আরেক রকম ● দশম বর্ষ নবম সংখ্যা ● ১-১৫ মে, ২০২২ ● ১৬-৩০ বৈশাখ, ১৪২৯

প্রবন্ধ

বর্তমান বাংলায় রাজনৈতিক হিংসা

শুভময় মৈত্র


এ লেখাটিকে খুব বেশি রাজনৈতিক গুরুত্ব দিয়ে পড়বেন না। বরং ধরে নিতে পারেন বিলম্বিত নববর্ষের কড়চা। বিশেষ করে এই সংখ্যা মে দিবসের দিন প্রকাশিত, তাই বিধিসম্মত সতর্কীকরণ শুরুতেই বারবার মনে করিয়ে দেওয়া অবশ্য কর্তব্য। এ লেখাটিতে সুগভীর কোন রাজনৈতিক বক্তব্য নেই। আসলে বাংলা বছর শুরুর হপ্তাখানেক পরেই একটি বিতর্কসভায় এই মার্জারের ভাগ্যে কথা বলার শিকে ছেঁড়ে। বিতর্কের বিষয় ছিল "বর্তমান বাংলায় হিংসাহীন রাজনীতি অসম্ভব"। কিছু বক্তাকে বিরোধী তো হতেই হবে। আর বিতর্কে বিরোধী হওয়াই প্রতিবাদী বাঙালির দস্তুর। তবে এক্ষেত্রে বিপক্ষে বলার মূল মুশকিল হল যুক্তি দিতে গেলেই মনে হবে এখানে হয়ত শাসক দলকে সমর্থনের চেষ্টা হচ্ছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অবশ্য সে সুযোগ থাকে। রাজনৈতিক নেতা এবং ভাসমান ভোটারের মত এ-দল থেকে ও-দলে পথ পরিক্রমায় ধরি-মাছ-না-ছুঁই-পানি বিশ্লেষকদের জুড়ি মেলা ভার। সেই ধারা মেনেই এই বিতর্কের প্রস্তুতির সময় সবদিক বজায় রেখে কিছু যুক্তি সাজানোর চেষ্টা করছিলাম। তবে একথা সত্যি যে সবথেকে সবল যুক্তি অঙ্কের পথেই মেলে। সেই পথেই আলোচনা শুরু করা যাক। পাঁচটি শব্দ আছে এখানে। প্রতিটির একাধিক ব্যঞ্জনা। প্রতিটি শব্দের সঙ্গে যদি শুধু একটি করে বিপরীত ধর্মী শব্দ নিয়ে আলোচনা করা হয়, উদাহরণস্বরূপ ধরুন বর্তমান আর অতীত (এখানে সময়রেখা), বাংলা আর বিলিতি (স্থান মাহাত্ম্য), হিংসাহীন আর সহিংস (মনোবিজ্ঞান), রাজনীতি আর মেলা-খেলা (সামাজিক প্রেক্ষিতের ব্যপ্তি) এবং স্বাভাবিকভাবেই অসম্ভব আর সম্ভব (এটাই ০ কিংবা ১, জটিলতা কম), সেক্ষেত্রে মোট পাঁচবার গুণ হবে দুই, অর্থাৎ ৩২। আধখানা ফাউ যোগ করলেই খুঁজে পাওয়া যাবে বিশ্ববঙ্গ রাজনীতির সাড়ে বত্রিশ ভাজা। এর বেশি পারমুটেশন কম্বিনেশনের অঙ্কে যাবো না। তবে প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে দুইয়ের অধিক বিকল্প থাকলে সংখ্যা আরও বাড়বে। অর্থাৎ মূল যে বিষয়টা আমি বলতে চাইছি, তা হল মোটের ওপর একটি সোজা সরল বাক্যের বিভিন্ন শব্দ পরিবর্তন করে প্রচুর পরিমাণে নতুন বাক্য সৃষ্টি করা যায়। সেই নিরিখে বিরোধাভাসে বিকল্প অনেক। যে কোন লেখাতেই অক্ষর সংখ্যা সীমিত। তাই যৌক্তিক বিরোধিতার খাতিরে কয়েকটি বিরোধী হাইপোথিসিস নিয়ে আলোচনা করব আমরা। বলাই বাহুল্য তার প্রত্যেকটিই ওপরে উল্লিখিত সভার মতের বিপরীতে।

সভার মত "বর্তমান বাংলায় হিংসাহীন রাজনীতি অসম্ভব"। এই কথাটিকে অঙ্কের ঢঙে নিলে পক্ষের মত শুরুতেই জয়যুক্ত। কারণ এই কথাটি ইংরিজিতে ভ্যাকুয়াসলি ট্রু। অর্থাৎ কথাটি সত্যি বটেই, এবং তার জন্যে যুক্তি খুঁজতে হয় না। অন্যদিকে বাস্তব আলোচনায় হিংসাহীন বিষয় সত্যিই শূন্যগর্ভ। আলট্রা সেনেটারি নক্ষত্রপুঞ্জের অন্য কোন গ্রহের কথা সত্যিই জানি না। তবে আমাদের এই সৌরজগতের তৃতীয় গ্রহে হিংসাহীন রাজনীতির খবর অন্তত জানা নেই। আগুন আবিষ্কার থেকেই ভাবুন। পুটিন-জেলেন্সকি বলুন বা বগটুই, হিরোসিমা-নাগাসাকি কিংবা গোধরা, দুপুর-রাতে রান্না করতে মানুষের যতটা আগুন লেগেছে, তার থেকে হিংসার আগুনের উত্তাপ বিশেষ কম নয়। সেখানে রাজনীতি আছে, ধর্ম আছে, আছে ব্যক্তিগত আক্রোশ। সে যত শান্তিমিছিলেই হাঁটুন না কেন, হিংসা আছে বলেই মানুষ সেই মিছিলে পথ হাঁটেন। তাই সভার মতকে পরমসত্য হিসেবে মেনে নিলে বিষয়টা দাঁড়াবে নিউটনের প্রথম সূত্রের মত। "বাহির হইতে প্রযুক্ত বলের দ্বারা অবস্থার পরিবর্তন না করিলে স্থির বস্তু চিরকাল স্থির থাকিবে আর চলমান বস্তু সরলরেখায় সমদ্রুতিতে চলিতে থাকিবে"। যখন বাইরে থেকে বল নেই, ঘর্ষণ অনুপস্থিত, তখন সবটাই সত্য। কিন্তু তা কেজো সত্য নয়। এখানেই ফলিত বিজ্ঞান আসে। অর্থাৎ সব কিছু নিউটনের 'ক্লাসিক্যাল মেকানিক্স' দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। সেই কারণেই উন্নততর পদার্থবিজ্ঞান আলোচিত হয় আইনস্টাইনের 'থিওরি অফ রিলেটিভিটি' কিংবা হাইসেনবার্গের 'কোয়ান্টাম মেকানিক্স' এবং তাদের আপেক্ষিকতাবাদ ও অনিশ্চয়তা তত্ত্বের আধারে। সেই কারণে সামাজিক সত্য সন্ধানে বারে বারে ফিরে আসতে হয় তুলনায়, আপেক্ষিক অবস্থানে, জীবন এবং সমাজের যে অনিশ্চয়তা তাকে মেনে নিয়ে। সেই জায়গায় প্রশ্ন উঠবে বর্তমান বাংলা বহির্বিশ্বের থেকে কতটা খারাপ? বর্তমানের কোলে প্রতিমুহূর্তে জন্ম নিচ্ছে যে ভবিষ্যৎ, সেখানে কি একেবারেই আশা নেই? বাস্তব ক্ষেত্রে 'হিংসাহীন' কথাটি অনুপস্থিত, এর অনেকটাই বিমূর্ত।

সেই পথেই একটু বাস্তবের অঙ্ক কষে নেওয়া যাক। বিচার তো হবে স্থান, কাল আর পাত্র নিয়ে। স্থান বাংলা, কাল বর্তমান, আর পাত্র মানুষ। গোটা জমিটাকে মেপে ফেলুন, ৮৮,৭৫২ বর্গকিমি। বর্তমান কাল বলতে এই মুহূর্তটির আগে এক বছর সময় ধরে নিন। জনসংখ্যা দশ কোটি। অর্থাৎ এগুলো যাবে হরে। আর লবে যাবে কোন কোন অঞ্চলে ঝামেলা হয়েছে, কোন কোন সময়ে, আর কত মানুষ এতে বিপর্যস্ত হয়েছেন। বোঝাই যাচ্ছে লবে জায়গা নেবে অনেক ক্ষুদ্রতর সংখ্যা। যেমন ধরুন বগটুই, একটু বেশি করেই ধরুন। এক বর্গকিলোমিটার জায়গা জুড়ে এক দিন আগুন জ্বলেছে, মারা গেছেন দশ জন। তাহলে লবে এর জন্যে যাবে ১ গুন ১ গুন দশ, আর হরে ৮৮,৭৫২ গুণ ৩৬৫ গুণ ১০ কোটি। ফলে একেবারে আঙ্কিক হিসেবে মাপলে কিন্তু ভগ্নাংশটা ছোট হতে হতে শূন্যের দিকেই যাবে। এক্ষেত্রে যেমন তার মান ০.০০০০০০০০০০০০০০৩০৮৬৯৪, অর্থাৎ খুবই ক্ষুদ্র এক ভগ্নাংশের কথা দশমিকে লেখা। কলনবিদ্যায় একেই লিমিট বলে। তাই প্রেক্ষিত বাদ দিয়ে যদি পরম এবং চরম (চড়াম নয়) অঙ্কে যেতে চান, তাহলে বাংলায় হিংসাহীন রাজনীতি যে চলছে তার আভাস প্রত্যক্ষ।

তবে সমাজবিদ্যার আলোচনায় বিজ্ঞানকে অতিক্রম করার দায় থাকে। বিজ্ঞান অনেকটাই অসংবেদনশীল। ব্যক্তিমানুষের অসহায়তা তাই সংখ্যাতত্ত্বের আধারে বোঝা শক্ত। তবে তিনটি বিষয় নজরে রাখা দরকার। প্রথমে আসি 'বর্তমান' শব্দে, যা কিনা ত্রিমাত্রিক জগৎ অতিক্রম করে চতুর্থ মাত্রা সময়কেকে নির্দেশ করে। প্রশ্ন হল 'আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম' একথা কি সত্য? একমাত্র বর্তমানেই কি হিংসা ঘটছে? মোটেই তা নয়। অতীতেও রাজনৈতিক হিংসার প্রচুর উদাহরণ আছে। এই বাংলাতেই আছে। অর্থাৎ 'বর্তমান' যোগ করে বিতর্কের বিষয়ের পক্ষে খুব যে নতুন অস্ত্র জুটবে এমনটা নয়। সেই হিংসা কখনও করেছে সরকারি পুলিশ, কখন বা রাজনৈতিক দলের নেতা কর্মীরা। গোটা বিশ্ব জুড়ে রাজনৈতিক হিংসার ইতিহাস এই চেনা পথেই এগোয়। অতীতে যে হিংসার ঘটনা ঘটেছিল, সেই উদাহরণ অনেক। তার মধ্যে একটি এখানে উল্লেখ করা যাক। আজকের দিনে আমাদের আলোচনায় বারবার আসে বিধান চন্দ্র রায়-এর নাম। বাংলার সেরা মুখ্যমন্ত্রী তিনিই কিনা তাই নিয়ে মাঝে মাঝেই আলোচনা হয়, আর সেই নিরিখেই ১৯৫৯ সালে খাদ্য আন্দোলনের কথা আসবে। নন্দীগ্রাম আন্দোলন যত তাড়াতাড়ি পাঠ্যপুস্তকের পাতায় ঢুকে পড়েছে ততটা না হলেও, বাংলার রাজনীতিতে সেই খাদ্য আন্দোলনের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। তথ্যসূত্র বলে, শুধুমাত্র ৩১শে অগাস্ট সন্ধ্যায় রাজভবনের কাছে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জনা পঞ্চাশ আন্দোলনকারী মারা যান। মনে রাখতে হবে আজকের দিনের মত প্রখর উপস্থিতি নিয়ে সংবাদমাধ্যম তখন চোখ রাঙাতো না। কিন্তু সরল পরিসংখ্যানে সেই অতীত যথেষ্টই অশান্ত ছিল। ফলে আজকের বর্তমানকে আলাদা করে বিদ্ধ করার কোন কারণ এখানে খুঁজে পাওয়া শক্ত। অর্থাৎ সময় রেখায় বিশেষ পরিবর্তন নেই। বাংলার বাইরেও অতীত ইতিহাসের কোন অভাব নেই। যে কথা আগেও বলছিলাম, উদাহরণগুলো অঙ্ক দিয়ে দেখলে উপেক্ষণীয়, নগণ্য বা তুচ্ছ। কিন্তু রাজনীতির ইতিহাসে বা ব্যক্তি মানুষের ভাবনায় তা ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক। অর্থাৎ অঙ্কে এক্সিস্টেন্স বলেও একটা বিষয় আছে। হিংসা যে বাংলায় ছিল তার প্রমাণ অকাট্য, এবং তা দিয়ে অতীত আর বর্তমানকে আলাদা করা যায় না। তার থেকে মুক্তিই আগামীর রাজনীতির শপথ হওয়া উচিৎ।

এবার দ্বিতীয় শব্দে স্থান মাহাত্ম্য। এই 'বাংলা' বলতে পশ্চিমবঙ্গ বোঝানো হয়েছে। বাড়িয়ে বাংলাদেশ ধরলে প্রেক্ষিত খুব বেশি বদলাবে না। কিন্তু গোলমাল কি শুধু বাংলায়? একঝুড়ি উদাহরণ বলবে শুধু বাংলা নিয়েই চমকে ওঠার কারণ নেই। উত্তর-পশ্চিমে কাছের আফগানিস্থান থেকে অল্প দূরের ইউক্রেন, আর তাদের অনেকটা দক্ষিণ-পশ্চিমে মধ্যপ্রাচ্য সিরিয়া ঘুরে অবগুণ্ঠিত আফ্রিকার সুদান, অর্থাৎ এশিয়া আর আফ্রিকাতে তো বটেই, পূর্ব ইউরোপেও অবস্থা কেরোসিন। মার্কিন দেশে যখন তখন ক্যাপ্টেন স্পার্কের ঠাঁই ঠাঁই ঠাঁই ঠাঁই ঠাঁই, দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোয় তেল মাফিয়ারা ব্যাগাডুলি খেলছে এমনও তো নয়। তুলনায় কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, উত্তর-পশ্চিম ইউরোপের কিছু দেশ, এরা বেশ ভালো। তবে হিংসা নেই এমন দেশ খুঁজে পাওয়া শক্ত। সন্ধের টেলিভিশন দ্বন্দ্বে শাসক দলের নেতারা এই কথা বারবার বলেন, যে ভ্যাটিকান আর আন্টার্কটিকা ছাড়া নাকি পৃথিবীর সব জায়গাতেই হিংসার উদাহরণ মেলে নিয়মিত। ফলে পশ্চিমবঙ্গে হিংসার খবর অবাক করার মত কিছু নয়। এই যুক্তিকে আরও পোক্তভাবে পেশ করা যায়। উদাহরণে এই দুটো জায়গাও ঢুকবে। শুরুতে পেঙ্গুইনের দেশে আসা যাক। 'দি গার্ডিয়ান'-এর খবর, ২৪ অক্টোবর, ২০১৮। বেলিংসাউজেন স্টেশন, কিং জর্জ দ্বীপে। রাশিয়ানদের গবেষণা কেন্দ্র। তার কয়েকদিন আগে ৯ অক্টোবরের ঘটনা। খাওয়ার জায়গায় এক সহকর্মীকে ছুরি মারেন সারগেই স্যাভিতস্কি। এছাড়াও আন্টার্কটিকায় যে মদ্যপানের পর গবেষকদের মধ্যে ধস্তাধস্তি অনেক হয়েছে এ খবর বিরল নয়। ভ্যাটিক্যান নিয়েও সামান্য আলোচনার প্রয়োজন আছে। ব্যাপক মারামারি রোজ না হলেও জায়গাটা পকেটমারদের স্বর্গরাজ্য। পকেট কাটাকে হিংসা না বললেও আইন শৃঙ্খলার অবনতি বলা যেতেই পারে। পরিসংখ্যান দিয়ে হয়ত এটাও দেখানো সম্ভব যে কলকাতার তুলনায় ভ্যাটিক্যানের পকেটমারের ঘনত্ব বেশি। অর্থাৎ উদাহরণ ভিত্তিক আলোচনায় বাংলা নিয়ে আলাদা ভাবে উত্তেজিত হওয়ার বিশেষ কারণ নেই।

এবার যাই আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শব্দ রাজনীতি-তে। এ যেন সব ব্যাটাকে ছেড়ে দিয়ে বেড়ে ব্যাটাকে ধর। হঠাৎ শুধু রাজনীতি কেন? সমাজের অন্য প্রেক্ষিতে কি বাংলায় হিংসা কম? অর্থাৎ অতীত বা বর্তমান বাংলায় এবং সম্প্রসারণে গোটা বিশ্বে রাজনীতি ছাড়া অন্য কোথাও কি হিংসা নেই? দু'দলে ভাগ হয়ে ধস্তাধস্তি অথবা বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা আমাদের সভ্যতার অংশ। মোরগ লড়াই থেকে বক্সিং রিং-এ ঘুষোঘুষির মধ্যে অতি কষ্টে পয়েন্ট যোগ করে সভ্যতার একটা মোড়ক দেওয়ার চেষ্টা হয়। কে কত পয়েন্ট পেল, কার হাত ওপরে উঠবে ইত্যাদি। মানুষের বকধার্মিকতার স্তরটা একবার ভাবুন। কাজকর্ম নেই অলিম্পিকের নাম করে দেশ বিদেশ থেকে মানুষ নিয়ে এসে দড়িঘেরা চার চৌকোয় মারপিট, যেখানে সভ্যতার মাপকাঠি কোমরের নিচে আঘাত করা যাবে না। মাথায় মারলে ঠিক আছে, কিন্তু তলপেট বাদ। কিক বক্সিং হলে আবার পটাপট পায়ে লাথি মারা যাবে। কুস্তিতে পেটের ওপর চেপে বসতে অসুবিধে নেই। এ তো গেল শরীরের জোর। নিদেন একটা পাড়ার ছোটদের আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয়ের বাবার মুখ গোমড়া হয়ে যায় প্রথমের মায়ের খুশির হাসি দেখে। এক্ষেত্রে হিংসা হাতাহাতি দিয়ে প্রমাণ হয় না, কিন্তু মনে তার উপস্থিতি অস্বীকার করার কোন জায়গা নেই। প্রতিযোগিতার যে সংজ্ঞায়ন, তাতে বন্ধুতার স্থান খুঁজে পাওয়া মুশকিল। খুব কম ক্ষেত্রে এমন হয় যে প্রতিযোগিতার ঠিক আগে প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে যে মানসিক সম্পর্ক, প্রতিযোগিতা শেষের পর তা থাকে না। অর্থাৎ জেতা হারার প্রতিপাদ্য থেকে শুরু করে উপসংহার, সবেতেই হিংসা প্রাথমিক, মৌলিক এবং অপরিহার্য। বাঙালি এবং তার সুপার সেটে বিশ্বমানবের হিংসা চিরন্তন। সমাজে প্রতিটি অংশের প্রতি অন্য অংশ নির্ভরশীল। প্রাথমিকে এভাবেই সমাজ সংজ্ঞায়িত হয়। ছোটবেলায় না বুঝলেও, প্রাপ্তবয়স্করা ভালোই বোঝেন যে এদের ক্রিয়া এবং প্রতিক্রিয়া বিশ্লেষণ করলে ভালোবাসার থেকে হিংসা অনেক বেশি। এইখানে আর একটু অঙ্ক আছে। ধরুন পাঁচটা দল লিগ খেলছে। মোট খেলা হবে ৫ গুণ ৪ ভাগ দুই, অর্থাৎ দশ। অর্থাৎ মানুষের যা সংখ্যা তার প্রায় বর্গে বাড়ে একে ওপরের সঙ্গে সম্পর্ক। প্রতিটি সম্পর্কের মূল ভিত্তি আদিম হিংসা। তাই শুধু রাজনীতির সঙ্গে হিংসাকে যুক্ত করা অতি সরলীকরণ মাত্র। হিংসার মোট পরিমাণ প্রায় মানুষের সংখ্যার বর্গের সঙ্গে সমানুপাতিক। তাই হিংসার আধিক্য শুধু এই বাংলার ধর্ম নয়, গোটা বিশ্বের, রাজনীতির নয়, গোটা সমাজের।

অর্থাৎ বর্তমান, বাংলা আর রাজনীতি, এই তিনটি শব্দ দিয়ে হিংসাকে বিশেষভাবে সংজ্ঞায়িত করার জায়গা বেশ কম। এই জায়গায় আর একটু রাশিবিজ্ঞানের কথা বলা যাক। বিজ্ঞান যতই এগোক না কেন, এ জগত অনেক বেশি জটিল এবং বিজ্ঞানে সব ব্যাখ্যা করা শক্ত। সেই কারণেই দুর্ঘটনা ঘটে। একটা সুস্থ সমাজে আমরা চাইবো যে হিংসার পরিসংখ্যান যেন দুর্ঘটনার পরিসংখ্যানকে ছাপিয়ে যা যায়। মানুষের ক্ষতি যদি অন্যের সচেতন হিংসার কারণে হয়, সেক্ষেত্রে মুশকিল। এইখানেই মূল যুক্তি হল আজকের দিনে অহিংস রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব সম্ভব। এখানে অসম্ভব আর সম্ভবের মাঝে গোটা রাস্তাটা দেখতে হবে। আমরা আছি সম্ভবের কাছেই। বাংলার কোন এক চায়ের দোকানে কাজ ফেরত লোকজন হালকা চালেই রাজনীতি আলোচনা করেন। অর্থাৎ এখানে মূল প্রশ্ন হল রাজনীতি বলতে কি আমরা শুধু ভোট বুঝি? আর বুঝি যেন তেন প্রকারেণ ক্ষমতা দখল? সেখানে আমেরিকা থেকে ভারত সব জায়গাতেই হিংসে আছে। বুঝতে হবে সেটা রাজনীতির একটা অংশমাত্র যাকে আমরা গণমাধ্যমে সবথেকে বেশি গুরুত্বের সঙ্গে দেখি। কিন্তু তার বাইরেও রাজনীতি আছে। প্রশ্ন হচ্ছে বাংলায় এই রাজনীতি আমরা দেখতে পাচ্ছি কিনা। এর উত্তর অনেক ক্ষেত্রেই ইতিবাচক।

এর মধ্যে অবশ্যই বলতে হবে বিভিন্ন সরকারের বিভিন্ন জনমুখী প্রকল্পের কথা। মানুষের কাছে পরিষেবা পৌঁছে দেওয়া তো আর হিংসার রাজনীতি নয়। রাজনৈতিক দলের শাখা সংগঠনগুলি অনেক সময়েই জনসেবায় যুক্ত থাকেন। সেখানে হিংসা কোথায়? চারদিকে যে রাজনৈতিক কর্মকান্ড, মিছিল, মিটিং, তার সবেতেই কি হিংসা? একেবারেই নয়। বরং খোলা বাজারে হিংসার কথা বললে সমালোচনার ঝড় বইছে। শাসক দলের মাঝের সারির সবল ছাত্র নেতারা অধ্যাপকদের ধমকালে উল্টো ধমক দিচ্ছে গোটা বঙ্গ সমাজ। জনসমক্ষে রাজনৈতিক দল হিসেবে সকলেই তার প্রতিবাদ করছে। একটা হিংসার বক্তব্যের বিরুদ্ধে সমাজ এবং সংবাদ মাধ্যমে আমরা যেভাবে অহিংস প্রতিবাদের প্লাবন দেখা যাচ্ছে তা হিংসার বিবৃতির থেকে অনেক বেশি। অর্থাৎ সহজ পরিসংখ্যানের নিরিখে অহিংসা এগিয়ে আছে তা সহজেই পরিলক্ষিত হচ্ছে। প্রতিটি মৃত্যুই দুঃখের। কিন্তু আনিস থেকে বগটুই, অহিংস প্রতিবাদ সাম্প্রতিক সময়ে থেমে থাকেনি।

এখানে এঁর একটা প্রশ্ন হল হিংসার ক্ষেত্রে সমাজের চাপ এবং ছাপ রাজনীতিতে পড়ে নাকি রাজনীতির চাপ সমাজের ওপর? আসলে বিষয় দুটি একে ওপরের ওপর ভীষণভাবে নির্ভরশীল। এই জায়গায় যে চ্যালেঞ্জ তা হল আরও উন্নতমানের অহিংসার সমাজ এবং রাজনীতিতে আমরা কিভাবে এগোতে পারি? মধ্যপন্থী উদারবাদী রাজনীতি কত তাড়াতাড়ি আমরা শিখতে পারি, বা ফিরিয়ে আনতে পারি? অর্থাৎ অনাগত কিন্তু উৎসাহব্যঞ্জক ভবিষ্যৎ সময়ের রেখায় কতটা কাছে? এখানে আমাদের তথ্যের ভাণ্ডার হিসেবে সংবাদমাধ্যমের কথা বলতেই হবে। মনে রাখতে হবে সমীক্ষার নিরিখে তা এক হিসেবে পক্ষপাতদুষ্ট। সংবাদমাধ্যমের স্বাভাবিক কর্মপদ্ধতির মধ্যে পড়ে মূলত নেতিবাচক এবং সমালোচনামূলক খবরের বিস্তার। এতো মানুষ যে শান্তিতে আছেন, প্রতি সন্ধ্যায় সে খবর দেওয়ার দায় সংবাদমাধ্যমের নেই। বাংলার কোন এক গ্রামে এক পুরুতমশাই তুলসীতলায় প্রদীপ দিচ্ছেন বা কোন দিদিমণি বিকেলে বাচ্চাদের সঙ্গে কবাডি খেলছেন, সে খবর তো দেখানোর কথা নয়। অন্যদিকে একটি অঞ্চলে যদি রাজনৈতিক মদতে পুষ্ট তোলাবাজ গোষ্ঠীকুল মারামারি করে, সেটা সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় আসা স্বাভাবিক। তাই কোন এক রকের রাজনীতি আড্ডায় অহিংস আলোচনার মাহাত্ম্য বর্ণনা প্রতিদিন সংবাদমাধ্যমে খুঁজে পাওয়া যাবে না। সেই নিরিখে আজকের বাংলায় হিংসাহীন রাজনীতি একেবারে অনুপস্থিত এমন নয়। তার জন্যে সংবাদ মাধ্যমের বাইরের জগতে চোখ রাখতে হবে।

অহিংস রাজনীতিতে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বাক স্বাধীনতা। বাংলায় যেমন নেতানেত্রীদের প্রচুর কাটআউটে আকাশের মুখ ঢাকছে, তেমনই সমাজ মাধ্যমে ভেসে বেড়াচ্ছে তার থেকেও বেশি ব্যঙ্গচিত্র। এক আধ জনের বিরুদ্ধে হয়ত শাসক দল প্রতিহিংসাপরায়ণ মনোভাব দেখাচ্ছে। কিন্তু সেটাই সামগ্রিক ছবি নয়। বাংলায় যদি অহিংসার রাজনীতি অসম্ভবই হত, তাহলে প্রতিবাদের স্বর শোনাই যেত না আজকে। আগামীদিনে রাজনৈতিক দলগুলির শুভবুদ্ধি বৃদ্ধি পেলে তা আরও ভালোভাবে অর্জন করার ক্ষেত্রে কোন অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। হিংসার প্রতিবাদ যেখানে করা যায়, সেখানে আসলে যে অহিংস রাজনীতির জোর যে বেশি তা বুঝতে অসুবিধে হয় না। ক্ষমতায় থাকা রাজনীতির একটা ছোট্ট অংশ মাত্র। বাকিটা আমাদের সকলের, যাদের সমাজবোধ এবং অহিংসার যোগফল হিংসা এবং সমাজবিরোধীতা উদযাপনের থেকে অনেক অনেক বেশি। আমাদের সম্মিলিত অহিংস প্রতিবাদ ব্যক্তিকে দলের উর্দ্ধে উঠে চরম ক্ষমতা দখলের পথ আটকায়। এই প্রতিবাদের রাজনীতি বিশ্বের অন্য যে কোন জায়গার তুলনায় এই বাংলায় কম কিছু নয়। যেহেতু শক্তিশালী মানুষ যারা গলা টেপেন এবং প্রতিবাদী মানুষ যাদের গলা টেপা হয়, তার থেকে কণ্ঠরোধ হয়নি এমন মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি, তাই এই বাংলায় অহিংস রাজনীতি বেঁচে ছিল, আছে, থাকবে। প্রতিটি মানুষের মগজ আছে। সেই অর্থে সকলেই বুদ্ধিজীবী। সেই মোট বুদ্ধির খুব অল্প অংশই হিংসার বা হিংসার রাজনীতির কাছে বিক্রি হয়। বাকিটা স্বাধীন এবং অহিংস, সেটা অনেক গুণে বেশি, এবং আমাদের এই বাংলাতেও।