আরেক রকম ● দশম বর্ষ অষ্টম সংখ্যা ● ১৬-৩০ এপ্রিল, ২০২২ ● ১-১৫ বৈশাখ, ১৪২৯

প্রবন্ধ

পুরুলিয়ার পাহাড়িয়া

রত্না রায়


গ্রামের নাম, কলাবেড়া। আর অযোধ্যা পাহাড়ের শেষ মাথার একটি মস্ত টিলাকে জড়িয়ে রয়েছে যে জঙ্গল তার নাম হাতিবেড়া। এই অরণ্যে বসবাসকারী 'পাহাড়িয়া' আদিবাসী গোষ্ঠীর বত্রিশটি পরিবারকে পাহাড়ের পায়ের কাছে নামিয়ে এনে আট ফুট বাই দশ ফুট কামরায় পুনর্বাসন দিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ সরকার। ঘরগুলির একটি জানালা, দরজাও একটি। একটি করে শৌচাগারও করে দেওয়া হয়েছে। বত্রিশটি পরিবারের জন্য একটি গভীর নলকূপ বরাদ্দ। মাসে দু'বার রেশনও বরাদ্দ তাদের জন্য। এ পর্যন্ত সবকিছু ঠিকঠাক।

গত ১২ই ফেব্রুয়ারী কলকাতার একটি সমাজসেবী সংস্থা 'বিনয়-বিকাশ-সাধনা' (বিবিএস)-এর সঙ্গে আমরা, বেহালার 'সুবৃত্তায়ন' নাট্যগোষ্ঠী কলাবেড়া গ্রামে এসে পৌঁছলাম। প্রায় দু'শো জনের রান্না শুরু হল ম্যারাপ বেঁধে। পথের ওপর ছাউনি খাটিয়ে বাচ্চাদের নিয়ে গান, বসে আঁকো প্রতিযোগিতা, নানারকম খেলা শুরু করলেন 'বিবিএস'-এর কর্ণধার তাপস বৈদ্য। তাঁর অফুরান উদ্দীপনা ও কর্মশক্তি বিস্ময়ের উদ্রেক করে। 'সুবৃত্তায়ন' পরিবেশন করলো কুসংস্কারবিরোধী একটি পথনাটক। প্রতিটি পরিবারকে দেওয়া হল তিন দিনের রেশন, একটি করে সোলার ল্যাম্প। মহিলাদের হাতে শাড়ী তুলে দেওয়া হল। বাচ্চাদের দেওয়া হল খাতা, পেন্সিল, মোম রং। সবই খুব সুন্দর, সুপরিকল্পিত। কিন্তু তারপর?

যাঁরা রয়ে গেলেন, এই স্মৃতি কতদিন তাঁদের প্রাণিত করবে জানিনা। প্রশ্ন করে জানলাম তাঁদের জীবিকা হাতিবেড়া জঙ্গলের কাঠকুটো জোগাড় করে নিকটবর্তী বাজারে বিক্রি করা। চাষ করার সামর্থ্য তাঁদের নেই... কোথায় হাল, কোথায় বলদ। ছোটখাটো সব্জিবাগান হলেও হতে পারতো। আছে কিছু পেঁপের গাছ। প্রতিটি ঘরের পেছনে ফলে আছে পেঁপের স্তবক।
'বাঃ তোমরা পেঁপে খাও সারা বছর তাইনা?'
'আমরা খাইনা।'
'তবে বিক্রি কর?'
'না, অপরে খায়।'

সেই 'অপর' কারা...?

অনেক পিড়াপীড়ির পর জানতে পারলাম হাতির পাল রাতে আছড়ে পড়ে পেঁপের ওপর। ওদের পাতলা টিনের দরজা ভাঙতে আর আসবে না। কি অপূর্ব রোমাঞ্চকর জীবনযাপন! রাতগুলি যেন বনবাংলোয় একরাত!

বাচ্চাদের 'বসে আঁকো' প্রতিযোগিতায় প্রায় পঞ্চাশ জন অংশ নেয়। ছিল তিন বছরের চরকি পাহাড়িয়া, তার দাদা টিজো আর এক বছরের ভাই হরেন। টিজোর ফুলশার্টের বোতাম আটকে দিতে দিতে লক্ষ্য করলাম নাকে সর্দির শুকনো মোটা চাদর। ততক্ষণে চরকি বসে বসেই হিসু করে দিয়েছে। ন্যাতা হাতে ছুটে এলেন ওদের মা আঠেরো বছরের তন্বী শ্যামা। ছবি আঁকতে বসেছিল ক্লাস সেভেনে পড়া বিবাহিত সিঁদুর পরা একটি মেয়ে। ও আবার স্কুলে যেতে চায়। টমেটো পোড়া দিয়ে ভাত খেয়ে জিনস পরা একটি মেয়েও এসেছিল। সে স্কুলে যেতে চায় না। এমন আরো অনেকে ছিল। কয়েকটি ছেলে নাকি হাইস্কুলে যায়। ওদের সবারই ভালো লেগেছিল এই আয়োজন। আমাদের মনও ভরে গিয়েছিল। কয়েকটি বাচ্চা মেয়ে 'রিংগা রিংগা রোজেস'-এর বদলে হাত ধরাধরি করে খেলছিল "এই ছেলে তোর নাম কি/ কলাপাতায় জিলিপি/ আজ আমাদের রবিবার/ আমরা যাবো নদীপার...।" সব কিছুর শেষে সবাই মিলে বসে মাংসভাত খাওয়া হল। আউটিং হিসেবে একজন শহরবাসী, কবি কিটসের 'টু ওয়ান হু হ্যাজ বিন লং ইন সিটি পেন্ট' আওড়াতে আওড়াতে বাড়ী ফিরতেই পারেন। কিন্তু যারা রয়ে গেল!

আয়লা, আম্পান এসবের পর বহু সরকার, বেসরকারি সংস্থা নিপীড়িতের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। 'মানুষ বড়ো একলা' এই অনুভবে এক হয়েছিলেন তাঁরা। অনেকদিন বাদে বিপন্ন মানুষগুলি কিছুটা হলেও উঠে দাঁড়াতে পেরেছিলেন সন্দেহ নেই। কিন্তু যাদের মেরুদণ্ডটি শক্তপোক্ত হয়ে গড়ে উঠতেই পারলো না, তারা বনবাসী না পাহাড়িয়া এই অভিধায় কি আসে যায় তাদের!

ভারতবর্ষের সংবিধান অনুযায়ী একচল্লিশটি তফশিলি উপজাতির পঁয়ত্রিশ নম্বরে আছে পাহাড়িয়া উপজাতি। যাযাবর গোত্রের অরণ্যচারী এই উপজাতি জনগোষ্ঠীকে মূলতঃ সাঁওতাল পরগনা, উড়িষ্যার কালাহান্ডি, বোলাঙ্গির এই জায়গাগুলিতে দেখা যায়। পুরুলিয়াতে অযোধ্যা পাহাড়ের কোল ঘেঁষে খুব অল্প সংখ্যক পাহাড়িয়া উপজাতির বাস। অবশ্য এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গে প্রায় সাড়ে চারশো বিরহড় উপজাতির দেখা পাওয়া যায়। 'বির' শব্দের অর্থ অরণ্য, 'হড়' হল মানুষ। পুরুলিয়ার ভূপতিপল্লী, কেন্দুমুন্ডি, বেড়সা এইসব গ্রামে ছোট ছোট ঘর করে সরকার এঁদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। কিন্তু এঁরা কিভাবে বেঁচে আছেন?

নিরাশায় শেষ হবে না এই ছোট্ট লেখা। খোঁজ পেলাম 'মৈত্রেয় ফাউন্ডেশন'-এর। বিরহড়ডেরা বেড়সায় বিরহড় উপজাতির কিছু মানুষকে যাঁরা দিশা দেখাচ্ছেন নতুন পথের। সঙ্গে আছে বলরামপুর ব্লক ডেভেলপমেন্ট প্রশাসন। আদিবাসী মহিলাদের নিয়ে তৈরী হয়েছে 'বেড়সা বিরহড় মৈত্রেয় মহিলা সমিতি'। বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে তাদের - আচার বানানো, মাশরুম চাষ, বীজ সংরক্ষণ, শাল পাতার থালা তৈরী করা। নিয়মিত স্বাস্থ্য শিবির করা হয় এখানে। ছেলেমেয়েদের প্রায় পাহারা দিয়ে স্কুলে পাঠানো হচ্ছে। কলকাতা থেকে সপ্তর্ষি বৈশ্য, প্রিয়াঙ্কা ভট্টাচার্য ও আরো বেশ কয়েকজন নিয়মিত ওখানে যান এবং নিবিড় যত্নে পরিচর্যা করেন এই মহান কর্মযজ্ঞের। এই বসন্তে সামান্য প্রশিক্ষণ নিয়েই মহিলা সমিতির সদস্যারা পলাশ, নিম আর বিটের নির্যাস থেকে সম্পূর্ণ ভেষজ আবীর প্রস্তুত করেন, যার নাম - 'বাহা সাঁদেশ' অর্থাৎ উৎসবের বার্তা। কলকাতা ও বিভিন্ন শহরে তা হৈ হৈ করে বিক্রি হল এবং দু'দিনেই ফুরিয়ে গেল। আবার ছুটতে হল পাহাড়ে পলাশ ফুল কুড়োতে। গাছ থেকে ফুল পাড়া চলবে না যে! এখানকার বিরহড়দের সকলের পদবী শিকারি। অরণ্যের বার্তা গভীরচারী এদের রক্তে। কিন্তু নগরের সাথেও কেমন অপূর্ব মৈত্রী তাদের!

কলাবেড়া গ্রামের পাহাড়িয়াদের মাতৃজঠরও এই অরণ্য আর পাহাড়। তাই ওঁরা ফিরে ফিরে আসেন পাহাড়ে আর জঙ্গলে। এমন দিন কবে আসবে যখন জঙ্গলের কাঠকুটোর ওপর নির্ভর করে থাকতে হবেনা ওঁদের? শেফালি পাহাড়িয়া, নগেন পাহাড়িয়াদেরও কি স্বনির্ভরতার পাঠ দেওয়া যায় না! অরণ্য বিলুপ্ত হলে ওঁরাও কি হারিয়ে যাবেন! ক্ষণিকের সাহায্য নয়, নিরন্তর নিবিড় যোগাযোগ আর স্বাবলম্বী হওয়ার দিশা দেখাতে হবে এঁদেরও। শিকারিরা যদি বন্ধুর হাত ধরে এগোতে পারেন পাহাড়িয়ারা কেন পারবেন না!

আশামুকুলগুলি আবার দল মেলে ধরেছে। বলেছে 'বন্ধু রহ রহ সাথে'। দিন গুনছি কবে এঁদের প্রতীক্ষার অবসান হবে। বারতা পেয়েছি মনে মনে - কলাবেড়ার চরকি পাহাড়িয়াও একদিন হাইস্কুলে যাবে, যাবেই।