আরেক রকম ● দশম বর্ষ অষ্টম সংখ্যা ● ১৬-৩০ এপ্রিল, ২০২২ ● ১-১৫ বৈশাখ, ১৪২৯

প্রবন্ধ

কর্পোরেট ভাইরাসের কবলে রাজ্যের ধান চাষ

মৃন্ময় সেনগুপ্ত


রাজ্যে একের পর এক কৃষক আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে চলেছে। অতিমারি জনিত নানা বিধিনিষেধ ও ঘন ঘন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বিগত প্রায় দুই বছর ধরে চাষে লোকসান বেড়েছে। পাল্লা দিয়ে বেড়েছে কৃষকদের ঋণের বোঝা। যদিও সরকার চাষের ক্ষতিতে কৃষক আত্মহত্যার ঘটনা স্বীকার করে না। কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের আচরণে এবিষয়ে কোনো পার্থক্য নেই। তফাৎ নেই, কৃষিক্ষেত্রে কর্পোরেট সংস্থাগুলির হানাদারির সুযোগ করে দেওয়ার প্রশ্নে। ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনে তিনটি কেন্দ্রীয় কৃষি আইন বাতিল হয়েছে। তবু হাল ছাড়েনি বড় বড় কোম্পানি। এই রাজ্যে এখন রুগ্ন রাইস মিল কিনছে আদানি গোষ্ঠী। পূর্ব বর্ধমান জেলার জামালপুরের জৌগ্রামে তারা এরমধ্যেই একটি বড় রাইস মিল কিনে নিয়েছে। সংবাদমাধ্যম জানাচ্ছে, মিলের আশেপাশের অনেকখানি জমিও তারা কিনেছে। সেখানে নাকি বড় গোডাউন হবে।

আদানি-উইলমার কোম্পানি আগেই বাসমতী চালের ব্যবসা শুরু করেছে। সংবাদমাধ্যম জানাচ্ছে, এখন প্রতিটি রাজ্যে চালের বাজার তারা দখল করতে মরিয়া। বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন প্রজাতির ধান চাষ হয়। সেই ধান কিনে চাল উৎপাদনের জন্য চাই রাইস মিল। পশ্চিমবঙ্গের চালের বাজার দখলে তাই কোম্পানি জলের দরে বিভিন্ন রুগ্ন রাইস মিল কেনার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। পূর্ব বর্ধমান জেলা রাজ্যের ধান ভান্ডার হিসেবে পরিচিত। অথচ, গত ডিসেম্বরে জাওয়াদের পর এই জেলাতেই সবচেয়ে বেশি কৃষক আত্মহত্যার খবর পাওয়া যায়। আমন ধান ও আলুর ক্ষতি হওয়া এর প্রধান কারণ। কৃষকের সর্বনাশের সঙ্গে কর্পোরেটদের পৌষমাসের সম্পর্ক আজ অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।

এক-দেড় দশকের মধ্যেই উল্কাগতিতে উত্থান হয়েছে আদানি গোষ্ঠীর। আদানি-উইলমার কোম্পানির ফরচুন ব্র্যান্ডের ভোজ্য তেল, আটা, চালসহ বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্যে ছেয়ে গেছে নগরের মল থেকে গ্রামের মুদি দোকান। স্থানীয় ছোট কোম্পানিগুলির তেলের টিনের বদলে সুদৃশ্য মোড়কে ব্র্যান্ডেড কোম্পানির ভোজ্য তেল। ব্র্যান্ডেড কোম্পানির চাল, আটা এখন দেশের বিকাশের প্রতীক। বিনিময়ে বন্ধ হয়েছে অনেক ছোট কোম্পানি। এলাকায় এলাকায় ছোট তেলকল, চালকল, ময়দাকল ধীরে ধীরে রুগ্ন হয়ে গেছে। সুদৃশ্য মোড়কে নামী কোম্পানির ব্র্যান্ডেড খাদ্যপণ্য কিনতেই আমরা অভ্যস্ত হয়ে উঠছি। খাদ্যপণ্যের বাজার আজ চলে গেছে কতগুলো কর্পোরেট সংস্থার নিয়ন্ত্রণে। ওরাই কৃষকের থেকে শস্য কিনবে, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্প গড়ে তুলবে আবার খুচরো ব্যবসার বাজারও দখল করবে। এর ফল কত ভয়াবহ হতে পারে তা, খাদ্যদ্রব্যের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি দেখে টের পাওয়া যাচ্ছে।

আদানি-উইলমার কোম্পানি আদানি ও উইলমারের যৌথ উদ্যোগে গড়ে উঠেছে। সিঙ্গাপুরের উইলমার এশিয়ার অন্যতম বড় খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ কোম্পানি। আদানি গোষ্ঠী অনেক আগেই ফুড কর্পোরেশনের সঙ্গে চুক্তি করেছে। বিভিন্ন খাদ্যশস্য ঝাড়াই-বাছাই করে তারা মজুত করবে, বন্টনের ব্যবস্থা করবে। এফসিআই’র কাজের ভার তুলে নিয়েছে আদানি গোষ্ঠীর আদানি এগ্রি লজিস্টিকস লিমিটেড (এএএলএল)। অনেকের আশঙ্কা আগামীদিনে সরকারের বদলে এই কোম্পানি খাদ্যশস্য মজুত ও বন্টনে আধিপত্য বিস্তার করে গণবন্টন ব্যবস্থাকে বিপন্ন করবে।

২০২০ সালে লকডাউনের সময়ে কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্যোগে গড়ে ওঠে, সিএসসি গ্রামীণ ই-স্টোর। গ্রামে খাদ্যদ্রব্যসহ বিভিন্ন দ্রব্যের হোম ডেলিভারির ব্যবস্থা। গত বছর আদানি গোষ্ঠী এই উদ্যোগের ১০ শতাংশ অংশীদারত্ব কিনে নেয়। এত সামান্য অংশীদারত্বে অবশ্য নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করা যায় না। কিন্তু আগামীদিনে অংশীদারত্ব বাড়িয়ে বা যৌথ উদ্যোগে গ্রামে ই-কমার্সে বিনিয়োগ বৃদ্ধির এটা প্রাথমিক পদক্ষেপ। এর মাধ্যমে তারা কৃষকের থেকে সরাসরি ফসল কেনার সুযোগ পাবে। আবার তাদের ব্র্যান্ডের খাদ্যপণ্য প্রত্যন্ত গ্রামেও বিক্রির সুযোগ বাড়বে। আদানি গোষ্ঠী গত বছর ফ্লিপকার্টের সঙ্গে অংশীদারি কারবারের চুক্তি করেছে। এর ফলে খাদ্যপণ্যসহ বিভিন্ন পণ্যের অনলাইন ব্যবসায়ে তাদের সুবিধে হবে।

কেবল আদানি নয়, কৃষিপণ্য সহ বিভিন্ন পণ্যের খুচরো ব্যবসায় বিভিন্ন কর্পোরেটেরই বিনিয়োগ বাড়ছে। এরা মল থেকে ই-কমার্স সবেতেই পুঁজি বিনিয়োগ করছে। যৌথ উদ্যোগ, অধিগ্রহণ, শেয়ার কেনার মধ্য দিয়ে দেশ-বিদেশের বড় বড় কোম্পানি মহাজোট গড়ে তুলছে। আম্বানি গোষ্ঠী ফিউচার গ্রুপের 'বিগ বাজার' অধিগ্রহণ করছে। আবার মার্কিন কোম্পানি সিলভার লেক ২০২০ সালে খুচরো ব্যবসার জন্য আম্বানি গোষ্ঠীর শেয়ার কেনে। তারা জিও প্ল্যাটফর্মেরও কিছু শেয়ার কিনেছে। ফেসবুকও জিও প্ল্যাটফর্মে বিনিয়োগ করেছে। লক্ষ্য সোশ্যাল মিডিয়া ও টেলিকম পরিষেবার মাধ্যমে ই-কমার্সের ব্যবসা বাড়ানো। সিএসসি গ্রামীণ ই-স্টোরে আদানির মতো টাটা ডিজিটাল, এইচডিএফসি ব্যাঙ্কও পুঁজি বিনিয়োগ করেছে।

কৃষকের থেকে সরাসরি ফসল কেনার সরকারি ব্যবস্থাকে দুর্বল করে, দেশজুড়ে কর্পোরেটদের ব্যবসার সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে। কেন্দ্রের তিনটি কৃষি আইন ছিল সেই নীতির পথে একলাফে অনেকখানি এগিয়ে যাওয়ার ছাড়পত্র। আইন আপাতত বাতিল হয়েছে। কিন্তু সরকারি নীতি বদলায়নি। কেন্দ্রীয় কৃষি আইনের আগেই রাজ্যের তৃণমূল সরকার সেই কাজে অনেকখানি এগিয়ে গেছে। ২০১৪ সালে রাজ্যের কৃষিপণ্য বিপণন (নিয়ন্ত্রণ) আইন সংশোধন করা হয়। সরকার নিয়ন্ত্রিত বাজার এলাকার মধ্যেই ব্যক্তি মালিকানায় কৃষিপণ্য কেনা, বিক্রি, বুকিং, সংরক্ষণের সুযোগ দেওয়া হয়। বেসরকারি কোম্পানি হাট, কৃষিবাজার, মেলা ইত্যাদিও করতে পারবে। তৃণমূল সরকার রাজ্যে বেসরকারি কোম্পানিগুলিকে কৃষিপণ্যের ই-ট্রেডিং এর অনুমোদন দিয়েছে। মতলব পরিষ্কার। বাজার সমিতি, সমবায়গুলিকে নিস্ক্রিয় করে ধীরে ধীরে কর্পোরেট সংস্থাগুলিকে সুবিধে করে দেওয়া। কৃষক থেকে ক্রেতা সবাই তাদের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল থাকতে বাধ্য হবে। বিজেপি সরকারও নয়া কৃষি আইনে তাই করতে চেয়েছিল। দাবি করেছিল, এর ফলে ই-ট্রেডিং-এর মাধ্যমে কৃষক সঠিক মূল্যে ফসল বেচতে পারবেন। তাঁরা স্বাধীন হবেন। স্বাধীনতার মোড়কে যে তাঁদের কর্পোরেট দানবদের শিকারে পরিণত করা হচ্ছে, তা বুঝতে কৃষকদের অসুবিধে হয়নি। এই রাজ্যের খনি, বন্দর, কৃষি সবেতেই মোদির নয়নের মণি আদানি গোষ্ঠীর নজর পড়েছে। তৃণমূলের সঙ্গেও তাদের ঘনিষ্ঠতা সকলের জানা। ২০১৮ সালেই রাজ্য সরকারের সঙ্গে এগ্রি লজিস্টিকসে বিনিয়োগের জন্য আদানি গোষ্ঠীর মৌ স্বাক্ষরিত হয়।

এমএসপি ঘোষণা করে সরাসরি ফসল কেনার সরকারি ব্যবস্থা এই রাজ্যে আগে থেকেই দুর্বল। যেটুকু ব্যবস্থা ছিল তাকেও রুগ্ন করে ফেলা হয়েছে। ঢাকঢোল পিটিয়ে কিষাণ মান্ডি হয়েছে। কৃষকের বিশেষ উপকারে লাগেনি। অধিকাংশ কৃষক সরকারি মূল্যে ধান বেচতে পারেন না। এই মরশুমেই সরকারের নির্ধারিত মূল্য ছিল, কুইন্টাল প্রতি ১,৯৪০ টাকা (কেন্দ্রীয় ক্রয় কেন্দ্রে বাড়তি ২০ টাকা)। অধিকাংশ কৃষক আমন ধান কুইন্টাল প্রতি ১,৪০০-১,৫০০ টাকা দরে বেচেছেন। লোকসান হলেও, ফড়ে, মহাজনদের কাছে তাঁরা ফসল বিক্রি করতে বাধ্য হন। নিয়মের বেড়াজালে, ধান কেনার সুবন্দোবস্ত না করে সরকার কৃষকদের অভাবী বিক্রিতে বাধ্য করে। কৃষি সরঞ্জামের মূল্য নিয়ন্ত্রণ বা কৃষি দপ্তর থেকে বিতরণ নিয়ে চূড়ান্ত দুর্নীতি সরকারি নীতিরই অঙ্গ। কালোবাজারি, ফড়েরাজের মাধ্যমে ফুলে ফেঁপে উঠছে অবৈধ কারবারের অর্থনীতি। যার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠছে শাসক দলের অনুগত লুম্পেন বাহিনী।

সেই সুযোগেই আসরে নামছে বিভিন্ন কর্পোরেট সংস্থা। এলাকার লুঠেরাদের চেনা যায়। কিন্তু এইসব কর্পোরেটদের আসল রূপ প্রথমে বোঝা যায় না। মানুষের দুরবস্থার সুযোগ নিয়ে এরা আসে ত্রাতার বেশে। নানারকম সুযোগের কথা বলে, প্রচারের মাধ্যমে কৃষকদের মন জয়ের চেষ্টা করে। ফড়ে, মহাজনদের কাছে ঠকতে ঠকতে, সরকারি ব্যবস্থা থেকে বঞ্চিত হতে হতে কৃষকরা তখন এদের ফাঁদে পা দিতে বাধ্য হন। বিকাশ বা উন্নয়নের নামে সরকারই এদের সুযোগ করে দেয়। সরকার যদি গ্রামে গ্রামে ক্রয় কেন্দ্র করে কৃষকের থেকে ফসল কেনার ব্যবস্থা করত, সার, কীটনাশকে কালোবাজারি বন্ধ করত তাহলে কর্পোরেটদের আসার সুযোগ হত না।

কর্পোরেট সংস্থার রাইস মিল কেনার বিপদ এখানেই। কৃষকদের অভাবী বিক্রির সুযোগ নিয়ে তাঁদের প্রলোভিত বা বাধ্য করা কঠিন নয়। সরকার ময়দান ছেড়ে দিলে কৃষকরা এদের কাছে ফসল বেচতে বাধ্য। ফড়ের বদলে থাকবে কোম্পানির এজেন্ট। বাজার দখল করতে প্রথমে ফসলের দাম তারা বেশি দিতে পারে। সেক্ষেত্রে ছোট রাইসমিলগুলো প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবে না। হয় বন্ধ হবে, নয় কর্পোরেটরা কিনে নেবে। তখন কর্পোরেটদের কাছে ধান বিক্রি করা ছাড়া কৃষকদের হাতে বিকল্প কিছু থাকবে না। কার্যত কৃষকদের দর কষাকষির ক্ষমতা থাকবে না। কৃষকদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে শুরু হবে চুক্তি চাষ, জমি কেনা। ধীরে ধীরে কর্পোরেট সংস্থারাই ধান চাষ নিয়ন্ত্রণ করবে।

রাজ্যের চালের বাজার সম্পূর্ণভাবে চলে যাবে আদানি-উইলমারের মতো কয়েকটি কর্পোরেটের দখলে। গ্রামেরই চাষ করা ধান থেকে তৈরি চাল তখন ব্র্যান্ডেড কোম্পানির মোড়কে গ্রামে বিক্রি হবে। ধান কেনা, চাল উৎপাদনকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা স্থানীয় বাজার ধ্বংস হবে। শহরেও আলো ঝলমলে শপিং মলে আমাদের সেই চাল কিনতে হবে। ধান চাষ থেকে শুরু করে চালের খুচরো ব্যবসা সবটাই এদের দখলে চলে গেলে, দাম আরও বাড়বে। শুধু চাল নয়। আগামীদিনে অন্যান্য খাদ্যপণ্যের এরাই নিয়ন্তা হবে। এভাবেই খড়গ হাতে ক্ষেত থেকে মল, মুদি দোকানে রাজত্ব করবে ‘উন্নয়ন’-এর দূত কর্পোরেট ভাইরাস। ভোটের ময়দানে তরজায় মেতে থাকা অধিকাংশ দলগুলির মধ্যে কর্পোরেট দালালির প্রশ্নে কোনো পার্থক্য নেই। পুঁজি নির্দেশিত উন্নয়ন বা বিকাশের মডেল বাস্তবায়নে তারা নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতায় মত্ত। তাই নিছক শাসকদলের বদল নয়, সরকারি নীতির বদল চাই। জমি, খনি, জল, জঙ্গল - সব লুঠ করার ‘উন্নয়ন’ মডেলকেই প্রশ্ন করতে হবে। কর্পোরেটের প্রতি মোহ নয়, তাদের বিরুদ্ধে তীব্র শ্রেণি ঘৃণাই পারে প্রতিরোধ গড়তে।