আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ একাদশ সংখ্যা ● ১-১৫ জুন, ২০২৩ ● ১৬-৩১ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩০

সমসাময়িক

বিস্ফোরণ, উন্নয়ন আর বাঙালি


সম্প্রতি বাংলার আকাশ বারুদ আর ঝলসানো শবের গন্ধে সচকিত হয়ে উঠেছে। বিগত ১ মাসে এই রাজ্যের বিভিন্ন কোণায় মজুত বাজি বা বোমার বিস্ফোরণে ১৭ জন মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। বাংলার তো বটেই, এমনকি সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমেও হইচই পড়ে গিয়েছে। বাংলার ঘরে ঘরে কি তবে বারুদের স্তুপ? রাজ্যের বিরোধী দলগুলি যদিও দীর্ঘদিন ধরে বলে চলেছে যে গোটা রাজ্যটাই আজ বারুদের স্তূপের উপর বসে রয়েছে, কিন্তু সত্যিই কি তাই? একি বাস্তবিকই রাজ্যের লুপ্তপ্রায় আইন-শৃঙ্খলার বাহ্যিক প্রকাশ, নাকি বেআইনি অর্থনীতির ফল, না এক গভীর রাজনৈতিক ব্যাধি তার উত্তর কে দেয়। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ, গত এক মাসে রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় বেআইনি বাজি কারখানায় বিস্ফোরণ ঘটেছে, আর অল্প কিছু ক্ষেত্রে শাসকদলের তরতাজা কর্মীর বাড়িতে মজুত বোমার বিস্ফোরণ ঘটায় ১৭ জন প্রাণ হারিয়েছেন। তবে বিস্ফোরণ ঘটলেই যেভাবে সরকারি মহল ও তার ধামাধারী সংবাদমাধ্যম বেআইনি বাজি কারখানার তত্ত্ব প্রচার করেন তাতে এই সন্দেহই জোরদার হয় যে ওগুলো আদৌ বাজি না অন্য কিছু।

রাজ্যের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির দাবি আসলে সবগুলোই বোমা বিস্ফোরণ। তাদের অভিযোগ আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচন উপলক্ষে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখার ও উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে রাজ্যের শাসকদল বদ্ধপরিকর। ফলে তারা পঞ্চায়েতে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা চান। সেই উপলক্ষে চলছিল এই বোমা শিল্প। কানাঘুষো যে অকালে বিস্ফোরণ না ঘটলে এই বোমা নির্বাচনের আগে পরে বিরোধী রাজনৈতিক দলের কর্মীদের উপরেই প্রয়োগ হত। দুর্ঘটনাক্রমে আগেই বিস্ফোরণ ঘটে গেছে। অন্যদিকে রাজ্যের শাসক দল এবং পুলিশ প্রশাসন জানাচ্ছেন যে এগুলি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বেআইনি বাজি কারখানার দুর্ঘটনা। কিছু দুষ্টু লোক গ্রামীন পুলিশ প্রশাসনকে নেহাতই বোকা ঠাউরে প্রায় এক দশক ধরেই এই কারবার করছে। স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন শিশুসুলভ সরলতায় স্থানীয় শাসকদলের নেতার আশ্বাসবাণীতে নিশ্চিত ছিলেন যে সোনার বাংলার গ্রামে গ্রামে সব ঠিক আছে। যদিও নিন্দুকেরা বলে বেআইনি কারখানার মুনাফার ভাগ প্রশাসনিক পকেট অবধি পৌঁছে যায়। তাই পুলিশও চোখ বুজে থাকে। তরজা চললেও একথা পরিষ্কার, গোটা বিষয়টাই আর কেবল আইন-শৃঙ্খলার সমস্যা নয়, কোনও না কোনওভাবে এক গভীর রাজনৈতিক অসুখের বহিঃপ্রকাশ।

এ যাবত সবচেয়ে বড় তথাকথিত বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে মেদিনীপুর জেলার এগরায়। মুখ্যমন্ত্রী এলাকায় গিয়ে দাবি করেছেন যে পুলিশের খবর সংগ্রহে গাফিলতি ছিল। স্থানীয় থানার অফিসার খোঁজখবর রাখেননি। তাই তাকে বদলি করে 'শাস্তি' দেওয়া হয়েছে আর বিস্ফোরণে নিহতদের পরিজনকে রাজ্য পুলিশের হোমগার্ডের চাকরি ও ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। তবে বাজি (নাকি বোমা) কারখানার মালিক, তৃণমূল নেতা খুব বদমাশ লোক। বিস্ফোরণে দুর্ভাগ্যবশত এই কর্মবীর মারা গিয়েছে। কিন্তু তার পরিবার কোনও ক্ষতিপূরণ পাবেনা। সুতরাং রাজ্যের প্রশাসন যে দোষীকে রেয়াত করছে না একথা এর চাইতে উচ্চকিতভাবে তো আর বলা যায় না। যদিও আদালতে মামলা হয়েছে এই ঘটনার তদন্ত কেন্দ্রীয় সংস্থা এনআইএ কেন করবে না বা বিস্ফোরক আইন কেন প্রয়োগ হবেনা ইত্যাদি প্রশ্নে। ওদিকে আবার মুখ্যমন্ত্রী বলেই দিয়েছেন যে এটি বেআইনি বাজি কারখানা ছিল, এখানে বাজি তৈরী হয়ে ভিন রাজ্যে যেত ইত্যাদি ইত্যাদি। যদিও এই বিস্ফোরণে একজন নিহত মহিলার পুত্র অভিযোগ করেছেন যে তার মা-কে জোর করে এই কারখানায় কাজ করতে নিয়ে যাওয়া হত এবং সামনে নির্বাচন থাকায় কাজের চাপ বেশী ছিল। সুতরাং এত দাবির ভিড়ে আসল সত্য যে গুলিয়ে যাবে তা আর নতুন কি।

তথ্যের ভিড়ে যে প্রশ্ন চাপা পড়ে যায়, তা হল বাজি হোক বা বোমা, প্রধানত বাংলার গ্রামে গ্রামে এই দুর্ঘটনার উৎপত্তি কেন? কেনই বা বাংলার রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে এত গোলা বারুদের দরকার পরে? কেনই বা নিহতের তালিকায় গরীব ও অন্ত্যজ মানুষের নামই থাকে? এই প্রশ্নের উত্তরগুলি একমাত্রিক নয়। স্থানীয় রাজনীতি, অর্থনীতির পাশাপাশি, শহর কলকাতার আমাদের মত বাবু-বিবিদের অবদানও নেহাত উহ্য নয়।

প্রথমত আমরা যদি সরকারি ভাষ্যেও বিশ্বাস রাখি তাহলে এই প্রশ্ন আসে যে গ্রাম বাংলায় এহেন বেআইনি বাজি কারখানার ছড়াছড়ি কেন? আইন মোতাবেক কি বাজি কারখানা তৈরী করা খুবই কষ্টসাধ্য, নাকি বিধিসম্মত অনুমতি নিতে গেলে বা সৎপথে ব্যবসা করতে গেলে শাসকদলের নেতা কর্মীদের তুষ্ট করতে গেলে লাভের গুড় পিঁপড়েতে খেয়ে যায়? আর যে সরকারের পুলিশ মাঝরাতে পাঁচিল টপকে বাড়ি ঢুকে গুলি চালিয়ে অভিযুক্তকে মেরে ফেলতে পারে তাদের কাছে এইসব বেআইনি কারখানার হালতামামি থাকেনা একথা কি বিশ্বাস করা যায়। বরং তাদের সাহায্য ছাড়া এসব যে সম্ভব নয় তা নাবালকেও বোঝে। সুতরাং গোটা রাজ্যে যে দুর্নীতির এক বাস্তুতন্ত্র কায়েম রয়েছে তা বোধগম্য। কিন্তু তাকে আটকানোর সরকারি সদিচ্ছা কি আদৌ আছে? নাকি এই বাস্তুতন্ত্র বজায় রাখার মাসিক খোরপোষ সরকারি নেতা মন্ত্রীদের পকেট ফাঁপিয়ে তোলে? একথা তবে বলতেই হয়, ব্যক্তিগত লাভের আশায় রাজ্যের শাসক দল রাজ্যে আইনের শাসনটুকু বজায় রাখার দায়িত্বটুকুও নিতে নারাজ। অন্য বিশ্লেষণে একথা প্রকাশ পায় যে এইসব আবিষ্কৃত বেআইনি বাজি শিল্পের অধিকাংশের মালিক তৃণমূল দলের নেতা বা কর্মী। এ কি নিছক সমাপতন, না আদতে এই অভিযোগেরই প্রমাণ যে এসব বাজি কারখানা নয়, বোমা কারখানা।

একথা আজ পরিষ্কার যে গ্রামীন অর্থনীতির দখল আজ এক লুব্ধকর প্রতিযোগিতা। খোলা বাজার অর্থনীতির হাত ধরে আজ ভারতবর্ষের গ্রামে গ্রামে উন্নয়নখাতে কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ হয়। ভাঁড়ে মা ভবানী এই রাজ্যের গ্রামে গরীব থেকে তৃণমূলের নেতা কর্মীদের আয়ের সংস্থান এই অর্থ থেকেই হয়। গরীব মানুষ আশায় থাকেন এই উন্নয়ন প্রকল্পের উচ্ছিষ্ট নিয়ে, বা এর আওতায় সামান্য একটা কাজ জুটে যাবে। অন্যদিকে হয় সেই অনুদানের ভাগ মেরে বা প্রকল্পের পুরো টাকাই বেআইনিভাবে নিজের পকেটে পোরার ধান্দায় ঘোরে তৃণমূলের নেতা থেকে কর্মীরা। ফলে বাঁদরের পিঠে ভাগের এই খেলায় তারাই এগিয়ে যাদের আছে অন্যকে তাঁবে রাখার জোর। প্রশাসনের পৃষ্ঠপোষকতা পেলে শাসকদলের তরতাজা কর্মীরাই যে এই যুদ্ধে জয়ী হবেন তা বলাই বাহুল্য। তবে এই সরকারি সাহায্যের হাত কার মাথায় থাকবে তা ঠিক হয় গ্রামের নির্বাচনী রায় কে সাফল্যের সাথে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে তার ভিত্তিতে। সুতরাং বন্দুকের নল আর বোমার আওয়াজ হয়ে ওঠে ক্ষমতার উৎস। তাই গ্রামীণ লুম্পেন বাহিনীর ভিতর শুরু হয় অস্ত্র তৈরীর প্রতিযোগিতা। জোর যার মুলুক তার।

কিন্তু নিহতের তালিকায় কেবল গ্রামের গরীব আর অন্ত্যজ মানুষেরাই কেন? আসলে তৃণমূলী শাসনে রাজ্যের গ্রামীন অর্থনীতির আজ নাভিশ্বাস উঠে গিয়েছে। ২০২১-এর কেন্দ্রীয় সমীক্ষা বলছে এ রাজ্যে কৃষিক্ষেত্রে দৈনিক আয় গড়ে ২২ টাকার আশেপাশে। রাজ্যের সরকার কৃষক আত্মহত্যা হয় না দাবী করলেও বেসরকারি সূত্রে প্রকাশ বিগত ২ বছরে এ রাজ্যে ১৫০-এর বেশী চাষী আত্মহত্যা করেছেন। এ রাজ্যে সরকার ফসলের অভাবী বিক্রী ঠেকাতে আজ অবধি কোনো পরিকল্পনা করেনি। অন্যদিকে স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলিও সরকারি সাহায্য আজ পায়না। ফলে সব মিলে এ রাজ্যে গ্রামের গরীবদের সামনে দুটি রাস্তা, হয় ভিন রাজ্যে কাজ করতে যাওয়া নয়ত তৃণমূলের নেতাদের গড়ে তোলা বেআইনি ব্যবসায় মজুর খাটা। সরকারি অনুদান প্রকল্প যে গ্রামের গরিব মানুষের কোন সুরাহা ঘটাতে পারেনি তার প্রমাণ এগরার বিস্ফোরণে নিহত ১২ জনের অধিকাংশই মহিলা। ফলে সরকারি ভ্রান্ত নীতি আর অপশাসনের যাঁতাকলে গরিব মানুষ পিষছেন। ক্ষমতার দাবা খেলায় তারা আজ শুধুই কামানের খাদ্য।

কলকাতার নাগরিক সমাজও কি এই নৈরাজ্যের দায় অস্বীকার করতে পারেন? গ্রামের মানুষের শোষণমুক্তির জন্য যারা এককালে সোচ্চার হয়েছিলেন, সরকারি মঞ্চে ভাড়া খেটে খেটে তারা এখন মগজে কারফিউ জারি করে ফেলেছেন। তাই সরকারি অনুদানকে মহিমান্বিত করে বিপ্লব এসে গেছে বলে চিৎকার করছেন। কলকাতা শহরের বাইরে তাদের চোখ যায়না। গোটা রাজ্যের অর্থনীতি যে ডুবছে আর তার পাঁকেই যে এই রাজ্যে বারুদের ফুল ফুটছে এই সত্য তারা কবে চিৎকার করে বলবেন? নির্বাচনে হানাহানি ঘটলে মাথা নেড়ে গলা ভারী করে সংবাদমাধ্যমের পর্দায় তারা এ রাজ্যের রাজনীতির নিম্নগামীতা নিয়ে বক্তব্য দেবেন কিন্ত কেন রাজ্যটা আজ বারুদের স্তূপের ওপর বসে পড়ল তার বিশ্লেষণে তারা নারাজ। আটকাতে পথে নামা তো দূর অস্ত। তাই আজ গ্রামের গরীব জনতাকেই দায়িত্ব নিতে হবে সংগঠিত হওয়ার, এই বাহুবলের রাজনীতির মোড় জনতার হিতার্থে পরিচালনা করার। উপরে না তাকিয়ে বরং আজ গরীব অন্ত্যজ মানুষদের নিজেদেরই দায়িত্ব নিতে হবে গ্রামীণ রাজনীতির রাশ নিজেদের হাতে নেওয়ার।