আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ একাদশ সংখ্যা ● ১-১৫ জুন, ২০২৩ ● ১৬-৩১ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩০

প্রবন্ধ

চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যের সেকাল ও একাল

প্রতীশ ভৌমিক


স্বাধীনতার পরে সারা দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা অত্যন্ত ধীর গতিতে শুরু হলেও পশ্চিমবঙ্গে অনেকগুলো মেডিক্যাল কলেজ, হাসপাতাল তৈরি হয়েছিল তার আগেই। ১৯৭০ পরবর্তী সময়ে গ্রামাঞ্চলে স্বাস্থ্য ও কল্যাণ দপ্তরের যথেষ্ট অগ্রগতি ঘটেছিল। বামফ্রন্টের সময়ে বিভিন্ন জেলায় গ্রামভিত্তিক হেল্থ সেন্টারগুলো গড়ে উঠেছিল। তখন থেকেই মানুষের জন্য বিনামূল্যে ওষুধ এবং চিকিৎসা সরঞ্জামের ব্যবস্থা করা হয়েছে। চাকরিসূত্রে চিকিৎসকের স্থায়ী কর্মস্থলই চিকিৎসকের স্থায়ী বাসস্থানে পরিণত হতো। দিন-রাতের ফারাক থাকতো না। এখনকার মতো এতো পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থাও ছিল না, বরঞ্চ চিকিৎসকের ক্লিনিক্যাল আই এবং বেসিক থাম্বরুল ব্যবহার করেই রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা করা হতো। এভাবেই হাজার হাজার রোগী প্রান্তিক অঞ্চলেই প্রাথমিক স্তরে চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে যেতেন। হাসপাতালের হোক বা অঞ্চলের চিকিৎসকই হোক, একথা সত্যি যে চিকিৎসক ও তার রোগীর মধ্যে ছিল পরিবার ও অভিভাবকের মতো সম্পর্ক। এলাকায় বিভিন্ন পরিবারের প্রতিটি মানুষের নাম জানতেন তাঁরা, খুঁটিনাটি বিভিন্ন শারীরিক সমস্যার কথাও জানতেন। ঐ সম্পর্কটা ছিল আত্মীয়তার। চিকিৎসকের উপর মানুষের আস্থা ছিল, ভরসা ছিল। রাতবিরেতে অসুখের খবর এলে চিকিৎসকেরা তখন ব্যাগে করে ডেকাড্রন, ডেরিফাইলিন, কোরামিন নিয়ে ছুটে যেতেন মানুষের প্রাণ বাঁচাতে। কিন্তু যেদিন চিকিৎসকের উপর মানুষের ঐ ভরসাটুকুও চলে গেল, সেদিন থেকেই চিকিৎসকের ব্যাগে ঐসব জীবনদায়ী ওষুধ রাখা বন্ধ হয়ে গেল। জরুরী চিকিৎসার জন্যে এখন সব চিকিৎসকই রোগীকে হাসপাতালে পাঠায়। সেকারণেই এখন জরুরি চিকিৎসা হয় নার্সিংহোমে, কর্পোরেট হাসপাতালে। বিভিন্ন পরীক্ষা, জীবনদায়ী প্রয়োজনীয় ওষুধ ট্রেপটোকাইনেজ-এর মতো ওষুধের আকাল, আর পাওয়া গেলেও তা অনেক বেশি দাম দিয়ে কিনতে হয়।

এই 'প্রফেশনাল সিস্টেমে' স্বাস্থ্য পরিষেবা পয়সা দিয়েই কিনতে হয়। সর্বত্রই শুধু ব্যবসায়ীক স্বার্থে লাভের অঙ্কটাই দেখা হয়। কর্পোরেট স্বাস্থ্য পরিষেবায় কমিশন আছে, তার বিরুদ্ধে চিকিৎসকদের বিরোধীতা আছে, প্রতিবাদ আছে। পাশাপাশি আবার রোগীর জন্য একটা ডিসকাউন্টের ব্যবস্থাও আছে, অর্থাৎ দাম বাড়িয়ে কিছুটা কমিয়ে সান্ত্বনার ব্যবস্থা করা হয়। ঝাঁ চকচকে কর্পোরেটের রূপে মুগ্ধ জনগণের ৭ দিনে চিকিৎসা শেষেও হাসপাতাল ছাড়ে না অর্থাৎ চিকিৎসকের উপর চাপ তৈরি করে নার্সিংহোম কর্তৃপক্ষ চায় আরো ৭ দিন, সঙ্গে পরীক্ষা-নিরীক্ষার শেষে বাড়ি ফেরার অনুমতি। জনসেবা আর কর্পোরেট সেবা কখনও এক হতে পারে না, কিন্তু প্রাইভেট নার্সিংহোমে চিকিৎসার জন্য বহু মানুষের জমা টাকার সবটুকুই প্রায় শেষ হয়ে যায়। মধ্যেবিত্তের একটা উপরের অংশ যদিও এতেই অত্যন্ত বিগলিত। তাদের কাছে সম্পূর্ণ চিকিৎসা, পরিষেবা, পরিবেশে, চিকিৎসার যত্ন - এইসব নিয়েই তারা আনন্দ-সুখে বিভোর। কতো দামের এ্যান্টিবাইওটিক কতদিন চললো, এসবের জন্যও ফারাক পড়ে। চিকিৎসকদেরকেও তেমনভাবেই বুঝেশুনে ওষুধ লিখতে হয়। এখন সময় বদলেছে, মিডিয়ার প্রচারে অতি উৎসাহী জনগণ নিজে থেকেই বলে, স্বাস্থ্য নিয়ে সব দায়িত্ব কি সরকারের? তাদের কথায় কর্পোরেট হাসপাতালে সুচিকিৎসার দাম তো দিতে হবে। সার্বজনীন চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রয়োগ না হলে মানুষের নিজস্ব অধিকার সম্পর্কেই উপলব্ধি হয়না।

এ প্রসঙ্গে আরও বলা প্রয়োজন যে ন্যূনতম পরিকাঠামো না থাকার কারণে করোনার সময়ে আমরা রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কঙ্কালসার অবস্থা দেখেছিলাম। বেড নেই, সিলিন্ডার নেই, অক্সিজেন নেই, ওষুধ নেই, ডাক্তার নেই, নার্স নেই, কোভিড পরীক্ষার কিট নেই, ভ্যাক্সিন নেই, শুধু নেই আর নেই। এখনও ঠিক তাই, সরকারি হাসপাতালের দৈন্য দশা দেখে জনগণ আঁৎকে উঠছে।

দেশের প্রায় ৭০% মানুষের ক্রয়ক্ষমতা যখন তলানিতে, সেখানে রাজ্যের সরকার তার প্রাথমিক স্বাস্থ্য ক্লিনিকগুলোতে অতি দ্রুততার সঙ্গে প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ সামগ্রী, পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা, ওষুধ সহ অন্যান্য ব্যবস্থা ও স্থায়ী চিকিৎসক নার্সের মাধ্যমে দিন-রাতের ন্যূনতম পরিষেবা দেবে এটুকু অন্তত আশা করা যায়। প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের প্রয়োজন মেটাতে উদ্যোগী হবে এটাই তো স্বাভাবিক। তবেই না সরকার মানুষের এই অসহায় অবস্থা থেকে মুক্তি দিতে পারে, সেজন্য অবশ্যই সরকারের সদিচ্ছার প্রয়োজন হয়।

আর ওষুধের কথা বলতে গেলে বলতে হয় যে শুরুতে আমাদের দেশের ওষুধ বলতে বেশিরভাগই বিদেশি কোম্পানির ওষুধ ছিল। কিন্তু রাষ্ট্রায়ত্ব ওষুধ কোম্পানিগুলো গড়ে ওঠার সাথে সাথেই ছবিটা বদলে গিয়েছিল। প্রতিযোগিতার কারণে, ওষুধের দাম কমে যাওয়ার জন্যই মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যেই এসেছিল। সে সময়ের অনেক উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন এবং সস্তা ওষুধের বাজার ক্রমে ক্রমে দামী ওষুধের দ্বারা পরিবর্তিত হতে থাকল, বদলে যেতে থাকল বাজার। এর পিছনে যদি মূল কারণ খুঁজতে হয় তা হলো গ্লোবালাইজেশন। বিদেশি কোম্পানিগুলো ১০০% পর্যন্ত (এফডিআই)-এর সুযোগ নিয়ে প্রয়োজনীয়, অপ্রয়োজনীয় সমস্ত ওষুধের সম্ভার নিয়ে হাজির হয়েছিল। প্রচারের অভাবে সস্তা ও প্রয়োজনীয় ওষুধগুলো তখন পিছনের আসনে। ক্রমশই রাষ্ট্রায়ত্ব ওষুধ সংস্থাগুলোকে রুগ্ন করে দখল নিল বহুজাতিক সংস্থাগুলো। কোম্পানি কেনাবেচার ফলে তাদের নিয়ন্ত্রণেই এলো ওষুধের রমরমা বাজার। রাষ্ট্রায়ত্ব ওষুধের কোম্পানিগুলোর হাল হলো অনেকটাই BSNL-এর মতো। পাশাপাশি একচেটিয়া ব্যবসায় ক্রমাগতভাবে ওষুধের দামও বেড়ে গেল। সরকারিভাবে নজরদারি বন্ধ করে বিক্রিত ওষুধের গড় মূল্যকে প্রাধান্য দিল সরকার। তার উপর আগে যেখানে ৪ শতাংশ এক্সাইজ ডিউটি লাগতো সেখানে ১২-১৮% GST যুক্ত করে ওষুধ হল মহার্ঘ্য। সরকার রুগ্ন পরিবারকে পথে বসতে দেখেও চোখ বন্ধ করে রইলো।

এই সময়ে সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা কেবল স্বাস্থ্যসাথী বা আয়ুস্মান ভারতের কার্ডের অধীনেই সীমাবদ্ধ। ইনসিওরেন্স-এর নামে এখানে যে চিকিৎসা হয় তার সমস্যা নিয়ে আলোচনা অনেক বিস্তৃতভাবেই দরকার। এককথায় মানুষের অভিজ্ঞতা বলে রাজনৈতিক দলের বদান্যতায় লাভ করে কর্পোরেট, আর পকেট ভরে তার, যাকে চোখে দেখা যায়না। এছাড়াও বর্তমানে সরকারি হাসপাতালে স্থায়ী চিকিৎসকের সংখ্যা ক্রমেই কমেছে। পাশাপাশি অবসরপ্রাপ্ত চিকিৎসকের সংখ্যা অনেক বেশি, তাঁরা আর চাইছেন না, শারীরিক ক্ষমতা নেই তবু তাঁকে চিকিৎসকের চাকরি করে যেতে হচ্ছে। নতুন চিকিৎসক নিয়োগ নেই। স্বাস্থ্য পরিষেবার সার্বিক বন্টনের ব্যবস্থা নেই বলেই সর্বত্র প্রান্তিক অঞ্চল থেকে রেফার কেসগুলো গিয়ে হাজির হয় মহকুমা হাসপাতালে বা মেডিকেল কলেজে। মাঝারি, ছোটো হাসপাতালে পরিকাঠামো বজায় রাখতে যা কিছুর প্রয়োজন তাঁরই সার্বিক অভাব। ঠিকা প্রথায় নিযুক্ত চিকিৎসকদের ভয়ে ভয়ে কাজ করতে হয়, আবার একটু উনিশ-বিশ হলেই জনগণের মার খেতে হয়। ঢাল-তলোয়ারবিহীন আজকের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। তাই শুধু আইনের নিয়মের মধ্যে চিকিৎসকেরা যন্ত্রের মতো কাজ করে যান। সমস্যা বেশি দেখলে অগত্যা বড় হাসপাতালে পাঠানো হয়। বড় হাসপাতালে হয় রেফার কেসের পাহাড়।

হাসপাতালে দালালচক্রের কাজ হল হতাশাগ্রস্থ রোগীর পরিবারকে বুঝিয়ে ছোট, মাঝারি নার্সিংহোমে নিয়ে যেতে মালিকের এজেন্ট হিসেবে কাজ করা। এতে সাধারণ মানুষ আবারও গিলোটিনের ফাঁসে জড়িয়ে যায়। বিভিন্ন ওষুধের কোম্পানি, চিকিৎসা সরঞ্জাম প্রস্তুতকারী সংস্থা সরাসরি যোগসূত্র তৈরী করে নার্সিংহোম, কর্পোরেট হাসপাতালগুলোতে, ফেয়ার প্রাইসের দোকানের সঙ্গে। MRP বেশি পরিমাণে বাড়িয়ে ডিসকাউন্ট দেয় নার্সিংহোমে, কর্পোরেট হাসপাতালে। চিকিৎসক কি ওষুধ লিখলেন তার কোনো গুরুত্ব নেই, ঐ দোকান বা হাসপাতাল/নার্সিংহোমের পছন্দের ওষুধই চলে। এক্ষেত্রে রোগীর থেকে MRP-র উপরে GST জুড়ে বাড়তি দাম নিলেও কিছু করার থাকে না।

WHO গাইডলাইন অনুযায়ী কোম্পানিগুলোকে 'ইউনিফর্ম কোড অব ফার্মাসিউটিক্যাল মার্কেটিং প্র্যাকটিস' - এই বেসিক কোড অনুযায়ী সমস্ত ওষুধ ও চিকিৎসা সংক্রান্ত সরঞ্জাম বিক্রির জন্য সরকারের বিধিবদ্ধ নিয়মে, বিশেষ করে 'এথিক্যাল মার্কেটিং'-এর নিয়মে বাধ্য থাকার কথা। কিন্তু আমাদের দেশে কেন্দ্রীয় সরকার কোম্পানিগুলোর উপরে কোনো নিয়মনীতি লাগু করেনি। ফলত সরকারের নমনীয় নীতির জন্য কোম্পানিগুলো ওষুধ বিক্রি করতে উপঢৌকন দিয়ে অনৈতিক ব্যবসা করছে। যদিও এক্ষেত্রে বিশাল সংখ্যক চিকিৎসকের ও চিকিৎসক সংগঠনের চূড়ান্ত পর্যায়ে বিরোধিতা ও আন্দোলন জারি রয়েছে।

একথা মানতেই হবে যে কর্পোরেটই হোক বা এলাকার প্রাইভেট ক্লিনিকের চিকিৎসকই হোক সংখ্যায় বিশাল যারা ঠিক আগের মতো আজও সামাজিক দায়িত্ব পালন করে, মানবিক, ন্যায়নীতি বোধ অক্ষুণ্ন রেখে মানুষের আস্থা অর্জন করে মহান আসনেই রয়েছেন।

হাসপাতালের পরিকাঠামো ও স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ ব্যবস্থার কড়া নিয়ন্ত্রণে চিকিৎসক সহায়ক কর্মী, নার্স, অফিসের যৌথ পরিচালনায় জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার বিস্তার ও সামাজিক সচেতনতার কথা ভেবেই পরিচালনা হতো। আজ তার বড় অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে, আর সেই কারণেই জনস্বাস্থ্য পরিকল্পনা রূপায়নের ক্ষেত্রে দুর্বলতা।

আগে কর্পোরেট হাসপাতাল বা নার্সিংহোমের কোনো অস্তিত্ব বা ভূমিকাই ছিল না, থাকলেও খুব কম ছিল। চিকিৎসকের কাছে হাসপাতাল ছিল মন্দির। সরকারি টাকায় পড়তে গিয়ে শিক্ষাই সেখানে প্রাধান্য পেয়েছে। আজকের সময় প্রচুর টাকা থাকলেই প্রাইভেটে চিকিৎসক হয়ে ওঠা সম্ভব। সেকারণেই স্বাস্থ্যক্ষেত্রে কর্পোরেটে জনগণের খরচ বাড়লেও তাঁদের অনেকেরই তাতে কিছু যায় আসে না। এই সময় শাসকদলের কর্পোরেটের কাছে আত্মসমর্পণ এক নতুন সমীকরণ। তাতে শাসক সহজেই মেনে নেবে যে, শোষণের ব্যবস্থাটি জারি থাকুক। অর্থাৎ বেশি শোষণের মানেই হলো বেশি লাভ, আর বেশি কর পেতে হলে শোষণ পদ্ধতি জারি থাকা অত্যন্ত জরুরি। এই প্রশ্নে শাসকশ্রেণি বিশাল সংখ্যক নিম্নবিত্ত মানুষের ভোটে জয়ী হয়ে তাঁদেরই পকেটের টাকা বকলমে কর্পোরেটের হাতে তুলে দেওয়ার রাস্তা প্রশস্ত করে।

স্বাধীনতার ৭৫ বছর পেরিয়ে আজ মানুষের দাবি জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোর সংখ্যাও বাড়বে। সাধারণ মানুষের জন্য কর্পোরেট পরিষেবার পাশাপাশি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা গড়ে উঠবে। ওষুধ ও চিকিৎসা সামগ্রী সহ প্রশিক্ষিত চিকিৎসক ও নার্সের উপস্থিতি থাকা আবশ্যিক। স্বাস্থ্য সচেতনতার জন্য জনস্বাস্থ্য প্রচার অত্যন্ত জরুরি। তবে রাজ্য সরকারের নতুন করে 'সিভিক চিকিৎসক' গড়ার ভাবনা উন্নত স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার স্বপ্নকে অঙ্কুরে বিনাশ করে।