আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ একাদশ সংখ্যা ● ১-১৫ জুন, ২০২৩ ● ১৬-৩১ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩০

প্রবন্ধ

সাভারকারের সাম্প্রদায়িক সত্তা

শ্রীদীপ


"একটি শিশুর যদি কোনো শারীরিক ত্রুটি থাকে, বা সে যদি কোনো দুরারোগ্য রোগ নিয়ে জন্মায়, বা সে যদি বিকৃত বা বিকলাঙ্গ হয়, তবে রাষ্ট্রের বিধান হওয়া উচিতঃ অবিলম্বে তার প্রাণদণ্ড দেওয়া।" - সাভারকার (ভারতবর্ষের ছটি মহৎ কাল)।

এটি কেবল একটি বাক্য নয়, এটি একটি অভ্যন্তরীণ নিষ্ঠুর ধারণা। এটি একটি পরিচালনা-শক্তি। হিংস্র হ'লেও তা সত্যি। হিংসার সাথে হিন্দুত্ববাদের যে নিবিড় সম্পর্ক আছে, সাভারকার-এর নির্মম ও সংবেদন-শূন্য উক্তি তারই চূড়ান্ত নিদর্শন। এই নৃশংস বোধের পিছনে কাজ করছে স্বধর্ম শুদ্ধিকরণের প্রয়াস ও বিধর্মের প্রতি ঘৃণা ও প্রতিহিংসার লালন-পালন। বিধর্মী মানেই বাইরের লোক, বা আক্রমণকারী, বা অনুপ্রবেশকারী। বিধর্মীর সংস্পর্শে হিন্দু ধর্মের সংকট বা ধর্ম কলুষিত বা অপবিত্র হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। সেই অস্তিত্বের সংকট ও নিরাপত্তাহীনতা বর্তমানেও অহরহ শোনা যায়ঃ 'হিন্দু খতরে মে হ্যায়' - অর্থাৎ, হিন্দুরা বিপন্ন। সেই কল্পিত ভিক্টিম-ন্যারেটিভ রাষ্ট্রসম্মতভাবে বিকোচ্ছে। সাভারকারের কিছু ধ্যান-ধারণা আমাদের বুঝতে সাহায্য করে, বিধর্মীর নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার প্রয়াসের আড়ালে কি জাতীয়তাবাদ মতবাদ কাজ করে। বা বিধর্মীকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত করার পিছনে কি প্রকার চক্রান্ত আছে।

বিধর্মীকে হয় ভিনদেশে ভাগাও, অথবা 'দেশদ্রোহী' তকমা এঁটে তার মর্যাদা লাঘব করো, অথবা জনসম্মুখে তাকে পিটিয়ে তার অবমাননা করো। তাতেও কাজ না হ'লে রামনবমীতে বন্দুকবাজি অথবা এনকাউন্টারের পথ তো এখন রাষ্ট্র প্রদত্ত সামাজিক অধিকার। হিংসা যেখানে সীমাহীন, সেখানে গান্ধী-হত্যাকেও ন্যায্যতা দিতে অসুবিধে হয় না হিন্দুবাদীদের। হিংসাকে মান্যতা দিতে গেলে তো শান্তি-দূতের নিধন অবশ্যম্ভাবী। তা সে গান্ধী হোক বা বুদ্ধ - শান্তির বাহক মাত্রেই তারা হিন্দু ধর্মকে পুরুষত্বহীন ও দুর্বল ক’রে তোলে - যা কিনা বিধর্মীদের আক্রমণের পথ সহজ ক'রে দেয় - এমনটাই ভাবতেন সাভারকার। বুদ্ধকে তিনি দুর্বল ও ‘অভ্যন্তরীণ-ভাইরাস’ বলতে পিছুপা হননি। যথেচ্ছ বলপ্রয়োগ যেখানে ক্ষমতা অর্জন ও প্রতিপালনের ভিত্তিস্বরূপ, সেখানে গান্ধী প্রতিপক্ষ হ'য়ে উঠবে সেটাই তো স্বাভাবিক। সবল হিন্দুর বলপ্রয়োগকে গৌরবান্বিত করতে গিয়ে সাভারকার নিজের লেখায় অকপটে উদযাপন করছেন গ্রিক, সাকা, কুশান, হুন ও মুসলমান পরাস্ত করার প্রচুর হিন্দু নিদর্শনঃ শিবাজীর হাতে আফজাল খানের মৃত্যু; বিক্রমাদিত্যের হাতে সাকাদের পরাস্ত হওয়া; দুর্বল বহিদ্রনাথ মৌর্যর মৃত্যু তারই সামরিক কর্মকর্তা পুষ্যমিত্রের দ্বারা। এ সকল জয়ই, সাভারকারের মতে, হিন্দু ধর্মের বীরত্ব ও পৌরুষের ধারক-বাহক।

সাভারকারের মতবাদের অনেকটা জুড়ে আছে আরেকটি ভাবনাঃ শুদ্ধিকরণ। সেই ভাবনার ভিত্তিতে যেই বিশ্বাস বিরাজমান, সেটি এক ধরণের হিন্দু উৎকৃষ্টতা। তাঁর মতে হিন্দু সমাজ-সংস্কৃতি একটি জীব যার প্রাণশক্তি হিন্দু রাষ্ট্রবাদী চেতনা। প্রতি ধর্মান্তরে সেই প্রাণ ও প্রাণী বিপন্ন হয়ে পরে ও তার অবক্ষয় ঘটে। আর সেটা শুধু পরিসংখ্যানগত ক্ষতি বা লোকসান নয়; তা একপ্রকারের মর্মান্তিক রক্তক্ষয়ের সমতুল্য। পুনর্বার ধর্মান্তরের মাধ্যমে যারা চলে গিয়েছিলো তাদের হিন্দু ধর্মে ফিরিয়ে আনতে হবে। তবেই স্বধর্মের জীবনীশক্তি ও বীর্য বজায় থাকবে।

পুনর্বার ধর্মান্তর দ্বারা, শুদ্ধিকরণ দ্বারা ও পৌরুষময় বলপ্রয়োগ প্রক্রিয়ায় - সাকার হবে 'অখণ্ড-ভারতের' স্বপ্ন। 'অখণ্ড' কথার অর্থ কেবল অবিভক্ত এমনটা ভাবলে, সেই ভাবনা অসম্পূর্ণ। ‘অখণ্ড-ভারত’ ঐতিহাসিকভাবে কেবলমাত্র হিন্দুদের জন্ম-কর্ম-পীঠস্থান। সেখানে আর কোনো বহিরাগত ধর্মের মানুষের জন্য জায়গা থাকতে পারে না। সাভারকারের ভাষায় তারা সকলেই ম্লেচ্ছ ও পাশবিক - 'পিশাচ প্রায়'। তাঁর লেখার মধ্যে আমরা পাই হিন্দু-রাষ্ট্র-গঠনের রূপরেখা। সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করতে গেলে বলপূর্বক উপায়ে সংখ্যাগরিষ্ঠের হাতে ক্ষমতা রাখা ও তাঁর প্রদর্শনই যথেষ্ট নয় - সেটি আদতে একটি সংকীর্ণ সমধর্মীয় প্রকল্প। বলাই বাহুল্য, সেখানে ধর্মীয় বৈষম্যর কোনো জায়গা নেই।

গোড়া থেকেই এই সাম্প্রদায়িক সূচির রন্ধ্রে রন্ধ্রে রয়েছে বহিষ্কারক-ভাবনা। অন্য ধর্মের প্রতি সৌহার্দ্য, সৎভাব ও প্রীতি নয়, বরং তাঁর থেকে নিজেকে আলাদা স্থাপিত ক'রে তাকে কলুষিত করা। বিধর্মের সাথে দূরত্ব ও তাঁর প্রতি ঘৃণা উৎপাদন করা। অন্যকে তুচ্ছ করে, খর্ব করে, নিজেকে মহিমান্বিত করা। অন্যকে দোষী সাব্যস্ত করে, নিজেকে নিপীড়িত প্রমাণিত করা। অন্যকে অনবরত 'শত্রু' বলে জাহির ক'রে - হয় তাকে বহিষ্কার করা, নয় তো নিজেকে তার হাত থেকে বাঁচাবার জন্য সচেষ্ট হওয়া - অস্ত্র হাতে তুলে। অস্ত্রের ভার সামলাবার জন্য, হিন্দু বিগ্রহদের (রাম বা হনুমান) দৃশ্যগতভাবে আরো আরো পুরুষালি ও পেশীবহুল করে তুলেছি আমরা গত ক-বছরে।

ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িক ভাবনা, এক সময় সাভারকার রচনা করলেও, আজ সে মন্ত্রে প্রভাবিত হয়ে, সাংগঠনিকভাবে সে কাজটি মন্ত্রণালয়, মিডিয়া, মন্দির-কমিটি, মস্তান-বাহিনী, গো-মাতা রক্ষকেরা সম্মিলিতভাবে করছে। ছাপ্পান্ন ইঞ্চির বুক প্রসারিত ক'রে আমরা মানুষে-মানুষে বিভেদ সৃষ্টিকারী আগ্রাসী নেশায় বিভোর হয়েছি। আমরা সৃষ্টি করেছি এক নতুন ভয়ডরহীন-ভারত, যেখানে ভেদ ও ভীতি সৃষ্টি করাটা বৈধ রাষ্ট্রীয়-প্রকল্প। এ নতুন ভারত নাকি শত্রু-দেশে হানা দিতে পিছু পা হয় না। এ নতুন ভারত এতটাই সাম্প্রদায়িক মন্ত্রে মন্ত্রমুগ্ধ, যে সেই সেনা-হানার কোনো প্রমাণ, নাগরিক চায় না। কথায় আছে - বিশ্বাসে মিলায়ে বস্তু, তর্কে বহু দূর। এই অমৃতকালে, আমরা বিশ্বাসকে প্রাধান্য দিয়ে যুক্তিকে এতটাই অবজ্ঞা করতে শিখেছি, যে সরকারের উদ্দেশ্যে যুক্তিসংগত প্রশ্ন বা সমালোচনা মানেই দেশদ্রোহিতা।

আমাদের সুগভীর সাম্প্রদায়িক-সত্তা, আমাদের সুস্থাপিত সংখ্যালঘু-বিদ্বেষ, সমস্ত বিভিন্নতার আদর্শ জলাঞ্জলি দিয়ে - সাভারকারকে জিতিয়ে দিচ্ছি রোজ। আমরা ভুলে গেছি আমরা এক ধর্ম-নিরপেক্ষ রাষ্ট্রের নাগরিক। প্রতি মুহূর্তে হিন্দু ধর্মের উৎকর্ষ ও ঐশ্বর্য প্রতিষ্ঠা করে, বিশ্ব-গুরু হওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে, আমরা ভুলে গিয়েছি - যে আধুনিকতা ও সংবিধানের মূলে আছে ধর্ম ও রাষ্ট্রের মধ্যে টানা সীমারেখা। আমরা ভুলে গিয়েছি যে ধর্ম একটা ব্যক্তিগত বিশ্বাসের ক্ষেত্র - সেটা রাষ্ট্র-অনুমোদিত আধিপত্য জাহির করার ক্ষেত্র নয়।

কোনো এক যুক্তি হরণকারী শক্তি প্রতিনিয়ত প্রমাণ করে চলেছে যে আমরা কতটা অনাধুনিক, অসহনশীল ও অযৌক্তিক। কোনো মধ্যযুগীয় অবিচারের প্রতিশোধ যে ২০২৩-এ নেওয়া সম্ভব নয়, সেটা বোঝার মতো স্বাভাবিক বুদ্ধি আমাদের লোপ পেয়েছে। অগ্রগতির পথে অতীতের গৌরব বা নিপীড়ন কোনোটাই মূলধন হ'তে পারে না - তা সে সাভারকার বা বঙ্কিম যাই লিখে থাকুক না কেন। তাঁদের সাম্প্রদায়িক দুর্ভাবনাগুলি অত্যন্ত বিপদজনক কিছু জঞ্জাল সৃষ্টি ক'রেছে - যা সাফ করার কোনো বিশোধক সুশীল সমাজ খুঁজে পাচ্ছে না।