি টাকা। মহারাষ্ট্রে বিনিয়োগের পরিমাণ যথাক্রমে ৪৫,৮৫৫ এবং ৩৫,৬৭৫ কোটি টাকা। পাশের রাজ্য ওডিশাতে বিনিয়োগের পরিমাণ যথাক্রমে ৮৯,১৬৭ এবং ৩৭,২৬৬ কোটি টাকা। এই দুই বছরে দেশের সমস্ত রাজ্যের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় সর্বনিম্ন। বিনিয়োগ হলেই যে প্রচুর কর্মসংস্থান তৈরি হবে তা নাও হতে পারে। কিন্তু বিনিয়োগ না হলে যে কর্মসংস্থান তৈরি হবে না, তা বলাই যায়। রাজ্যে বিনিয়োগের খরা চলছে। ফলত, রাজ্যের খেটে খাওয়া মানুষকে পাড়ি দিতে হচ্ছে ভিন রাজ্যে কাজের আশায়।

কেউ বলতেই পারেন, শিল্পে বিনিয়োগ না হলেও সমস্যা থাকার কথা নয় যদি রাজ্যে কৃষিতে কর্মসংস্থান এবং আয় বাড়ে। চাষিদের আয় বাড়ানো নিয়ে প্রচুর দাবি রাজনৈতিক নেতারা করে থাকেন। কিন্তু প্রকৃত চিত্র কী? কেন্দ্রীয় নমুনা সমীক্ষার ২০১৯ সালের রিপোর্ট থেকে দেখা যাচ্ছে যে পশ্চিমবঙ্গের কৃষিতে কর্মরত পরিবারের মাসিক আয় ৬,৭৬২ টাকা, যার মধ্যে ফসল ফলিয়ে আয়ের পরিমাণ মাত্র ১,৫৪৭ টাকা। ওডিশা এবং ঝাড়খন্ডকে বাদ দিলে পশ্চিমবঙ্গের গড় কৃষকের আয় দেশের মধ্যে সর্বনিম্ন। ৬,৭৬২ টাকায় সংসার চালানো সম্ভব নয়। অন্যদিকে, এই রিপোর্ট থেকেই জানা যাচ্ছে যে রাজ্যের ৯২ শতাংশ চাষি আসলে প্রান্তিক কৃষক। তাই সব মিলিয়ে বলা যেতে পারে যে কৃষিকাজের মাধ্যমে একটি পরিবারের ব্যয়ভার বহন করা আর সম্ভব হচ্ছে না। অতএব কৃষি ছেড়ে বেড়িয়ে আসার প্রবণতা বাড়তে বাধ্য। কিন্তু কৃষিকাজ থেকে বেরিয়ে রাজ্যের অকৃষিকাজে নিযুক্ত হতে পারছে না অধিকাংশ মানুষ, কারণ শিল্পের অভাব। অতএব, রাজ্যের বাইরে যেতে হচ্ছে অধিক টাকার আশায়। চড়তে হচ্ছে ভিড়ে ঠাসা জেনারেল কম্পার্টমেন্টে - আশা এটাই ট্রেন যাত্রার কষ্ট লাঘব হবে গন্তব্যে পৌঁছিয়ে অধিক রোজগারের মাধ্যমে। কিন্তু ২ জুন ট্রেন গন্তব্যে পৌঁছায়নি। বহু মানুষ চাকরির আশায় বেরিয়ে মৃত্যুবরণ করলেন।

কিন্তু শুধুমাত্র পরিযায়ী শ্রমিক নয়। ওই ট্রেনে সফর করতে হয় বহু মানুষকে যারা চিকিৎসার আশায় পাড়ি দেন দক্ষিণের রাজ্যগুলিতে। কঠিন রোগের চিকিৎসা পশ্চিমবঙ্গে হয় না, এমন নয়। কিন্তু সরকারী হাসপাতালের পরিকাঠামোর যা অবস্থা তাতে বহু মানুষ চিকিৎসার সুযোগ পান না। অসাধারণ ডাক্তার-রা সেখানে আছেন, তবু রোগীর চাপ এত বেশি যে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার সুযোগ হয় না বহু মানুষের। অন্যদিকে রাজ্যে যে বেসরকারী হাসপাতালগুলি আছে তারা মানুষের অসহায়তার সুযোগ নিয়ে যথেচ্ছাচার করে। লক্ষ লক্ষ টাকার বিল দিয়ে সর্বস্বান্ত হতে হয়ে মানুষকে। তাই ঢল নামে দক্ষিণের দিকে। সেই রোগীরা সঠিক পরিষেবা এবং পরিকাঠামো পেলে দক্ষিণের উদ্দেশ্যে যাত্রা করতেন না। কিন্তু করতে হয়। এবং ট্রেন বেলাইন হলে রোগে নয়, মরতে হয় ট্রেনের বগির নিচে।

এই যে বহু মানুষ এই ট্রেনে যাত্রা করতে গিয়ে প্রাণ দিলেন, তাদের নামগুলোর দিকে তাকালে রাজ্যের আরেকটি সমস্যার দিক উঠে আসবে। হারান গায়েন, নিশিকান্ত গায়েন, দিবাকর গায়েন - তিন ভাইয়ের বাড়ি বাসন্তীতে। তিনজনেই এই ট্রেন দুর্ঘটনায় মৃত। মাসরেকুল হক, শেখ মুন্না, পিনাকী মণ্ডল, শেখ ইয়াদ আলি ইত্যাদি মানুষ মৃত। অধিকাংশ মৃত এবং আহত ব্যক্তি হয় তফশিলী জাতি বা তফশিলী উপজাতি অথবা মুসলমান অথবা ওবিসি সম্প্রদায়ের মানুষ। সামাজিকভাবে বঞ্চিত এবং প্রান্তিক মানুষগুলিই চলেছেন পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে কাজের আশায়। পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যার অধিকাংশ এই শ্রেণির মানুষ। কিন্তু সমাজের তথাকথিত সম্মানীয় চাকরি (ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-অধ্যাপক-উকিল) ইত্যাদিতে তাদের প্রতিনিধিত্ব প্রায় নেই। কিন্তু পরিযায়ী শ্রমিকদের দলে তারা বিপুলভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ। যারা মনে করেন শুধু শ্রেণিগত বিভাজনই একমাত্র বিভাজন তারা বুঝতে পারেন না যে ভারতের রাজনীতিতে শ্রেণি এবং তথাকথিত নিম্নজাতির লড়াই একই সূত্রে বাঁধা।

এই মানুষগুলির জন্য রাজনৈতিক নেতাদের যেন চিন্তার শেষ নেই। সবাই গরীব দরদী, সবাই প্রান্তিক মানুষের পক্ষে। তবু বছরের পর বছর চলে যায়, কিন্তু এই মানুষদের জীবনে কোনো পরিবর্তন হয় না। কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, রুটি-রুজির নিশ্চয়তা নিয়ে বিতর্ক রাজ্য রাজনীতি থেকে বিদায় নিয়েছে বিগত দশ বছরে। খবরের কাগজ খুললেই দেখা যাবে কোনো নেতা আবারও ঘুষ নিতে গিয়ে ধরা পড়েছেন, কোনো মন্ত্রী বা তৃণমূলের মাস্তান জেলে গেছে, দিদি আবার কোনো একুশে আইন জারি করেছেন ইত্যাদি। অথবা দেখা যাবে রাম-রহিমের লড়াইয়ের কাহিনি। রামনবমী, হনুমান জয়ন্তীর মিছিল ঢুকে যেতে চাইবে কোনো মসজিদে। ফেসবুকে কেউ বিদ্বেষ ছড়িয়ে দাঙ্গা লাগানোর উপক্রম করেছে ইত্যাদি খবরের ভিড়ে কোথায় আর সময় হয় গ্রামের মানুষ কেমন আছে তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার। যাদের এইসব নিয়ে প্রশ্ন তোলার কথা ছিল এবং আন্দোলন করার কথা ছিল সেই বামপন্থীদের শক্তি হ্রাস পেয়েছে। রাজ্য রাজনীতিতে গরীব মানুষের কথা আর প্রায় নেই বললেই চলে।

পড়ে রয়েছে শুধু তাদের জন্য মেকি দরদ এবং প্রচুর তথাকথিত উন্নয়নের প্রকল্প। লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, কন্যাশ্রী, স্বাস্থ্যসাথী ইত্যাদি বহুধা প্রকল্পের নাম রাজ্যের মানুষ জেনে গিয়েছেন। কিন্তু এই প্রকল্পগুলির মাধ্যমে যে মানুষের মৌলিক সমস্যার সমাধান হবে না, সেই কথা বলার মত লোকের সংখ্যাও কমছে। প্রকল্পের ভিড়ে হারিয়ে গিয়েছে মানুষের রুটি-রুজির মৌলিক সমস্যাগুলি।

এই সমস্যা নিরসনের জন্য যে লড়াই আন্দোলনের প্রয়োজন তা আর দেখা যায় না বললেই চলে। খবরের কাগজ থেকে ইতিমধ্যেই সরে গেছে করমণ্ডলের দুর্ঘটনার খবর। তবু রোজ শালিমার এবং অন্যান্য স্টেশন থেকে ট্রেনে চেপে হাজারো যুবক রাজ্যের বাইরে চলেছে কাজের সন্ধানে। তাদের খবর আবার পাবেন পরবর্তী ট্রেন দুর্ঘটনার পরে।