আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ দশম সংখ্যা ● ১৬-৩১ মে, ২০২৩ ● ১-১৫ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩০

সমসাময়িক

শেষ পর্যন্ত লড়াইটা আমাদের সকলের


এমন দিনের জন্যই কি আমরা অপেক্ষা করছিলাম না? আমরা কি জানতাম না কী হতে চলেছে? আর কী হতে পারে?

জানতাম। একেবারে প্রথম থেকে এর সর্বলক্ষণ পরিস্ফুট ছিল। প্রথম থেকেই এই নিম্নগমনের চিহ্ন ছিল সুস্পষ্ট।

সেই ২০১৩ সালেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে গেছে। শুধুমাত্র সারদা চিটফান্ড ১৭ লক্ষ আমানতকারীর কাছ থেকে প্রায় ২০,০০০-৩০,০০০ কোটি টাকা অর্থ আদায় করেছিল। রোজ ভ্যালি তুলেছে ১৭,০০০-৪০,০০০ কোটি টাকা। এমপিএস গ্রুপ ১৮ লক্ষ আমানতকারীর থেকে তুলেছে ১,৭৬৫ কোটি টাকা। এছাড়াও আছে আরও অসংখ্য নাম জানা ও না জানা চিটফান্ড সংস্থা। আলকেমিস্ট, আইকোর, সানশাইন। সব মিলিয়ে কত টাকার স্ক্যাম তা জানে একমাত্র মা সারদা। সেই চিটফান্ডের মালিকরা আবার সংবাদপত্রের মালিকদের সঙ্গেই তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে রাজ্যসভা আলো করে বসত।

তাই সিবিআই, সিআইডি, কলকাতা পুলিশ সবাই জোরদার তদন্ত করলেও ঠিকঠাক জানতে পারা যায়নি এই বিভিন্ন চিটফান্ড ও পঞ্জী স্কিমে মোট চোট খাওয়া আমানতকারীর সংখ্যা ও মোট আদায় করা অর্থের পরিমান। স্রেফ হাওয়ায় মিলিয়ে গেল বিপুল টাকা।

এজেন্টদের মৃত্যু মিছিল, আমানতকারীদের হাহাকার, লক্ষ লক্ষ মানুষের সব হারানোর বেদনা, এসব অতি তুচ্ছ ঘটনা। এই আমানতকারীদের অধিকাংশ ছিলেন গ্রাম ও শহরের গরীব ও স্বল্প শিক্ষিত মানুষ। এদের বাড়িতে যখন এজেন্টরা এসেছে, ভবিষ্যতের অনেক স্বপ্ন নিয়ে তাদের হাতে আঁচলে বাধা নোট মাসে মাসে আমানতকারীরা গুনে দিয়েছেন - এই আমার আপনার বাড়ির কাজের বিনিময়ে পাওয়া নোট। এরা এখন লুকিয়ে চোখের জল মোছেন। রাষ্ট্রের সাথে লড়াই করার ক্ষমতাই এদের নেই। আমরা শহুরে রাজনৈতিক, সামাজিক গোষ্ঠী, মিডিয়া, লিবারাল সমাজ এদের হয়ে লড়াই করিনি।

তারপর থেকে এই রাজ্যে ও অন্য রাজ্যে একের পর এক নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের ভূমিকা দেখছি। বিগত কয়েক বছরে বিভিন্ন রাজ্যের নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস কত হাজার কোটি টাকা ঢেলেছে তা নিয়ে আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে না। কোথা থেকে তারা এই বিপুল টাকা পেয়েছে তা নিয়েও প্রশ্ন করিনি। প্রশ্ন জাগে না কারণ আমরা নিজেদেরও প্রশ্ন করতে ভয় পেলাম।

আর তাই পঞ্জী স্ক্যামের পরে ২০২২ সাল থেকে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে আবার ফিরে এল অসংখ্য কেলেঙ্কারির খবর। সেই সময়ে হাইকোর্টের কতিপয় বিচারপতির তৎপরতায় নড়াচড়া শুরু করে সিবিআই। পশ্চিমবঙ্গের এসএসসি শিক্ষক নিয়োগ কেলেঙ্কারি থেকে পাওয়া ১০০ কোটি টাকারও বেশি অর্থ বাংলার প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী ও তৃণমূলের প্রাক্তন মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের কাছে পাওয়া গেল। ২৩ জুলাই, ২০২২ সালে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট তার বান্ধবীর বাসভবন থেকে ২১ কোটি টাকা উদ্ধার করার পরে তাকে গ্রেপ্তার করে।

নিয়োগ কেলেঙ্কারি মিডিয়ার শিরোনামে যায় কারণ রাজ্য শিক্ষা দফতরের ছয় জন আধিকারিককে ইডি অথবা কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরো (সিবিআই) গ্রেপ্তার করেছে। কলকাতা হাইকোর্টের হস্তক্ষেপে নিয়োগ কেলেঙ্কারির বিশদ বিবরণ প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথে, কীভাবে ওএমআর (অপটিক্যাল মার্ক রিডার) শিটগুলো ফাঁকি দেওয়া হয়েছিল তা প্রকাশ্যে এসেছে। তাবৎ বঙ্গবাসী ও বাঙালি বুদ্ধিজীবী সেই শিট নিয়ে বিশিষ্টদের বক্তব্য শুনে বুঝতে পেরেছেন, এই জমানায় কত অনায়াসে কত বিশাল প্রতারণা রাজ্য সরকার তার চাকরিপ্রার্থীদের সঙ্গে করতে পারে।

সন্দেহ হয়, সরকারি সমস্ত বিভাগেই কি নিয়োগ দুর্নীতি এই স্তরে পৌঁছেছিল?

চতুর্থ শ্রেণির কর্মী নিয়োগ সংক্রান্ত মামলার শুনানিতে সিবিআইয়ের আইনজীবী আদালতে দাবি করেন, গ্রুপ ডি কর্মী নিয়োগে সুপারিশের ৫০ শতাংশ ক্ষেত্রেই কারচুপি হয়েছে। অযোগ্য ১ হাজার ৯১১ জন গ্রুপ ডি কর্মীকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করার নির্দেশ দিয়েছে কলকাতা হাইকোর্ট। নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় এখনও পর্যন্ত কলকাতা হাইকোর্ট মোট সাড়ে পাঁচ হাজারের বেশি কর্মরতের চাকরি বাতিলের রায় দিয়েছে।

এতেও শেষ হয়নি। গত কয়েক বছরে পেঁয়াজের খোসার মতো পরতে পরতে বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতির তথ্য সামনে এসেছে। প্রতিদিন জানা যাচ্ছে একটার পর আরেকটা নতুন স্ক্যামের খবর। আসে বালি, অবৈধ কয়লা, খাদানের পাথর, গরু কেলেঙ্কারির খবর। শিক্ষক নিয়োগ ছাড়াও এসেছে বিভিন্ন বিভাগের সরকারি চাকরি বঞ্চনার খবর; একের পরে এক পৌরসভা, বনবিভাগ ও অন্যান্য নিয়োগ কারচুপির সংবাদ। এমনকী মিড ডে মিলেও চলে কারচুপি। কচিকাঁচাদের খাবারের জন্য বরাদ্দ সামান্য টাকা যাচ্ছে অন্য কারও পকেটে।

এদিকে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের গ্রেপ্তারের পর চাকরি প্রত্যাশীদের ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয়। বিগত কয়েক বছরে নিয়োগ প্রক্রিয়ার সাথে আপস করা হয়েছে বলে তাদের নিয়োগ দেওয়ার দাবিতে চাকরিপ্রার্থীরা রাস্তায় নামে। বিক্ষোভকারীরা আইনের দরবারে গিয়েও শহরের বিভিন্ন স্থানে ক্যাম্প করে, বিক্ষোভ, মিছিল, ফ্ল্যাশ বিক্ষোভের আয়োজন করে। আন্দোলনরত চাকরিপ্রার্থীদের ওপরে রাতের অন্ধকারে দমন পীড়ন দেখেও সমাজ ও তার বিদ্বজ্জনদের ঘুম ভাঙল না?

আর আমরা, বঙ্গীয় সুশীল সমাজ কত দিন এই চরম অন্যায় ও বঞ্চনা দেখে মুখ বুজে থাকব?

নিয়োগ কেলেঙ্কারির পাশাপাশি, আন্তঃসীমান্ত গবাদি পশু পাচার কেলেঙ্কারিতে আরেক তৃণমূল নেতা অনুব্রত মণ্ডলের গ্রেপ্তারও ছিল ২০২২ সালের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ইনিই তিনি, যিনি হুঙ্কার দিয়ে বলতে পারেন, “বড় বড় কথা বলছে এক কবি। এ কোন কবি? যে আমার ‘উন্নয়ন’ নিয়ে কথা বলছে। আমি এখনও বলছি রাস্তায় উন্নয়ন দাঁড়িয়ে আছে। ঘর থেকে বার হলেই উন্নয়ন দেখতে পাওয়া যায়।”

"দেখ্ খুলে তোর তিন নয়ন; রাস্তা জুড়ে খড়্গ হাতে; দাঁড়িয়ে আছে উন্নয়ন।" শঙ্খ ঘোষের সেই জবাব হতে পারত আপামর বুদ্ধিজীবীর মুখের ভাষা, সকলের লড়াইয়ের স্লোগান।

শঙ্খ ঘোষ আর নেই। বাঙালি বুদ্ধিজীবীর মৃদু ভাষা মাতৃক্রোড়ে হারিয়ে গেল। চাকরিপ্রার্থীদের লড়াই সকলের লড়াই হয়ে উঠল না।

এত কেলেঙ্কারি, এত দুর্নীতি আর তার গন্ধ এত তীব্র, মনে হচ্ছে নিজেরা সেই দুর্নীতির গন্ধে গন্ধগোকুল হয়ে বসে আছি। দুর্নীতির বিরোধিতা করবার শক্তি যেন হারিয়ে গেছে, আর এই নীরবতা একপ্রকার পরোক্ষ সমর্থন যোগাচ্ছে এই কেলেঙ্কারিতে আপাদমস্তক কালো সরকারকে।

সকলের চোখের সামনে এই দুর্নীতির ভাগ নিতে তৃণমূল কংগ্রেসের নিজেদের দলের মধ্যে চলছে চূড়ান্ত খেয়োখেয়ি, ঝগড়াবিবাদ এমনকী মারামারি, রক্তপাত। পঞ্চায়েত ভোটে বিরোধীদের মনোনয়ন জমা না দিতে দিয়ে, মেরে তাড়িয়ে যারা হাত পাকিয়েছিল, তারাই এখন ‘মক পঞ্চায়েত’ করতে গিয়ে একটি উপদল অন্য উপদলকে মেরে ভাগিয়ে নির্বাচন জিতছে। স্ক্যামের এমনই মহিমা। জীবন বিজ্ঞানে প্রতিবর্ত ক্রিয়া পড়ানো হয়। তৃণমূল কর্মীরা সেই প্রতিবর্ত ক্রিয়াতেই চলে। ব্যালট বাক্স দেখলেই লুট করতে ইচ্ছা করে। সত্যি ভোট না দলীয় ভোট সেই হুঁশ থাকে না।

এই পাহাড় প্রমাণ দুর্নীতি, স্বৈরতান্ত্রিক আচার কোনো রাজনৈতিক দলকে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সৈনিক হতে দেয় না। আজকের তৃণমূল কংগ্রেস হল সত্তরের দশকের অধঃপতিত, আরও নিকৃষ্ট নবকংগ্রেসের প্রতিভূ। তাই ২০২১ সালের বিধানসভার নির্বাচনের আগে ও পরের চিত্রগুলো আমরা দেখি। এদিক থেকে স্রোতের মতো জোয়ারের সময়ে নেতারা ওদিকে যায়, ওদিক থেকে আবার আরেক দল ভাটার টানে এদিকে ফেরে। বিজেপি এবং তৃণমূল মিলে যায়, মিশে যায়।

আজকে রাজ্যের ছেলে-মেয়েরা পরীক্ষায় পাশ করে শবরীর প্রতীক্ষা নিয়ে বসে থাকে রাস্তায়। সে কিন্তু আমার বা আপনার বাড়ির সন্তান। এদের যৌবন গড়িয়ে চলে অপরাহ্নে। একটা চাকরির জন্য। চোখের সামনে দেখে কড়ি দিয়ে সেই চাকরি বিকিয়ে গেল। রাস্তায় বসে থাকে অনাহারে, অশক্ত শরীরে আমাদের ভবিষ্যত শিক্ষক সম্প্রদায় (হতে পারত, হল না অবশ্য)।

রাতের আঁধারে জোটে শুধু লাঞ্ছনা। আর বঞ্চনা।

আমরাও এই-রকমভাবেই বেঁচে আছি; ক্রোধ নেই, ক্ষোভ নেই, ঘাম নেই, অশ্রু নেই।

তোমাদের সঙ্গে। আপনাদের সঙ্গে।

অথবা একবার রুখে দাঁড়াতে পারি। ভাবতে পারি এই লড়াই শুধু সন্তানদের নয়, তাদের পালকদেরও বটে।