আরেক রকম ● দশম বর্ষ নবম সংখ্যা ● ১-১৫ মে, ২০২২ ● ১৬-৩০ বৈশাখ, ১৪২৯

প্রবন্ধ

গ্রন্থ সমালোচনাঃ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় একটি জীবনী

শুভাশীষ মুখোপাধ্যায়


জীবনী মানে আপনার চরিত্রগত ও জীবনীগত সামগ্রিক বৈশিষ্ট্য... সর্বসাধারণের উপযোগী করে আপনি মানুষটা কেমন এবং আপনার জীবনটা কেমন মোটামুটি রূপ দেওয়া একটা জীবনকাহিনী...

- মুজফফর আহমদকে লেখা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের চিঠি

২০০৮ সালে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম শতবার্ষিকী চলে গেছে। সেই কথা স্মরণে রেখে অধ্যাপক মালিনী ভট্টাচার্য 'পশ্চিমবঙ্গ বাংলা একাডেমি' থেকে মানিকের একটি জীবনীগ্রন্থ প্রকাশ করেন। সংগত কারণে নানা পুরস্কারে গ্রন্থটি ভূষিত হয়েছে, একাদেমি থেকে তার দ্বিতীয় সংস্করণও যথা সময়ে প্রকাশিত হয়েছে। এ সমস্ত ঘটনা না ঘটলেও বইটির যে মেধা-মূল্য, তার কিছুই ক্ষুণ্ণ হতো না। গত এক-দেড় দশক ধরে বাংলার সংস্কৃতি জগতে যে পরিব্যাপ্ত মাৎস্যন্যায় বিরাজ করছে, তার এক প্রত্যক্ষ নিদর্শন হিসেবে বলা যায় যে বইটির চাহিদা সত্ত্বেও পুনমুর্দ্রণের কোনও সদর্থক ও সক্রিয় উদ্যোগ একাডেমি-র পক্ষ থেকে নেওয়া হয়নি, মানিক রচনাবলী-র প্রস্তাবিত ১২তম খণ্ড আজও প্রকাশিত হয়নি, বাংলা একাডেমি-কৃত মানিক রচনা সমগ্র আজ আর লভ্য নয়, দারুন অযত্নে রাখা সেই রচনাবলীর কিছু কিছু খণ্ড গুদাম খালি করার উদগ্র তাগিদে 'চৈত্র-সেল'-সদৃশ 'বই-বাজার'-এ চালান করে দেওয়া হয়। 'চিহ্ন' উপন্যাস, 'হারানের নাতজামাই'-এর লেখক মানিক-কে পাঠকের স্মৃতিতে বেঁচে থাকতে হলো, হচ্ছে 'চতুষ্কোণ-বিভ্রাট' আর ফ্রয়েডিও বাতাবরণকে সঙ্গে করে।

এইসব দুস্তর বাধা অতিক্রম করে মানিক কিন্তু সিরিয়াস চর্চা-তে আজও বেঁচে আছেন আর সেই তাড়নাতেই মালিনী ভট্টাচার্য-এর এমন চমৎকার বইটি আর ডি এন্টারপ্রাইসেস-এর হাত ধরে আবার পাঠকদের হাতে উঠে এল এমন এক সময়ে, যখন বাংলা ভাষা থেকে র-ফলা উঠে যাচ্ছে ক্ষমতার মদতে, বাংলা ভাষা বাঙ্গালি-র হাত ধরে এক খিঁচুড়ি উপভাষায় পর্যবসিত হচ্ছে ক্রমশ।

সরোজমোহন মিত্র, যুগান্তর চক্রবর্তী বা অরুণ মুখোপাধ্যায়, অশ্রুকুমার সিকদার প্রমুখ পুর্বসূরীবৃন্দ সময়োচিত তথ্যের অভাবে মানিকের জীবনের যেসব অংশ নিয়ে হয় নীরব বা সামান্য আলোকপাতে বাধ্য হয়েছিলেন, এই জীবনীগ্রন্থটি নানা দিক থেকে পাঠকের সেই তথ্য ও বিশ্লেষণ-ক্ষুধা-য় অনেকটা খাদ্যের জোগান দিয়েছে। কৃতজ্ঞতা স্বীকার অংশে মালিনী ভট্টাচার্য জানিয়েছেন যে “মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এমন একজন লেখক, যিনি নিজের সাহিত্যচর্যাকে অবিরত তাঁর জীবনচর্যার সঙ্গে মেলাবার চেষ্টা করেছেন। এই কারণে শুধু তথ্যের সমাবেশ ঘটিয়ে তাঁর জীবনীগ্রন্হ রচনা করা অসম্ভব, তাঁর অন্তর্জীবন - যা তাঁর সৃষ্ট সাহিত্যের মধ্যে অনেকখানি অভিব্যাক্তি পায় - জীবনীকারের কাছে মূল কৌতুহলের বিষয়।” সাতটি অধ্যায়ে বিন্যাস্ত মানিকের এই জীবনীগ্রন্থ গ্রন্থকারের পাশাপাশি সচেতন পাঠকের সেই কৌতুহলের অনেকটাই তৃপ্তির সঙ্গে মেটাতে পেরেছেন।

বইটি-র মূল বিষয় যেহেতু মানিকের একটি যথাসম্ভব পূর্ণাঙ্গ জীবনী তুলে ধরা, বিশেষত পরবর্তীকালে হাতে আসা তথ্যের ভিত্তিতে, তাই গ্রন্থকার প্রথমেই তথ্যের ক্ষেত্রে এখনও যে সব সীমাবদ্ধতা (ঐতিহাসিক?) রয়েছে সেগুলি পাঠককে জানিয়ে দিয়েছেন, তথ্যের অনুপস্থিতিতে কল্পনাশ্রয়ী ব্যক্তিগত ধারণা দিয়ে সেই 'ঘাটতি পূরণ'-এর রাস্তা সযত্নে এড়িয়ে গিয়ে লিখেছেন, “কিন্তু এত কিছু সত্ত্বেও বিশেষ করে তাঁর বাল্য ও যৌবন কাল সম্বন্ধে তথ্যের ঘাটতি থেকে যায়, অনেক প্রশ্নের জবাব মেলে না।” (পৃষ্ঠা-১১) লেখকের 'অন্তর্জীবন' কেন গুরুত্বপূর্ণ, সেই বিষয়ে গ্রন্থকার একেবারে স্পষ্ট করেই ঘোষণা করেছেন, “...লেখকের মূল দায় পুঁজিবাদী সমাজে একটাই, ভেবেছিলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। তা হল বিপ্লবী মজুরের মতোই জীবিকার সংগ্রামকে অহরহ মুক্তির সংগ্রামে পরিণত করা। এই জীবনীতে আমাদের প্রধান জোর থাকবে এই প্রসঙ্গেরই ওপরে।” (পৃষ্ঠা-১৫) গ্রন্থকার আগাগোড়া এই বিষয়টির প্রতি দায়বদ্ধ থেকেছেন।

লেখকের পক্ষে 'কলমপেষা মজুর' হয়ে ওঠা একটা দীর্ঘ এবং কষ্টকর সচেতন প্রক্রিয়া, যা লেখক হয়ে ওঠার প্রতিটি পরতে অনুশীলন করে যেতে হয়। যিনি 'কেবল প্রেমকে নির্ভর করে' উপন্যাস লেখার 'সাহস' দেখান কুড়ি বছর বয়েসে, সেই তিনি, গ্রন্থকার আমাদের জানাচ্ছেন, বাঁকুড়া ওয়েসলিয়ান মিশন কলেজে আইএসসি পড়ার সময় সত্যকিংকর দত্ত-র মাধ্যমে অনুশীলন পার্টি সম্পর্কে উৎসাহী হন, সেই সময়ের চালু কাজ হিসেবে তিনি লাঠি খেলা ও ছোরা চালানোও শিখে নেন। ১৯৪০ সালে, যখন মানিক ভারতের সাম্যবাদী আন্দোলনে নিজেকে সম্পৃক্ত করেননি, তখনই তিনি একটি অপ্রকাশিত চিঠিতে লিখেছেন, “অর্থোপার্জনের দিকে আমি বিশেষ সুবিধা করিতে পারি নাই, কিন্তু গরিব হওয়াটা অপরাধ নয়। তাছাড়া আমার অসুখটা আমার অক্ষমতার জন্য হয় নাই।” (পৃষ্ঠা-৪১) পরবর্তী ঘটনা সকলের জানা - ১৯৪৪ সাল থেকে ১৯৫৬ সালের ডিসেম্বর ৩, তাঁর মৃত্যুর দিন পর্যন্ত মানিক ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির পশ্চিমবঙ্গ শাখার সদস্য ছিলেন। দারিদ্র্য, ভগ্নস্বাস্থ্য, পারিবারিক বিপর্যয় সামলে তিনি তাঁর সাহিত্যিক ও রাজনৈতিক পরিচয় সমান্তরালে সক্রিয়ভাবে বজায় রেখেছেন, কোথাও কোনও আপোষ করেননি। তাঁর মৃত্যুর পর দীপেন বন্দ্যোপাধ্যায় এক অসাধারণ রিপোর্টাজ লিখে মানিকের শেষ যাত্রার বর্ণনা দিয়েছেন তাঁর 'নেয়ারের খাট, মেহ্গিনি পালঙ্ক এবং একটি দুটি সন্ধ্যা'-তে। তিনি লিখেছেন, “...মনে হচ্ছিল মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় একটা চোখ মেলে তাকিয়ে যেন সব কিছুই দেখছেন। আর তিনি যে দেখছেন, তা তাঁর ঠোঁটের চাপা হাসির টু্করোয় গোপন করেও রাখেননি। দেখা আর প্রকাশ - মৃত্যুর পর মানিক বাঁড়ুজ্জের চরিত্র পালটায়নি!” (মানিক বিচিত্রা, পৃষ্ঠা-২৪৭, বিশ্বনাথ দে সম্পাদিত, সাহিত্যম, প্রথম প্রকাশ ১৯৫৬)

নিতাই বসুকে উদ্ধৃত করে গ্রন্থকার আমাদের জানিয়েছেন যে, “১৯৩৯ সালেই মানবেন্দ্রনাথ রায়ের 'Radical Humanist Party'-র সঙ্গে মানিকের যোগাযোগ হয়েছিল, যদিও এ পার্টির সদস্য তিনি কখনও হননি।” (পৃষ্ঠা-৯১) অন্যত্র জানিয়েছেন, “...'বৃহত্তর মহত্তর' নামের গল্পটি[তে]... প্রথম আমরা সারাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের প্রত্যক্ষ উল্লেখ পাই।” (ঐ) মানিকের 'কলমপেষা মজুর' হওয়ার যাত্রাপথ ছিল যুক্তিসঙ্গত ও ধারাবাহিক। ফ্যাসিস্ট-বিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘ গঠিত হলে সংঘের সাংগঠনিক কমিটিতে মানিকের অন্তর্ভুক্তি ছিল প্রায় অবধারিত, ঠিক তেমনি ১৯৪৩ সালে তিনি ছিলেন 'পিপলস রিলিফ কমিটি'-র সদস্য। মানিকের সাম্যবাদে আকর্ষণ এবং সেই কর্মকাণ্ডকে সক্রিয় অংশগ্রহণের বিপুল তথ্য তাঁর গ্রন্থে তুলে এনেছেন মালিনী ভট্টাচার্য। যেমন, ১৯৪৬ সালে চট্টগ্রামে নির্বাচনে কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী, কল্পনা দত্ত-র সমর্থনে বক্তব্য রাখতে চট্টগ্রাম যাওয়া, চট্টগ্রামে পুলিশি অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিবৃতি দেওয়া, ১৯৪৪ সালের জানুয়ারিতে ফ্যাসিস্ট-বিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘের সভা পরিচালনা করা, ১৯৪৯-এ ছাত্রদের আইন অমান্য আন্দোলনে সামনের সারিতে থাকা, বক্সা ক্যাম্প-এ বন্দী শিল্পী-সাহিত্যিকদের মুক্তির দাবিতে প্রবন্ধ লেখা ইত্যাদি।

মানিকের মৃত্যুর পর কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা 'স্বাধীনতা'-তে মানিক-কে ঘিরে প্রকাশিত লেখার খুব তথ্যবহুল বিবরণ রয়েছে 'দিবারাত্রির সীমানায়' নামক শেষ অধ্যায়টিতে।

এ ছাড়া রয়েছে বিস্তৃত জীবনপঞ্জী, মানিকের এখনও পর্যন্ত জানা সমস্ত লেখার বিস্তারিত বিবরণ এবং একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় নির্ঘন্ট।

মানিকের দিনলিপি এবং সেই দিনলিপিতে উল্লেখ থাকে 'মা'-কে ঘিরে মানিককে শেষ জীবনে কালীভক্তে পর্যবসিত করার এক কষ্টকল্পিত প্রয়াস মানিকের ডায়েরি প্রকাশিত হওয়ার থেকেই চলে আসছে। দিনলিপি থেকে প্রভূত উদ্ধৃতি সহযোগে এই প্রকল্প সপ্রমাণে অনেকেই সময় ব্যয় করেছেন। মালিনী ভট্টাচার্য এই 'অস্বস্তিকর' প্রসঙ্গটি এড়িয়ে যাননি। গ্রন্থকারের এই বিষয়ে বক্তব্যগুলি এক জায়গায় জড়ো করলে দাঁড়ায়,

১) “প্রকৃতপক্ষে ডায়েরিতে এক অতিলৌকিক ‘মা’য়েরই উল্লেখ আছে, ‘কালীভক্তি’-র নিদর্শন কোথাও নেই। এতদ্ব্যতীত, এই মায়ের উল্লেখ একমাত্র তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত ডায়েরি ছাড়া আর কোথাও আমরা পাই না।” (পৃষ্ঠা-১৬১)

২) মানিকের ডায়েরি থেকে তাঁর ‘মা’ সংক্রান্ত প্রথম লেখা উদ্ধৃত করে, মালিনী ভট্টাচার্য এক যুক্তিগ্রাহ্য সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন, “সকালে উঠেও এই মায়ের নাম করেই তিনি সিদ্ধান্তে আসছেন। 'রোগ দারিদ্র্যের কারণগুলির সঙ্গে লড়তে হবে। স্বভাব বদলে নিতে হবে।' নিজের সঙ্গে এই লড়াইয়ের জন্যই যে একান্ত মানসিক জীবনের কোনও ‘প্রতীক অবলম্বন’-এর প্রয়োজন এখানে তা খুব স্পষ্ট। এর সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ নিয়মিতভাবে অষুধ এবং আস্তে আস্তে তা কমানো, এবং মদ্যপানের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম অনুসরণ করার সংকল্প।”

৩) “১৯৫৪-৫৬-র মধ্যে এই অতিলৌকিক ‘মা’-এর কথা বেশ কয়েকবার আসে, এর শেষ উল্লেখ আমরা পাই ১৬ নভেম্বর ১৯৫৬-তে, অর্থাৎ মৃত্যুর ১৫-১৬ দিন আগে, যখন ‘খাদ্য সম্পর্কে নতুন নীতি’ গ্রহণের কথা বলছেন, ‘খাদ্যাতঙ্ক’ কাটিয়ে শরীরের ক্ষয় রোধ করার জন্য খাওয়া বাড়ানোর চেষ্টার প্রসঙ্গে...। কিন্তু এ সময়ে তাঁর শেষ শারীরিক বিপর্যয় আসন্ন।” (পৃষ্ঠা-১৬৩)

৪) “ব্যক্তিগত সংকটে বিপর্যস্ত হয়ে একজন কমিউনিস্ট সাময়িকভাবে তাঁর বস্তুবাদী বিশ্বাসের বাইরে অলৌকিকের অবলম্বন খুঁজেছেন, এমন উদাহরণ বিরল নয়। প্রশ্ন হল, এই নির্ভরতা তাঁর সামগ্রিক জীবনচর্যাকে কতটা প্রভাবিত করেছে। মানিকের ক্ষেত্রে নিঃসংশয়েই বলা যায়, তাঁর সচেতন সত্তা এই একান্ত প্রয়োজনকে একটি নির্দিষ্ট সীমানার মধ্যেই ধরে রাখতে পেরেছিল।” (পৃষ্ঠা-১৬৫-৬৬)

ব্যক্তি মানিক, সাহিত্যিক মানিক, 'কলমপেষা মজুর' মানিক, কর্মী মানিক - এই সব ধরণের বিচিত্র বিভাগের সমাহারে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের যে বর্ণময় ঋজু চরিত্র মালিনী ভট্টাচার্য আমাদের সামনে মেলে ধরেছেন, তাঁকে অতিমানব, অবাঙমানসগোচর পর্যায়ে না নিয়ে গিয়ে বিগ্রহের নির্দিষ্ট উচ্চাসন থেকে সরিয়ে বড় কমলাপুরের জমির সমভূমিতে স্থাপন করে তাঁর স্বাভাবিক মানবিক সীমাবদ্ধতাকে গোপন না করে একজন রক্তমাংসের মানুষ হিসেবে শতবর্ষের অভিজ্ঞতার আলোকে বিচার করেছেন, বইটির অনন্যতা তাতেই পরিস্ফূট হয়েছে। যে পাঠক-আনুকুল্য আগের সংস্করণগুলি পেয়েছিল, এই সংস্করণেও তার অন্যথা ঘটবে না।



মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় একটি জীবনী
মালিনী ভট্টাচার্য
প্রথম আর বি এন্টারপ্রাইসেস সংস্করণ,
ফেব্রুয়ারি ২০২১
মূল্যঃ ৩০০ টাকা