আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ দশম সংখ্যা ● ১৬-৩১ মে, ২০২৩ ● ১-১৫ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩০

প্রবন্ধ

অবিরত দ্বৈরথে বিজ্ঞান - হিন্দু-ইসলামি-খ্রিস্টীয় সংস্কৃতিবলয়

শুভাশিস মুখোপাধ্যায়


বইটির নামেই মালুম যে বর্তমান কালের যে তিনটি ধর্মীয় ভাবধারা চালু রয়েছে, তাদের সঙ্গে বিজ্ঞানের সংঘাত অবধারিত, এই সংঘাত ঘটমান-বর্তমান। তিনটি ধর্মীয় বাতাবরণ বিজ্ঞানের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে বেদ-বাইবেল-কোরানের জয়গানে মুখর। এর বিপরীতে ব্রুনো-কে পুড়ে মরতে হয়, গ্যালিলিও শেষ জীবনের দীর্ঘ সময় কাটান কারাগারে। ইসলামের আজকের চেহারা যাই হোক না কেন, আরব দেশে গ্রিসের জ্ঞানচর্চার সলতেটি জ্বলন্ত অবস্থায় সংরক্ষিত না হলে আমাদের আধুনিক দুনিয়ায় পৌঁছোতে আরও কয়েক শতাব্দী বেশি অপেক্ষা করতে হতো। সেখানেও আমরা দেখি যে আলোকবিজ্ঞানের জনক Ibn Al-Haytham (৯৬৫-১৪৪০) কারাগারে কাটিয়েছেন অনেক কটা বছর। আশীষ লাহিড়ীর সুচিন্তিত মত, “আর হিন্দু কৃষ্টি বলয়ে? সেখানে বিজ্ঞানের সঙ্গে ধর্মের কোনো জোরালো সংঘাতই কোনওদিন বাধেনি। ভারতের মহা-মহাবিজ্ঞানীরা অনায়াসেই অতি উচ্চমার্গের বিজ্ঞানচর্চার পাশাপাশি পদে পদে ধর্মের সঙ্গে আপোশ করে নিয়েছিলেন”।

যে মূল কয়েকটি প্রশ্নকে ঘিরে আশীষ লাহিড়ী তাঁর স্বতন্ত্র ১১টি প্রবন্ধ সাজিয়েছেন, তার মূল বিষয়, “আজকের হিন্দুত্ববাদ-কবলিত উত্তর-ঔপনিবেশিক ভারতে সেই ধর্ম-বিজ্ঞান সহাবস্থানের ঐতিহ্য আরও শক্তিশালী হয়েছে। কেন এমন হয়? বিজ্ঞানের ইতিহাস মন্থন করে সেই সব প্রশ্নের তথ্যসমর্থিত উত্তর খোঁজার চেষ্টা”, এটিই তাঁর অন্বিষ্ঠ। বলা বাহুল্য, বিষয়ের গাম্ভীর্য, পাশাপাশি স্থানাভাব, এই দুইএর মধ্যে আপোশ করতে গিয়ে সব বিষয়ে সমান গভীরতা নিয়ে আলোচনা করা যায়নি, কিন্তু মোটের ওপর তিনি সফল।

একটু খটকা লাগে, তিনি এই প্রবন্ধাবলীর চাঁদমারি কাদের করেছেন সেই বিষয়ে। যদি জনপ্রিয় কালচারের ঢং-এ গভীর দার্শনিক বিষয়কে ছাঁচজাত করার অভিপ্রায় থাকে, তবে আশঙ্কা থেকে যায় যে কেবল ভঙ্গিটিই অনেক পাঠক আত্মস্থ করে ফেলতে পারেন, রসালো আমের আঁটিটিকে শাঁস হিসেবে চর্বনের দুর্মর চেষ্টা করতে পারেন। বইটির প্রথম প্রবন্ধটির নামকরণটিকেই ধরা যেতে পারে - “বড়মন্ত্রীর গুলিসুতোভক্ষণ”! গুরুচণ্ডালী অভিঘাতে এবং সরস উপস্থাপনায় মজে পাঠকের মগজে আশীষবাবুর মূল সিদ্ধান্তে পৌঁছোনোর কাজটা দুরূহ হয়ে উঠবে, সেই চিরন্তন 'কন্টেন্ট ও ফর্ম'-এর ধ্রুপদী বিতর্কের গোলকধাঁধায়। অথচ তিনি যে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন, সে বিষয়ে দেশের বহু যুক্তিবাদী মানুষ এবং বিজ্ঞানীরা একমত - “...ভারতের সংবিধানেই রয়েছে ‘বিজ্ঞানমনস্কতা’ (সাইন্টিফিক টেম্পার) গড়ে তোলার সংকল্পের কথা। কিন্তু ভারতীয় সমাজ - এমনকি সেই সমাজের কোনো কোনো বিজ্ঞানীও - সেই শুভ সংকল্পকে বাস্তবায়িত করার বদলে তার বিপরীত ধর্মীয় মেজাজ গড়ে তোলার জন্য সদাব্যস্ত, ধর্ম-বিজ্ঞান সমন্বয়ই তাঁদের ইষ্টমন্ত্র”।

“পয়গম্বরি হিন্দু বিজ্ঞান” প্রবন্ধে তিনি মীরা নন্দার সূত্র ধরে বিজ্ঞানের ইতিহাসের অপব্যখ্যার মাধ্যমে হিন্দুত্ববাদীরা তাদের মিথ্যার যে জাল প্রসারে অতিব্যস্ত, তার নির্মম উদ্ঘাটনের পর অতি প্রাসঙ্গিক মন্তব্য করেছেন, “...পিথাগোরাস না বৌধায়ন, কে ওই উপপাদ্যের ‘আবিষ্কারক’, এ প্রশ্নটাই বিজ্ঞানের ইতিহাসের বিচারে অবান্তর। বস্তুত ওই আকারে প্রশ্নটিকে উত্থাপনের পিছনে রয়েছে হিন্দুত্ববাদীদের নাতিসূক্ষ্ম চাল। তারা চাইছে অর্ধসত্য প্রচার করে সাধারণ, অ-বিশেষজ্ঞ মানুষের মনকে গুলিয়ে দিতে। কে না জানে, অর্ধসত্য মিথ্যার চেয়েও বিপজ্জনক?”

এই সংকলনের একটি প্রবন্ধের নামকরণ থেকে প্রতিপাদ্য বিষয়, দুই-ই যথেষ্ঠ চিত্তাকর্ষক। “উপমহাদেশে ইসলামঃ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি” (৭ম প্রবন্ধ)। আল-ঘাজ্জালি-র বয়ানে তিনি আমাদের জানিয়েছেন যে, “...বিজ্ঞানীরা যেসব ঘটনার মধ্যে কার্যকারণ সম্পর্ক আছে বলে মনে করেন, আসলে সেসব ঘটনার প্রতিটিই আলাদা আলাদা করে ঈশ্বরের তাৎক্ষণিক ইচ্ছায় সংঘটিত, একটা ঘটনার সঙ্গে অন্য ঘটনার কোনো বস্তুঘটিত সংযোগ নেই। সুতরাং ওপথে সত্যের সন্ধান পাওয়া যাবে না। ধর্মসাধনাই সত্যানুসন্ধানের একমাত্র পথ, একমাত্র কোরান-এর আক্ষরিক অনুসরণই সেই পথ দেখাতে পারে।”

এর বিপরীতে আশীষ লাহিড়ী দেখিয়েছেন যে, “...অনেক টাকা ঢেলে, অনেক বিজ্ঞানীর সমন্বয়ে, অনেকদিন ধরে, বিরাট মাপের বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান চালানো বিগ সায়েন্সের লক্ষণ।... ৮১৩ থেকে ৮৩৩ সাল পর্যন্ত শাসনকালে আল-মনসুর [বাগদাদের খালিফা, ৭১৪-৭৭৫] সেই কাজটিই করেছিলেন। বাগদাদের প্রথম মানমন্দিরটি তিনিই প্রতিষ্ঠা করেন। টলেমির কাছ থেকে প্রাপ্ত উপাত্তগুলির যাথাযথ্য এবং সত্যতা যাচাই করবার জন্য একদল ভূগোলবিদ, গণিতবিদ আর জ্যোতির্বিজ্ঞানীকে নিয়োগ করেন। শুধু তাই নয়, পৃথিবীর পরিধি মাপার জন্য এক বিরাট বৈজ্ঞানিক কর্মকাণ্ড সংগঠন করেছিলেন। এই সুসংগঠিত প্রয়াসের ফলেই সে' সময়কার পৃথিবীর সবচেয়ে বিস্তারিত মানচিত্র আঁকা সম্ভব হয়।” ভারতে নানা ধরণের 'মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং' প্রকৌশল ব্যবহারের ঐতিহাসিক স্বাক্ষ্য মিলেছে ত্রয়োদশ শতক থেকেই। নানান ঐতিহাসিক স্থানে এই সময় থেকেই পুলি, গিয়ার, এবগ তাদের সমাহারে অপেক্ষাকৃত জটিল যন্ত্রাদির দেখা মেলে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো এগুলি মূলত এসেছিল ইসলামি দুনিয়ার থেকে। প্রযুক্তির তাত্ত্বিক দিকেও উন্নতির লক্ষণ দেখা যায়। ঘূর্ণন গতিকে কেমন করে সরলরৈখিক গতিতে রূপান্তরিত করে নেওয়া যায় এবং সেই তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে কী করে যন্ত্র নির্মাণ করা যায়, তার উদাহরণও এই সময়ের ভারতে দেখা যায়। নানান আলোচনার পর আশীষ লাহিড়ী মন্তব্য করেছেন, “উদীয়মান পুঁজিতন্ত্রের অনুকূল উৎপাদনশীল এবং বিজ্ঞানবন্ধু নতুন কোনো প্রগতিশীল শ্রেণির উদ্ভব হল না বলেই ইসলামি বিজ্ঞানের শাসকনির্ভরতা কাটল না, ফলে এক সময় তা ধর্মধ্বজীদের কাছে হার স্বীকার করে নিল। এই জায়গাতেই ভারতে আর ইসলামি কৃষ্টিবলয়ে বিকশিত বিজ্ঞানের ইতিহাসের মিল। উভয় ক্ষেত্রেই বিজ্ঞানের বিকাশ ত্বরান্বিত হয়েছে তখনই, যখন ধর্মধ্বজীদের প্রতাপ অন্তত কিছুটা কমেছে, আর উভয় ক্ষেত্রেই বিজ্ঞানচর্চার পতন প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে আছে ধর্মধ্বজীদের উগ্র উত্থানের সঙ্গে।” আশীষ লাহিড়ীর এই কথাগুলি প্রণিধানযোগ্য।

শেষ প্রবন্ধে আশীষ লাহিড়ী, তাঁর নিজের ভাষায় “এক মোক্ষম কথা” বলেছেন। “...আধুনিক বিজ্ঞানের বয়স চার-শো বছর। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের বয়স কত? অন্তত পাঁচ হাজার বছর। এক দুধের শিশুর সঙ্গে লড়ছেন বহু যুদ্ধের বিজয়ী বীর পিতামহ ভীষ্ম। চার-শো বছরের ডেভিড হাড়ে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছে পাঁচ হাজার বছরের অভিজ্ঞতায় পরিপক্ক গোলয়াথের। বাইবেল-এ আছে, সামান্য ‘ফিংগা ও পাথর দিয়ে’ গোলয়াথকে পরাস্ত করার পর ডেভিড ‘তারই তরবারি খাপ থেকে খুলে নিয়ে তার মাথা কেটে ফেললেন। ফিলিস্তিনীরা তাদের বীর যোদ্ধাকে পরাজিত হতে দেখে পালাতে শুরু করল’।”

এই বইটিতে দুটি অত্যন্ত সুচিন্তিত পরিশিষ্ট আছে আর আছে এক বিস্তৃত সূত্রনির্দেশ। আজকের এই পরিব্যাপ্ত হিঁদুয়ানীর বেনো জলের বন্যায় ভেসে যাওয়া মানুষের কাছে বইটি “ওআরএস”-এর কাজ করবে।



অবিরত দ্বৈরথে বিজ্ঞান - হিন্দু-ইসলামি-খ্রিস্টীয় সংস্কৃতিবলয়
আশীষ লাহিড়ী
নির্ঝর
ফেব্রুয়ারি, ২০২২
পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ১৭৩
মুদ্রিত মূল্যঃ ২৭৫ টাকা