আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ একাদশ সংখ্যা ● ১-১৫ জুন, ২০২৩ ● ১৬-৩১ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩০

সম্পাদকীয়

‘স্বর্ণ আর দর্পের বুদ্‌বুদ্‌’


২৮ মে দিনটি ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল আজ থেকে বহু বছর আগেই, কারণ সাম্প্রদায়িক-ফ্যাসিবাদী হিন্দুত্বের জনক, বিনায়ক সাভারকারের জন্ম হয়েছিল এই দিনটিতে। আর ঠিক এই দিনটিতেই ভারতের নতুন সংসদ ভবনের উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ঠিক এই দিনটিকেই বেছে নেওয়ার নেপথ্যে রয়েছে আরএসএস-বিজেপি-র সুচিন্তিত পদক্ষেপ। 'হিন্দু রাষ্ট্র' বানানো যাদের লক্ষ্য তাদের গুরু সাভারকর। অতএব সাভারকরের জন্মদিনে নতুন সংসদ ভবনের উদ্বোধন এই বার্তাই দিচ্ছে যে দেশটি আসলে বকলমে 'হিন্দু রাষ্ট্র' হয়ে গেছে।

যাদের মনে হচ্ছে যে কথাটি একটু অতিরঞ্জিত শোনাচ্ছে তারা দয়া করে ২৮ মে, ২০২৩ তারিখে নবনির্মিত সংসদে প্রধানমন্ত্রী কাদের দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিলেন সেইদিকে একবার তাকাবেন। প্রধানমন্ত্রীর আশেপাশে কোনো মন্ত্রী, আমলা, রাজনীতিবিদ, বিরোধী দলের নেতা, সাংস্কৃতিক জগতের মানুষ, এমনকি দেশের রাষ্ট্রপতিকেও দেখা যায়নি। প্রধানমন্ত্রী পরিবেষ্টিত হয়ে ছিলেন হিন্দু সাধুদের দ্বারা। যজ্ঞ-হোম ইত্যাদি ক্রিয়াকর্ম সম্পাদিত হয়েছে সংসদে। পুরোহিত-ব্রাহ্মণরা মন্ত্র উচ্চারণ করেছেন, প্রধানমন্ত্রী সটান শুয়ে পড়ে প্রণাম জানিয়েছেন একটি রাজদণ্ডকে। গণতান্ত্রিক দেশের প্রধানমন্ত্রী, যিনি দেশের গণতান্ত্রিক সংবিধান মেনে শপথ নিয়েছেন তিনি প্রণাম জানাচ্ছেন একজন সাধুর উপহারকে। এই রাজদণ্ড আসলে বিধাতার তরফে মর্ত্যলোকে রাজার রাজত্বের প্রতীক। যতই আরএসএস-বিজেপি প্রচার করুক না কেন যে রাজদণ্ডটি ব্রিটিশ শাসন থেকে ভারতের জনগণের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রতীক, এখন প্রমাণিত হয়ে গেছে যে রাজদণ্ডটি আসলে তামিলনাডুর একটি মঠের উপহার, পণ্ডিত নেহরুকে।

ইতিহাসকে বিকৃত করে এই দণ্ডটিকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে একটি প্রতীক হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা হচ্ছে, আসল সত্য থেকে মানুষের মন ঘুরিয়ে নেওয়ার জন্য। আসলে সেদিন নবনির্মিত সংসদ ভবনে প্রধানমন্ত্রী যেন অভিষিক্ত হয়েছেন রাজসিংহাসনে। তাই ওই রাজদণ্ডে প্রণাম, তাই স্পিকারের চেয়ারের পাশে তার অধিষ্ঠান।

রাষ্ট্র বিজ্ঞানের ছাত্র-ছাত্রীরা জানে যে প্রজাতন্ত্রের অর্থ এমন একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা যেখানে রাষ্ট্রপ্রধান জনগণের দ্বারা নির্বাচিত। আমাদের দেশের রাষ্ট্রপ্রধান মাননীয় রাষ্ট্রপতি, যিনি সরাসরি জনগণের দ্বারা নির্বাচিত নন, কিন্তু সাংসদ এবং বিধায়কদের ভোটে নির্বাচিত। দেশের সংসদের সাংবিধানিক প্রধান মাননীয় রাষ্ট্রপতি। তাই সংসদ অধিবেশন শুরু হয় রাষ্ট্রপতির ভাষণের মাধ্যমে। অতএব, সংসদ ভবনের উদ্বোধন রাষ্ট্রপতি করবেন এটাই কাম্য। কিন্তু রাষ্ট্রপতি তো আর মোদী নন। তিনি মোদীর বরেই রাষ্ট্রপতি হয়েছেন। অতএব, রীতি-নীতি-সংবিধান এইসব জটিল বিষয় মাথায় রাখলে চলবে না। রাষ্ট্রপতিকে দিয়ে উদ্বোধন করানো যাবে না। কিন্তু রাষ্ট্রপতি কোনো সরকারী অনুষ্ঠানে থাকলে তাকে বাদ দিয়ে অন্য কেউ, এমনকি প্রধানমন্ত্রীও, কোনো কিছু উদ্বোধন করতে পারেন না। তার সমাধান মোদী করেছেন খুব সহজভাবেই। রাষ্ট্রপতিকে আমন্ত্রণই জানানো হয়নি। সমস্ত প্রচারের আলো মোদীর উপর। তিনিই রাষ্ট্রপ্রধান, তিনিই প্রধানমন্ত্রী, তিনিই রাজা, তিনিই মাই-বাপ, তিনিই হলেন হিন্দু-হৃদয়সম্রাট। এই বার্তা দেওয়ার উদ্দেশ্যেই সেদিনের অনুষ্ঠান সম্পন্ন হল।

নাকি ব্রাহ্মণ-পুরোহিতদের দ্বারা মন্ত্রোচ্চারিত অনুষ্ঠানে আদিবাসী মহিলা রাষ্ট্রপতির কোনো স্থান নেই, এই বার্তা দেওয়া হল? ভোটের জন্য, নির্বাচনী প্রচারের জন্য, আদিবাসী মহিলাকে রাষ্ট্রপতির আসনে মনোনয়ন দিয়ে জেতানো যায়। কিন্তু তামিলনাডুর মঠের প্রধান ব্রাহ্মণদের সঙ্গে শুধু নয়, তাদের উপরের আসনে কি একজন আদিবাসী মহিলাকে স্থান দেওয়া যায়? মোদীর হিন্দুরাষ্ট্রে যে তা হবে না তার জ্বলন্ত প্রমাণ মাননীয়া রাষ্ট্রপতিকে আমন্ত্রণ না জানানো। খেয়াল করলে দেখা যাবে যে সেদিনের অনুষ্ঠানে প্রায় কোনো মহিলাকেই কোনো ভূমিকায় দেখা যায়নি। দেশের ৫০ শতাংশ মানুষের প্রতিনিধিরা নতুন সংসদের উদ্বোধনে প্রায় অদৃশ্য হয়েই রয়ে গেলেন।

মনে রাখা দরকার যে এই নতুন সংসদ ভবন তৈরি করা হয়েছে এমন এক সময় যখন দেশে লকডাউন চলছিল। চারিদিকে হাহাকার, ভ্যাক্সিন-অক্সিজেন অপ্রতুল, দিল্লিতে চিতার আগুন নিভছে না। তবু, নতুন সংসদ ভবন এবং 'সেন্ট্রাল ভিস্টা'র নির্মাণ বন্ধ করা হয়নি। অনেকে বলেছিলেন নির্মাণ বন্ধ রাখুন। সেই টাকা দরিদ্রদের মধ্যে বিলিয়ে দিন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী অবিচল। তাঁর সাধের নতুন সংসদ ভবন নির্মাণ না করলে যে তিনি মধ্যযুগীয় বাদশাদের মতন তাঁর স্থাপত্যের নিদর্শন রেখে যেতে পারবেন না। দিল্লির লালকেল্লা, জামা মসজিদ বানিয়েছে মুঘলরা। ইতিহাস থেকে তাদের নাম মুছে দেওয়ার চেষ্টা করলেও লালকেল্লাকে তো আর ভেঙে ফেলা যাবে না! কিন্তু বাদশা মোদীর স্থাপত্য নির্মাণ কোথায়? উত্তর নতুন সংসদ ভবন।

অনেকে বলছেন যে বিরোধীরা এই সংসদ ভবন উদ্বোধন অনুষ্ঠান বয়কট করে ভুল করেছে। কিন্তু এই বিশ্লেষকদের তখন খুঁজে পাওয়া যায়নি যখন ভবনটি নির্মাণ হচ্ছিল। যখন কোনো স্তরে বিরোধীদের সঙ্গে কোনো আলোচনা না করে, তাদের আপত্তি উড়িয়ে দিয়ে ভবনটি নির্মাণ করা হয় তখন কিন্তু বলতে শোনা যায়নি যে সংসদ ভবনের নির্মাণ নিয়ে কেন বিরোধীদের সঙ্গে আলোচনা করা হচ্ছে না? তদুপরি, রাষ্ট্রপতিকে আমন্ত্রণ না জানানোর বিরুদ্ধে বিরোধীরা স্বাভাবিকভাবেই মোদী সর্বস্ব এই অনুষ্ঠান বয়কট করেছেন।

এই সংসদ যে গণতন্ত্রের পীঠস্থান হিসেবে পরিকল্পিত হয়নি, তার প্রমাণ সংসদের দেড় কিলোমিটার দূরে পাওয়া গেল। বিজেপি সাংসদ ব্রীজভূষণ শরণ সিংহ, যিনি ভারতের কুস্তি ফেডারেশনের সভাপতি, তাঁর বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার অভিযোগ করেছেন একাধিক মহিলা কুস্তিগির এবং তাঁর শাস্তির দাবিতে ধরনা চলছিল যন্তর-মন্তরে। কুস্তিগিরদের দীর্ঘদিনের আন্দোলনের সামনে সরকার মৌনব্রত ধারণ করে রয়েছে। যারা পদক জেতার পর মোদী তাদের পাশে নিয়ে গর্বিত ছবি পোস্ট করেছিলেন টুইটারে, সেই পদকজয়ী মহিলাদের আন্দোলন নিয়ে একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি তিনি। কিন্তু যেই কুস্তিগিররা নব্যনির্মিত সংসদের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলে দিল্লি পুলিশ তাঁদের উপর সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। অথচ যৌন হেনস্থায় অভিযুক্ত বিধায়ক সংসদের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সুসজ্জিত হয়ে হাজির। যারা অলিম্পিকে বিপক্ষের খেলোয়াড়দের কুস্তির প্যাঁচে মাটিতে ফেলে দেশের পতাকা উঁচু করেছেন, তাঁদের মাটিতে ফেলে মারা হল দিল্লির রাজপথে। ঠিক সেই সময় অনতিদূরে প্রধানমন্ত্রী ভাষণে বলছিলেন যে এই সংসদ ভবন গণতন্ত্রের পীঠস্থান!

গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি যেই সংসদ ভবনের উদ্বোধনে আমন্ত্রণ পাননি, যেখানে বিরোধী দলগুলি অনুপস্থিত, যেখানে গেরুয়া সাধু পরিবেষ্টিত হয়ে দেশের প্রধানমন্ত্রী একটি রাজদণ্ডকে প্রণাম করেন, যেখানে গণতান্ত্রিকভাবে আন্দোলন করতে গিয়ে পুলিশের হাতে হেনস্থা হতে হয় দেশের পদকজয়ী খেলোয়াড়দের সেখানে সংসদ ভবন নির্মাণ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু দেশের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান যে ভূলুন্ঠিত হয়েছে তা অনস্বীকার্য। এই সংসদ ভবনের আড়ম্বর ফিকে হয়ে গেছে মোদীর আত্মম্ভরিতার সামনে। এই সংসদ ভবনে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে কি না, তা সময় বলবে। আপাতত এই ভবন, কবির ভাষায়, ‘স্বর্ণ আর দর্পের বুদ্‌বুদ্'।