আরেক রকম ● দশম বর্ষ নবম সংখ্যা ● ১-১৫ মে, ২০২২ ● ১৬-৩০ বৈশাখ, ১৪২৯

সমসাময়িক

শিল্প তামাশা


নিরবিচ্ছিন্ন অনৃতভাষণ সমৃদ্ধ আয়োজিত মহোৎসব পূর্ব প্রত্যাশা মতোই প্রচারের আলোয় উদ্ভাসিত। সরকারি অর্থে-উদ্যোগে অনুষ্ঠিত শিল্পোদ্যোগীদের এই বাৎসরিক সমাবেশে আড়ম্বরের অভাব ছিল না বলেই সংবাদে প্রকাশ। দেশবিদেশের নামী শিল্পোদ্যোগীদের উপস্থিতিতে নিঃসন্দেহে অনুষ্ঠানস্থল উজ্জ্বল। রাজ্যে মেলা শিল্প-উদ্যোগ স্থাপিত না হলেও ক্ষতি নেই; বৎসরান্তে শিল্পোদ্যোগীদের মেলা না করলেই নয়। এবং বেলাশেষে মেলার প্রধান উদ্যোক্তা সাড়ম্বরে ঘোষণা করেছেন রাজ্যে ৩.৪২ লক্ষ কোটি টাকার লগ্নি প্রস্তাব পাওয়া গেছে। নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় প্রস্তাব। কিন্তু বাস্তবের মাটিতে এই বিনিয়োগের ফল কবে নাগাদ দেখা যাবে তার কোনো সময়সীমা সরাসরি উচ্চারিত হয়নি।

মোট ১৩৭টি সমঝোতাপত্র (মউ) ও আগ্রহপত্র স্বাক্ষরিত। সেই সূত্রে প্রাথমিক ভাবে ৩ লক্ষ ৪২,৩৭৫ কোটি টাকার লগ্নি প্রস্তাব। আর তার হাত ধরে অন্তত ৪০ লক্ষ কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা। এই তিন পরিসংখ্যানের বুনোটে ঠাসা ষষ্ঠ বিশ্ববঙ্গ শিল্প সম্মেলন (বিজিবিএস) গত ২১ এপ্রিল ২০২২ কলকাতায় সমাপ্ত হয়েছে।

প্রশ্ন ওঠে, প্রতিবার এমন আকাশছোঁয়া বিনিয়োগের অঙ্ক এবং বিপুল সংখ্যক কাজের সুযোগ তৈরির সম্ভাবনা সাড়ম্বরে ঘোষণার পরেও বাস্তবের মাটিতে তা চোখে পড়ে না কেন? কটাক্ষ ভেসে আসে, বিগত পাঁচ সম্মেলনের সূত্রে পাঁচটি নতুন কারখানার উদ্বোধনও হয়েছে কি?

মুখ্যমন্ত্রী যদিও সম্মেলনের দু’দিনেই জানিয়েছেন, গত পাঁচটি বিজিবিএস-এ যে ১২ লক্ষ কোটি টাকার লগ্নি-প্রস্তাব এসেছিল, এখন তা বিভিন্ন স্তরে বাস্তবায়নের পথে। কোথায় কোন শিল্পসংস্থা স্থাপনের কাজ চলছে তার কোনো বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া গেছে কি? মুখ্যমন্ত্রীর আরও দাবি, দেশের বৃদ্ধির হারের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গের বৃদ্ধির হার অনেক ভালো। একই ছবি কর্মসংস্থানে। রাজ্যে পাঁচশোর বেশি ক্লাস্টার এবং দু’শোর বেশি শিল্পতালুক রয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে। তাতে নাকি চাহিদা বাড়ছে। কয়েক বছরে এই ক্ষেত্রে ১.৩৬ কোটি মানুষ কাজ পেয়েছেন বলে নথি প্রকাশিত হয়েছে। সেই নথি অনুযায়ী কৃষি, পরিকাঠামো এবং সামাজিক ক্ষেত্রে রাজ্যের অগ্রগতি চোখে পড়ার মতো। এরপরও কেন যে দলে দলে শ্রমিক অন্য রাজ্যে কাজের খোঁজে চলে যাচ্ছে কে জানে? শিক্ষিত যৌবনও একই পথের পথিক।

তৃতীয় বার ক্ষমতায় ফিরে শিল্পায়ন এবং কর্মসংস্থানই যে তাঁর পাখির চোখ, তা বারবার স্পষ্ট করে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর কথায়, ‘‘ট্রাস্ট (বিশ্বাস), টিমওয়ার্ক (সম্মিলিত চেষ্টা) এবং টেকনোলজি (প্রযুক্তি) - সাফল্যের তিন মন্ত্র।’’ দিল্লিতে বসে যিনি স্বপ্নের ফিরি করেন তিনিও প্রায়শঃই এমন মন্ত্র উচ্চারণ করতে অভ্যস্ত। সার্থক অনুকরণ অথবা অনুসরণ।

উত্তর এবং দক্ষিণবঙ্গে রফতানি হাব তৈরির নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর দাবি এর ফলে পরের ১০ বছরে বাংলা যা করবে, তাকে কেউ ছুঁতে পারবে না। আগে বলা হত গুদাম ঘর। ব্রিটিশ তার নাম দিল ওয়ারহাউস্। মার্কিন মুলুকে তারই নাম লজিস্টিক হাব। নামে কী আসে যায়! দিনের শেষে সেই পণ্য রাখার স্থায়ী আস্তানা। দেশি-বিদেশি কর্পোরেট সংস্থাগুলির এখন এই ধরনের গুদাম ঘর প্রয়োজন। জেলা তো বটেই দরকার হলে মহকুমা-গঞ্জ স্তরেও বিভিন্ন আয়তনের গুদাম ঘর গড়ে তোলার কাজ শুরু হয়েছে অথবা ইতিমধ্যেই নির্মিত। ই-কমার্স বা অনলাইনে কেনা-বেচার কাজ চালানোর জন্য বড়ো বড়ো গুদাম ঘর প্রয়োজন। ক্ষেত-খামার-বাগান থেকে কৃষিপণ্য, ফল-মূল এককথায় সবকিছুই এখন সরাসরি কর্পোরেট সংস্থাগুলি কিনে নিচ্ছে। প্রয়োজনে দাদন দিয়েও কেনা হচ্ছে। এবং রাজ্য সরকার চার-পাঁচ বছর আগে এ বিষয়ে একটি আইন প্রণয়ন করায় কর্পোরেট বাণিজ্য এখন মোটেও বেআইনি নয়। কাজেই নিশ্চিতরূপে বলা যায় লজিস্টিক হাব হচ্ছে এবং হবে। প্রশ্ন হল এর ফলে রাজ্যের কী লাভ হবে? অর্থাৎ কতটুকু মূল্য সংযোজন বা ভ্যালু অ্যাডিশন হবে? আর কর্মসংস্থান? রাজ্যের যে কোনো হিমঘর বা শস্য গুদামে খোঁজ নিলেই জানা যাবে যে কতজন সেখানে কাজ করে।

লজিস্টিক হাব ছাড়া নির্দিষ্ট ভাবে আর কোন ক্ষেত্রে বিনিয়োগের প্রস্তাব রয়েছে? শিক্ষা ও স্বাস্থ্য। দুটি ব্যবসাই লাভজনক। প্রমাণিত সত্য। আবার এও সত্য যে এর ফলে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে সরকারের বিনিয়োগ কমিয়ে দেওয়ার সুযোগ বেড়ে যাবে। করোনা সংক্রমণ তীব্র সংকট তৈরি না করলে বোঝা যেত না রোগীর নিরাময়ের বিষয়ে এইসব বেসরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা ব্যবস্থা কতটা যত্নশীল। রোগী ও তার পরিজনেরা কী বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে ন্যূনতম চিকিৎসা কিনতে বাধ্য হয়েছেন তা সংবাদমাধ্যমে ব্যাপক ভাবে প্রচারিত। কাজেই স্বাস্থ্য পরিষেবার নতুন বিনিয়োগ সাধারণ মানুষের উপযোগী হবে কিনা সে প্রশ্ন থেকেই যায়। শিক্ষা ক্ষেত্রেও একই চিত্র। ইশকুল বন্ধ। তবুও মাসের শেষে বেতন দেওয়া বাধ্যতামূলক। অন্যথায় পড়ুয়াদের নাম কাটা পড়ে। বিষয়টি নিয়ে আদালতে মামলা হয়েছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে নতুন বেসরকারি বিনিয়োগ এই ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে পারে কিনা তা ভবিষ্যতে জানা যাবে।

লজিস্টিক হাব, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ে নির্দিষ্ট প্রস্তাব প্রচারিত হয়নি। সবই ভাসা ভাসা। ভাষণ সর্বস্ব। প্রচার, প্রচার শুধুই প্রচার। রাজ্যে সত্যি সত্যিই শিল্প সহায়ক আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি আছে কিনা তা বিশ্লেষণ না করে নিশ্চয়ই কোনো বিনিয়োগকারী বিনিয়োগের উদ্যোগ নেবেন না। তখনই প্রমাণ হয়ে যাবে কথার কথা আর কঠিন বাস্তবের মধ্যে বিরাজ করে যোজন দূরত্ব। বিগত পাঁচটি সম্মেলনের অভিজ্ঞতায় তা ইতিমধ্যেই প্রমাণিত।

দেশভাগ পরবর্তী পশ্চিমবঙ্গে উনিশশো পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে সরকারি বিনিয়োগে সিএসটিসি, হরিণঘাটা ডেয়ারি, ডিপিএল, কল্যাণী স্পিনিং মিল ইত্যাদি ছোটোবড়ো অনেক শিল্প ও পরিষেবা ব্যবস্থা স্থাপিত হয়েছিল। ফলে গড়ে ওঠে অনেক অনুসারী সংস্থা। কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল দুর্গাপুর ইস্পাত প্রকল্পের মতো বৃহৎ শিল্প। স্থাপিত হয়েছিল আইআইটি, আইআইএম প্রভৃতি উন্নত মানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, আইএসআই পায় কেন্দ্রীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি। সেই সময় টিভি চ্যানেল বা ডিজিটাল সংবাদমাধ্যম না থাকুক সংবাদপত্র তো ছিল। তখন কি এমন ঢালাও প্রচার হত? বড়জোর শিল্যান্যাসের খবর ছাপা হত। আর প্রকাশিত হত প্রতিষ্ঠানের উদ্বোধন অনুষ্ঠানের সংবাদ।

পরবর্তী সময়ে হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যালস্, মিৎসুবিশি কারখানা, খড়্গপুরে টাটার ট্র্যাক্টর কারখানা, কোলাঘাট-বক্রেশ্বর-সাগরদীঘি তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পুরুলিয়া পাম্পড স্টোরেজ জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র ইত্যাদি গড়ে তোলার সময়ও খবর প্রকাশিত হত। প্রতিটি প্রকল্পের অনুমোদন আদায় করতে রাজ্য সরকারকে ধারাবাহিক ভাবে কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে নিয়মিত বিতর্ক-আলোচনা করতে হত বলে প্রকল্পের সর্বশেষ পরিস্থিতি জানার জন্য জনগণের আগ্রহ ছিল। আর বাকি খবর প্রচারিত হত উদ্বোধনের সময়। এমনকি কলকাতার মধ্যেই যখন বিধাননগরের সেক্টর ফাইভে সুবিশাল তথ্য প্রযুক্তি হাব গড়ে উঠছিল তখন কি তা নিয়ে কোনো প্রচার হয়েছিল? না। এমনকি তার উদ্বোধনের খবরও কোথাও প্রকাশিত হয়নি। নীরবে চালু হয়ে যায় বেশ কয়েক হাজার শিক্ষিত কর্মীর আধুনিক কর্মস্থল। পাশেই গড়ে উঠেছিল 'জ্যোতি বসু নগর' যা এখনকার 'নিউ টাউন'।

ধারাবাহিক ভাবে চলতে থাকা এইসব অর্থনৈতিক উন্নয়নের কর্মকাণ্ড চলার সময় তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীদের ছবি দিয়ে নগরে-গঞ্জে প্রচার হয়নি। খবরের কাগজে পাতা জোড়া বিজ্ঞাপন ছাপা হয়নি। শিল্পোদ্যোগীদের নিয়ে জাঁকজমক সমৃদ্ধ বাৎসরিক সম্মেলনের আয়োজন করতে হয়নি। কিন্তু কাজ হয়েছিল। কর্মসংস্থান হয়েছিল। ঝাঁকে ঝাঁকে শ্রমিককে কাজের খোঁজে অন্য কোথাও যেতে হয়নি। শিক্ষিত ছেলেমেয়েদের মধ্যে কর্মহীনতা জনিত এমন হাহাকার আগে কখনো দেখা যায়নি।

স্বপ্ন ফিরি করে সাময়িক ভাবে ভোটে জেতা যায়। বিভিন্ন ধরনের অনুদান দিয়ে স্বল্প সময়ের জন্য জনপ্রিয়তা অর্জন করা যায়। ভিক্ষা ভবিষ্যতের জন্য কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। মানুষ কাজ চায়। কাজের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে সঙ্ঘবদ্ধ মানুষের পথে নামা এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। তখন শিল্পোদ্যোগীদের নিয়ে বাৎসরিক ধুমধামের আয়োজনে গৃহীত বিনিয়োগ প্রস্তাবের পরিসংখ্যান বাতিল জঞ্জাল হিসেবে স্বীকৃতি পাবে।