আরেক রকম ● দশম বর্ষ নবম সংখ্যা ● ১-১৫ মে, ২০২২ ● ১৬-৩০ বৈশাখ, ১৪২৯

প্রবন্ধ

তোমার পূজার ছলে তোমায় ভুলেই থাকি

রজত রায়


আর ক'দিন পরেই রবীন্দ্রনাথের ১৬০তম জন্মবার্ষিকী প্রত্যাশিত ধুমধামের সঙ্গে উদযাপন শুরু হয়ে যাবে।

রাজ্য সরকার ও সাধারণ মানুষের উদ্যোগে কলকাতা সহ পশ্চিমবঙ্গের আনাচে কানাচে অন্তত এক মাস ধরে এই উৎসব হবে। লক্ষ্যণীয়, এইসব উৎসবে প্রধানত রবীন্দ্রনাথের গান, কিছু নৃত্যনাট্য, কিছু কবিতা, কখনও কখনও দুয়েকটা নাটক স্থান পায়। দেশের অন্যত্র, রাজধানী দিল্লি সহ বিভিন্ন প্রাদেশিক শহরেও মোটামুটি একই ছকে রবীন্দ্র জন্মোৎসব পালিত হয়। কোথাও কখনও রবীন্দ্রনাথের আঁকা ছবির প্রদর্শনীও হয়ে থাকে। রবীন্দ্রচর্চার এইসব উপকরণের মধ্য দিয়ে, তাঁর কবিতা, গান, নাটক ইত্যাদির চর্চার মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথের একটা পরিচয় সাধারণ মানুষের মানসপটে গড়ে ওঠে  ঠিকই, কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে কি কেবল এই সঙ্কীর্ণ পরিচয়ের গণ্ডীর মধ্যে আবদ্ধ রাখা যায়? তাঁর সমাজচিন্তা, শিক্ষা বিষয়ক চিন্তা, এবং এই দুই নিয়ে হাতেকলমে পরীক্ষানিরীক্ষা কি একেবারেই বর্জনীয়?

যদি রবীন্দ্রনাথের লেখা বইয়ের বিক্রির দিকে তাকানো যায়, তাহলে একটা আভাস মেলে এই বর্জন প্রক্রিয়ার। কপিরাইট উঠে যাওয়ার পরে এখন বহু প্রকাশকই রবীন্দ্রনাথের লেখা নানাভাবে প্রকাশ করে চলেছেন। তার বিক্রিবাটাও নেহাৎ কম নয়। তবে এখনও বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগই রবীন্দ্রনাথের রচনা প্রকাশের সবচেয়ে বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠান। সেই সূত্রেই জানা যাচ্ছে, সারা বছরই সবচেয়ে বেশি রবীন্দ্রনাথের বই বিক্রি হয় 'গীতবিতান', তার পরে 'স্বরবিতান' ও 'সঞ্চয়িতা'। সেগুলির চাহিদা মেটাতে ঘন ঘন পুনর্মুদ্রণ করতে হয়।  তার অনেক পরে রয়েছে নাটক, উপন্যাস ও ছোটগল্প। প্রবন্ধাবলী, যার মধ্যে রয়েছে স্বদেশ, সমাজ ও শিক্ষা বিষয়ক একগুচ্ছ লেখা, সেগুলির চাহিদা প্রায় নেই বললেই চলে। তবে এর মধ্যে দুয়েকটি লেখা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত থাকায় তার কিছু বিক্রি হয়ে থাকে।

শিক্ষিত বাঙালি সমাজে রবীন্দ্রনাথ যে এখনও অপাংক্তেয় নয়, তা বাঙালির ঘরে ঘরে আলমারিতে সযত্নে সাজানো রবীন্দ্র রচনাবলী (বিশ্বভারতী প্রকাশনা বা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রকাশনা) দেখলেই বোঝা যায়। তবু রবীন্দ্রচর্চার মধ্যে রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাভাবনা ও সমাজচিন্তা নিয়ে চর্চার একান্ত অনুপস্থিতি দেখে একথা বলা হয়তো অত্যুক্তি হবে না যে বাঙালি সমাজ রবীন্দ্রনাথকে কেটেছেঁটে নিজের মতো করে তাঁর একটা রূপ বা পরিচিতি নির্মাণ করে নিয়েছে, যেখানে নাচ গান কবিতা নৃত্যনাট্যই মুখ্য। আর নির্মমভাবে বর্জন করেছে তাঁর শিক্ষা ও সমাজচিন্তাকে।
বাঙালির এই বর্জনের প্রক্রিয়াকে উপযুক্ত সঙ্গত করেছে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারও। রবীন্দ্রনাথের সমাজ বিষয়ক চিন্তা বিধৃত রয়েছে 'সমবায় নীতি', 'ভারতবর্ষের সমবায়ের বিশিষ্টতা', 'শ্রীনিকেতন', 'শ্রীনিকেতনের ইতিহাস ও আদর্শ', 'উপেক্ষিত পল্লী', 'পল্লীর উন্নতি', 'পল্লীর প্রকৃতি', 'পল্লী সেবা', 'স্বদেশী সমাজ', 'স্বদেশী সমাজের পরিশিষ্ট', 'সমবায়ে ম্যালেরিয়া নিবারণ', 'বাঙালির কাপড়ের কারখানা ও হাতের তাঁত, 'লোকহিত' প্রভৃতি অজস্র রচনায়। এর মধ্যে কিছু রচনা তিনি নির্দিষ্ট উপলক্ষে অভিভাষণের আকারে বলেছেন। তেমনই শিক্ষা নিয়েও তাঁর চিন্তা ছড়িয়ে আছে  'শিক্ষা সমস্যা', 'শিক্ষা-সংস্কার', 'শিক্ষার মিলন', 'শিক্ষা ও সংস্কৃতি', 'শিক্ষার হেরফের', 'শিক্ষার আন্দোলনের ভূমিকা', 'জাতীয় বিদ্যালয়', 'বিদ্যার যাচাই', 'আশ্রমের শিক্ষা', 'বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপ' প্রভৃতি অজস্র লেখায়। এছাড়াও রয়েছে বহু চিঠিপত্র। কিন্তু আজও রবীন্দ্রনাথের সমাজ ও শিক্ষা বিষয়ক এইসব লেখা দেশের সরকার ইংরেজি ও হিন্দিতে অনুবাদ করে তা বৃহত্তর সমাজের নজরে আনার ন্যূনতম চেষ্টাও করল না।

কেন এমন হল?

আসলে রবীন্দ্রনাথ তো ব্রিটিশ শাসনাধীন ঔপনিবেশিক ভারতের মানুষের দূর্দশা দেখে বড় হয়েছেন। বিদেশি শাসকরা যে ধাঁচে আমাদের সমাজকে পরিচালনা করছিল, যে ছাঁচে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে গড়ে তুলেছিল, তা যে আখেরে আমাদের সমাজকে  কী জ্ঞানচর্চায়, কী অর্থনৈতিক ক্রিয়াকর্মে মুক্তি দিতে পারবে না, এই উপলব্ধি তাঁর হয়েছিল। তাই বিংশ শতাব্দীর গোড়া থেকেই তিনি শিক্ষা ও সমাজ নিয়ে তাঁর ভাবনাকে প্রকাশ্যে দেশবাসীর কাছে মেলে ধরতে শুরু করেন। তিনি প্রাইমারি শিক্ষা লেখেন বাংলা ১৩১২ সালে (ইংরেজি মতে ১৯০৫), শিক্ষার আন্দোলনের ভূমিকাও একই বছরে। পরের বছর লেখেন শিক্ষার সংস্কার, শিক্ষার সমস্যা ও জাতীয় বিদ্যালয়। স্ত্রীশিক্ষা (১৩২২), বিদ্যার যাচাই (১৩২৬)। আরও পরে লেখেন শিক্ষা ও সংস্কৃতি (১৩৪২), আশ্রমের শিক্ষা (১৩৪৩), ছাত্র সম্ভাষণ (১৩৪৩) ইত্যাদি আরও বেশ কিছু প্রবন্ধ ও ভাষণ রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে লেখা এইসব শিক্ষা বিষয়ক লেখার অভিমুখ কিন্তু একটাই। স্বাধীন ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঔপনিবেশিক শিক্ষা ব্যবস্থার শৃঙ্খলমুক্ত করে তুলতে হবে, যাতে মানুষ মুক্তমনে দেশ, সমাজ ও প্রকৃতিকে বিচার করে যুক্তিমন -
"পূর্বেই আভাস দিয়েছি আশ্রমের শিক্ষা পরিপূর্ণভাবে বেঁচে থাকবার শিক্ষা। মরা মন নিয়েও পড়া মুখস্থ করে পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীর ঊর্ধশিখরে ওঠা যায়; আমাদের দেশে প্রত্যহ তার পরিচয় পাই। তারাই আমাদের দেশের ভালো ছেলে যারা মন গ্রন্থের পত্রচর, ছাপার অক্ষরে একান্ত আসক্ত, বাইরের প্রত্যক্ষ জগতের প্রতি যাদের চিত্তবিক্ষোভের কোনো আশঙ্কা নেই। এরা পদবী অধিকার করে, জগত অধিকার করে না। প্রথম থেকেই আমার সঙ্কল্প এই ছিল, আমার আশ্রমের ছেলেরা বাইরের জগতের অব্যবহিত সম্পর্কে উৎসুক হয়ে থাকবে - সন্ধান করবে, পরীক্ষা করবে, সংগ্রহ করবে। অর্থাৎ এখানে এমন সকল শিক্ষক সমবেত হবেন যাঁদের দৃষ্টি বইয়ের সীমানা পেরিয়ে গেছে, যাঁরা চক্ষুমান, যাঁরা সন্ধানী, যাঁরা বিশ্ব কুতূহলী, যাঁদের আনন্দ প্রত্যক্ষজ্ঞানে এবং সেই জ্ঞানের বিষয় বিস্তারে, যাঁদের প্রেরণাশক্তি সহযোগীমণ্ডল তৈরি করে তুলতে পারে।" (আশ্রমের রূপ ও বিকাশ)

এ নিয়ে নানা সময়ে বিস্তারিত করে তিনি বলেছেন। যেমনঃ 
"...আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা বিষয়শিক্ষা। আমরা নোট নিয়েছি, মুখস্থ করেছি, পাস করেছি। বসন্তের দক্ষিণ হাওয়ার মতো আমাদের শিক্ষা মনুষ্যত্বের কুঞ্জে কুঞ্জে নতুন পাতা ধরিয়ে ফুল ফুটিয়ে তুলছে না। আমাদের শিক্ষার মধ্যে কেবল বস্তুপরিচয় ও কর্মসাধনের মধ্যে যোগ নেই তা নয়, এর মধ্যে সংগীত নেই, চিত্র নেই, শিল্প নেই, আত্মপ্রকাশের আনন্দময় উপকরণ নেই। এ যে কত বড়ো দৈন্য তার বোধশক্তি পর্যন্ত আমাদের লুপ্ত হয়ে গেছে। (পল্লীর উন্নতি)

একই প্রবন্ধে আর এক জায়গায় পল্লী উন্নয়নের সম্পর্কে শহুরে মানসিকতার (যা এখন রাষ্ট্রেরও ধারণা) দুর্বলতার প্রতি অঙ্গুলিনির্দেশ করে সতর্ক করে দিয়ে তিনি বলছেনঃ "বাইরে থেকে একটি একটি করে উপকার করে আমরা দুঃখের ভার লাঘব করতে পারি নে। এই জন্য উপকার করব না, উপকার ঘটাব, এটাই আমাদের লক্ষ্য হওয়া চাই। যার অভাব আছে, তার অভাব মোচন করে শেষ করতে পারব না, বরং বাড়িয়ে তুলব।" তার বদলে রবীন্দ্রনাথের প্রস্তাব অভাবগ্রস্তের অভাব মোচনের শক্তিকে জাগিয়ে তুলতে হবে। এক কথায় বললে, এখন যে গ্রামোন্নয়ন ও দারিদ্র দূরীকরণের প্রকল্পে বছর বছর কোটি কোটি টাকা কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার বর্ষণ করে চলেছে, গ্রামসমাজ এখন তার উপর একান্তভাবে নির্ভরশীল হয়ে নিজেদের উদ্যম হারিয়েছে। উন্নয়নের এই top down মডেলের বদলে রবীন্দ্রনাথের চিন্তা bottom up মডেলের অনুসারী, যেখানে বাইরের পুঁজির উপর নির্ভরতা কমিয়ে নিজেদের যা আছে তাই জড়ো করে দরিদ্র কৃষক সমবায় গড়ে এগোতে পারে।

আজ রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকলে স্বাধীন ভারতে ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থা গড়ে ওঠার মাধ্যমে গ্রামস্তর পর্যন্ত স্বায়ত্ত শাসন ও গ্রামসভায় সমবেত হয়ে নিজেদের উন্নয়ন সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিধিব্যবস্থা দেখলে নিশ্চয়ই আনন্দিত হতেন। কিন্তু পঞ্চায়েত ব্যবস্থা কীরকম সঙ্কীর্ণ দলীয় রাজনীতির প্রভাবে ক্রমেই গুরুত্ব হারিয়ে ক্ষমতাসীনদের হাতে অনুগতদের ডোল দেওয়া ও অবাধ্যদের বঞ্চিত করে চলার হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে, তা দেখলে অবশ্যই হতাশ হতেন।

একই অবস্থা হত তাঁর স্বাধীন ভারতে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার মুখস্থ-নির্ভর কাঠামো দেখলে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর আদর্শকে বাস্তবে পরিণত করতে নিজের যাবতীয় উপার্জনের অধিকাংশ দিয়ে গড়ে তোলেন শান্তিনিকেতন বিদ্যালয় যা পরে বিশ্বভারতীতে পরিণত, এবং শ্রীনিকেতনকে কেন্দ্র করে পল্লীসমাজ পুনর্গঠনের প্রয়াস করেন। তার মধ্যে স্ত্রীর গহনা, নোবেল পুরস্কারের অর্থ, দেশে দেশে বক্তৃতা দিয়ে আয় (যা সম্পর্কে অমর্ত্য সেনের মন্তব্য - "His lecture honoraria, '$700 a scold,' went to support it.), বই বিক্রির টাকা, সবই ঢেলেছিলেন তিনি। এ ছাড়া মহাত্মা গান্ধী সহ দেশের কিছু মানুষ সাহায্যের হাত বাড়িয়েছিলেন। কেমন ছিল সেই শান্তিনিকেতন? সেখানকার প্রাক্তন ছাত্র অমর্ত্য সেনের কথায়ঃ
I am partial to seeing Tagore as an educator, having myself been educated at Santiniketan. The school was unusual in many different ways, such as the oddity that classes, excepting those requiring a laboratory, were held outdoors (whenever the weather permitted). No matter what we thought of Rabindranath's belief that one gains from being in a natural setting while learning (some of us argued about this theory), we typically found the experience of outdoor schooling extremely attractive and pleasant. Academically, our school was not particularly exacting (often we did not have any examinations at all), and it could not, by the usual academic standards, compete with some of the better schools in Calcutta. But there was something remarkable about the ease with which class discussions could move from Indian traditional literature to contemporary as well as classical Western thought, and then to the culture of China or Japan or elsewhere. The school's celebration of variety was also in sharp contrast with the cultural conservatism and separatism that has tended to grip India from time to time. (Tagore and His India)

ওই লেখাতেই অমর্ত্য সেন সত্যজিৎ রায়ের একটি মন্তব্যের দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ১৯৯১ সালের ১ আগস্ট 'The Guardian' পত্রিকাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সত্যজিৎ রায় বলেনঃ
I consider the three years I spent in Santiniketan as the most fruitful of my life... Santiniketan opened my eyes for the first time to the splendours of Indian and Far Eastern art. Until thenI was completely under the sway of Western art, music and literature. Santiniketan mademethe combined product of East and West that I am.
 
কিন্তু স্বাধীন ভারত তাঁর শিক্ষা ভাবনাকে গ্রহণ করল না। স্বাধীন দেশের সরকার সেই ঔপনিবেশিক শিক্ষা কাঠামোকেই আঁকড়ে রইল। রবীন্দ্রনাথের মতোই আরও একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি দেশের জন্য ইংরেজ সরকারের শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তে দেশজ মানুষের কথা মাথায় রেখে একটা নিজস্ব শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার তাগিদ অনুভব করেছিলেন। তিনি মহাত্মা গান্ধী। রবীন্দ্রনাথ শুরু করেছিলেন ১৯০১ সালে, আর গান্ধী শুরু করলেন ১৯২০ সালে। 'গুজরাত বিদ্যাপীঠ' নাম দিয়ে আহমেদাবাদে তিনি শুরু করলেন একটা বিদ্যালয়, যেখানে ছাত্ররা, বিশেষ করে সমাজের অনুন্নত শ্রেণী থেকে আসা ছাত্রদের শিক্ষাদানের ব্যবস্থা থাকবে। এই শিক্ষা শুধুই পুঁথিপড়া  নয়, বরং অনেক বেশি জোর থাকবে হাতেকলমে বৃত্তিমূলক শিক্ষার দিকে। লক্ষ্য ছিল, এই বুনিয়াদি শিক্ষার সুবাদে ছাত্ররা বহির্জগতে নিজেরা নিজের নিজের পেশায় থিতু হতে পারবে।

গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথ, এই দুজনের শিক্ষাচিন্তায় কিছু মৌলিক পার্থক্য থাকলেও একটা বিষয়ে প্রচণ্ড মতৈক্য - ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা চলবে না। কিন্তু স্বাধীন ভারত রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধী দুজনকেই বর্জন করে পাশ কাটিয়ে গেল। শুধু গুজরাত বিদ্যাপীঠ  ও বিশ্বভারতীকে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বীকৃতি দিয়ে  আংশিকভাবে ছাঁচে ঢেলে সাজানো হল। পুরনো কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য জীইয়ে রাখা হল। যেমন, গুজরাত বিদ্যাপীঠে এখনও সমাজের অনুন্নত শ্রেণীর ছাত্রদের উজ্জ্বল উপস্থিতি দেখা যায়। তেমনই, বিশ্বভারতীর কলাভবন, সঙ্গীত ভবন এখনও নিজ নিজ বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। কিন্তু যে স্বাধীন চিন্তার জমিতে দাঁড়িয়ে শিক্ষক ও ছাত্রের একযোগে জ্ঞানচর্চা করার কথা, রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপে সেটাই উধাও।

রবীন্দ্রনাথ কিন্তু আমাদের বার বার সতর্ক করেছিলেন। তিনি মনে করিয়ে দিয়েছিলেন যে আমরা যে পথে শিক্ষাব্যবস্থাকে নিয়ে যেতে চাইছি, তা আর যাই হোক মুক্তচিন্তা ও যুক্তিবাদী মানুষ তৈরি করতে পারবে না।

"যতটুকু অত্যাবশ্যক কেবল তাহার মধ্যেই কারারুদ্ধ হইয়া থাকা মানবজীবনের ধর্মনহে। ...আমাদের দেহ সাড়ে তিন হাতের মধ্যে বদ্ধ, কিন্তু তাই বলিয়া ঠিক সেই সাড়ে তিন হাত পরিমাণ গৃহ নির্মাণ করিলে চলে না। স্বাধীন চলাফেরার জন্য অনেকখানি স্থান রাখা আবশ্যক, নতুবা আমাদের স্বাস্থ্য ও আনন্দের ব্যাঘাত হয়। শিক্ষা সম্বন্ধেও একই কথা খাটে।... কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে আমাদের হাতে কিছুমাত্র সময় নাই। যত শীঘ্র পারি বিদেশী ভাষায় পাস দিয়া কাজে প্রবিষ্ট হইতে হইবে। কাজেই শিশুকাল হইতে ঊর্ধশ্বাসে দ্রুতবেগে, দক্ষিণে বামে দৃকপাত না করিয়া পড়া মুখস্থ করিয়া যাওয়া ছাড়া আর কোনো কিছুর সময় পাওয়া যায় না। সুতরাং ছেলেদের হাতে কোনো শখের বই দেখিলেই সেটা তৎক্ষণাৎ ছিনাইয়া লইতে হয়।" (শিক্ষার হেরফের)

কিন্তু না বাঙালি সমাজ, না কেন্দ্র বা রাজ্যের সরকার, কেউই সে কথায় কর্ণপাত করেনি। ফলে, মুখস্থ বিদ্যা কেন্দ্রিক যে শিক্ষার পাঠ চলছে, তাতে স্কুলের পাশাপশি টিউশন নেওয়া ছাত্রদের পক্ষে একরকম বাধ্যতামূলক দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত সমাজের ছাত্ররাই নয়, অমর্ত্য সেনের 'প্রতীচি রিসার্চ ইনস্টিটিউট' কয়েক বছর আগে সমীক্ষা করে দেখিয়েছে, গ্রামের দরিদ্র ঘরের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যেও প্রাইভেট টিউটরের কাছে যাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। রবীন্দ্রনাথ এখন বেঁচে থাকলে দেখতে পেতেন, কীভাবে স্কুলের পড়াশোনার সমান্তরালে বিরাট টিউশনের ব্যবসা জাঁকিয়ে বসেছে। প্রচুর অর্থ ব্যয় করে ছাত্রছাত্রীদের এই টিউশন নিতে প্রলুব্ধ করা হচ্ছে আইআইটি বা মেডিকেল কলেজে ভর্তির যোগ্যতা পেতে। অনেক সময় স্কুল চলাকালীন স্কুলের মধ্যেই এই টিউশন চলছে। মুখস্থ ও ডিগ্রিসর্বস্ব এই শিক্ষা ব্যবস্থায় স্কুল ও টিউশনের যুগলবন্দীতে ছাত্রছাত্রীরা দিশাহারা। পরীক্ষায় বেশি মার্কস পাওয়ার জন্য যে সামাজিক চাপ তাদের মাথার উপর পড়ছে, তাতে অনেকে অবসাদের শিকার হয়ে পড়ছে। অন্যদিকে গ্রাম ও শহরের আর্থিক দিক থেকে অনুন্নত শ্রেণীর ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে স্কুলছুট হওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। কিন্তু সমাজ ও রাষ্ট্র নিজেদের বিশ্বাসে অটল। তারা মনে করছে, এই ব্যবস্থায় শিক্ষিত হয়েই দেশের মানুষ পূর্ণ সচেতন নাগরিক হয়ে উঠবে।

শিক্ষার ক্ষেত্রে যেমন রবীন্দ্রনাথের চিন্তা রাষ্ট্র প্রত্যাখ্যান করেছে, তেমনটাই ঘটেছে রবীন্দ্রনাথের সমাজচিন্তার ক্ষেত্রেও। দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত নেহরু রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধীর সম্পর্কে শ্রদ্ধাশীল হয়েও তাঁদের শিক্ষাচিন্তা বা সমাজচিন্তা দেশের মাটিতে সরকারি উদ্যোগে বপন করার কথা ভাবেনইনি। বরং, শুরু থেকেই আমেরিকার ফোর্ড ফাউন্ডেশনের সাহায্য নিয়ে গ্রামোন্নয়নের অন্য মডেল আঁকড়ে ধরলেন।

ফোর্ড ফাউন্ডেশন ১৯৩৬ সালে একটা অলাভজনক সংস্থা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হলেও প্রথম দশকে তার কাজকর্ম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কিছু অঞ্চলের মধ্যেই সীমিত ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী অবস্থায় ঠান্ডা যুদ্ধ শুরু হতেই তাদের দৃষ্টি ভারত সহ এশিয়ার দেশগুলির দিকে পড়ল। বিশ্বযুদ্ধের পরে সোভিয়েত ইউনিয়নের সামরিক শক্তির খ্যাতি ও প্রভাব অনেক বেড়ে যায়। ১৯৪৯ সালে চিনেও কমিউনিস্ট পার্টি কুওমিনটাংকে হারিয়ে ক্ষমতাসীন হয়। এই পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে ফোর্ড ফাউন্ডশন এবং মার্কিন সরকারের বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা হয়, এশিয়ার কৃষিপ্রধান দেশগুলির অন্যতম ভারত। একদিকে তার কৃষকরা দরিদ্র, অন্যদিকে সদ্যস্বাধীন সরকারের হাতে পুঁজির অভাবের কারণে দারিদ্র্য সহজে দূর হবে না। অথচ প্রতিবেশী চিন যদি দ্রুত আর্থিক উন্নতির পথে হাঁটতে পারে এবং ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে চলে, তাহলে ভারতের সাধারণ মানুষের মধ্যে কমিউনিজমের আবেদন দ্রুত বাড়বে। তাদের এক বিশেষজ্ঞ তো আর এক ধাপ এগিয়ে দাবি করেন যে ১৯৪৫ সালেই যদি আমেরিকা চিনের উন্নয়নের জন্য বছরে ২০০ মিলিয়ন ডলার করে বরাদ্দ করত, তা হলে চিনে কমিউনিজম আদৌ আসতে পারত না। ভারতেও যাতে সেই অবস্থা না হয়, সে জন্য দেরি না করে গ্রামোন্নয়নের প্রকল্প শুরু করা দরকার। নেহরু সরকারের সঙ্গে আলোচনার পরে ১৯৫২ সালের ৪ জানুয়ারি ভারতের সঙ্গে ফোর্ড ফাউন্ডেশনের চু্ক্তি সম্পাদিত হয়। ঠিক হয়, ফাউন্ডেশনের সহায়তায় ভারতে ৫৫টি Community Development Project (CDP) শুরু হবে। প্রতিটিতে ৩০০ করে গ্রাম নেওয়া হবে, আর প্রতিটির আওতাতেই দুই লক্ষ করে মানুষকে আনা হবে। এ জন্য প্রথম দফায় ফোর্ড ফাউন্ডেশন ৫০ মিলিয়ন ডলার দেবে এবং তাদের বিশেষজ্ঞরাও প্রকল্পে ভারতীয় বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কাজ করবে। গ্রামোন্নয়নের এই উদ্যোগের মাধ্যমে একেবারে তৃণমূল স্তরে গ্রামবাসীদের কতটা উদ্যোগী করে তোলা সম্ভব হয়েছিল, সে প্রশ্ন থেকেই গিয়েছিল। মোদ্দা কথা, রবীন্দ্রনাথের স্বপ্ন অনুযায়ী গ্রামের গরিব মানুষকে আত্মশক্তিতে বলীয়ান করা, বা গান্ধীর স্বপ্ন অনুযায়ী স্বনির্ভর গ্রামসমাজ তৈরি করার চেষ্টাকে সরাসরি খারিজ করে নেহরুর কংগ্রেস সরকার মার্কিন পরামর্শে নির্ভর করে গ্রামোন্নয়নের জন্য সম্পূর্ণ অন্য পথ ধরল, যে পথে পরবর্তী সরকারগুলি ও কংগ্রেসবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলিও পা বাড়াল।

রবীন্দ্রনাথের কাছে শিক্ষাকে সমাজের একেবারে তৃণমূল স্তরে নিয়ে যাওয়া ও সেই কর্মযজ্ঞে সমস্ত প্রান্তিক মানুষকে সামিল করাটা ছিল সবচেয়ে বড় কর্তব্য। তারই পরিপূরক কর্তব্য হল যাতে পল্লীসমাজে প্রাণ সঞ্চার হয়, সেই পরিবেশ তৈরিতে সাহায্য করা। এই শিক্ষার পরিবেশ কী রকম হবে, সেটাও তিনি সুনির্দিষ্ট করে বুঝিয়ে দিয়েছেন।

১৯৩০ সালে রাশিয়া সফরের শেষ দিনে সেখানকার বহুল প্রচারিত সংবাদপত্র 'ইজভেস্তিয়া'কে এক সাক্ষাৎকার দেন তিনি। তার আগে রাশিয়ার সমায়জের কর্মকাণ্ডের, বিশেষ করে আপামর জনগণের মধ্যে শিক্ষার প্রসারের বিপুল উদ্যোগ দেখে তিনি যে অভিভূত, সেই কথা তাঁর রাশিয়ার চিঠিতে  ফলাও করে লিখেছেন। কিন্তু দেশে ফেরার আগে 'ইজভেস্তিয়া'কে সাক্ষাৎকার যখন দিতে বসলেন, ততদিনে সোভিয়েত সমাজের মধ্যকার হিংসা ও সন্ত্রাস (স্তালিনের আমল তখনই শুরু) সম্পর্কে তিনি কিছুটা আঁচ পেয়ে গেছেন। তাই তিনি তীব্র ভাষায় তার সমালোচনা করে বলেনঃ
I must ask you: Are you doing your ideal a service by arousing in the mind of those under your training anger, class hatred, an revengefulness against those whom you consider to be your enemies? ...Freedom of mind is needed for the reception of truth; terror hopelessly kills it... For the sake of humanity I hope you may never create a vicious force of violence, which will go on weaving an interminable chain of violence and cruelty.... (Tagore and his India)

(রবীন্দ্রনাথের এই সমালোচনা পছন্দ না হওয়ায় স্তালিনের নির্দেশে তখন 'ইজভেস্তিয়া' ওই সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেনি। তবে গোরবাচেভের গ্লাসনস্তের খোলা হাওয়া বইতে শুরু করলে ওই নিষিদ্ধ সাক্ষাৎকারটি ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত হয়।)

রাশিয়া সফরে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ যে এই কড়া সমালোচনা করেছিলেন, তার একটাই কারণ, তিনি বিশ্বাস করেন যে ভয়মুক্ত পরিবেশেই শিক্ষার চর্চা ঠিকমতো হতে পারে। শিক্ষার পরিবেশ যে একেবারেই ভয়ভীতিহীন হতে হবে, এটা রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাদর্শের পূর্বশর্ত।

তাই তাঁর মন্ত্রঃ
চিত্ত যেথা ভয়শূণ্য, উচ্চ যেথা শির,
জ্ঞান যেথা মুক্ত, যেথা গৃহের প্রাচীর
আপন প্রাঙ্গনতলে দিবসশর্বরী
বসুধারে রাখে নাই খণ্ড ক্ষুদ্র করি,

...
যেথা তুচ্ছ আচারের মরুবালিরাশি
বিচারের স্রোতঃপথ ফেলে নাই গ্রাসি,
পৌরুষেরে করেনি শতধা; নিত্য যেথা
তুমি সর্ব কর্ম চিন্তা আনন্দের নেতা -
নিজ হস্তে নির্দয় আঘাত করি পিতঃ,
ভারতেরে সেই স্বর্গে করো জাগরিত।

 
এখন তো দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাকে সংসদের ভিতরে বা বাইরে সুযোগ পেলেই রবীন্দ্রনাথের এই কবিতাটি আওড়াতে শোনা যায়। কিন্তু এই সব নেতারাই তো ক্রমাগত শিক্ষাব্যবস্থার টুটি চেপে ধরছেন, শিক্ষায়তনে - তা সেটা বিদ্যালয়ই হোক, বা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণই হোক - ক্রমাগত সন্ত্রাস নামিয়ে আনছেন। শিক্ষাবিদরাও পিছিয়ে নেই। একজন উপাচার্য তো বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে একটা আস্ত ট্যাঙ্ক এনে বসাতে আগ্রহ প্রকাশ করে বসেন। উদ্দেশ্য, নানা প্রশ্ন করে চলা ছাত্রদের 'দেশপ্রেমের পাঠ' দেবেন।

কিন্তু বাঙালি ও ভারতীয় সমাজ আজ যেখানে এসে পৌঁছেছে, রবীন্দ্রনাথের এই মন্ত্র সেখানে কে উচ্চারণ করবে?