আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ একাদশ সংখ্যা ● ১-১৫ জুন, ২০২৩ ● ১৬-৩১ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩০

প্রবন্ধ

ইয়ে তো হোনাহি থা

সুখবিলাস বর্মা


অরুণাচল প্রদেশের বিজেপির তিনবারের এমপি যুবনেতা কিরেন রিজিজু এই সেদিন পর্যন্ত নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহের অতি প্রিয়জন রূপে পরিচিত ছিলেন। তাঁকে তাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকে অমিত শাহের অধীনে রাষ্ট্র মন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। সেখানে তিনি মোটামুটি ভালোভাবেই তাঁর দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তাঁর কাজের নমুনা ও প্রধানমন্ত্রীর প্রতি অবিচল ভক্তি ও বিশ্বাস দেখে নরেন্দ্র মোদি নিশ্চিত হয়েছিলেন যে এঁকে দিয়েই তিনি পারবেন বাজিমাৎ করতে।

ইদানীং সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারক সহ কতিপয় বিচারক, সরকারের কথা শুনছেন না, সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করছেন না। এঁদেরকে একটু শবক শেখানো দরকার। এবং সেই কাজে কিরেন রিজিজুর মতো উচ্চাভিলাষী ইংরাজী ও হিন্দি ভাষায় সড়গড় নেতাই তো উপযুক্ত মানুষ। ওঁর তো একটা ল' ডিগ্রীও আছে - যদিও তিনি কখনো ল' প্রাকটিস করেননি। তাতে কি হয়েছে? তাঁর সবচেয়ে বড় কোয়ালিফিকেশন যে তিনি উত্তর পূর্বাঞ্চলের আদিবাসী নেতা। নিপীড়িত, বঞ্চিত আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষ হয়েও তিনি আরএসএস-চালিত ব্রাহ্মণ্যবাদী বিজেপি দলকে সমর্থন করেন, নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহকে শ্রদ্ধা ভক্তি করেন, এটাই তো তাঁর বড় কোয়ালিফিকেশন। তাছাড়া ইদানীং রবিশঙ্কর প্রসাদজি কেমন যেন মিইয়ে গেছেন - বিচারকদের মুখোমুখি হলে আমতা আমতা করেন। কৌশলবাজ মোদিজি তাই এক ঢিলে অনেক পাখি মারার চাল চাললেন - কিরেন রিজিজুকে ক্যাবিনেট পর্যায়ে উন্নীত করে বসালেন আইন মন্ত্রকের শীর্ষে, রবিশঙ্কর প্রসাদকে ছেঁটে ফেলে। ‘মনুসংহিতা’ যাদের আইনের অবলম্বন সূত্র, আরএসএস পরিচালিত সেই বিজেপি সরকারের আইন মন্ত্রী আদিবাসী যুবনেতা, যাঁর অন্যতম কাজ হওয়া উচিত গণতান্ত্রিক দেশের বিচার-ব্যবস্থার পরিকাঠামো শক্ত করতে সরকারী সহায়তার হাত বাড়ানো। আইন মন্ত্রকের দায়িত্ব দিয়ে মোদিজি নিশ্চয়ই তাঁকে সেভাবে ব্রিফ করেছিলেন। মন্ত্রকের কাজ, বিশেষ করে সুপ্রিম কোর্টের মাননীয় বিচারপতিদের সঙ্গে সরকারের, বিশেষত আইন মন্ত্রীর সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত সে বিষয়ে নিশ্চয়ই তিনি সুপরামর্শ দিয়েছিলেন। এটাই তো স্বাভাবিক।

কিন্তু রিজিজুর কাজের ধরণ থেকে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে তেমন কিছু না করে প্রধানমন্ত্রী মহোদয় উচ্চাকাঙ্ক্ষী নেতাকে কুপরামর্শ দিয়ে পরীক্ষা করতে চাইছিলেন দেশের বিচারপতিদের বাগে আনতে তিনি কতটা সফল হতে পারেন। অতীতে রঞ্জন গগৈ-এর ক্ষেত্রে তো তিনি একশ ভাগ সফল হয়েছিলেন। মোদিজির পরামর্শ মতো কাজে লেগে পড়লেন রিজিজু। সুপ্রিম কোর্টকে আক্রমণের প্রধান বিষয় - দেশের সমস্ত হাইকোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নির্বাচন ও বদলির ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকারের বক্তব্যের স্বীকৃতি। হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টে বিজেপি মনোভাবাপন্ন বিচারপতির বড় প্রয়োজন মোদিজির। রিজিজুরও প্রয়োজন মোদিজির সন্তোষ প্রসাদ। রিজিজুর মরিয়া অবস্থা লক্ষ্যণীয় হয়ে উঠল। কারণে অকারণে যেখানে সেখানে কিরেনজি বিচারপতিদেরকে বিশ্রী ভাষা-ভঙ্গিতে আক্রমণ করলেন, তার আক্রমণ থেকে এমনকি কিছু প্রাক্তন বিচারপতিও বাদ গেলেন না। দেশের মানুষ সবাই বুঝতে পারলেন যে এই কাজটি করছেন নরেন্দ্র মোদি এবং তিনি তা করাচ্ছেন রিজিজুকে দিয়ে। দুঃখের বিষয়, সবাই বুঝলেও রিজিজু বুঝলেন না। তিনি তখন প্রধানমন্ত্রীকে তুষ্ট করতে সব পারেন।

রিজিজুর বই পড়া অভ্যেস কেমন জানি না, কিন্তু আমি নিশ্চিত যে তিনি তেহেলকার প্রখ্যাত সাংবাদিক রাণা আইয়ুব-এর 'Gujarat Files: Anatomy of a Cover up' পড়ার সুযোগ পাননি। নরেন্দ্র মোদির মুখ্যমন্ত্রীত্বে ‘এনকাউন্টার’ বা ভুয়ো সংঘর্ষ নাম দিয়ে অমিত শাহের স্বরাষ্ট্র বিভাগ কর্তৃক গুজরাটে নিরীহ মানুষকে কিভাবে খুন করা হয়েছে তার নির্মম দলিল এই গুজরাট ফাইলস্। এই রাজ্যের ভুয়ো সংঘর্ষগুলির অন্যতম নাম সাদিক জামাল, ইসরাত জাহান, সোরাবুদ্দিন, তুলসিরাম প্রজাপতি ইত্যাদি। ভুয়ো সংঘর্ষগুলির সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত পুলিশ ও প্রশাসনের উচ্চপদাধিকারী অফিসারদের সঙ্গে সাক্ষাৎকার থেকে বেরিয়ে আসা তথ্যভিত্তিক প্রতিবেদন এই গুজরাট ফাইলস। এই প্রতিবেদনে বেরিয়ে এসেছে কেমন স্বার্থপর নির্দয় প্রকৃতির মানুষ নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহ। তবে এ ব্যাপারে মোদিজি এক কাঠি উপরে। আর একটি সত্য বেরিয়ে এসেছিল যে ‘এনকাউন্টারের সঙ্গে জড়িত অধিকাংশ অফিসারই দলিত জাতের মানুষ’। এটা ছিল মোদিজির কাজের ডিজাইন। এদেরকে কুকর্ম করতে বাধ্য কর, কাজ হয়ে গেলে ছুঁড়ে ফেলে দাও। সুতরাং রিজিজুর গর্হিত কর্মের ফলও তাই হল। আরএসএস প্রশিক্ষিত কৌশলী ব্রাহ্মণ্যবাদী নেতা মোদিজি যখন বুঝলেন যে এ পথে বেশিদূর এগোনো সম্ভব নয়, বিশেষ করে রিজিজুকে দিয়ে, বুঝলেন সুতো গোটানোর সময় হয়েছে, তখন তিনি রিজিজুকে আইন মন্ত্রক থেকে সরিয়ে দিতে এতটুকু দ্বিধা করলেন না। তাইতো বলি ‘ইয়ে তো হোনাহি থা’। মোদি অমিত শাহদের আম্বেদকর প্রীতি, তপশীলি আদিবাসী প্রীতি যে শুধু ভোট সংগ্রহের তাগিদে লোক দেখানো প্রীতি, সেকথা এই সম্প্রদায়ের মানুষগুলো কবে বুঝবে? আদৌ বুঝবে কি?