আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ একাদশ সংখ্যা ● ১-১৫ জুন, ২০২৩ ● ১৬-৩১ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩০

প্রবন্ধ

কেমন আছো হে, কলকাতা

প্রবুদ্ধ বাগচী


শান্তিনিকেতনের আশ্রমিক রামকিঙ্কর বে'জ শহর কলকাতায় একেবারেই আসতে খুব একটা পছন্দ করতেন না। অনেকটা বেশি বয়সে তিনি একবার কলকাতা শহরে এসে বিভিন্ন এলাকায় তৈরি করা বিশিষ্ট মানুষদের মূর্তিগুলি দেখে শিউরে উঠে মন্তব্য করেছিলেন, এইসব কুৎসিত শিল্প নিদর্শনগুলি কেন শহরে স্থাপন করা হয়েছে? তাঁর বিচারে মনে হয়েছিল, একমাত্র দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরী নির্মিত গান্ধী-মূর্তিটি ছাড়া আর সব মূর্তিই শৈল্পিক বিবেচনায় একেবারেই পাতে দেওয়ার যোগ্য নয়। শিল্পী-সাহিত্যিকদের কথা শোনার লোক সচরাচর একেবারেই কম। ফলে শান্তিনিকেতনের এক ‘গেঁয়ো ভাস্কর’ কী বললেন তাতে শহরের প্রশাসনের বয়েই যায়। আজও শহরজুড়ে ওইসব ‘বীভৎস’ শিল্প নিদর্শনগুলি বহাল তবিয়তে যে যার নিজের জায়গায় অবস্থান করছে। খুব সাদা চোখে দেখেও বোঝা যায়, বাবুঘাট এলাকায় শ্রীঅরবিন্দের মূর্তি ঠিক কীরকম বেঢপ এবং পরিভাষায় যাকে বলে ‘প্রোপরশনলেস’, বঙ্কিমচন্দ্রের পূর্ণাবয়ব মূর্তির হাতে ‘আনন্দমঠ’ বইটি ধরা না থাকলে ভাস্কর্যের ঠিক কতখানি ক্ষতি হত তাও বোঝা ভার। আবার ক্ষুদিরাম বসু শহিদ হয়েছিলেন বলেই তাঁর মর্মর মূর্তির ঘাড় উঁচু করে ফাঁসি দেওয়ার ‘পোজ’ আনতেই হবে এমন মাথার দিব্যি কে দিয়েছেন, কে জানে? ফাঁসি দেওয়ার সময় কি ওইভাবে দন্ডিতের মাথা উঁচু করিয়ে সত্যিই ফাঁসির দড়ি পরানো হয়? স্বামী বিবেকানন্দের প্রচলিত যে-মূর্তি সব জায়গায় চলে, ওই ভঙ্গিমায়, শরীরের সঙ্গে মাথার প্রায় নব্বই ডিগ্রি কোণ তৈরি করে কোনো মানুষ সত্যিই দাঁড়িয়ে থাকতে পারে কি না সেই কথা বিবেচনা করা হয় বলে মনে হয় না। এমনকি রবীন্দ্রসদনের সামনেও যে ‘রবি ঠাকুর’ তাকেও একতাল পাথরের ঢিপি বলে চিহ্নিত করলে খুব বাড়িয়ে বলা হয় না। তাছাড়া রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে তাঁর বিভিন্ন বয়সের সব উজ্জ্বল ছবি সংরক্ষিত আছে, তবু রবীন্দ্রনাথের মূর্তি মানেই তাঁর ওই জোব্বা পরিহিত শেষ বয়সের ছবিই তাঁর মূর্তির ভিত্তি কেন হবে, এর কোনো ব্যাখ্যা আমাদের কাছে অন্তত নেই। কংগ্রেস নেতা হিসেবে নেতাজি সুভাষচন্দ্রের খুব প্রসন্ন ও দীপ্ত ধুতি-পাঞ্জাবি পরা ছবি বিভিন্ন সূত্রে আমরা দেখেছি, কিন্তু আশ্চর্য এই যে, যুদ্ধ-প্রবণ জাতি না হয়েও সারা কলকাতায় সমস্ত নেতাজি মূর্তিই সামরিক পোশাকে আচ্ছাদিত।



সম্ভবত সাতের দশকে কলকাতা শহরের মধ্যে স্থাপিত ব্রিটিশ রাজপুরুষদের মূর্তিগুলি শহরের বিভিন্ন জায়গা থেকে উৎপাটন করে বারাকপুরের লাটবাগানে নিয়ে যাওয়া হয়। আর কিছু মূর্তি জায়গা পায় ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের বাগানে। সেইসব মূর্তির যেগুলি এখনও চোখে দেখা যায় তাতে সেগুলির শিল্পসৌকর্য নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ আছে বলে মনে হয় না। তবে স্বাধীন দেশের স্বাধীন শহরে কেন সাম্রাজ্যবাদী শাসকদের প্রতিনিধিদের মূর্তি থাকবে সেটা আসলে রাজনৈতিক প্রশ্ন, শিল্পের নয়। তবে ইচ্ছে করলেই তো আর ইতিহাসকে মুছে দেওয়া সম্ভব নয়, তাই কলকাতা শহর থেকে ব্রিটিশ আমলের মূর্তিগুলি সরিয়ে দেওয়া হলেও এবং প্রচুর রাস্তার নামের বদল ঘটলেও এখনও বেশির ভাগ মানুষ ওইসব রাস্তাকে পুরোনো নামেই ডাকেন - এই অভ্যাসকে মুছে দেওয়া মুশকিল। হয়তো তার দরকারও নেই। এই কারণেই প্রাক্তন বামমন্ত্রী যতীন চক্রবর্তী মশায় যখন ‘অক্টারলোনি মনুমেন্ট’-এর নাম পাল্টে ‘শহিদ মিনার’ করেছিলেন তখন স্বয়ং সত্যজিৎ রায়ও এই কাজের প্রতিবাদ করেন। সত্যিই তো কলকাতা শহরটা তৈরি হয়েছিল ব্রিটিশদের হাতে, একদিন তা ছিল ভারতের রাজধানী। তাঁদের তৈরি করা স্থাপত্যগুলির সঙ্গে তাঁদের সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতার যোগ খুঁজে ফেরা আদপে এক ভুল ইতিহাসের নির্মাণ। শহরের বিভিন্ন চার্চ, রাইটার্স বিল্ডিং সহ অন্যান্য নানা সরকারি ভবন, আদালত - এর প্রতিটির মধ্যে আছে ইতিহাস। ইচ্ছে করলেও আজ কি আমরা কলকাতা শহরে সাম্রাজ্যবাদী শাসনের সবথেকে বড় দুটো নিদর্শন ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল ও রাজভবন ভেঙে দিতে পারি? রুশ বিপ্লবের পরেও কিন্তু জারের প্রাসাদ ‘বলশেভিক’রা ভেঙে দেয়নি, রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পরেও রোমের ‘কলোসিয়াম’ আজও দাঁড়িয়ে আছে, দাঁড়িয়ে আছে দিল্লির কুতুবমিনার বা লালকেল্লা। আসলে রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিবেচনায় ‘বড় ইংরেজ’ আর ‘ছোট ইংরেজ’-এর একটা উল্লেখ করেছিলেন - নিছক ইংরেজ বলেই কি আমরা সেক্সপিয়ার বা মিল্টন কিংবা আইজ্যাক নিউটন, মাইকেল ফ্যারাডে-র বিরোধিতা করতে পারি? এঁরা ‘বড় ইংরেজ’। আবার একইভাবে আমাদের প্রতিবাদ করতে হয় ক্লাইভ থেকে জেনারেল ডায়ার বা কিংস্ফোর্ড কিংবা জেমস পেডি, চার্লস টেগার্টের - এরা ‘ছোট ইংরেজ’। কিন্তু ব্রিটিশ আমলে এইসব স্থাপত্যের পেছনে যে শিল্পভাবনা বা প্রযুক্তির উৎকর্ষ ছিল সেগুলি ওই ‘বড় ইংরেজ’-দের অবদান।

।। ২ ।।

এখন এই সাম্রাজ্যবাদের প্রধান শহর কলকাতা থেকে সাম্রাজ্যবাদের সমস্ত নিদর্শন ও স্মারক সরিয়ে দেওয়ার এক ধারাবাহিক প্রকল্পের পরেই এক দশক আগে আমরা শুনেছিলাম এক আশ্চর্য প্রতিশ্রুতি - কলকাতাকে ‘লন্ডন বানানোর’ কথা। একটা শহর কীভাবে অন্য একটা শহরে পরিবর্তিত হতে পারে তার ‘রাসায়নিক সমীকরণ’ অম্ল থেকে ক্ষার-এ পরিবর্তন হওয়ার মতোই ‘বিজ্ঞান সম্মতভাবে প্রমাণিত’ কিনা এসব প্রসঙ্গ যে আমাদের ‘নিরেট’ মাথায় ঢুকবে না সেই তথ্য আমরা তখনই খানিকটা বুঝে গিয়েছিলাম। নানান তথ্য ও ‘তথ্যসম্রাজ্ঞী’ গুগল ঘেঁটেও এমন উদাহরণ আমরা পাইনি যে ‘লিসবন’ শহর আচমকা ‘বন’ হয়ে উঠতে চেয়েছে, ‘প্যারিস’ হয়ে উঠতে চেয়েছে ‘ওয়াশিংটন’ বা ‘দুবাই’ হতে চাইছে ‘হংকং’, ‘ঢাকা’ হতে চাইছে ‘পাটায়া’ কিংবা ‘ব্রাসিলিয়া’ হতে চায় ‘মেক্সিকো’। তবু আমাদের প্রাণের শহর যদি লন্ডন না হলেও যদি অন্তত ‘লন্ডন-সম’ হয় তাতে আপত্তি কী? সাবেকি ব্রিটিশরাজের ওই রাজধানী শহরে যাওয়ার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা না- থাকলেও উপনিবেশের শাসনের সুযোগে এই দেশের সাহিত্যে সিনেমায় ‘লন্ডন’ শহরের উপস্থিতি খুব প্রত্যক্ষ, চেনা পরিচিতের অনেকেই সেখানে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছেন, লন্ডন শহর নিয়ে এই বাংলাতেও প্রচুর লেখালিখি হয়েছে। আজকাল ইন্টারনেটের কল্যাণে খোদ লন্ডন শহরের দৃশ্য-শ্রাব্য চিত্র পাওয়া কোনো ব্যাপারই নয়। লন্ডন মানেই ‘টেমস’ নদী, তার ওপর ব্রিজ, লন্ডন মানে লন্ডন গেট, ওয়েস্ট মিনিস্টার অ্যাবে, ইন্ডিয়া লাইব্রেরি, ব্রিটিশ মিউজিয়াম ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে সাতশো বছরের পুরোনো লন্ডন শহরে যা যা আছে তা তো আর তিনশো বছরের কলকাতায় হুবহু এনে বসানো যায় না, তবু সৌন্দর্যের দিক থেকে যদি আমাদের শহরকে একটু সংস্কার করা হত তা হলেও নেহাত মন্দ হত না। অন্তত যদি শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর পাড় একটু সুন্দর করা হত, মানুষের বেড়ানোর উপযোগী, নব্য প্রেমিক-প্রেমিকাদের একটু নিভৃতি দেওয়া যেত সেখানে - খারাপ কী? আর শুধু গঙ্গার পাড় কেন কলকাতায় পুরোনো রাস্তাঘাটের অভাব নেই, সেগুলো যদি একটু সুচারুভাবে চিহ্নিত হত (‘সরণী’কে ‘ধরণী’তে ‘পরিবর্তন’ করা না হতো), কলকাতার প্রাচীন সারস্বত প্রতিষ্ঠানগুলিকে হেরিটেজ মর্যাদায় রক্ষণাবেক্ষণ করা হত - তবে একটা সুরুচির পরিচয় নিয়ে আবার জেগে উঠত আমাদের শহর। ব্রিটিশ জাতির ঔপনিবেশিক চরিত্র তার রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সংস্কৃতির দিক, কিন্তু সাহিত্য-শিল্পকলা-জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় এবং নিজেদের ইতিহাসকে সুসংবদ্ধ রাখার সংস্কৃতিতে তাঁদের জুড়ি মেলা ভার। তাঁরা যেমন এইদেশ থেকে ‘কোহিনুর’ চুরি করে নিজেদের দেশে রেখেছে আবার ভারত বিষয়ে কোনো রাজনৈতিক গবেষণার জন্য তৈরি করেছে 'ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরি' যা আজও গবেষকদের ‘হাতে পাওয়া স্বর্গ’। তাঁদের ‘অক্সফোর্ড’, ‘কেম্ব্রিজ’ আজও সারা পৃথিবীর জ্ঞানচর্চার রাজধানী, চিকিৎসার ক্ষেত্রে তাঁদের ‘রয়্যাল সোসাইটি’গুলির ‘ফেলো’-রা দুনিয়াজোড়া স্বীকৃতি পেয়ে থাকেন।

কিন্তু কী হল, ‘লন্ডন’ হতে চাওয়া কলকাতার? এর প্রথম পর্বে আমরা শুনলাম ও দেখলাম ‘ত্রিফলা’ আলোর কথা। ‘ত্রিফলা’-র জল, কোষ্ঠকাঠিন্যের প্রতিরোধী বলেই আমরা জেনে এসেছি এতদিন, এবার শিখলাম, না এর মধ্যেও ‘আলো’ আছে। আর ‘আলো’ থাকলে যেহেতু ‘অন্ধকার’ থাকবেই তাই এই ‘ত্রিফলা’ কর্মসূচি যত কলকাতা থেকে বৃহত্তর কলকাতায় ছড়িয়ে পড়তে লাগল তত আমাদের কানে আসতে লাগল ‘আলো আঁধারির খেলা’-র ধারাবিবরণী। এর পরে এল রঙের পালা - সব কিছুকে ‘নীল-সাদা’য় সাজিয়ে তোলার জন্য তোলপাড় হল প্রশাসন। ফরাসি বিপ্লবের দু'শো বছর উপলক্ষ্যে উৎপল দত্তের পিএলটি ‘নীল সাদা লাল’ নামক একটি নাট্য প্রযোজনা করেছিলেন - তার অনেক বছর পরে ‘লাল’-কে বাতিল করে বেছে নেওয়া হল ‘নীল-সাদা’ - একটা শহরের এইরকম কোনো রং থাকা কি বাঞ্ছিত? ব্রিটিশরা অবশ্য তাঁদের তৈরি সরকারি ভবন, আদালত, থানা ইত্যাদিতে একটা মেটে রং ব্যবহার করতেন - ঘটনাচক্রে মহাকরণ, কলকাতা পুরসভা, হাইকোর্ট, জেলখানা এবং কলকাতার কিছু পুরোনো থানার বাড়ি এখনও সেই রং বহন করছে। কিন্তু ওটা কোনো উপনিবেশের পরিকল্পিত রং ছিল বলে মনে হয় না - সম্ভবত তার একটা নান্দনিক দিক বিবেচনায় ছিল। একটা সময় এমনকি এই প্রস্তাবও কলকাতা পুরসভার পক্ষে দেওয়া হয়েছিল যে বসতবাড়িতে ‘নীল-সাদা’ রং করলে নাকি তাঁদের ট্যাক্স-ছাড় দেওয়া হবে। লন্ডনে কি এমন কোনো নিয়ম আছে নাকি?

কিন্তু এই ‘নীল-সাদা’-র কর্মসূচিতে এমন একটা প্রকল্প যোগ করা হল যা তুলে দিল সমালোচনার সূত্র। শহরের রাস্তার বিভিন্ন ডিভাইডারকেও যখন ওই ‘নীল-সাদা’য় সজ্জিত করা হল তখন আসলে লঙ্ঘন করা হল, 'আন্তর্জাতিক রোড কংগ্রেস'-এর নির্দেশ, যা বলে, রাস্তার ডিভাইডারে হলুদ-কালো রং করাই আন্তর্জাতিক বিধি - দুনিয়ার সব দেশ এই নিয়ম মেনে চলে। তাহলে ব্যাপারটা তো এই দাঁড়াল যে ‘আন্তর্জাতিক শহর’ হয়ে উঠতে গিয়ে আন্তর্জাতিক আইনটাই অস্বীকার করা হল এইবার। কিন্তু বলবে কে? তাছাড়া অনেক রাস্তার ডিভাইডারে কিছু কিছু পুরোনো গাছ ছিল, আইনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে কাটা পড়ল সেগুলি পরিবর্তে স্বল্প পরিসরে ডিভাইডারের গর্তের ভিতর ‘সৌন্দর্যায়ন’-এর নামে বসানো হল কিছু ফুলগাছ। বাতাসের অক্সিজেন সরবরাহের প্রশ্নে এইসব ছোট গাছের অবদান নিতান্তই কম, তাছাড়া এককালীন কিছু অর্থব্যয় করে গাছ লাগিয়ে দেওয়ার থেকেও বড় বিষয় এগুলির রক্ষণাবেক্ষণ। স্বভাবত কলকাতা পুরসভার উদ্যান বিভাগের এত বাজেট নেই যে এইসব দীর্ঘ ফুলগাছের সারি নিয়মিত দেখাশোনার জন্য তাঁরা কর্মী নিয়োগ করতে পারেন। মনে রাখতে হবে, প্রায় এক বছরের ওপর পুরসভার অবসরপ্রাপ্ত কর্মীরা তাঁদের অবসরকালীন পাওনা পাচ্ছেন না। সেইসব হতভাগ্য কর্মীদের চোখে এগুলি হয়তো ‘কাঁটাগাছের ঝোপ’ বলেই মনে হয়, কে জানে!

সবকিছু ‘খারাপ! খারাপ!’ বলে চিৎকার করলে ‘অপপ্রচারের’ দায় নিতে হয়। তাই ‘লন্ডন’-এ এমন ব্যবস্থা আছে কি না জানি না - তবে দুটো উল্লেখ্য কাজ চোখে পড়েছে আমাদের। প্রথমত, শহরের প্রায় প্রতিটি এলাকায় রাস্তার ধারে ‘সুলভ শৌচাগার’ তৈরি হয়েছে - পথচারীদের পক্ষে, বিশেষত মহিলাদের জন্য এটি একটি আশীর্বাদ। একটি সুসভ্য শহর তার নাগরিকদের জন্য গণ-শৌচালয় প্রত্যাশা করে। তবে এর পাশাপাশি উন্মুক্ত শৌচালয়গুলি বন্ধ করে দিলে বিষয়টি আরও শোভন হত নিশ্চয়ই। দ্বিতীয়ত, প্রায় সব রাস্তার ধারেই তৈরি হয়েছে বাসের জন্য যাত্রী প্রতীক্ষালয়। কলকাতার পরিবহন ব্যবস্থা সমস্ত নিয়মকানুনকে তোয়াক্কা না-করে বরাবরই বিশৃঙ্খল, কাজেই নির্দিষ্ট প্রতীক্ষালয়ের সামনে বাস এসে থামবে এসব ভাবা বাতুলতা, কলকাতার প্রাইভেট বাস তাঁদের নিজেদের মর্জিতেই চলে। কিন্তু এই ব্যবস্থায় যাত্রীরা অন্তত একটা ছাউনির নিচে দাঁড়াতে বা বসতে পারেন। আর রাস্তার মোড়ে মোড়ে কিছু কিছু পানীয় জলের ‘জলসত্র’ তৈরি করাটাও নিশ্চয়ই ভাল কাজ। রাস্তায় বেরিয়ে পানীয় জল আর শৌচালয় এইদুটি পথচারীদের মৌলিক প্রয়োজন - এই দুটির দিকে যে নজর দেওয়া হয়েছে এটা বলার মতো বিষয় নিশ্চয়ই। তার জন্য লন্ডন কলকাতা তুলনা টেনে এনে লাভ নেই। সেদিক দিয়ে তো লন্ডন শহরের দোতলা বাস আর ট্রাম বরং আগে কলকাতার পালকেও শোভা পেত - ‘লন্ডনায়িত’ হওয়ার প্রক্রিয়ার আগে থেকেই সেগুলোর পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটে গেছে।

।। ৩ ।।

কিন্তু সমস্ত শহরেরই একটা নান্দনিক দিক থাকে যার থেকে সেই শহরের সংস্কৃতির একটা আন্দাজ পাওয়া যায়। পৃথিবীখ্যাত শহরগুলির মধ্যে প্রায় প্রতিটিরই সেই অভিজ্ঞান ছিল এবং আছে - এটা লিখতে খুব কষ্ট হচ্ছে যে গত এক দশকে কলকাতা তার সেই নান্দনিক মাত্রাটি হারিয়ে ফেলেছে। শহর কলকাতা লন্ডন হল কি হল না তার থেকেও আমাদের পরম আশ্বাসের বিষয় ছিল এই একটা চিহ্ন যা কলকাতাকে কোথাও একটা ‘রেনেসাঁসের শহর’ বলে চিনিয়ে দিত, আজ সেই গতায়ু স্মারকের জন্য তাই এমন মন উচাটন-করা বিপন্নতা। মৃণাল সেন লিখেছিলেন, 'ক্যালকাটা, মাই এল ডোরাডো!' গত এক দশকে কলকাতায় সব থেকে চর্চিত ও বহুল বিজ্ঞাপিত শব্দ হল ‘সৌন্দর্যায়ন’ - আর এই শব্দের থেকে নান্দনিক নির্যাসটুকু সরিয়ে নিলে যা পড়ে থাকে, তা এক মননহীন নির্মাণ, এলোমেলোভাবে যা খুশি তাই করে ফেলার উগ্র ‘দাদাগিরি’। একটু ঘুরে দেখলেই বোঝা যায়, ‘সৌন্দর্য’ শব্দটাকে তার অব্যর্থ ব্যঞ্জনার বাইরে টেনে এনে কীভাবে তাকে স্থাপন করা চলেছে আধিপত্যের মুঠোর ভিতর।

শহর ও শহরতলির পাড়ার মোড়ে মোড়ে শহিদ বেদীর পাশে ‘শনি মন্দির’ তৈরি ও তাকে ঘিরে পাড়ার লোকের শনিবারের সান্ধ্য জটলা (আমরা পরিহাস করে বলতাম ‘স্যাটারডে ক্লাব’) - এই কালচার তৈরি হয়েছিল বাম আমলেই, সন্দেহ নেই। মনে পড়ছে, ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসার বছরেই ‘বাবা তারকনাথ’ নামের এক ফিল্ম হিট হয়ে যায়, যার প্রত্যক্ষ প্রতিক্রিয়ায় চালু হয়ে যায় শ্রাবণ মাসে বাঁক কাঁধে নিয়ে ‘বাবার মাথায়’ জল ঢালতে যাওয়ার এক কিম্ভুত সংস্কৃতি। মৃণাল সেন ক্ষুব্ধ হয়ে বলেছিলেন, বামফ্রন্ট আর বাবা তারকনাথ কীভাবে একসঙ্গে চলে তিনি বুঝতে পারছেন না! কিন্তু গত এক দশকে পাড়াতুতো ঠাকুরদের ‘বংশবৃদ্ধি’ ঘটেছে অকাতরে - শনির পাশেই অনায়াসেই ঠাঁই পাচ্ছে কালী, শিব এবং কোথাও কোথাও বজরংবলী। প্রতিটি মন্দিরের আয়তন হিসেবে তাদের মিনি-মিডি-ম্যাক্সিতে ভাগ করে ফেলা যায়। এঁদের প্রত্যেকেই স্থান পেয়েছেন হয় রাস্তার কিছু অংশ দখল করে, নয়তো ফুটপাথের একটা বড় অংশ পথচারীদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে। বলা বাহুল্য, এর প্রতিটি নির্মাণই ‘বেআইনি’ - সরকারি জমি দখল করে তৈরি করা। কিন্তু আমাদের রাজ্যে শিক্ষা, চাকরি, সরকারি অর্থ আর যা-কিছুরই অভাব থাক, ‘অনুপ্রেরণা’র কোনো অভাব নেই। ফলে এই দেবস্থানগুলির প্রতিটির পেছনেই বড় ‘অনুপ্রেরণা’ চুঁইয়ে মেজ ও ছোট ‘আঞ্চলিক’ ‘অনুপ্রেরণা’য় সঞ্চারিত এবং তার সোচ্চার ঘোষণা মন্দিরের আশেপাশে প্রবল বিক্রমে শোভা পায়। এমনকি এই মন্দিরগুলির প্রতিটিই ঝকঝকে টাইল বা মার্বেল পাথরে সুসজ্জিত, বেশ জমজমাটভাবে আলোকিত এবং এঁদের মধ্যেই কিছু মন্দির শীততাপ-নিয়ন্ত্রিত। দেবতাদের মাথা ঠান্ডা রাখার নিশ্চয়ই দরকার আছে। এই মুহূর্তে শহর কলকাতার বেশ কিছু উল্লেখ্য জায়গায় বি-শা-ল হনুমান মূর্তির উপস্থিতি যা কোনো না কোনো আঞ্চলিক ‘প্রভু’-র বদান্যতায় প্রতিষ্ঠিত এবং এই ‘মহতী কর্মের’ জন্য তাঁকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানানোর বারতাও আশেপাশের দেওয়াল, ল্যাম্পপোস্টের দখল নিয়েছে। সম্প্রতি দেখা গেল, বাগবাজারের মোড়ে ফুটপাথ সম্পূর্ণ দখল করে তৈরি হয়েছে ঝাঁ চকচকে ‘চৈতন্য মন্দির’ - আয়োজক স্থানীয় পুরপ্রতিনিধি। ‘বাগবাজার গৌড়ীয় মঠ’ বহুদিনের প্রতিষ্ঠান যাদের ভক্ত সংখ্যা অনেক তবু রাস্তার ওপর এমন একটা মন্দিরের দরকার হল কেন তা জানেন স্বয়ং চৈতন্যদেব আর স্থানীয় পুরপ্রতিনিধি! এমন দৃষ্টান্ত বাড়িয়ে নেওয়া চলে অনায়াসে।

এর পাশাপাশি আছে দুটি কুৎসিত উপদ্রব। গত এক দশকে শহরকে সুন্দর করার অছিলায় প্রায় পাইকারি হারে তৈরি করা হয়েছে বিদ্যাসাগর, বিবেকানন্দ, রামকৃষ্ণ, রবীন্দ্রনাথ ও নেতাজির ছোট ছোট মূর্তি। না বললেও চলে, এগুলির শৈল্পিক চেহারা নিতান্তই কদর্য - পাড়ার ভিতরে ভিতরে এঁদের প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে যার মধ্যে এতটুকু কোনো নান্দনিক ভাবনা নেই। একজন মনস্বীজনের মূর্তির নির্মাণে একটা শ্রদ্ধা ও সৌজন্যের বোধ থাকা দরকার, এসবের মধ্যে তার ছিটেফোঁটাও চোখে পড়ে না। অনেক জায়গায় পাড়ার ছোট ময়লা ফেলার ভ্যাট বন্ধ করার জন্য সেইখানে মনীষী-মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে। দক্ষিণ দমদম এলাকার এক ডাকাবুকো নেতা যেমনভাবে প্রকাশ্যে ‘বুক চিতিয়ে’ দাঁড়ান, তাঁর এলাকায় ‘রবীন্দ্রনাথ’ ঠিক ওই ভঙ্গিমাতেই দাঁড়িয়ে রয়েছেন পাড়ার মোড়ে - যেন বা তিনি ‘পাড়ার দাদা’! আসলে যেখানে সেখানে যেমন তেমন করে মূর্তি বসিয়ে যে গুণীজনের প্রতি শ্রদ্ধা দেখানো বা ‘সৌন্দর্যায়ন’ কোনোটাই হয় না - শহরের কর্তাদের এই মগজহীন কাজেকর্মে ক্রমশ তাই যেন প্রকাশ পেয়ে চলেছে। তবু ‘অনুপ্রেরণা’য় কী না হয়?

আরও একটি মূর্তিমান দূষণ হল শহরজুড়ে গড়ে ওঠা বিভিন্ন সব ‘ভাস্কর্য’ যা টালা থেকে টালিগঞ্জ পেরিয়েও ছড়িয়ে পড়েছে শহরতলির আনাচে কানাচে বা প্রকাশ্য রাজপথে। এর কোনোটি হল বিচিত্র ও বেঢপ এক ‘বিশ্ব বাংলা’ লোগো, কোনোটি একটি মাঝারি স্তম্ভের গায়ে নানা সরকারি প্রকল্পের নাম খোদাই করা, কোথাও দেখা যায় কয়েকটি পাথরের সারস ঝর্ণায় জল খাচ্ছে আর ওপর থেকে উঁকি মারছে এক উদ্ভট চেহারার বাঘ, কোথাও বা হাল্কা জলের ধারার মধ্যে স্নান করছে কিছু জলপরি, কোথাও বা কিছু বাউল তাঁর মাথার ওপর একতারা তুলে নাচের ভঙ্গিমায়, কোথাও কিছু ভক্তজন গলায় করতাল- পাখোয়াজ ঝুলিয়ে সারি দিয়েছে কীর্তনের, আবার কোথাও দেখা যায়, গরুর গাড়িতে মাল ভরে গাড়োয়ান চলেছে গাঁয়ের পথে - তারই গা ছুঁয়ে চলে যাচ্ছে বাস অটো টোটো। কী বিচিত্র আর বীভৎস এইসব ভাবনা। তবে এই বিষয়ে টেক্কা দিয়েছে একটি বিরাটাকায় ভাস্কর্য - তাতে দেখা যায় রথারূঢ় অর্জুন আর তাঁর সামনে সারথি শ্রীকৃষ্ণ - বোধহয় কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের একটি দৃশ্য। আমি নিজে এই একই ভাস্কর্য দেখেছি বেলেঘাটার খালপাড়ে, গৌরিবাড়ি এলাকায়, দেখেছি পাইকপাড়ায় ও কলকাতার বৃহত্তম লালবাতি এলাকায়। শহরের পথে পথে এই ভাস্কর্যের তাৎপর্য কী? লালবাতি এলাকার ‘বনিতারা’ এই ভাস্কর্যের আশপাশ থেকেই তাদের খদ্দের সংগ্রহ করেন। ‘শ্রীকৃষ্ণ’ তাঁদের ওই ক্লিন্ন জীবনে কোন উদীয়মান আলোর আভা বয়ে আনেন? কেউ জানেন তার হদিশ? একটা ক্লেদাক্ত অঞ্চলে কেন পরিহাসের মতো স্থাপনা করা হবে এই অ-নান্দনিক দৃষ্টান্ত, সে কি ওই অন্ধকারকে আরও কালো করার জন্য? কেন একটা আধুনিক শহরের মধ্যে এরকম প্রাসঙ্গিকতাহীন ভাস্কর্য জায়গা পাবে? ভেবে আমি কোনো কিনারা করতে পারিনি, কাদের উর্বর মাথা থেকে ‘সৌন্দর্যায়ন’-এর কোন নিরিখ থেকে এইসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে চলেছে অনবরত। মাঝে মাঝে মনে হয়, যদি ড্রোন ক্যামেরা থেকে আজকের শহরটার ছবি তোলা যায় সেটাকে যেন মনে হবে এক কৃত্রিমভাবে সাজানো ঝুলনতলা! সেই যে আমরা বাড়ির বারান্দায় ঝুলন গড়তাম - ইট দিয়ে তৈরি পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে গড়িয়ে নামত পাইপ দিয়ে জল আনা ঝর্ণা, তারই এক কোণে উঁকি দিত বাঘ, অন্যদিকে কাঠের গুঁড়ো দিয়ে তৈরি মাঠে একদিকে ফুটবল খেলা, অন্যদিকে হাঁটু মুড়ে বসা সৈনিক, তার পাশেই ট্রাফিক পুলিশ হাত তুলে যান নিয়ন্ত্রণ করছে, আবার তারই মধ্যে হাতির পিঠে চলেছে এক সাহেব বা দাওয়ায় বসে হুঁকো খাচ্ছে এক বৃদ্ধ। কারোর সঙ্গে কারোর কোনও সামঞ্জস্য নেই, নেই কোনো সংহত ভাবনার আল্পনা - শুধু হাতের কাছে থাকা পুতুলগুলিকে যেমন তেমন করে সাজিয়ে তোলা। প্রাণহীন, স্পন্দনহীন, মননহীন।

শহর মানে শুধু ইট কাঠ পাথরের নির্মাণ নয় তারও থাকে এক নিজস্ব ল্যান্ডস্কেপ। কলকাতারও ছিল। কিন্তু আমাদের প্রাণের শহর আজ তার সেই স্পন্দমান প্রাণচিহ্নগুলি থেকে চ্যুত হয়ে কেবলই কিছু নেতা-নেত্রীর মুখোশ ঝোলানো দূষণচিত্রের এক মস্ত ক্যানভাস - বেরঙিন, বেতালা, বেভুল। পথের দু'ধারে সর্বোচ্চ স্তর থেকে দু-আনা- চার-আনার নেতা-নেত্রীর মুখাবয়ব, কাট আউট। গোটা শহরে কোনো পরিচ্ছন্ন দেওয়াল নেই, নেই একটা পোস্টার বা হোর্ডিংহীন ছায়াবীথি। বিমানবন্দর দিয়েই শহরে ঢুকুন বা অন্য কোনো রেল স্টেশনে - প্রতিটি প্রবেশপথের মুখই আজ ঢেকে গেছে আধিপত্য আর প্রচারের চড়া আলোয়।

লন্ডন এখন দূর অস্ত! পরিবর্তে গঙ্গার ঘাটে চালু হয়েছে উত্তর-ভারতীয় কায়দায় গঙ্গা-আরতির সরকারি ঘনঘটা। শহরে একটি সারস্বত প্রতিষ্ঠানও নেই যা অন্তত আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত। বিদ্রোহের শহর, বিপ্লবের প্রাণকেন্দ্র, মেধাচর্চার রাজধানী আজ সবহারা জীর্ণ, রবীন্দ্রনাথের গানের কথায় ‘জীবনহারা’ - তার জন্য পড়ে আছে শুধু ‘সৌন্দর্যায়ন’-এর রংচটা ফানুশ, সমস্ত শাসকের ‘বুক ফোলানো’ বিজ্ঞাপন আর কটু ধর্মীয় দূষণ। স্বপ্নের এল ডোরাডো আর নয়, উত্তর-ভারতীয় চপচপে ভক্তিরসের এক নন্দন-বর্জিত ‘দুঃস্বপ্নের নগরী’ - যা আমাদের কেবলই ক্লান্ত করে, বিপন্ন করে, মগজে জারি করতে চায় কারফিউ।

সুনীল লিখেছিলেন, ‘সুন্দর মেখেছে এত ছাই ভস্ম! ভালোই লাগে না’। ঠিক তাই।