আরেক রকম ● দশম বর্ষ নবম সংখ্যা ● ১-১৫ মে, ২০২২ ● ১৬-৩০ বৈশাখ, ১৪২৯

সমসাময়িক

ফৌজদারি কার্যবিধি (শনাক্তকরণ) বিল


পুলিশ রাষ্ট্র হবার দিকে এক ধাপ এগোল ভারতবর্ষ। সম্প্রতি লোকসভায় ধ্বনি ভোটের মাধ্যমে ফৌজদারি কার্যবিধি (শনাক্তকরণ) বিল পাশ হয়। ১৯২০ সালের বন্দি সনাক্তকরণ আইন প্রতিস্থাপিত করা এই বিলের লক্ষ্য। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের বক্তব্য অনুযায়ী, পুরনো যে কৌশল রয়েছে, তাতে বর্তমান প্রজন্মের অপরাধ মোকাবিলা করা যায় না, আর তাই আমাদের ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থাকে নতুন যুগে নিয়ে আসার চেষ্টা করতে হবে। যদিও বিরোধীরা বিলটির বিরুদ্ধে একাধিক উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাঁদের দাবি, এটি রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা হতে পারে। বিলটি সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানোর দাবি তুলেছেন তাঁরা। বিলটি পুলিশ এবং কারা কর্তৃপক্ষকে দোষী সাব্যস্তদের রেটিনা এবং আইরিস স্ক্যান-সহ শারীরিক এবং জৈবিক নমুনা আইনত সংগ্রহ, সংরক্ষণ এবং বিশ্লেষণ করার অনুমতি দেয়। বিল অনুসারে, সংগ্রহের তারিখ থেকে পরবর্তী ৭৫ বছর এগুলির রেকর্ড রাখা হবে। আইন অনুসারে, যদি পরিমাপ নেওয়ার জন্য দোষীরা কোনও প্রতিরোধ করেন, তবে সেটি আইপিসির ১৮৬ ধারা (সরকারি কর্মচারীকে বাধা দেওয়া)-র অধীনে একটি অপরাধ হিসাবে গণ্য করা হবে। এর ফলে তিন মাসের জেল বা জরিমানা হতে পারে। তবে যাঁরা নারী বা শিশুদের বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য দোষী সব্যস্ত বা গ্রেপ্তার নন, বা যাঁরা সাত বছরের কম শাস্তিযোগ্য অপরাধের জন্য হেফাজতে রয়েছেন, তাঁরা জৈবিক নমুনা দিতে অস্বীকার করতে পারেন।

এবার, বিলটির ব্যাপারে আশংকার জায়গা যেটা তা হল, সংবিধান প্রদত্ত নিজের জীবনের ওপর অধিকারকে এই বিল লঙ্ঘন করছে, যেটা বিরোধী সাংসদ মণীশ তিওয়ারী সঠিকভাবে দেখিয়েছেন। এছাড়াও, নিয়ম অনুযায়ী বিলটিকে গণমতামত গ্রহণ প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যাওয়া উচিত ছিল, সেটা হয়নি। সাধারণ নাগরিকের ব্যক্তিগত জীবনকে এই বিল কতটা লংঘন করবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। এছাড়াও, ব্যক্তিগত জীবনের অধিকারের নিশ্চয়তা সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্টের মন্তব্যই আছে যে এ ধরণের তথ্য সংগ্রহ সরকারের করণীয় কাজের সংগে সামঞ্জস্যপূর্ন ও প্রয়োজনীয় হতে হবে। কিন্তু বর্তমান বিল অনুযায়ী যে বিপুল পরিমাণ তথ্য নেওয়া হচ্ছে, তা সরকারের কোন কাজে লাগবে যেহেতু স্পষ্ট নয়, তাই একে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলা যায় না। ৭৫ বছর ধরে তথ্য জমিয়ে রাখার ক্ষেত্রেও একই বক্তব্য প্রযোজ্য। ততদিন হয়ত অভিযুক্ত মানুষটি বেঁচেই থাকবেন না, কিন্তু তাঁর তথ্য রাখা থাকবে, ব্যাপারটা খুব সুবিধের নয়।

আরও চিন্তার যেটা, তথ্য তো জোগাড় হল, কিন্তু আজকের তথ্যপ্রযুক্তির বিস্ফোরণে সবথেকে গুরূত্বপূর্ণ হল প্রাপ্ত তথ্যের নিরাপত্তা, যাকে 'ডেটা প্রোটেকশন' বলা হয়। সে বিষয়ে এই বিলে একটা কথাও বলা হয়নি। প্রাপ্ত তথ্য কীভাবে সুরক্ষিত থাকবে, তা সরকার বা রাজনৈতিক দলের বিশেষ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হবে কী না, সরকার এই তথ্য বিদেশী শক্তির হাতে বেচে দেবে কী না, এরকম নানাবিধ আশংকা থাকে, যার কোনও উত্তর নেই। এমনকী তথ্য নেওয়া হবে বিচারাধীনের কাছ থেকে, এমনকী এমন অভিযুক্তের কাছ থেকেও, যিনি খুব সামান্য অপরাধে দোষী, যেমন হয়ত বা পাবলিক প্লেসে ধূমপান করা, ট্রাফিক আইন ভাঙা, এমনকি প্রতিবাদ বা বিক্ষোভ অবস্থান থেকে গ্রেপ্তার হওয়া মানুষজনও এই আইনের আওতায় পড়বেন। ফলত, আসল দোষী আর নিরপরাধ বা পেটি অপরাধে দুষ্ট মানুষের মধ্যেও ফারাক করা হচ্ছে না এখানে। এমনকী সামাজিক আন্দোলনের কর্মীদেরও এই আইনের আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে। যদিও বিল অনুযায়ী তাঁরা তথ্য দিতে অস্বীকার করতেই পারেন, কিন্তু থানার ভেতর কেমন চাপ থাকবে তাঁদের ওপর, কেউ জানে না। এই মুহুর্তে ডেটা প্রটেকশন বিলের একটি খসড়া যৌথ সংসদীয় কমিটির কাছে রাখা আছে, কিন্তু সেই খসড়াতে সরকারকে প্রচুর ছাড় দেওয়া হয়েছে, এবং খসড়াটি পাশ হলে সরকার তথ্য নিরাপত্তার বেশ কিছু জায়গা লঙ্ঘন করতে পারে।

ব্যাপারটা হল, এই বিল অনুযায়ী এমনকি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অংশ নেওয়া মানুষ এবং বিরোধী রাজনৈতিক কর্মীরাও এই তথ্যের আওতায় এসে পড়ছেন। সেটা ভয়ের। সরকার কি তাহলে নজরদারি চালাবে এবার থেকে এঁদের ওপর? বিজেপি সরকার এমনিতেই নানারকম গণতান্ত্রিক অধিকারকে দমন করতে সিদ্ধহস্ত। এরপর বায়োমেট্রিক বিলের সাহায্য নিয়ে তারা যদি প্রোফাইলিং শুরু করে, তথ্য আদায়ের অজুহাতে আটক করে বিরোধীদের, তাহলে সেটা সুখকর পরিস্থিতি মোটেও হবে না। যদি এমনটাও হয় যে বিপুল পরিমাণে তথ্য নিয়ে সরকার সেটাকে বিশ্লেষণ করে জনগণের সার্বিক পরিস্থিতি বুঝতে চাইছে, সেটাই যদি উদ্দেশ্য হয়, তাহলেও সেই তথ্য বেসরকারী হাতে চলে যাবে না তার নিশ্চয়তা কোথায়? তাই এই বিলের বিরোধীতা সমাজের সর্বস্তর থেকে করতে হবে। গণতন্ত্রের স্বার্থে সেটাই আশু করণীয়।