আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ একাদশ সংখ্যা ● ১-১৫ জুন, ২০২৩ ● ১৬-৩১ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩০

প্রবন্ধ

হুতোম প্যাঁচার নকশাঃ একটি বহুমুখী পাঠ

গার্গী সরকার


উনিশ শতকের শ্রেষ্ঠ নকশাটির নাম ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’। লেখক কালীপ্রসন্ন সিংহ। প্রকাশকাল ১৮৬২। উনিশ শতকের নগর কলকাতার অসঙ্গতির ‘আর্কেটাইপ’কে তুলে ধরেছে নগর কলকাতারই কথ্য ভাষার কাছাকাছি ভাষায়। আর এই হুতোম প্যাঁচার নকশার সটীক সংস্করণের ভূমিকাতে অরুণ নাগ যে কথাটি লিখেছিলেন তা বিশেষভাবে নজর করবার মতো -
শহর কলকাতার উনিশ শতকীয় বাঙালি সমাজ সম্পর্কে জানতে হলে ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’ অবশ্যপাঠ্য। উনিশ শতক, কলকাতা এবং বাঙালিয়ানা, তিনটিই হুতোমের নকশার অপরিহার্য চরিত্রলক্ষণ। [১]



শুধু তাই নয় এ কাহিনির ইতিহাসপট জুড়ে আছে কোম্পানির বাংলা দখল, কলকাতার গড়ে ওঠা, নন্দকুমারের ফাঁসি, মানসিংহ, জগত শেঠ, প্রতাপচাঁদ, মিউটিনির মতো বিষয়। বস্তুত ইতিহাস-সমাজ-সংস্কৃতি-সাহিত্য এই বহুমুখী অন্বেষণের ভিতর দিয়েই আমরা খুঁজে দেখব ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’কে।

এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে একটি সাহিত্যের টেক্সটকে পড়বার জন্য কেন ইতিহাস পটভূমিকে বুঝতে হবে, কেন বিশ্লেষণ করতে হবে সময়ের ধারাবাহিক ক্রমবিকাশ, আর কেনই বা ইতিহাস-সমাজ-সাহিত্যের পারস্পরিক যাতায়াতের মধ্যে দিয়ে গড়ে তুলতে হবে বিদ্যাচর্চার নতুন পরিসর?

উনিশ শতক ইংরেজের সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্য বিস্তারের সময়। ১৬৯০-এর ২৪ অগাস্ট পাকাপাকিভাবে বাণিজ্য বিস্তারের লক্ষ্য নিয়ে সুতানুটি পৌঁছলেন জব চার্ণক। সেখান থেকে ঔপনিবেশিক কলকাতার নির্মাণ শুরু। ইংরেজদের সুতানুটি-গোবিন্দপুর-কলকাতার জমিদারি কেনা, পলাশীর যুদ্ধ জয়, দেওয়ানী ও ফৌজদারি অধিকার লাভের ভিতর দিয়ে শুরু হল তাদের আধিপত্য। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত দেশীয় জমিদারদের ভূমিচ্যুত করলো। পরিবর্তে ইংরেজদের সাহায্যকারী এবং একই সঙ্গে তাদের দ্বারা অনুগৃহীত ও পুষ্ট হয়ে গড়ে উঠল দেওয়ানী, বেনিয়ানি, মুৎসুদ্দি বৃত্তিধারী এক শ্রেণি। এরা হল কলকাতার প্রথম প্রজন্মের বাবু। কালের বিস্তারে যাদের বহু রকমফের। এবার প্রশ্ন উঠবে এই দীর্ঘ ইতিহাসপট জানার কী দরকার। উত্তর হল, আমাদের আলোচ্য নকশা যে শ্রেণিকে ব্যঙ্গ করছে, কলমের আঁচড়ে যাকে তুলে ধরছে সেই-ই তো বাবু। তাই ইতিহাস চর্চা ব্যতিরেকে উনিশের সাহিত্য চর্চা অসম্পূর্ণ।

হুতোম লিখছেন -
নবাবী আমল শীতকালের সূর্যের মতো অস্ত গ্যালো। মেঘান্তের রৌদ্রের মত ইংরেজদের প্রতাপ বেড়ে উঠলো। বড় বড় বাঁশঝাড় সমূলে উচ্ছন্ন হলো।... নব মুনশি, ছিরে বেণে ও পুঁটে তেলি রাজা হল। সেপাই পাহারা, আসা সোটা ও রাজা খেতাপ ইন্ডিয়া রবারের জুতো ও শান্তিপুরের ডুরে উড়ুনির মতো ...গড়াগড়ি খেতে লাগলো। কৃষ্ণচন্দ্র, রাজবল্লভ, মানসিংহ, নন্দকুমার, জগত শেঠ প্রভৃতি বড় বড় ঘর উৎসন্ন যেতে লাগলো।... হাফ-আখড়াই, ফুল আখড়াই, পাঁচালি ও যাত্রার দলেরা জন্মগ্রহণ কল্লে। ...টাকা বংশ গৌরব ছাপিয়ে উঠলেন। [২]

সামন্ততন্ত্র থেকে পুঁজির যাত্রা বা সোশ্যাল শিফটিংকে বুঝতে গেলে ইতিহাস পাঠ ও সমাজ চর্চা জরুরি সাহিত্য বিচারের ক্ষেত্রেও।

আমরা বলতে বসেছি ঔপনিবেশিক নগর কলকাতার ছবি সাহিত্যে কীভাবে প্রতিফলিত হয় তার কথা। রাষ্ট্রনৈতিক প্রভুত্ব কায়েমই কেবল ঔপনিবেশিকতার বিস্তার ঘটায় না। ঔপনিবেশিকতা আসলে শাসক ও শাসিতের যৌথ বয়ান। শাসক দখল করতে চায় পরাধীন জাতির সমগ্র সত্তাকে - তার সংস্কৃতি, জীবনযাপন প্রণালী, রীতিনীতিকে। এহেন সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদের মধ্যদিয়ে শাসক চায় শাসিতের অন্যতা বা নিজস্বতাগুলোকে ধ্বংস করতে। আর এখান থেকেই আসে ‘মিমিক্রি’ বা ‘অনুকরণপ্রিয়তা’। ইংরেজদের বৃহত্তর উপনিবেশটির নাম ভারতবর্ষ। যার তৎকালীন রাজধানী কলকাতা। যে কলকাতার রক্ত-মাংস-মজ্জা থেকে জন্ম নিয়েছিল ঔপনিবেশিকতার সন্তান 'বাবু'। ফলে হুতোমের বাবুদের চরিত্র বুঝতে গেলে ইতিহাস চর্চার অঙ্গীভূত ‘কলোনিয়ালিজম’ থিয়োরিকে জানতেই হবে।

ঔপনিবেশিকতার প্রথম প্রহরে জন্ম নিয়েছিল বাবুরা। যাদের উদ্ভব -
কিন্তু আঠারো শতকের মধ্যভাগেই কলকাতায়... এমন এক দল ভুঁইফোঁড়ের আবির্ভাব ঘটল যারা বাণিজ্যে প্রভুত্বকামী ইংরেজ কোম্পানির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সংশ্লিষ্ট, কুলবহির্ভূত বৃত্তি ও কর্মের মাধ্যমে অর্জিত বিত্তের অধিকারী, ক্ষমতায় ও প্রতিপত্তিতে সীমাহীন, বণিক রাজশক্তির দেশীয় প্রতিভূ। এরা ব্রাহ্মণ হয়েও বেনিয়া, কায়স্থ হয়েও ব্যবসায়ী, শূদ্র হয়েও সামাজিক প্রভুত্বকামী, মহাশয় না হয়েও মহাশয়ত্বের দাবিদার। ...ব্যক্তিগতভাবে দেওয়ান, বেনিয়ান, মুনশি, ইয়াদি রূপে পরিচিতি লাভ করতে করতে শ্রেণী হিসেবে এরা আখ্যাত হলেন বাবু নামে। [৩]

এরাই আছেন হুতোমের নকশায়। আদিবাবু বলতে হুতোম বাবুদের প্রপিতামহকে বুঝিয়েছেন যারা কোম্পানির বাংলা দখলের কিছু পরে, নন্দকুমারের ফাঁসি হবার কিছু আগে দেওয়ানী কর্মে লিপ্ত ছিলেন। মাত্র পাঁচ বছর কাজ করেই মৃত্যুকালে বিশ লক্ষ টাকা রেখে যেতে পারতেন। এই সময় থেকেই বাবুরা বড় মানুষ।

ঔপনিবেশিকতার অনিবার্য লক্ষণ অনুকরণপ্রিয়তা। বাবুরা দেখেছিল কোম্পানির কর্মচারীদের বিপুল বিলাস ব্যসনের মধ্যে দিন কাটাতে। ইংরেজ কবলানো এক পুরুষে বড়লোক বাবুদেরও সাধ জাগে বিলাসের। হুতোম লিখছেন -

ক) ...মা দুর্গার শেতলের জলপান ও অন্যান্য সরঞ্জাম সেই সময় দালানে সাজিয়ে দেওয়া হল - মা দুর্গা যত খান বা না খান, লোকে দেখে প্রশংসা কল্লেই বাবুর দশ টাকা খরচের সার্থকতা হবে। [৪]

খ) ...বাবু জরি ও কালাবৎ এবং নানাবিধ জড়োয়া গহনায় ভূষিত হয়ে ঠিক একটি ‘ইজিপশন মমি’ সেজে মজলিসে বার দিলেন। [৫]

ঔপনিবেশিকতার লক্ষণ শাসিতের নিজস্বতাকে ধ্বংস করতে চাওয়া। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের নব্যবাবুদের পোশাকের মধ্যে এই দিকটি বিশেষভাবে প্রতীয়মান -
বাবুর একটি কাল বনাতের পেন্টেলুন ও চাপকান পরা ছিল, তার ওপর অ্যাকটা নীল মেরিনোর চাইনা কোট, মাথায় অ্যাকটা বিলিতি ওকের গাঁট বাই করা কেঁদো কোঁতকা। এতদ্ভিন্ন বাবুর সঙ্গে একটি ওয়াচ ছিল, তার নিদর্শন স্বরূপ একটি ওয়াচ ছিল, তার নিদর্শন স্বরূপ একটি চাবি ও দুটি শিল চুলের গার্ড চেনে ঝুলচে, হাতের আঙ্গুলে একটি আংটীও পরা ছিল... [৬]

মনে পড়বে হুতোমের অসাধারণ ব্যঙ্গবিদ্ধ এই অংশটি যেখানে ইংরেজদের অন্ধ অনুসরণকারী বাবুরা বস্তুগত দ্রব্য ব্যবহার বা আচরণগত বৈশিষ্ট্য - সবেতেই মিমিক্রির ধ্বজাধারী। এহেন ইংরেজি কেতার বাবুরা -
প্রথম দল উঁচুকেতা সাহেবের গোবরের বসট... প্রথম দলের সকলি ইংরাজি কেতা, টেবিল চেয়ারের মজলিস, পেয়ালা করা চা, চুরুট... হরকরা, ইংলিশ ম্যান ও ফিনিক্স সামনে থাকে,... টেবিলে খান, কমোডে হাগেন এবং কাগজে পোঁদ পোঁচেন...। [৭]

উনিশ শতকের নগর কলকাতাকে দু'ভাগে ভাগ করেছিলেন সুমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়। একদিকে চিন্তাচর্চার জগতে রামমোহন-বিদ্যাসাগর-মধুসূদন, আর অন্যদিকে চিত্ত বিনোদনের জগতে বাবুদের দল - এই দু'য়ে মিলেই উনিশ শতকের বিচিত্র বৈপরীত্যের পৃথিবী। কালীপ্রসন্ন বলতে বসেছেন উনিশ শতকের বিলাস ব্যাভিচারে দীর্ণ বাবুদের কথা। সেখানে একদিকে যেমন থাকে ‘বাবু পদ্মলোচন দত্ত’ ওরফে ‘হঠাৎ অবতার’-এর কথা। যিনি ১৭৯৩ থেকে ১৮৭০ সালের জীবনে এক অর্বাচীন অখ্যাত গ্রাম থেকে উঠে এসে উমেদারি, মুৎসুদ্দিগিরি, ছেলের বিয়েতে পাঁচ লক্ষ টাকা ব্যয়, বারাঙ্গনা রাখার ভিতর দিয়ে একপুরুষে বড়লোক বাবু হয়ে উঠেছিলেন তার বৃত্তান্ত। অন্যদিকে আবার এদেরই পরবর্তী প্রজন্ম নববাবু হয়ে কীভাবে উপার্জনহীন অবস্থাতেও সীমাহীন বিলাস ব্যাভিচারের স্রোতে গা ভাসিয়েছিল সেই সামাজিক ছবিও ফুটে ওঠে হুতোমের জবানিতে। মাহেশের স্নানযাত্রার দিনে ফুর্তি করতে এসে গুরুদাস মেয়েমানুষের ব্যবস্থা করতে না পেরে নিজের বিধবা পিসিকে বারাঙ্গনা সাজিয়ে নৌকোয় তুলতে চায়। এমনকী পিসিও আমোদের টানে রাজি হয়ে যান। নবজাগরণের আলোকোজ্জ্বল উনিশ শতকের বাইরেও যে আরও একটি সমাজ বাস করছিল তার হদিশ পেতে গেলে আমাদের এই কালচারাল টেক্সটটির কাছে আসতেই হবে।

'বঙ্গদর্শন' পত্রিকা প্রকাশের সময় বঙ্কিমচন্দ্র সাহিত্যের উদ্দেশ্য নির্দেশ করতে গিয়ে কেবল সৌন্দর্যসাধনেই থেমে থাকেননি। তাঁকে বলতে হয়েছিল চিত্তশুদ্ধিজননের কথাও। অন্যদিকে নকশা তার জন্মসূত্রেই সমাজ সম্পৃক্ত। সমাজ শিক্ষাদান বা সমাজ সংশোধনের তাগিদ থেকেই নকশার উদ্ভব। বাংলা নকশার ক্ষেত্রে যার মূলে আছে জাতির জীবনের একটি সন্ধিক্ষণের বিক্ষোভ - প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের জীবন ও সংস্কৃতির দ্বন্দ্ববোধ। সাহিত্য যখন সমাজের আয়না তখন তা কেবল নন্দনতাত্ত্বিক বা অপ্রয়োজনের আনন্দ উপাদান হিসেবেই সীমাবদ্ধ থাকেনা। ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে আদিবাবু হঠাৎবাবু থেকে নববাবু নব্যবাবু কেরানিবাবু হয়ে ছুতোরবাবু পর্যন্ত বিস্তৃত যে বাবুত্বের পরম্পরা সেখানে সাহিত্য ইতিহাস সমাজ মিশে আছে। হুতোমের তৈরি নিজস্ব ভাষাশৈলী যেখানে বাংলা ভাষা চর্চাকে নতুন পথ দেখাচ্ছে, নকশার কোনো কোনো অংশ হয়ে উঠছে ছোটগল্পের অস্ফুট কিম্বা ভাঙ্গা রূপ সেখানে একই সঙ্গে ইতিহাসের যাত্রাপথে সমাজের বাস্তব ছবিও ফুটে উঠছে। সামন্ততন্ত্র থেকে পুঁজিবাদের দিকে যাত্রার আগামী প্রবণতাকে স্পষ্ট করে 'হুতোম প্যাঁচার নকশা'। আবার এটাও ঠিক সাহিত্যিক নিদর্শন হিসেবে হুতোমের নকশা সমাজকে এতটাই প্রভাবিত করেছিল যে হুতোম পরবর্তী সময়ে এজাতীয় নকশা ও প্রহসন রচনার একটি ধারাই বাংলা সাহিত্যে তৈরি হয়ে গেল। বস্তুত, এভাবেই একটি লিটারারি টেক্সট তার বহুমুখী উপাদানে কালচারাল টেক্সট হয়ে ওঠে। ইতিহাস-সমাজ-সাহিত্যের ত্রিবেণী সঙ্গমে বিদ্যাচর্চার নতুন পরিসর উন্মুক্ত হয়। ইন্টারডিসিপ্লিনারি পাঠ আধুনিক বিদ্যাচর্চার বিষয় হলেও বাংলা সাহিত্য তার ভাণ্ডারে দুই শতাব্দী আগে থেকেই বহুত্ববাদী পাঠের জানালা খোলা রেখেছিল। যার অন্যতম প্রমাণ কালীপ্রসন্ন সিংহ-র ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’।


তথ্যসূত্রঃ

১। ভূমিকা, অরুণ নাগ, সটীক হুতোম প্যাঁচার নকশা, সম্পাদনা অরুণ নাগ, আনন্দ, কলকাতা, ২০১০, পৃষ্ঠা ৯।
২। কালীপ্রসন্ন সিংহ, হুতোম প্যাঁচার নকশা, অরুণ নাগ (সম্পাদিত), সটীক হুতোম প্যাঁচার নকশা, আনন্দ, কলকাতা, ২০১০, পৃষ্ঠা ৬৫।
৩। অবন্তীকুমার সান্যাল, বাবুর বংশবিচার, এক্ষণ পত্রিকা, কলকাতা, শারদীয় ১৩৮৩, পৃষ্ঠা ৮-৯।
৪। কালীপ্রসন্ন সিংহ, হুতোম প্যাঁচার নকশা, অরুণ নাগ (সম্পাদিত), সটীক হুতোম প্যাঁচার নকশা, আনন্দ, কলকাতা, ২০১০, পৃষ্ঠা ১৫২।
৫। তদেব, পৃষ্ঠা ১৫৪।
৬। তদেব, পৃষ্ঠা ১৬৮।
৭। তদেব, পৃষ্ঠা ৫০-৫১।